You dont have javascript enabled! Please enable it! বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং রাজনৈতিক হত্যাকান্ড -জিয়া হত্যাকাণ্ড - সংগ্রামের নোটবুক
জিয়া হত্যাকাণ্ড
মেজর জিয়াউর রহমান। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বাংলাদেশকে এগারােটি সেক্টরে বিভক্ত করে প্রতি সেক্টরে একজন সেক্টর কমান্ডার নিয়ােগ দেওয়া হয়। জিয়া ছিলেন তখন একটি সেক্টরের কমান্ডার। তার অধীন বাহিনীকে বলা হতাে ‘জেড’ ফোর্স। বিতর্কিত হলেও বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘােষক হিসেবেও তার নাম উচ্চারিত হয়। অবশ্য অনেকের কাছে তিনি ঘােষক নন, পাঠক মাত্র । আরেকটি বিতর্ক রয়েছে তারিখ নিয়ে । কেউ বলেন জিয়ার। ঘােষণা ছিল ২৬শে মার্চ, কেউ বলেন ২৭শে মার্চ। মােদ্দাকথা, স্বাধীনতার ঘােষণার সঙ্গে জিয়াউর রহমান যে-কোনাে ভাবেই হােক, সংশ্লিষ্ট ছিলেন, এটা সর্বসম্মত। বাহাত্তরে শেখ মুজিব তাকে মেজর জেনারেল পদে প্রমােশন দিয়ে সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ পদে নিযুক্ত করেন। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য তিনি বীর উত্তম খেতাব পেয়েছিলেন।  ১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমান বিদ্রোহী সেনা কর্তৃক সপরিবারে নিহত হলে জিয়া সেনাবাহিনীর চিফ অফ স্টাফ পদে নিযুক্ত হন। ৩রা নভেম্বর খালেদ মােশাররফ অভ্যুত্থান ঘটালে তিনি হন গৃহবন্দী এবং পদচ্যুত। আবার ৭ই নভেম্বর কর্নেল তাহের (অবসরপ্রাপ্ত, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে গুলিতে একটি পা হারাবার কারণে) জাসদের কিছু কর্মী এবং সেনাবাহিনীর কতিপয় সেনার সাহায্যে গৃহবন্ধী জিয়াকে মুক্ত করে আনেন। ঘটে যায় এক পাল্টা অভ্যুত্থান। খালেদ তার সহযােগী সেনা কর্মকর্তাসহ নিহত হলে জিয়া আবার সেনাপ্রধানের দায়িত্বে ফিরে যান। তাহেরসহ জাসদ নেতারা জিয়াকে দিয়ে কিছু দাবিপূরণ করতে চেয়েছিলেন। তারা ছিলেন সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী। বাংলাদেশকে সেই আদর্শে গড়ে তুলতে আগ্রহী ছিলেন তারা। জিয়ার দ্বারা তাদের দাবি পূরণ হলাে না। তারা আন্দোলন শুরু করে দিলেন। ২৪শে নভেম্বর তাহেরকে বন্দী করে জেলে পাঠানাে হলাে। আরও কতিপয় জাসদ নেতা, যথা— মেজর জলিল, আ, স, ম, আব্দুর রব, মােঃ শাহজাহান প্রমুখকেও আটক করে জেলে পাঠানাে হয়। ১৯৭৬-এর ২১শে জুন ঢাকা সেন্ট্রাল জেল-এ বিশেষ সামরিক ট্রাইবুনালে তাহেরের বিচার শুরু হয়। তার বিরুদ্ধে সরকার উৎখাতের  গুরুতর অভিযােগ আনা হয়। অবশ্য অভিযােগটি ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যা। এই অভিযােগের বিচারে ১৭ই জুলাই তার মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হয়। ২০শে জুলাই প্রেসিডেন্ট সায়েম-এর কাছে তার মৃত্যুদণ্ড মওকুফের আবেদন নাকচ হয়ে যায়।
২১শে জুলাই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। বন্দী জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে এনে ক্ষমতায় পুনর্বহাল হবার সুযােগ সৃষ্টিকারী কর্নেল আবু তাহেরের করুণ পরিণতির দায় জিয়া কিছুতেই এড়াতে পারেন না। সেনাপ্রধান এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়া ২১শে এপ্রিল ১৯৭৭-এ প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বিচারপতি সায়েম অবসর গ্রহণ করায় জিয়া এ পদটি পেয়ে যান। তিনি পাকিস্তানি শাসনামলের সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল আইউবের পদাংক অনুসরণ করে একটি হ্যা-না ভােটের আয়ােজন করে তার প্রেসিডেন্ট পদকে পাকাপােক্ত করে নিলেন। এই সময়ে তিনি সংবিধানে কিছু পরিবর্তন ঘটান, যেমন— সংবিধান শীর্ষে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রহীম সংযােজন, বাঙালি জাতীয়তাদ বর্জন এবং তদস্থলে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ গ্রহণ, ধর্মনিরপেক্ষতা বর্জন।  সেনাবিদ্রোহ জিয়াকে অস্থির করে তুললাে। বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টের সেনারা জিয়াকে উৎখাত করতে বদ্ধপরিকর। জিয়াউর রহমান কঠোর হস্তে বিদ্রোহ দমনে তৎপর হলেন। হত্যা, গুপ্তহত্যা, বিচারের নামে হত্যা চলতে থাকলাে। সরকারি হিসেবমতে ১১৪ জন সৈন্যকে ফাঁসি দেওয়া হলাে। আর, নির্বিচারে যাদেরকে হত্যা করা হয়েছে, সে হিসেব কে রেখেছে? জিয়ার ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রয়ােজনে ঘটানাে হয়েছে অঢেল রক্তপাত। ১৯৭৮ সালের জুন মাসে অনুষ্ঠিত হয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। জেনারেল এম. এ. জি. ওসমানী এ-নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। কিন্তু কূটকৌশলে জিয়া বিজয়ী হন। তখন থেকে তিনি নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন। অবশ্য এ-নির্বাচনের ফলাফল ছিল বিতর্কিত। তাছাড়া জিয়াকর্তৃক জারিকৃত প্রেসিডেন্সিয়াল অর্ডিন্যান্স-এর ধারা অনুসারে তার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার যােগ্যতাই ছিল না। সেই অর্ডিন্যান্স-এ বলা হয়েছিল :
১। যদি বয়স ৩৫ বছরের কম হয়।
২। যদি এম. পি. নির্বাচনে অযােগ্য হয়ে থাকেন।
৩। যদি প্রেসিডেন্টপদে বহাল থাকেন।
এমতাবস্থায় কেউ প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হতে পারবেন না। অথচ জিয়া প্রেসিডেন্ট পদে বহাল থেকেই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং বিজয়ী হন।

শুধু এ-পর্যন্তই নয়। তিনি তখনও সেনাপ্রধান এবং চিফ মার্শাল ল’ এ্যাডমিনিসট্রেটর পদেও বহাল ছিলেন । পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান উপলব্ধি করেন যে, সামরিক শক্তির বদৌলতে তিনি বেশি দিন ক্ষমতায় থাকতে পারবেন না। তাছাড়া সামরিক বাহিনীতেও মাঝে মাঝে বিদ্রোহ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল । তার এই উপলব্ধির ফলে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল। দলটিতে স্থান করে নিলেন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বিরােধীরাও। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে দলছুট হয়েও এলেন অনেকে । দলটির সভাপতি নির্বাচিত হন জিয়াউর রহমান। যেহেতু তিনি তখন দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার শীর্ষে ছিলেন, তাই অন্যান্য দলের কিছু কিছু নেতা-কর্মী ভেবে নিলেন যে, সরকারি দলে যােগদানই অধিক লাভজনক। তাই এই নতুন দলটি স্ফীত হতে বেশি সময় নিলাে না। অল্প সময়ের মধ্যে দেশের সাবেক বৃহত্তম দল আওয়ামী লীগকে ছাড়িয়ে গেল এই নবগঠিত দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বি. এন. পি)। ১৯৮১ সাল। মে মাসের ২৯ তারিখ । জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামে আসেন। এখানে বি.এন.পি-র দুই গ্রুপের কোন্দল চলছিল। সেই কোন্দল মিটানাের জন্যই এখানে তার আগমন। তিনি ক্যান্টনমেন্টে না গিয়ে উঠলেন সার্কিট হাউসে। তার সঙ্গে ছিলেন নৌবাহিনীর প্রধান রিয়ার এ্যাডমিরাল এম, এ. খান, বি,এন,পি নেতা ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী, মন্ত্রী সৈয়দ মহিবুল হাসান, মন্ত্রী ড. আমিনা রহমান, ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা, আব্দুর রাজ্জাক চৌধুরী প্রমুখ। চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে বি.এন.পি-র নেতৃবৃন্দের সঙ্গে জিয়ার আলাপ চলছিল । সাড়ে বারােটায় জুমার নামাজের জন্য আলােচনা স্থগিত করা হলাে। চকবাজারের জামে মসজিদে জুমার নামাজ আদায়ের জন্য গেলেন জিয়া। নামাজান্তে বিশ্রাম নিলেন কিছুক্ষণ। বিকেল পাঁচটায় আবার আলােচনায় বসলেন। রাত ৯টা থেকে ১১টা পর্যন্ত দলের নয়জন নেতার সঙ্গে তিনি পৃথক পৃথক আলােচনা করলেন। এগারােটার পরে তিনি আহার করে বিছানায় গেলেন ঘুমানাের জন্য। এদিকে রাত সাড়ে এগারােটার দিকে বিদ্রোহী সেনারা জিয়া হত্যার পূর্ব প্রস্তুতি নিচ্ছিল অতি দ্রুততার সঙ্গে। মেজর জেনারেল মঞ্জুরকে চট্টগ্রাম থেকে বদলী করা হলেও তিনি তখনও নতুন কর্মস্থলে যােগদান করেননি। তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের বাহিনীর অধিনায়ক। মঞ্জুরই ছিলেন এই অভিযানের মূল নায়ক।
 
রাত আড়াইটায় কালুর ঘাটে এসে অবস্থান নিল একদল ঘাতক সেনা । অবশিষ্ট তিনটি গ্রুপ সার্কিট হাউসের দিকে ছুটলাে। একটি গ্রুপ আক্রমণ চালাবে। অন্য দুটি গ্রুপ থাকবে আশেপাশে প্রােটেকশন দেবার জন্য। এই তিন গ্রুপের নেতৃত্বে ছিলেন লে. কর্নেল মতি। ঘুমন্ত জিয়ার উপরে আঘাত হানার দায়িত্বে ছিল ক্যাপ্টেন সাত্তার এবং ফজলে হােসেন। ঘাতক দল বিনাবাধায় সার্কিট হাউসে প্রবেশ করতে সক্ষম হলাে। প্রথমে লাথী মেরে যে কক্ষের দরজা ভাঙ্গা হলাে, সেকক্ষে ছিলেন ড. আমিনা রহমান। পরে তারা জিয়ার কক্ষ পেয়ে গেল এবং লাথী মারতে দরজা ভাঙ্গতে উদ্যত হতেই জিয়া নিজেই কক্ষের বাইরে বেরিয়ে এলেন। মতি জিয়াকে লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়েন। দরজার কাছেই তিনি লুটিয়ে পড়েন। জিয়াকে হত্যা করে ঘাতকরা চলে গেল। প্রহরীরা ছাড়া আর কাউকে হত্যা করা হয়নি। তাদের টার্গেট ছিল জিয়াকে হত্যা করা, প্রহরীদের মধ্যে যারা নিহত হয়েছে, তাদেরকে হত্যা করা হয়েছে প্রতিরােধ করার কারণে। অপারেশনের ঘণ্টাখানেক পরে ঘাতকেরা আবার ফিরে আসলাে সার্কিট হাউসে। তারা জিয়াউর রহমান এবং তার সিকিউরিটি অফিসার লে. কর্নেল আহসান ও ক্যাপ্টেন হাফিজের লাশ নিয়ে গেল। অতঃপর তারা লাশগুলাে নিয়ে মাটি চাপা দিয়ে রাখলাে। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মেজর জেনারেল মঞ্জুর ৬ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের হেড কোয়ার্টারে গেলেন। সেখানে প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে দ্রুত চলে গেলেন, ছয় ডিভিশন হেড কোয়ার্টারের নিজের অফিসে। সকল ব্রিগেড কমান্ডার, ডিভিশনাল স্টাফ অফিসার এবং সমস্ত আর্মী সেক্টরের কমান্ড্যান্টদের ডেকে পাঠালেন। সবাই সমবেত হলে তিনি তাদের উদ্দেশ্যে বলেন : ‘কয়েকজন তরুণ অফিসারের হাতে প্রেসিডেন্ট নিহত হয়েছেন। প্রশাসন দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ায় সেনাবাহিনীতেও তার প্রভাব পড়েছিল। বারংবার সতর্ক করা সত্ত্বেও জিয়া কোনাে পরিবর্তন আনতে চেষ্টা করেননি । ইসলাম প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি দমনের লক্ষ্যে একটি বিপ্লবী কাউন্সিল গঠন করা হয়েছে। আপনারা সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে তাতে যােগ দিন। তিনি বিমান বাহিনীর সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করলেন। তার ভাষণে তিনি তার উদ্দেশ্য ব্যক্ত করলেন। ঢাকা, কুমিল্লা, যশাের ক্যান্টনমেন্টে যােগাযােগ করলেন সমর্থন আদায়ের জন্য। কিন্তু তিনি কোনাে দিক থেকেই সাড়া পেলেন না। ঢাকায় সেনাবাহিনী প্রধান এরশাদ যখন জিয়া হত্যার সংবাদ পেলেন, তখন তিনি বুঝতে এবং জানতে চেষ্টা করলেন এই সেনাবিদ্রোহের সঙ্গে কী পরিমাণ সেনা জড়িত।
বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টের সেনা অফিসারদের সমর্থন আছে কিনা এই বিদ্রোহের প্রতি, তাও তিনি যাচাই করতে চেষ্টা করলেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যে তিনি জেনে গেলেন যে, মঞ্জুরের এ-কর্মকাণ্ডে অধিকাংশের সমর্থন নেই । অতএব, এ অভ্যুত্থান ব্যর্থ হতে বাধ্য । তিনি তৎক্ষণাৎ অসুস্থ ভাইস প্রেসিডেন্ট আবদুস সাত্তারের সঙ্গে যােগাযােগ করে তাকে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করতে অনুরােধ জানালেন। তিনি সম্মত হলেন। তাকে দিয়ে শান্তি-শৃংখলা রক্ষার্থে বেতার ভাষণ দেওয়ালেন। জেনারেল মঞ্জুরকে তার দলসহ বিনা শর্তে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেওয়া হলাে। জেনারেল মঞ্জুর চট্টগ্রামের ক্যান্টমেন্টের সবগুলাে ইউনিটকে ঐক্যবদ্ধ করবার চেষ্টা করতে থাকলেন। কিন্তু তাতে কোনাে ফায়দা হলাে না। সেনাবাহিনীর চিফ অফ স্টাফ জেনারেল এরশাদের বেতার ঘােষণার প্রতি সকলের দৃষ্টি আকৃষ্ট হলাে । মঞ্জুর এবং তার দল হতাশ হয়ে পড়লেন। ৩১শে মে তিনি তার দলসহ চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে পড়লেন। তার সঙ্গে ছিল তার স্ত্রী, দুইপুত্র, দুই কন্যা এবং ৪১ জন সেনা অফিসার । মঞ্জুর তার স্ত্রী, ছেলে-মেয়েসহ আশ্রয় নিলেন একটা বাগানের কুলি মনু মিয়ার বাড়িতে। অতঃপর প্রেসিডেন্ট জিয়ার কবর অনুসন্ধান করে তার লাশ পাওয়া যায় এবং ঢাকায় এনে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়।  বাংলার ইতিহাস রক্তের ইতিহাস। বাংলার ইতিহাস ষড়যন্ত্রের ইতিহাস। বাংলার ইতিহাস বিদ্রোহ-বিপ্লব-বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস। পলাশী থেকে ঢাকা। পর্যন্ত একই ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করা গেছে। বাংলার স্বাধীনতা এসেছে বিদ্রোহবিপ্লব আর রক্তপাতের মধ্য দিয়ে। ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে বিদ্রোহ-বিপ্লব আর ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে। শেখ মুজিবুর রহমানের সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়েই ক্ষমতায় এসেছিলেন জিয়া। জিয়াউর রহমানকে হত্যার মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। প্রতিবারেই ঘটেছে হত্যা, ঝরেছে। রক্ত। রক্তে রঞ্জিত পিচ্ছল পথ মাড়িয়ে ক্ষমতার মসনদে আরােহণ করতে হয়েছে সবাইকে। এরশাদের পর ক্ষমতায় আসেন বেগম জিয়া। তাতেও রক্ত দিতে হয়েছে নূর হােসেনের মতাে অনেককেই। তাই বলতে হয় –
নূর হােসেনেরা যুগে যুগে আসে
ওরা না এলেতাে নড়ে না গাড়ির চাকা
ওরা আসলেই রাজপথ ভাসে রক্তে
ওরা আসলেই পথ-ঘাট সব ফাকা ।
ওরা পথ থেকে সরায় সকল জঞ্জাল
অতঃপর সবে সাবলীল গতি হাঁটে
ওরা সমুদ্র মন্থনে আনে সুধা
বিলিয়ে সবারে ওরাইতাে ওঠে লাটে।
নূর হােসেনেরা বুকের রক্ত ঢেলে
উর্বর করে ফল-ফসলের মাঠ
সেই ফসলেই ভরে কারাে কারাে পােলা
আবার নগরে বসে যায় নয়া হাট।
নূর হােসেনেরা স্বীকার করে না নতি
দুর্দম ওরা, ছােটে দুর্বার গতি।
বাংলাদেশের হত্যাকাণ্ড এখনও অব্যাহত। এখনও মিছিলে-মিটিং-এ, অনুষ্ঠানে গােলাগুলি, বােমাবাজি— এখনাে রাজপথে লুটিয়ে পড়ে তাজা প্রাণ। এখন আর তাকে গণহত্যা কিংবা হত্যা বলা হয় না । বলা হয় সন্ত্রাস। রক্ত দিয়ে পাওয়া বাংলাদেশে রক্তপাত বন্ধের কোনাে আলামত এখনও দেখা যাচ্ছে না। এখনও সন্ত্রাসী তৎপরতা ঝরায় রক্ত, কেড়ে নেয় প্রাণ। 

সূত্রঃ  বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং রাজনৈতিক হত্যাকান্ড – মুহাম্মদ হাবীবুর রহমান