You dont have javascript enabled! Please enable it! 1975.11.07 | সেনা অভ্যুত্থান : খালেদ মােশাররফ - সংগ্রামের নোটবুক
সেনা অভ্যুত্থান : খালেদ মােশাররফ
১৫ই আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে ভাগ্যবান হয়েছেন খন্দকার মােস্তাক, জিয়াউর রহমান এবং ফারুক-রশীদসহ ক’জন জুনিয়ার সেনা অফিসার ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফ এবং কর্নেল শাফায়াত জামিল আদৌ লাভবান হয়নি। তাই এরা ক্ষোভাম্বিত ছিলেন। খালেদ এবং জিয়া একই ব্যাংকে ছিলেন। শেখ মুজিবের আমলেই জিয়া প্রমােশন পেয়ে সেনবাহিনীর ডেপুটি চিফ হয়ে যান। আর মােস্তাকের আমলে হলেন চিফ অফ স্টাফ তাই খালেদ মােশাররফ জিয়াউর রহমানের প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েন। শাফায়াত জামিলের ক্ষোভ এখানে যে, ফারুক-রশিদ তার অধীনস্থ জুনিয়ার অফিসার হয়েও বঙ্গভবনে অবস্থান নিয়ে সরকারের কলকাঠী নাড়াচ্ছেন। অথচ তারা তারই অধীনস্থ সেনাবাহিনীর সাহায্যে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতাবান হয়েছেন। এটা তার কাছে অসহ্য লাগছিল। আর, জিয়া নাখােশ ছিলেন সেনাপ্রধান হবার পরেও, একারণে যে, তিনি রাষ্ট্রপতির প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা হতে পারেননি। এ পদটা চলে গেছে এম. এ. জি. ওসমানীর হাতে  এটা জিয়া পছন্দ করেননি। খালেদ এবং শাফায়াত জামিল চেয়েছিলেন বঙ্গভবন থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসা মেজরদেরকে উৎখাত করতে। তারা জিয়াউর রহমানকে একটা কিছু পদক্ষেপ নিতে আহ্বান জানালেন। কিন্তু জিয়া তাদের কথায় সাড়া দিলেন না। তিনি হয়তাে ভিন্ন পন্থায় চিন্তা করছিলেন। কিন্তু খালেদ মােশাররফ তার পরিকল্পনা মাফিক এগিয়ে যাচ্ছিলেন। ২রা নভেম্বর দিবাগত মধ্যরাতে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টে এলেন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফ। কমান্ডিং অফিসার কর্নেল আমিনুল হককে কৌশলে সরিয়ে দিয়ে তিনি ইউনিটের পরিচালনার দায়িত্ব নিজেই গ্রহণ করলেন।
 
তার সঙ্গে ৪৬ ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিলও ছিলেন। আরও ছিলেন কর্নেল মালেক, ব্রিগেডিয়ার রউফ, ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামান, মেজর হাফিজ উদ্দিন, মেজর ইকবাল, মেজর নাসের, মেজর আমিন, স্কোয়াড্রন লিডার লিয়াকত প্রমুখ। ইউনিটের কমান্ডিং অফিসার কর্নেল আমিনুল হক এবং এ্যাডজুটেন্ট ক্যাপটেন মুনীরকে নিষ্ক্রীয় করে রাখা হলাে। ক্যাপটেন হাফিজুল্লাহর নেতৃত্বে প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি প্লাটুন। জেনারেল জিয়ার বাসায় পাঠিয়ে দিয়ে তাকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়। তখন রাত একটা। জিয়ার বাসার টেলিফোন লাইন কেটে দেওয়া হয়। ভুলক্রমে বেডরুমের লাইনটি কাটা হয়নি। ক্যাপটেন হাফিজ জিয়ার বৈঠকখানায় তাকে পেয়ে বললেন : ‘স্যার, আপনি বন্দী। প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকেরা তখন জিয়ার বাসা ঘিরে রেখেছিল। জিয়াকে গৃহবন্দী করার কাজ সুসম্পন্ন হবার পর খালেদকে সংবাদ পৌছানাে অতঃপর খালেদ ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের দুটি কোম্পানি এয়ারপাের্ট রােডের কাওরান বাজার এরিয়াতে অবস্থান নেয়। ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি দল রেডিও স্টেশন দখল করে। প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের কিছু সেনা বঙ্গভবন ঘেরাও করে রাখে। মােদ্দাকথা, সবদিক দিয়ে আটঘাট বন্ধ করে রাখা হয়। যথাসময়ে অভ্যুত্থানের খবর পেয়ে গেলেন রশীদ এবং ফারুক। ফারুক সঙ্গে সঙ্গে তার ট্যাংকগুলাে সচল করে ফেললেন। একটা যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে গেল। ৩ই নভেম্বর রেডিওতে সকালবেলা বাংলাদেশের সেন্টারে কোনাে সাড়া পাওয়া যাচ্ছিল না। বঙ্গভবনে ফারুক-রশীদ ট্যাংক এবং তাদের বাহিনী নিয়ে প্রস্তুত । ক্যান্টনমেন্টে খালেদ-শাফায়াতের পদাতিক বাহিনীও প্রস্তুত। যেকোনাে মুহূর্তে যুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে। মােস্তাক আহমদ ভীত হয়ে পড়লেন। তিনি ওসমানীকে ফোন করলেন। ওসমানী খালেদের সঙ্গে ফোনে আলাপ করলেন। খালেদ ওসমানীকে জানালেন : স্যার, বঙ্গভবনের মেজরদের শান্ত থাকতে বলুন। ওরা চুপচাপ থাকলে কোনাে রক্তপাতের সম্ভাবনা নেই।’ দু’পক্ষ মুখােমুখি থাকলাে ।
যুদ্ধ শুরু হলাে না। আপােষের আলােচনা চলতে থাকলাে। দু’পক্ষের আলাপ-আলােচনা চলছিল টেলিফোনের মাধ্যমে। মাধ্যম ছিলেন ওসমানী। খালেদের পক্ষ থেকে দাবি ছিল বঙ্গভবনে অবস্থানরত মেজরদেরকে ক্যান্টনমেন্টে ফিরে আসতে হবে। ওসমানী এ-কথা জানালেন মােস্তাককে। মােস্তাক তাতে সম্মত হন কিন্তু ফারুক-রশীদ ক্যান্টনমেন্টে ফিরে যেতে রাজি হলেন না। তারা মােস্তাককে বললেন : “আমরা ক্যান্টনমেন্টে ফিরে যাবাে না কিছুতেই  আমাদেরকে বাইরে পাঠাবার ব্যবস্থা করুন। অতঃপর ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টে খালেদের হেড কোয়ার্টারে এক মিটিং বসে। মিটিং-এ উপস্থিত ছিলেন এয়ার মার্শাল তােয়ব, এডমিরাল এম. এইচ. খান, ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামান, ব্রিগেডিয়ার রউফ, কর্নেল মালেক প্রমুখ। আলােচনার পর সিদ্ধান্ত গৃহীত হলাে যে, বিদ্রোহী মেজরদের দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়াই বরং ভালাে। তাদের দেশত্যাগের ব্যবস্থা হয়ে গেল। গৃহবন্দী জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধানের পদ থেকে পদত্যাগ করলেন খালেদ মােশাররফকে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত করে সেনাপ্রধানের পদে নেওয়া হলাে। খালেদের ইচ্ছা ছিল মােস্তাককে প্রেসিডেন্টপদে বহাল রাখা কিন্তু শাফায়াত জামিল আপত্তি করলেন। ইতােমধ্যে জেলহত্যার খবরও তারা জেনে গিয়েছিল। শাফায়াত জামিল জেলহত্যার জন্য মােস্তাককে দায়ী করলেন বললেন : “একজন খুনীকে প্রেসিডেন্ট পদে রাখা যায় না। তাকে এই মুহূর্তে পদত্যাগ করতে হবে।’
তিনি প্রেসিডেন্ট পদে বিচারপতি আবু সাদাত মােঃ সায়েম-এর নাম প্রস্তাব করলেন। মােস্তাক পদত্যাগে বাধ্য হলেন। ৬ই নভেম্বর সায়েম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। মেজর ফারুক-রশিদ ১৫ই আগস্টে যে-অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিলেন, তাতে সেনাবাহিনীর কোনাে উর্ধ্বতন কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতা কিংবা অংশগ্রহণ লক্ষ্য করা যায়নি। আর অল্পসংখ্যক সেনা এ অভ্যুত্থানের অভিযানে অংশগ্রহণ করেছিল। তবে তারা অতি সতর্কতার সাথে আটঘাট বেঁধে কাজ শুরু করেছিল। তাদের সকল কার্যক্রম অতি দ্রুততার সঙ্গে নিষ্পন্ন করা হয়। তারা সর্বত্র চরমপন্থা গ্রহণ করেছে এবং কোনাে কাজেই দীর্ঘসূত্রিতা ছিল না। কিন্তু ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফের কার্যক্রম ছিল তার সম্পূর্ণ বিপরীত। তার অভ্যুত্থানের প্রথম দিনে সেনাবাহিনীর চিফ জেনারেল জিয়াকে গৃহবন্দী করেই তিনি ক্ষান্ত হন হত্যা করার কথা ভাবেননি। তাকে বাঁচিয়ে রেখে তিনি জোরপূর্বক পদত্যাগপত্র লিখিয়ে নিয়ে সেনাপ্রধান হন। ত্বরিত গতিতে তিনি রাষ্ট্রপতির পদটাও গ্রহণ করতে পারতেন।
তা না করে তিনি মােস্তাককেই বহাল রাখেন। বঙ্গভবনকে তিনি সম্পূর্ণভাবে নিজ নিয়ন্ত্রণে নিতে পারতেন, কিন্তু তাও নেননি। বেতারে বাংলাদেশের সম্প্রচার নিয়ন্ত্রণ করেই ভেবেছেন, কেল্লা ফতে। তিনি সঙ্গে সঙ্গে বেতারে তার অভ্যুত্থানের বিষয়টি সম্প্রচার করতে পারতেন এবং সেটাই উচিত ছিল ফলত তাতে জনসাধারণের অবগতির সুযােগ হতাে। তাতে হয়তাে তিনি জনসমর্থন পেয়ে যেতেন। আর, অভ্যুত্থানের সঙ্গে সঙ্গে ক্যান্টনমেন্টের সকল সেনাবাহিনীকে ঘটনা অবগত করিয়ে চেইন অফ কমান্ড ঠিক করে নিতে সক্ষম হলে পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটতে হয়তাে পারতাে না। হয়তাে সকলের আনুগত্য লাভে সমর্থ হতেন কিন্তু তিনি অত্যন্ত শান্তশিষ্ট থেকে ধীরে সুস্থে এগুচ্ছিলেন। আর, সেটাই হয়েছিল তার দুর্ভাগ্যের কারণ । প্রতিপক্ষ পেয়ে গেল পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটানাের সুযােগ। তার ফলে তার অভ্যুত্থান ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলাে এবং তিনি নিহত হলেন। ৭ই নভেম্বর, ১৯৭৫। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের সেনাবাহিনী বিদ্রোহ ঘােষণা করলাে একদল সেনা গৃহবন্দী জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করে আনে। জিয়া ক্যান্টনমেন্টে আসার পর কর্নেল তাহের সেখানে এসে উপস্থিত হন।
৬ই নভেম্বর মধ্যরাতের অভ্যুত্থানের ফলে খালেদ মােশাররফ ক্ষমতাচ্যুত হন এবং জিয়া মুক্তি লাভ করেন। এ-অভ্যুত্থান ঘটায় কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের বিভিন্ন ইউনিটের সৈনিকবৃন্দ। জেনারেল জিয়া আবার সেনাবাহিনীর চিফ অফ স্টাফ পদে বহাল হন। ৬ই নভেম্বর দিবাগত মধ্যরাত  সিপাহী বিদ্রোহের খবর পেয়ে খালেদ মােশাররফ বঙ্গভবন থেকে তার প্রাইভেট কারে দ্রুত বেরিয়ে যান। তার সঙ্গে ছিলেন কর্নেল হুদা এবং কর্নেল হায়দার। খালেদ প্রথমে রক্ষীবাহিনীর প্রধান ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামানের বাসায় যান। সেখান থেকে তিনি কলাবাগানে এক আত্মীয়ের বাসায় গেলেন। অতঃপর তিনি ১০ম বেঙ্গল রেজিমেন্টে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এ ইউনিট ছিল তার বিশ্বস্ত  এর কমান্ডিং অফিসার ছিলেন কর্নেল নওয়াজিশ  তিনি ফোন করে জিয়াকে খালেদের অবস্থানের খবর জানিয়ে দেন। সিপাহী বিদ্রোহের খবর এখনকার সেনারা পুরােপুরি জানতাে না। কিন্তু শীঘ্রই জেনে গেল। সিপাহীরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলাে। কর্নেল নওয়াজিশ তাদেরকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হলেন না। বিদ্রোহী সেনাদের গুলিতে নিহত হলেন জেনারেল খালেদ মােশাররফ, কর্নেল হুদা এবং কর্নেল হায়দার। এ ঘটনা ঘটে। ৭ই নভেম্বর সকাল বেলা ।

শাফায়াত জামিল বঙ্গভবনে ছিলেন। অবস্থা বেগতিক দেখে তিনি একটি পা ভেঙ্গে ফেলেন। সেই অবস্থায় তিনি হাসপাতালে ভর্তি হন। এভাবেই তিনি প্রাণে বেঁচে গেলেন। অতঃপর জেনারেল জিয়া বেতার ভাষণ দিলেন। বিচারপতি আবু সাদাত মােঃ সায়েমকেই প্রেসিডেন্ট পদে বহাল রাখা হলাে। জারি করা হলাে সামরিক আইন তিনি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্বও পেলেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যে তিনি পরিস্থিতি আয়ত্তে আনতে সক্ষম হলেন। আর যা-ই হােক, খালেদ মােশাররফের সেনা অভ্যুত্থান ছিল রক্তপাতহীন। কিন্তু তা মাত্র পাঁচদিনের মধ্যেই ব্যর্থ হয়ে গেল। পরবর্তী পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটে ৭ই নভেম্বর। এ-অভ্যুত্থান একেবারেই রক্তপাতহীন ছিল না। খালেদ মােশাররফসহ বেশ ক’জন সেনা অফিসার নিহত হন এ-পাল্টা অভ্যুত্থানে। খালেদ মােশাররফের লাশ পড়ে থাকলাে পুরাে দু’দিন ৯ই নভেম্বর তার এক চাচা ক্যান্টনমেন্টে যােগাযােগ করলেন তার লাশ নেবার জন্য। তার চাচা। লাশ নিতে ক্যান্টনমেন্টে আসতে সাহস করলেন না। অগত্যা বনানী স্টেশনের কাছে নিয়ে লাশটি তার চাচার কাছে হস্তান্তর করা হয়। তিনি সেনানিবাসের গােরস্তানে খালেদকে দাফন করার অনুমতি চাইলেন। তাকে অনুমতি দেওয়া হয়। সন্ধ্যার অন্ধকারে অতি দ্রুততার সঙ্গে ক্যান্টনমেন্টের গােরস্থানে দাফন কার্য সমাধা করা হয় দাফনের সময়ে খালেদের চাচা এবং তার ৫/৬ জন ঘনিষ্ঠ আত্মীয় উপস্থিত ছিলেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার দুর্ধর্ষ ‘কে’ফোর্সের প্রধান খালেদ মােশাররফ বীর উত্তম-এর এই ছিল শেষ পরিণতি! এরশাদ তখন নয়া দিল্লীতে একটি কোর্স করছিলেন। কোর্স অসমাপ্ত রেখেই তিনি জিয়ার ডাকে দেশে ফিরে আসেন। জিয়া তাকে মেজর জেনারেল র্যাংকে পদোন্নতি দিয়ে সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ অফ স্টাফে উন্নীত করেন। বিভিন্ন উপায়ে তিনি সেনাবাহিনীতে শৃংখলা ফিরিয়ে আনতে তৎপর হলেন।

সূত্রঃ  বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং রাজনৈতিক হত্যাকান্ড – মুহাম্মদ হাবীবুর রহমান