You dont have javascript enabled! Please enable it! 1973.11.04 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | জাতীয় সমবায় দিবস | আবার রেল দুর্ঘটনা | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা : ৪ঠা নভেম্বর, রবিবার, ১৯৭৩, ১৮ই কার্তিক, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

জাতীয় সমবায় দিবস

কথায় বলে, দশে মিলি করি কাজ হারি জিতি নাহি লাজ। প্রকৃত প্রস্তাবেও এই বহুশ্রুত প্রবনটির নিবিড় সার্থকতার পরিচয় পাওয়া যায়। যে কোনো ব্যাপারেই একক কিংবা ব্যক্তিগত উদ্যোগের চেয়ে সমষ্টিগত উদ্যোগের অবদান এবং ফলশ্রুতি অত্যন্ত গভীর—বাস্তবসম্মত। তাই দীর্ঘকাল ধরেই আমাদের দেশে সমবায় আন্দোলনের নানা রকম কর্মকান্ডের পরিচয় পাই। সমবায় আন্দোলনকে সার্থকতা মন্ডিত করার জন্যেও নানা মহল থেকে মহাজন বাক্য উচ্চারিত হয়। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে, সমবায় আন্দোলন দেশের সার্বিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সবিশেষ অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছে, এ রকম উচ্চবাচ্য আমরা উচ্চারণ করতে অপারগ। তার কারণ সমবায় পদ্ধতিকে আমরা জীবন যাত্রার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তুলতে পারিনি। সমবায় আন্দোলন সংগঠিত করার ব্যাপারে আমরা তেমন কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারিনি এজন্যে যে দেশের বিধ্বস্ত অর্থনীতি উন্নয়নকল্পে আমাদের যৌথ কর্মসূচী গ্রহণের ব্যর্থতা এ ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। সমবায় আন্দোলনের মৌলাদর্শ হচ্ছে সততা, একতা এবং সমঝোতা। কিন্তু সমবায় আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে আমরা যথার্থভাবে এ মূলমন্ত্রের প্রতি বিশ্বস্ত হতে পারিনি। অথচ এ কথা আমাদের সবার জানা উচিত যে, সমবায় ব্যবস্থাই হচ্ছে সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠনের অন্যতম প্রধান পদক্ষেপ। বাংলাদেশ সমাজতন্ত্রে আদর্শ বাস্তবায়িত করার জন্যে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে এবং সেজন্যে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা এবং শিক্ষার নিশ্চয়তা বিধানকল্পে সমবায় ব্যবস্থার আমরা প্রসার কামনা করছি। সন্দেহ নেই, সমবায় আন্দোলনকে জোরদার করতে হলে সম্মিলিত উদ্যোগ একান্ত প্রয়োজন।
গতকাল শনিবার সমগ্র দেশে দ্বিতীয় জাতীয় সমবায় দিবস পালিত হয়েছে। এ উপলক্ষে প্রদত্ত এক বাণীতে রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বলেছেন, সমবায়ের সাফল্যের মাধ্যমেই ধীরে ধীরে সমাজতন্ত্রের বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। রাষ্ট্রপতি বলেছেন, শুধু সমবায় অর্থনৈতিক সংগঠনের মাধ্যম নয়, সমবায় একটি জীবন দর্শনও বটে। বাংলাদেশের মানুষ ঐতিহ্যগতভাবে অন্যের সুখ-দুঃখের অংশীদার হয়ে এসেছে। তাই সমবায় আমাদের জাতীয় ঐতিহ্যের অংশ।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে সমবায় আন্দোলনের সার্থক রূপায়ণের জন্যে সমষ্টিগত প্রচেষ্টা লক্ষিত হচ্ছে। দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্যে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমবায়ীরা উৎসাহ-উদ্দীপনা ও কর্মপ্রেরণার পরিচয় বিধৃত করে আসছেন, এটা ঠিক। সমষ্টিগত এই উৎসাহ ও কর্মউদ্দীপনা ভবিষ্যৎ সমবায় আন্দোলনের পাথেয় হয়ে থাকবে। অর্থনৈতিক জীবনে নিজেরাই যদি আমরা নিজেদের বিরাজিত অবস্থার উন্নয়ন সাধন করতে সক্ষম না হই, তাহলে সমবায় পদ্ধতির ব্যর্থতা নেমে আসতে বাধ্য। সেজন্যেই সমবায়ের আদর্শের প্রতি অনুপ্রাণিত হয়ে আমাদের নিজেদের জীবন ব্যবস্থা নিজেদেরই উন্নয়ন করতে হবে। এবং সমবায় আন্দোলনকে সার্থকতর করতে পারলে আমরা আমাদের গন্তব্যে পৌঁছতে পারবো বলে বিশ্বাস করি।
যেহেতু সমবায় একটি যৌথ প্রচেষ্টা সেহেতু ব্যক্তি কিংবা সমাজের কল্যাণ সাধন করতে হলে সমবায় ব্যবস্থার সার্থক রূপায়ণ কাঙ্ক্ষিত। আমাদের বিপুল জনশক্তি রয়েছে, এই জনশক্তিকে কাজে লাগাতে হলে সম্মিলিতভাবে সমবায় আন্দোলন সংগঠিত করা দরকার। কিন্তু সর্বশেষে একটি কথা বলা দরকার যে, প্রতিবছর যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে শুধু জাতীয় সমবায় দিবস পালন করলেই সমবায় পদ্ধতির প্রসার এবং সার্থকতা মন্ডিত হবে, এমন আশা করা উচিত হবে না। সমবায় ব্যবস্থাকে কার্যকর করার জন্যে সক্রিয় উদ্যোগ নেওয়াটাই হবে সত্যিকারের কাজের কাজ।

আবার রেল দুর্ঘটনা

রেলওয়ে দুর্ঘটনাটা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঈশ্বরদী-সিরাজগঞ্জ লাইনে জামতৈল-উল্লাপাড়া স্টেশনের মাঝামাঝি স্থানে এসআই দুই নং ডাউন প্যাসেঞ্জার ট্রেন ও এমটি পাকশী দুইটি ট্রেনের মধ্যে সংঘর্ষের ফলে দুর্ঘটনা ঘটে গত ১৭ই অক্টোবর। এ দুর্ঘটনায় ৫ জন নিহত ও রেলওয়ে ইঞ্জিন ও বগি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
জামতৈল-উল্লাপাড়া রেল দুর্ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই গত বৃহস্পতিবার সিলেট-আখাউড়ার মধ্যবর্তী হরেশপুর স্টেশনের পাঁচ শত গজ দূরে ‘একটি স্টীম ইঞ্জিনের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে ইঞ্জিন দু’টি এবং প্যাসেঞ্জার ট্রেনের তিনটি বগি লাইনচ্যুত হয়েছে।’ প্রত্যক্ষদর্শীর মতে, এ ট্রেন ‍দুর্ঘটনায় দুইটি শিশু নিহত হয়েছে এবং আনুমানিক পঞ্চাশ জন আহত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ঢাকাস্থ রেল সুপারিন্টেন্ডেন্ট জানিয়েছেন যে, ‘কন্ট্রোল লাইন খারাপ থাকার জন্যে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। দুইজন ড্রাইভার ও একজন ফায়ারম্যান সহ এগারো জন সামান্য আহত হয়েছেন।’
কর্তৃপক্ষ বলেছেন যে, জামতৈল ট্রেন দুর্ঘটনার তদন্ত চালানো হবে। বাংলাদেশ রেলওয়ের সহকারী ইন্সপেক্টর আগামী ৭ই ও ৮ই নভেম্বর দুর্ঘটনা সম্পর্কে তদন্ত চালাবেন। হরেশপুর ট্রেন দুর্ঘটনার তদন্ত কবে নাগাদ হবে সে সম্পর্কে কর্তৃপক্ষ এখনো কিছু বলেন নি।
তদন্তের ফলাফল কি দাঁড়াবে আমরা তা জানি না। তবে সাম্প্রতিক রেল দুর্ঘটনা থেকে সাদা চোখে আমরা যা উপলব্ধি করতে পারছি তা হলো, রেলওয়ে ট্রাফিক বিভাগের অকর্মণ্যতার দরুণই দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে। জামতৈল দু’টো ট্রেনের মুখোমুখি সংর্ঘষের মতো একই ধরনের সংঘর্ষ ঘটেছে হরেশপুরে। কর্তৃপক্ষ বলেছেন, ‘কন্ট্রোল লাইন’ খারাপ থাকার দরুণই দুর্ঘটনা ঘটেছে। যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে বিকল্প কোনো ব্যবস্থা নেওয়া কি সম্ভব ছিলো না? ‘কন্ট্রোল লাইন’ খারাপ সুতরাং ট্রেনযাত্রীদের জানমালের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান করা যায়নি এটা একটা খোঁড়া যুক্তি বলেই মনে হয়। এভাবে যদি দুর্ঘটনা ঘটতে থাকে তাহলে নিরীহ নাগরিকদের জীবন যেমন বিপন্ন হবে তেমনি এদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রায় কেনা ইঞ্জিন ও রেলওয়ে বগির সংখ্যাও দিনে দিনে কমবে। এমনিতেই যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে রেলওয়ে ইঞ্জিন ও বগির অভাব। হানাদার বাহিনী বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ পঙ্গু করে দিয়ে গেছে। এমতাবস্থায় রেলওয়ের যে ক’টা ইঞ্জিন ও বগি আছে তা দিয়েই কাজ চালাতে হচ্ছে। তার সঙ্গে যদি গোঁদের উপর বিষ ফোঁড়ার মতো অহরহ দুর্ঘটনা ঘটে তাহলে যে ক’টা ইঞ্জিন বা বগি আছে তাও যাবে। শুধু তাই নয়, রেল কর্তৃপক্ষ যাত্রীদের আস্থাও হারাবেন।
রেল কর্তৃপক্ষের অবহেলা, অযোগ্যতা ও অকর্মতার মাশুল দেশবাসী দেবে এটা তো হতে পারে না। এ ব্যাপারে রেলওয়ে বোর্ড চেয়ারম্যানের কি কোনো দায় দায়িত্ব নেই? কারণ ট্রাফিক ও পরিবহন দপ্তরের দায়িত্ব তারই উপর অর্পিত। অন্যান্য দেশে রেল দুর্ঘটনার পর পদস্থ কর্মচারী থেকে আরম্ভ করে নিম্নপদস্থ কর্মচারীদের বিরুদ্ধে পর্যন্ত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয় অথচ আমাদের এখানে আদৌ কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না তা আমাদের জানা নেই।
শোনা যাচ্ছে বর্তমান রেলওয়ে বোর্ডকে ভেঙে দিয়ে সরকার রেলওয়ের জন্যে অবিলম্বে একটি নতুন প্রশাসন ব্যবস্থা চালু করবেন। রেলওয়ে বোর্ড ভেঙে দিলে কি ফলাফল দাঁড়াবে তা আমাদের জানা নেই। তবে এ বিষয়ে আমাদের বক্তব্য হলো রেল-দুর্ঘটনা এড়াবার জন্যে এবং রেলওয়ে ব্যবস্থা ঢেলে সাজাবার জন্যে রেলওয়ে বিশেষজ্ঞ ও অভিজ্ঞ প্রকৌশলীদের কাজে লাগাতে হবে, অন্যথায় দুর্ঘটনার পরিমাণ যে কমবে এমনটি আশা যায় না। কর্তৃপক্ষকে এদিকে অবশ্যই সচেতন হতে হবে।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন