যুদ্ধাহত খালেদ মােশাররফ সম্পর্কে চিকিৎসকের মতামত
মেজর আখতার আহমেদ বীরপ্রতীক পেশায় একজন চিকিৎসক। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর ক’দিন আগে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যােগ দিয়ে কুমিল্লার ময়নামতিতে আসেন ৪০ ফিল্ড অ্যাম্বুলেন্স নামের ইউনিটে। তখন তিনি ছিলেন লেফটেন্যান্ট। মার্চের মাঝামাঝি সময়ে আখতার আহমেদ দ্বিতীয় দফায় পেস্টিং নিয়ে চলে যান ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অবস্থান নেয়া ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। সেখানেই তিনি সান্নিধ্যে আসেন মেজর খালেদ মােশাররফের। ২৬ মার্চ ভােরে ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বিদ্রোহ করে। আখতার আহমেদও এই বিদ্রোহে যােগ দেন। তারপর মুক্তিযুদ্ধের ক্রমবিকাশের ধারায় তিনি খালেদ মােশাররফকে আবিষ্কার করেন রণাঙ্গনের এক মহানায়ক হিসেবে। মেজর খালেদ মােশাররফ মুক্তিযুদ্ধের প্রায় প্রতিদিনই তার মােড়কবদ্ধ প্রতিভার একেকটি পাপড়ি মেলে ধরেন। আর তা থেকে প্রতিনিয়ত জীবনের কিছু পাঠ ধারণ করে প্রস্তুত হয়েছেন তার সহযােদ্ধারা আগামীর জন্য। আর এভাবেই মেজর আখতার মােহাবিষ্ট হয়ে পড়েন খালেদের অবিস্মরণীয় তরুণ নেতৃত্বের প্রতি। কসবার উল্টোদিকে কমলা সাগরে খালেদ আহত হয়ে রণাঙ্গন থেকে বিদায় নেন। পাকিস্তানিদের নিক্ষিপ্ত শেলের একটি স্পিন্টার তার কপাল ভেদ করে সম্মুখভাগের মস্তকে ঢুকে পড়ে। সেখান থেকে মস্তকের বেশ কিছু অংশ ছিটকে বেরিয়ে আসে। তাকে প্রথমে আগরতলার সামরিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে গৌহাটি এবং অতঃপর পুনায়। আখতার আহমেদ আগরতলা পর্যন্ত খালেদের সঙ্গে ছিলেন। তিনিই সম্ভবত খালেদের আহত হওয়ার ঘটনাটি আদ্যোপান্ত নিরীক্ষণ করেছেন এবং এ ব্যাপারে চিকিৎসকদের ব্যাপক মতামতও নিয়েছেন। তার নেয়া মতামতটি নিচে হুবহু প্রকাশ করা হলাে :
The frontal lobes are the part of the brain most remote from sensory input and whose functions are most difficult to capture. They can be thought of as the executive that controls and directs the operation of the brain systems dealing with cognitive function. Indeed the deficits seen atter frontal lobe damage have been described as a dysexecutive syndrome. Frontal lobe damage can affect people in any of several ways, and the results are at once subtle and drastic. On the one hand, they may have difficulty initiating behavior, in extreme cases being virtually unable to move or speak but more often simply having difficulty in getting started on a task. On the other, they may persevere, being apparently unable to stop behavior once started. Rather than appearing apathetic and hypoactive, they are uninhibited, rude, and boorish. Such people may also have difficulty in planning and problems solving and may be incapable of creative thinking. Mild cases of this definite can be revealed by a difficulty in solving mental arithmetic problems that are couched in word, even though it can be shown that the patient is capable of remembering the question and performing the required calculation. In such cases it appears that the failure to select the appropriate cognitive strategy. A unifying theme in these disorders is the notion of inadequate controller organization of pieces of behavior that main themselves be well formed. Frontal lobe patients are easily distracted, although their deficits may be superficially less dramatic than foes associated with posterior lesions, they can have a drastic effect on everyday function, irritability and personality change are also frequently seen after frontal lobe damage .
Khaled’s departure from the war field with this injury. may not be have been irreversible. But even if he gets well soon. it may take him much longer to become fighting fit again. Consequently, chances of Khaled’s coming back in command would be remote. Even if he recovers fully, how far and how deep this traumatic injury would influence Khaled’s basic intelligence and thinking process, only time could tell that. মেজর আখতার আহমেদ যুদ্ধের পর সুস্থ খালেদকে দেখতে কলকাতায়। যান। সেখানে খালেদকে দেখে তার যে প্রতিক্রিয়া তিনি ব্যক্ত করেন, তা। নিচে বিবৃত হলাে :
“খালেদ ভালাে হয়ে কলকাতায় ফিরে এসেছিলেন। পরিবারসহ ছিলেন ডক্টর সুজিত দে’র পৈত্রিক বাড়িতে। আমাদের দেখে খুশি হলেন খুব। লুলু টুলুদেরকেও নিয়ে গিয়েছিলাম তার সঙ্গে দেখা করতে। তার একটা ছবি সই করে আমাকে দিলেন। | খালেদ ভালাে হয়ে গেছেন দেখে খুব ভালাে লাগল। কিন্তু তার চেহারায়, চোখের চাহনিতে সেই ধারটা আর নেই। কথাবার্তা আস্তে আস্তে বলছেন। হাসিটা কেমন ভোঁতা। শরীরে চর্বি লেগেছে। পায়জামা-পাঞ্জাবি। পরে স্ত্রীর পাশে বসে আছেন খালেদ মােশাররফ। ঘর ভর্তি করে বসে। আরাে আছেন সুজিত দে’র আধুনিকা বােনেরা, মা, আরাে অনেক আত্মীয়স্বজন। আমার কমান্ডার সেই অগ্নিপুরুষ খালেদ মােশাররফকে এখানে খুঁজে পেলাম না। সে বােধহয় চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেল মেলাঘরের শালবাগানে।”
৬ নভেম্বর রাতে রাষ্ট্রপতি হিসেবে জাতির উদ্দেশে দেয়া বিচারপতি আবু সাদাত মােহাম্মদ সায়েমের ভাষণ :
প্রিয় দেশবাসী অসিসালামু আলাইকুম। আজ এক সঙ্কটময় মুহূর্তে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে জনগণের সহযােগিতার ওপর দৃঢ় আস্থা রাখিয়া আমি রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করিয়াছি। দেশের স্বাধীনতা এবং আপামর জনসাধারণের ও আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের সুখী-সমৃদ্ধিশালী জীবন নিশ্চিত করার জন্য যে লক্ষ লক্ষ ভাই ও বােনেরা আত্মাহুতি দিয়াছেন এবং জীবন বিপন্ন করিয়াছেন, আজ সর্বান্তঃকরণে তাদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করিতেছি। যে আদর্শের বাস্তবায়নের জন্য আমরা স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হইয়াছিলাম, স্বাধীনতার প্রায় দীর্ঘ চার বছর পরেও তাহার আশনুরূপ বাস্তবায়ন হয় নাই। ফলে জনসাধারণ আজও অর্থনৈতিক সমস্যায় জর্জরিত। তাহাদের মনে হতাশা ও নিরাপত্তাবােধের অভাব। দেশের সাধারণ মানুষের এই সামাজিক ও অর্থনৈতিক দুরবস্থার ফলে রাজনৈতিক স্বাধীনতাপ্রসূত আশা-আকাক্সক্ষার পূর্ণ প্রতিফলন হয় না। গত ১৫ আগস্ট কতিপয় অবসরপ্রাপ্ত এবং চাকরিরত সামরিক অফিসার এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ও তার পরিবার-পরিজনকে হত্যা করে। জনাব খন্দকার মােশতাক আহমদ রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ। করিয়া সামরিক আইন জারি করেন। প্রকৃতপক্ষে এই ঘটনার সঙ্গে সামরিক বাহিনী সংশ্লিষ্ট ছিল না। দেশে আইন-শৃঙ্খলা ফিরিয়া আসিবে এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হইবে- দেশবাসী এই আশা করিয়া নিরাশ হইয়াছে। দেশে নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হয় নাই, এমনকি সম্প্রতি কারাগারে অন্তরীণ কিছু বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হইয়াছে। এমতাবস্থায় জনাৰ খন্দকার মােশতাক আহমদ আমাকে রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার গ্রহণের অনুরােধ জানাইয়াছেন।
এই সরকার উপমহাদেশে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের প্রচেষ্টা চালাইয়া যাইবে এবং একই সঙ্গে নিকট প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বিদ্যমান ঘনিষ্ঠ ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরাে জোরদার করার লক্ষ্যে নিষ্ঠাবান থাকিবে। বৃহৎ শক্তিসমূহের সহিত সরকার ঘনিষ্ঠতর বন্ধুত্বপূর্ণ সহযােগিতা চালাইয়া যাইবে। দেশে সামরিক আইন জারি আছে। আমি একটি নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করিয়াছি। আমাদের মুখ্য উদ্দেশ্য দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরাইয়া আনা ও ন্যূনতম সময়ের মধ্যে অবাধ নিরপেক্ষ সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা। আমরা এই দায়িত্ব ১৯৭৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অথবা সম্ভব হইলে তাহার পূর্বেই পালন করিতে বদ্ধপরিকর। এই উদ্দেশ্য সামনে রাখিয়া জাতীয় সংসদ বাতিল করা হইল। আমাদেরকে দেশে আইন ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করিয়া এবং সমাজ দেহ হইতে দুর্নীতি, মুনাফাখােরি কালােবাজারি, চোরাকারবারি ও বেআইনি অস্ত্রধারী এবং খুন, রাহাজানি ও লুটতরাজের মতাে ঘৃণ্য অপরাধসমূহ দূর করিতে হইবে, যাহাতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়া আসে। একই সঙ্গে আইনের শাসন, জনগণের মৌলিক অধিকার, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং আত্মনির্ভরশীল অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার বিরামহীন প্রচেষ্টায় আমাদের লিপ্ত হইতে হইবে। বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে পারস্পরিক সমতা, সার্বভৌমত্ব এবং স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকিয়া প্রত্যেক রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা এবং একে অপরের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার নীতিতে আমরা অবিচল থাকিব । আমরা সক্রিয়ভাবে জোটনিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ করিব। আমি দৃঢ়তার সহিত পুনরায় ঘােষণা করিতেছি যে, আমাদের সরকার জাতিসংঘের সনদ ও তাহার নীতিমালা ও লক্ষ্যের প্রতি পূর্ণ আস্থাবান। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আমাদের সরকার সকল দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক চুক্তি এবং দায় সম্পর্কে পূর্ণ মর্যাদাশীল থাকিবে। আমরা বর্ণবাদ, বর্ণবৈষম্যবাদ এবং নয়া উপনিবেশবাদ বিরােধী নীতি অনুসরণ করিয়া যাইব।
ইসলামী সম্মেলন, জোটনিরপেক্ষ ও কমনওয়েলথ সম্মেলনের সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ও সহযােগিতা বজায় থাকিবে। বিশ্বশান্তি এবং আন্তর্জাতিক সহযােগিতা দৃঢ়তর করার প্রচেষ্টায়ও আমরা সক্রিয় থাকিব। এখনাে পর্যন্ত যেসব রাষ্ট্রের সহিত আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয় নাই, সে সব দেশের সাথে আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আমরা প্রচেষ্টা চালাইয়া যাইব। “সকলের প্রতি বন্ধুত্ব এবং কারাে প্রতি বিদ্বেষ নয়”, এই প্রতিপাদ্যই আমাদের পররাষ্ট্রনীতির মূল ভিত্তি। আমরা উপমহাদেশে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের প্রচেষ্টা চালাইয়া যাইব। একইসঙ্গে আমরা আমাদের নিকট প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে বিদ্যমান ঘনিষ্ঠ ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে আরাে জোরদার করার লক্ষ্যে নিষ্ঠাবান ও বৃহৎ শক্তিসমূহের সঙ্গে আমাদের সরকার ঘনিষ্ঠতর বন্ধুত্বপূর্ণ সহযােগিতা চালাইয়া যাইবে। ইসরাইলের কবল হইতে পবিত্র আরবভূমি পুনরুদ্ধারের জন্য এবং আরব ভাইদের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রাম ও ফিলিস্তিনি জনগণের ন্যায্য দাবি প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রতি আমরা আমাদের অকুণ্ঠ সমর্থন অব্যাহত রাখিব। পরিশেষে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, জনসাধারণের ভাগ্য উন্নয়ন এবং সামাজিক-অর্থনৈতিক সমস্যাসমূহ সমাধানে আপনাদের সর্বাত্মক সহযােগিতা কামনা করি। ইনশাআল্লাহ আমরা সফলকাম হইব। খােদা হাফেজ। বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।
সূত্রঃ বাংলাদেশ বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তর – মেজর নাসির উদ্দিন