বাংলার বাণী
২৩শে আগস্ট, বৃহস্পতিবার, ১৯৭৩, ৬ই ভাদ্র, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
শিক্ষক সমিতির সিদ্ধান্তকে অভিনন্দন
দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ দিন স্থায়ী স্কুল শিক্ষকদের ধর্মঘট প্রত্যাহৃত হয়েছে। খবরটি সকলের কাছেই শুভ এবং স্বস্তির।
শিক্ষকদের ৬ দফা দাবী ন্যায়সঙ্গত—এ কথা যেমন আমরা আগেও বলেছি, আজও বলি। দেশের সার্বিক কল্যাণের স্বার্থেই তাঁদের দাবীগুলো সরকারের মেনে নেয়া উচিত। বঙ্গবন্ধুর সরকার তাঁদের দাবীগুলোকে নীতিগতভাবে মেনে নেবার কথা ইতিপূর্বেই ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু কি প্রক্রিয়ায় দাবীগুলো পূরণ করা হবে তার সঠিক কর্মপন্থা বা বাস্তব প্রয়োগের ব্যবস্থা না দেখে অবশেষে শিক্ষকগণ ধর্মঘটের আশ্রয় নিয়েছিলেন। ফলে সারাদেশের শিক্ষাঙ্গনে এক অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে, আসন্ন এসএসসি পরীক্ষা পিছিয়ে যায়, বুদ্ধিজীবী, ছাত্র ও অভিভাবকদের মনে নেমে আসে দুশ্চিন্তা ও অনিশ্চয়তা। এমনিতর অবস্থায় জাতির জনক ও প্রধানমন্ত্রী বঙ্গব্ন্ধুর অনুরোধে শিক্ষক মন্ডলী ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। আমরা তাঁদের এই সিদ্ধান্তকে অভিনন্দন জানাই।
আমরা আগেই বলেছি দেশের সার্বিক কল্যাণ, বিশেষ করে সমাজতান্ত্রিক ও বৈজ্ঞানিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রেক্ষিতেই শিক্ষকবৃন্দের দাবী ন্যায়সঙ্গত বিবেচনায় তা সরকারের মেনে নেয়া উচিত। বঙ্গবন্ধুর সরকার নীতিগতভাবে তা মেনেও নিয়েছেন। এক্ষণে যে কারণে শিক্ষক মন্ডলী তাঁদের দাবী পূরণের ব্যাপারে সন্দিহান ছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দীর্ঘ দু’ঘন্টা ধরে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু তাঁদের দাবী পূরণের আশ্বাস প্রদান করেছেন এবং সে কারণে আগামী তিন চার দিনের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু নিজেই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ও শিক্ষক সমিতির প্রতিনিধিদের এক বৈঠক আহ্বান করার কথাও ঘোষণা করেছেন।
আমরা দৃঢ়ভাবে আস্থাশীল যে, বঙ্গবন্ধুর সরকার শিক্ষকদের পূর্ণ মর্যাদা রক্ষা করে তাঁদের ন্যায্য দাবী যথাসম্ভব সত্বর পূরণে কুন্ঠিত হবেন না।।
প্রসঙ্গতঃ বলে রাখতে চাই, শিক্ষকবৃন্দের দাবীগুলো যেমন ন্যায়সঙ্গত তেমনি সেগুলো বাস্তবায়ন সময়সাপেক্ষ, বিশেষ করে দেশের বর্তমান বিধ্বস্ত অর্থনৈতিক অবস্থায়। সুতরাং তাঁদের দাবীগুলো দেশের মঙ্গলের স্বার্থেই সত্বর বাস্তবায়নে আন্তরিকভাবে প্রচেষ্টা চালানোর জন্যে এবং শিক্ষক মন্ডলীকেও দেশের আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করে তাঁদের দাবী পূরণের প্রেক্ষিতে অধৈর্য না হবার জন্যে আমরা অনুরোধ জানাই। দেশের শিক্ষাঙ্গনে উদ্ভূত বর্তমান অচলাবস্থা নিরসনের প্রেক্ষিতে এবং দেশের বৃহত্তর স্বার্থের কথা ভেবে ভবিষ্যতেও শিক্ষক মন্ডলীর কাছ থেকে সারা দেশবাসীর ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামে তাঁরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করবেন বলে আমরা আশা রাখি। এবং সেই সঙ্গে একথাও বলে রাখছি যে আশ্বাসের ভিত্তিতে শিক্ষক সমিতি ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নিলেন তা পূরণ করতে সরকার কোন কারণে ব্যর্থ হলে তার পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তীকালে শিক্ষক সমিতির গৃহীত কর্মসূচীর সঙ্গেও অতীতের ন্যায় ভবিষ্যতে আমাদের পূর্ণ সহানুভূতি থাকবে।
বাংলাদেশের বাস্তবতা ও মিঃ উমিত
তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিঃ উমিত হালুক বাউলকেন ব্যাংকক থেকে নয়াদিল্লী যাবার পথে গত মঙ্গলবার ঢাকা বিমানবন্দরে কিছুক্ষণের জন্যে অবস্থান করেছিলেন। সে সময়টাতে তিনি আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডঃ কামাল হোসেনের সাথে কিছু কথাবার্তাও বলেছেন। তাদের এই কথাবার্তা পারস্পরিক মতবিনিময় বেশ ফলপ্রসূ হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে ৪০ মিনিট ধরে কথাবার্তা বলার পর মিঃ উমিত সাংবাদিকদের কাছে বলেছেন : বাংলাদেশ একটি বাস্তব সত্য এবং সবাই এখন এদেশটির সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে চায়। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি একথা বললেও তাঁর দেশ কবে নাগাদ এই বাস্তব সত্যাটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে নেমে নিচ্ছেন—অর্থাৎ বাংলাদেশকে তুরস্ক কবে নাগাদ স্বীকৃতি দিতে সক্ষম হবে বা কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে এগিয়ে আসবে মিঃ উমিত সরাসরিভাবে সে ব্যাপারে এ মুহূর্তে কিছু বলে যাননি।
তুরস্ক ‘আঞ্চলিক উন্নয়ন সহযোগিতা’ বা আরসিডির মাধ্যমে পাকিস্তান ও ইরানের সঙ্গে গাঁটছড়ায় আবদ্ধ। সেন্টো-সিটোয় গাঁটছড়া তো আছেই। তার উপর আছে ন্যাটোর সাথে সম্পর্ক। তাছাড়া ইরান যখন পারস্যোপসাগরের স্বঘোষিত রক্ষাকর্তা সেজে পশ্চিম ইউরোপে আরব দেশের তেল সরবরাহের একমাত্র জলপথটির মালিক বনে যাচ্ছে, সেক্ষেত্রে তুরস্ককে ইরানের সাথে তার সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ করতে হচ্ছে সঙ্গত কারণেই। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ তথা এ উপমহাদেশের ব্যাপারে তুরুস্ককে কিছু বলতে হলে বা করতে গেলে ইরানের মুখ চেয়েই বলতে হবে। কেননা ইরান এখন বহির্বিশ্বে পাকিস্তানের রক্ষাকর্তার ভূমিকায়। তাছাড়া পাকিস্তানের সাথে আরসিডি ছাড়াও তুরস্কের বহু পুরোনো সম্পর্ক রয়েছে। কাজেই পাকিস্তানের মনোবেদনা ঘটতে পারে, এমন কোন কথাও তুরস্কের পক্ষে বলা সম্ভব নয়—সম্ভব হয়নি তুর্কী পররাষ্ট্রমন্ত্রীরও বাংলাদেশের বাস্তবতাকে আনুষ্ঠানিকভাবে মেনে নেবার প্রশ্নে কিছু বলার। তাই তিনি এ মুহূর্তে সেই বাস্তবতা স্বীকার করেই ক্ষান্ত হয়েছেন।
তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকা বিমানবন্দরে যা বলেছেন, তা অবশ্যই আশার বাণীবাহী। তিনি বলেছেন, আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে তাঁর যে কথাবার্তা হয়েছে তাতে এই উপমহাদেশের সমস্যাবলী সমাধানে বাংলাদেশ যে উদ্যোগ নিয়েছে—উপমহাদেশের মানবিক সমস্যাবলী সমাধানে বাংলাদেশ যে বক্তব্য রেখেছে তিনি তার যথার্থতা অনুধাবন করতে পেরেছেন এবং উপমহাদেশের পরিস্থিতির উন্নয়নে তিনি আশান্বিত ও সুখী।
এ প্রসঙ্গে তিনি অবশ্যই বর্তমানে নয়াদিল্লীতে অনুষ্ঠানরত ভারত-পাকিস্তান আলোচনার কথাও উল্লেখ করেছেন এবং ঢাকা থেকে দিল্লী যাবার পর বলেছেন যে, তিনি আশা করছেন তাঁর দিল্লীতে অবস্থানকালেই তিনি একটা সুখবর শুনবেন। বৈঠকের বর্তমান অগ্রগতিই যে তাঁর আশা প্রকাশের কারণ তা বলাই বাহুল্য।
যাহোক বিশ্বের ১০৩টি দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের পর অন্যতম মুসলিম দেশ যখন এখন এই দেশটির বাস্তবতা উপলব্ধি করে নিয়েছে তখন আমরা অবশ্যই আশা করবো তুরস্কের সাথে একই বন্ধনে আবদ্ধ অন্য দু’টি দেশ বিশেষ করে ইরানও তা উপলব্ধি করার মানসিকতা লাভ করবে। সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী এবং বাংলাদেশ একটি সত্য—এই সত্যকে এখনো যারা জোর করে উপলব্ধি করতে চাচ্ছেন না—তাদের সেই ভুল অবশ্যই ভাঙবে—সে ব্যাপারে আমরা আশাবাদী।
ঠাঁই নেই, ঠাঁই নেই
ঢাকা নগরীতে এখন বাসগৃহ সমস্যা প্রকট। গ্রাম-গ্রামান্তর থেকে জীবিকার অন্বেষণে মানুষ রাজধানীতে আসতে শুরু করেছে। কিন্তু ছোট্ট একটু বাসা কেউ খুঁজে পাচ্ছে না। নগরীর জনসংখ্যা ক্রমাগত যতোই স্ফীততর হচ্ছে, এই বাসগৃহের সমস্যাও যেন দিন দিন ততোই প্রবল হয়ে উঠছে। পত্রিকান্তরে সম্প্রতি স্পেনের কাষ্টলন শহরের একটি ঘটনা প্রকাশিত হয়েছে। খবরটির সঙ্গে অবশ্য আমাদের রাজধানী ঢাকা শহরের বাসগৃহ সমস্যার মতো কোন সমস্যার হুবহু মিল নেই, তবে কাষ্টলনে রাত্রিবাসের জন্যে হোটেলের কক্ষ পাওয়া যায়নি, তাতে কিছুটা মিল খুঁজে পাওয়াটাও তেমন কোন অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। স্পেনের কাষ্টলনের হোটেলে কক্ষ না পাওয়া আর বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা নগরীতে মাথা গুঁজে রাত্রি কাটানোর মতো এতোটুকু আশ্রয় না পাওয়ার ঘটন যেন একই সূত্রে গাঁথা। খবরে জানা গেছে, জনৈক নব দম্পতি বিয়েটা সেরেই হানিমুন করার জন্যে স্পেনের কাষ্টলনে ছুটে যান। কিন্তু কাষ্টলনের কোন হোটেলেই তাঁদের এতোটুকু আশ্রয় জুটলো না। এক চিলতে নিরালা নিভৃত সুখ শয্যার জন্যে তাই নব দম্পতি হন্যে হয়ে পথে পথে ঘুরতে লাগলো। পথ পরিক্রমায়ই রাত নেমে এলো—অগত্যা হানিমুনও পথেই সারতে হলো। কিন্তু সহসা পুলিশের ধূর্তচোখে নব দম্পতির এই হানিমুল ধরা পড়ে গেলো। ওরা পুলিশকে সমস্ত ঘটনা খুলে বললো। পুলিশের পাষাণ হৃদয় হয়তো তাদের দুঃখের কথা শুনে বিগলিত হয়েছিলো। পুলিশ ওদের জন্যে জেলের নির্জন কক্ষে জায়গা করে দিয়েছিলো। এবং তাতে ঐ নব দম্পতি খুশীতে বাগ বাগ হয়ে জেলখানার শেলের অন্ধকারেই হানিমুনের মাধুর্য উপভোগ করেছিলো। ঘটনাটি ছোট্ট। কিন্তু দারুণ দুঃখ দহনে দীর্ণ। ঢাকা নগরীর বাসগৃহ সমস্যার সমাধান না হলে হয়তো নিকট ভবিষ্যতে কাষ্টলন শহরের মতো মর্মবিদারক ঘটনা ঘটলেও আমরা অবাক বা বিস্মিত হবো না।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক