You dont have javascript enabled! Please enable it! 1973.10.11 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | এ হরতাল ফায়দা লাভের হরতাল | উপকূলীয় এলাকায় নদীর ভাঙ্গন | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা: ১১ই অক্টোবর, বৃহস্পতিবার, ২৪শে আশ্বিন, ১৩৮০

এ হরতাল ফায়দা লাভের হরতাল

তিনি দলীয় ঐক্যজোট গঠনের বিস্তারিত পরিকল্পনা ও কর্মসূচি গ্রহণের জন্য গত তিনদিন ধরে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে খুব শীঘ্রই একটা চূড়ান্ত রূপ পরিগ্রহ করবে প্রস্তাবিত ঐক্য জোট। গতকাল ত্রিদলীয় জোটের পক্ষ থেকে মওলানা ভাসানি কর্তৃক আহুত হরতাল পালন কে জাতীয় জনমনে বিভ্রান্তি বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। মাওলানা ভাসানী আরবদের সমর্থনে ইসরাইলি আক্রমণের প্রতিবাদে সারা বাংলাদেশব্যাপী হরতাল পালনের কর্মসূচি সম্প্রতি ঘোষণা করেছেন। আরবের পবিত্র ভূমিতে ইসরাইল আক্রমণ চালিয়েছে তার প্রতিবাদ জানানো বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের নৈতিক কর্তব্য। বয়োবৃদ্ধ নেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী সাহেব আরব ভাইদের প্রতি অনাবিল সহৃদয়তা প্রকাশ করতে গিয়ে হরতাল পালনের আহ্বান জানিয়েছেন। মওলানা ভাসানি সাহেবের এই সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মনোভাব তথা মানবতার পক্ষে সোচ্চার কণ্ঠস্বরের প্রতি আমরা সশ্রদ্ধ সালাম জানাই। ভাসানী সাহেব যথাসময়ে তার মনোভাব নির্যাতিত আরবদের সপক্ষ ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু কথা উঠেছে তার প্রস্তাবিত হরতাল পালনের প্রশ্ন নিয়ে। দেশের নানা প্রতিকূল অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে হরতাল পালন করা উচিত কি উচিত নয় এটা একটা বিবেচনা করার মতো বিষয়। ত্রিদলীয় ঐক্যজোট ভাসানী সাহেবের হরতাল পালনের প্রস্তাব কে বিভ্রান্তিমূলক বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাদের মতে হরতাল বর্তমানে নিরর্থক। আগামীকাল অর্থাৎ বারোই অক্টোবর ভাসানীর আহূত হরতালের দিন। ইসরাইল আরব রাষ্ট্রগুলোর প্রতি চরম আঘাত হেনেছে। তাকে মদদ দিচ্ছে তারই পুরনো বন্ধুরা। যাদের ভেদবুদ্ধি ও সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবের দরুন দীর্ঘকাল ধরে আরো ভূমিতে রক্তের নদী বয়ে চলেছে। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরাইল আরব এলাকার এক বিরাট অংশ দখল করে নিয়েছিল। জাতিসংঘের নিষ্পত্তির মাধ্যমে আরব এলাকা ফিরিয়ে দেবার জন্য ইসরাইলের ওপর চাপ সৃষ্টি করা সত্ত্বেও এতদিন ইসরাইল গোয়ার্তুমি করে আরব এলাকা ছেড়ে দেয়নি। এবারও পুনরায় ইসরাইল আরব ভূমির উপর চরম আঘাত এনেছে। অবশ্য এবারের আরব রাষ্ট্রসমূহের ঐক্য ঐতিহাসিক। সংঘবদ্ধভাবে তারা প্রতিঘাত হেনেছে ইসরাইলের বিরুদ্ধে। আরবদের শপথ তাদের দখলকৃত এলাকা পরিপূর্ণভাবে ফিরিয়ে না নেওয়া পর্যন্ত তারা যুদ্ধ চালিয়ে যাবে। আরবদের এই ন্যায্য অধিকার আদায়ের সংগ্রামে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ ঐক্যমত্য। আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আরবদের স্বপক্ষের স্বার্থহীন মনোভাব জানিয়ে দিয়েছেন। গোটা জাতির পক্ষ থেকেই তিনি তার মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। জাতির তিনিই কন্ঠস্বর। মওলানা ভাসানী সাহেব জানেন দেশের প্রধানমন্ত্রী এ ধরনের কোনো বিষয় পক্ষে মতামত ব্যক্ত করলে সেটাই হয় ন্যায়ত গোটা দেশের পক্ষ থেকে বলা। এর চাইতে বড় সমর্থন আর হতে পারে না। তবু ভাসানী সাহেব তার নিজের কৃতিত্ব প্রচার করতে চান। মওলানা সাহেবের সারা জীবনের রাজনীতিতে একটি মূল বিষয় রয়েছে তা হলো রাজনৈতিক ফায়দা লুটা। সময় ও সুযোগের সদ্ব্যবহার করে থাকেন। আরব রাষ্ট্রের সমর্থন তার এই হরতালও যে একটি ফায়দা লুটার মওকা ছাড়া অন্য কিছু নয় তা বেশ সুস্পষ্ট। দেশের নানা সমস্যা। এমনিতেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ করে কলকারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। সরকার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন উৎপাদন বৃদ্ধি করার। জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধির উপরই দেশের মানুষের মুখের হাসি ফিরে আসা নির্ভর করে। এই মুহূর্তে তাই হরতাল করা জাতীয় ক্ষতি ছাড়া আর কিছুই নয়।
ভাসানী সাহেব এই জাতীয় ক্ষতির বিষয়টিও বোঝেন। তবু তিনি রাজনৈতিক ফায়দা লাভের প্রত্যাশায় মরিয়া হয়ে উঠেছেন। আমরা ভাসানী সাহেবের ইসরাইলি সাম্রাজ্যবাদী আক্রমণের বিরুদ্ধে অঘোষিত মনোভাবের সঙ্গে ঐক্যমত পোষন করি কিন্তু দেশের বর্তমান পূনর্গঠনের সংগ্রামের সময় আহূত হরতালের সমর্থনে করিনা। কেননা আমরা জানি একদিনের হরতালে দেশের কোটি কোটি টাকার উৎপাদন ব্যাহত হবে আর তা জাতির এই নিদারুণ কালে মারাত্মক ব্যাপার। ভাসানী সাহেব এই বাস্তব দিকটি উপলদ্ধি করতে সক্ষম কি?

উপকূলীয় এলাকায় নদীর ভাঙ্গন

নদীর ভাঙ্গনে আবার দক্ষিণাঞ্চলের এক বিস্তীর্ণ জনপদ বিলীন হতে চলেছে। বঙ্গোপসাগরের উপকূল এলাকায় হাতিয়া, সন্দ্বীপ ও কুতুবদিয়া দ্বীপাঞ্চল এবং কর্ণফুলী নদীর পূর্ববর্তী নদীর ভাঙ্গনে এক বিপর্যস্ত অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। বঙ্গোপসাগরের কর্ণফুলী নদীর তীব্র স্রোতের ফলেই এই উপকূলীয় এলাকা ভাঙছে বলে জানা গেছে। অন্যদিকে হাতিয়া দ্বীপ এর উত্তর পূর্ব ও পশ্চিম এবং কুতুবদিয়ার উত্তর-পশ্চিম ও সন্দ্বীপের উত্তর এলাকায় ভাঙ্গন অব্যাহত রয়েছে। সন্দ্বীপের চারটি ইউনিয়নে ইতিমধ্যেই নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
এছাড়াও উপকূলীয় বাঁধ থেকে দশ মাইল দূরে অবস্থিত কুতুবদিয়ার ব্যাপক ভাঙ্গন এখন বিপদজনক অবস্থার সম্মুখীন হয়েছে বলেও জানা গেছে। ভাঙ্গনের ফলে চট্টগ্রাম বন্দরের বিপরীত দিকের অর্থাৎ কর্ণফুলীর পূর্ববর্তী একটি ব্যাপক এলাকা নদীর গর্ভে বিলীন হতে শুরু করেছে। এদিকে পর্যাপ্তসংখ্যক প্রস্তুত খন্ডের অভাবে কর্ণফুলী সহ উপকূলীয় এলাকার উন্নয়ন প্রকল্পে কাজকর্মের ব্যাঘাত ঘটছে।
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে তথা উপকূলীয় এলাকায় নদীর ভাঙ্গন নতুন কিছু নয়। হরহামেশাই নদীর ভাঙ্গনের ফলে দক্ষিণাঞ্চলের বিরাট বিরাট জনপদ বিলীন হচ্ছে। এই সেদিনও মেঘনার ভাঙ্গন এর ফলে চাঁদপুর পুরান বাজার এর এক ব্যাপক এলাকা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। শেষটায় জরুরী ভিত্তিতে কিছু কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের প্রত্যেকটিতেই সেই ভাঙ্গন এখন সাময়িকভাবে রোধ করা সম্ভব হয়েছে বটে, তবে স্থায়ী কোনো ব্যবস্থা না নিলে সেটা আরও বড় আকার ধারণ করতে পারে যেকোনো সময়।
হাতিয়া, সন্দ্বীপ, কুতুবদিয়া, মেঘনা ও বঙ্গোপসাগরের অভ্যন্তরে অবস্থিত। কর্ণফুলী ও মেঘনার সঙ্গমস্থল কুতুবদিয়ার কাছাকাছিতে। ছোট্ট পাহাড়ি নদী কর্ণফুলী প্রায় সবসময় খরস্রোতা। আর এই খরস্রোতের ফলেই নদী ভাঙ্গন একটি অবশ্য বিফল হয়ে দাঁড়ায়।
এমতাবস্থায় এই নদী ভাঙন রোধের জন্য কিছু না কিছু কার্যকরী ব্যবস্থা সবসময়ই নেয়া উচিত। স্থায়ী কোনো ব্যবস্থা না নিলে নদীর ভাঙ্গন এর হাত থেকে উপকূলীয় অঞ্চলগুলোকে কখনো রক্ষা করা যাবে না। পর্যাপ্ত পরিমাণ প্রস্তরখন্ডের সাহায্যে উপকূল এলাকায় আরও বেড়িবাঁধ নির্মাণ করে এই ভাঙ্গনের হাত থেকে উপকূলীয় এলাকা এবং সেখানকার জীবন ও সম্পদ রক্ষা করার ব্যবস্থা নেয়া হোক।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন