বাংলার বাণী
ঢাকা: ২৭শে এপ্রিল, রোববার, ১৪ই বৈশাখ, ১৩৮১
পর্তুগালে নয়া সরকার
পর্তুগালে রক্তপাতহীন সামরিক অভ্যুত্থান ঘটেছে। পদচ্যুত জেনারেল এন্টোনিও ডি স্পিনোলার নেতৃত্বে শুক্রবার ২৬শে এপ্রিল সাত সদস্যের সামরিক জান্তা পর্তুগালের শাসনভার হাতে নিয়েছে।
বিগত চার যুগ ধরে স্বৈরতন্ত্রী শাসন চলার পর এই প্রথম লিসবনের সংবাদপত্র গুলোর উপর থেকে সেন্সরশীপ তুলে নেওয়া হয়। বহুল প্রচারিত ‘দিয়ারিও ডি নোটিশিয়াস’ এবং ‘ইপোকা’ এ নয়া অভ্যুত্থান তথা সামরিক জান্তাকে অভিনন্দন জানিয়ে খবর পরিবেশন করেছে।
জেনারেল স্পিনোলা সামরিক জান্তার সদর দপ্তর পন্টিনা বারাকে আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে ঘোষণা করেন যে, ক্যাটানোর আমলে আটক রাজবন্দীদের মুক্তি দেওয়া হবে, গুপ্ত পুলিশ বাহিনী ‘ডিজিএস’বাতিল করা হবে এবং এক বছরের মধ্যে নতুন সংবিধান প্রণয়নের জন্য গণপরিষদ নির্বাচন হবে। এই এক বছর কাল অস্থায়ী সরকার কাজ চালাবে। তিনি আরো বলেন, তার সরকার ভোট ও কাজের স্বাধীনতা নিশ্চিত করবে।
৬৩ বছর বয়স্ক এক টেলিভিশন ভাষণে পর্তুগালকে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে রাখার নিশ্চয়তা প্রদান করেন। এমনকি নাগরিকদের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করেন।
জান্তার ৭ জনের মধ্যে ৬ জন টেলিভিশন অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন। তাদের মধ্যে সাবেক সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ফ্রাংসিসোকো ও ডিকোষ্টাও রয়েছেন। আফ্রিকান নীতির প্রশ্নে গত মাসে তাকে বরখাস্ত করা হয়েছিল।
অভ্যুত্থানের দিন পর্তুগালে সেন্সরশীপ ছাড়াই পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে। পর্তুগালের জাতীয় ইতিহাসের চার যুগের মধ্যে এ ধরনের ঘটনা এই প্রথম। বলা চলে ৪৮ বছর স্বৈরতান্ত্রিক শাসন এর পর এহেন নতুন আশার কথা পর্তুগালবাসী এই প্রথম শুনল। স্বভাবতঃই গণতান্ত্রিক অধিকার ও মর্যাদা প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা আজ সবারই মনে। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও বিদ্যা-বুদ্ধির সৌজন্যে মানবিক অধিকার গুলি সম্পর্কে এবং সেই ন্যায্য দাবি আদায়ের প্রশ্ন আজ সচেতন নাগরিক মাত্রেই সোচ্চার হয়ে উঠেছে। তারই প্রেক্ষিতে পর্তুগালের সামরিক অভ্যুত্থান হলেও তাদের পক্ষ থেকে গণতান্ত্রিক মনোভাবের এই প্রকাশটুকুও পর্তুগালবাসি সহ বিশ্ববাসীর অভিনন্দনযোগ্য।
তবে উপনিবেশবাদের আস্থাবান পর্তুগালের আভ্যন্তরীণ উত্থান-পতনের চেয়ে আমরা তাদের ঔপনিবেশিক তৎপরতার প্রতি দৃষ্টি দিতে অধিক আগ্রহী। যদিও অভ্যুত্থান সম্পৃক্ত বন্দি নির্বাসন, হত্যাকাণ্ড ঘটনাবলীর খবরও আমরা আগ্রহের সঙ্গে লক্ষ্য করে থাকি। কিন্তু আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির প্রসারিত ক্ষেত্র যখন কোনো রাষ্ট্রীয় শক্তির দ্বারা বিঘ্নিত হতে থাকে তখন তার আভ্যন্তরীণ ঘটনার চেয়ে বহির্বিশ্ব প্রতিক্রিয়া প্রতি স্বাভাবিক ভাবেই আমরা অধিক গুরুত্ব আরোপ করে থাকি।
এই প্রসঙ্গে বলা যায়, সমগ্র বিশ্বে যখন শান্তি ও নিরাপত্তার প্রশ্নে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে উঠেছে তখন মোজাম্বিকে দ্বিতীয় ‘মাইলাই’ ঘটনার পুনরাবৃত্তি করে পর্তুগাল বিশ্বের ক্ষুব্ধ দৃষ্টি তার দিকে আকর্ষণ করেছিল। সেখানে বর্বর অত্যাচার, অগ্নিসংযোগ, নির্বিবাদ হত্যা, নারী নির্যাতন ইত্যাকার অমানবিক ঘটনাবলীতে বিশ্ববিবেক শিউরে উঠেছিল।
শুধু মোজাম্বিকেই নয় এমন ধরনের ঔপনিবেশিক বর্বরতা তারা অ্যাঙ্গোলা ও গিনি-বিসাউতেও চালিয়েছে। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে তীব্র দমননীতির স্টিমরোলার চালিয়ে তাদের মানবিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে তীব্রভাবে প্রতিহত করেছে। ফলে জাগ্রত দেশগুলোর গণচেতনা পর্তুগালের প্রতি সমর্থন রাখতে পারেনি।
অধুনা বিশ্বে ন্যায় নীতির প্রশ্নে আজ নিরপেক্ষ জোট গড়ে উঠেছে, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে তাদের মানবিক দাবিসমূহ স্বীকৃতি পাবার আশ্বাসও পাচ্ছে। এখন তাই পর্তুগাল তার আভ্যন্তরীন ব্যাপারে যাই করুন আন্তর্জাতিক আস্থা ও বিশ্ব বিবেকের শ্রদ্ধা পেতে হলে তার ঔপনিবেশিক নীতির পরিবর্তন আবশ্যিক। বর্তমান বিশ্ব বিজ্ঞানের সৌজন্যে মানুষের বড় কাছে এসেছে। তাই একদিকে ধ্বংস নীতি সাম্রাজ্যবাদী শাসন নীতি অন্যদিকে প্রভাব বিস্তার করতে বাধ্য হয়। তেমনি একটি কল্যাণ দীপশিখা শত কল্যাণের মাঙ্গলিকীকে আলোকিত করার প্রয়াস পায়।
তাই পর্তুগালের বর্তমান সামরিক অভ্যুত্থান ও তাদের গণতান্ত্রিক পদক্ষেপ গ্রহণের সম্ভাবনা যদি বিশ্বমানবতার রানীকে অগ্রাধিকার দেয় তবে সার্বিক মঙ্গল আসতে পারে।
চা শ্রমিকদের সমস্যা
সরকার দেশের চা শিল্পে ঋণ চাহিদা মেটানোর জন্য বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের হাতে সাড়ে ৭ কোটি টাকা দিয়েছেন। বাণিজ্য ও বৈদেশিক বাণিজ্য মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ গত শুক্রবার সাত সদস্য বিশিষ্ট প্রতিনিধি দলের সাথে আলোচনাকালে এই তথ্য প্রকাশ করেন। প্রতিনিধি দলটি মন্ত্রীমহোদয়কে জানান দীর্ঘদিন ধরে চা-বাগান শ্রমিক স্বল্প হারে রেশন পাচ্ছে। তারা কাপড়ের অভাব সম্পর্কেও অবহিত করেন।
বাণিজ্যমন্ত্রী প্রতিনিধি দলের বক্তব্য শোনার পর জানান যে, চা বাগানের শ্রমিকদের চাহিদা মেটানোর জন্য প্রতি মাসে ৬০ হাজার মণ খাদ্য বরাদ্দ করা হয়েছে। এপ্রিল মাসের জন্য এই খাদ্য বরাদ্দের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তিনি আরও জানান যে, চা বাগানের শ্রমিকদের ন্যায্য মূল্য বিক্রয়ের জন্য ১ লক্ষ ২০ হাজার শাড়ি ২ লক্ষ ২০ হাজার লুঙ্গি এবং ১ লক্ষ ৩০ হাজার মার্কিন কাপড় বরাদ্দ করা হয়েছে। চা বাগান গুলির আর্থিক চাহিদা মেটানোর উদ্দেশ্যে ঋণ দানের জন্য কৃষি ও অন্যান্য ব্যাংকের প্রতি নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একথা নতুন করে উল্লেখ করার অপেক্ষা রাখে না যে, চা আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে থাকে। চা একদিকে যেমন দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটায় অন্যদিকে তেমনি বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে। অথচ স্বাধীনতার পর থেকে আমরা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নানান ধরনের অভিযোগ দেখেছি। চায়ের বাক্সের অভাব। চা বাগানে ঘাস ও আগাছা নির্মূল করার জন্য রাসায়নিক দ্রব্যের অভাব ইত্যাকার আরো কত কি। এরই মধ্যে চা শ্রমিকদের সমস্যা ও সংকট রয়েছেই।
গত ২৫শে এপ্রিল ‘বাংলার বাণী’র সম্পাদকীয় পৃষ্ঠায় চা শ্রমিকদের সমস্যা ও সংকট শীর্ষক চিঠিতে সিলেট জেলা চা বাগান শ্রমিক ইউনিয়ন সম্পাদক লিখেছেন যে, “অনাহারে অর্ধাহারে থাকাটাই হচ্ছে চা শ্রমিকদের কাছে স্বাভাবিক ঘটনা। অনাহারে মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে। দীর্ঘদিনের অনাহার জনিত কারণে কর্মস্থলে মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়াটা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। কাপড়ের অভাবে মেয়েরা কাজে যেতে পারছেনা। বস্তা পড়ে ঘরে থাকতে হচ্ছে। বাংলাদেশের পরিবর্তিত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অন্যান্য শ্রমিকদের মজুরি কিছু বাড়লেও শ্রমিকদের মজুরি পাকিস্তানি আমলে যা ছিল তাই রয়ে গেছে। পাকিস্তানি আমলে তিন শ্রেণীর বাগানে ১.৯৫ টাকা হতে ২.৩৫ টাকা দৈনিক মজুরি দেওয়া হয়েছে। অথচ সকল বাগানের কাজ সমান।”
চা শ্রমিকদের বর্তমান অবস্থাটা যে খুব সুবিধাজনক নয় আলোচ্য চিঠি তার প্রমাণ। তাছাড়া চা শ্রমিকদের সমস্যা ও সংকটের কথাটা কারো অজানা নয়। সুতরাং সার্বিক অবস্থার পরিবর্তন অবশ্যই প্রয়োজন। কেননা সমস্যা ও সংকটের মধ্যে থাকলে আর যাই হোক উৎপাদন বৃদ্ধি সম্ভব নয়। সরকার যে এ বিষয়ে অবহিত হয়ে সময়োচিত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন সেটা সুখের কথা। তবে এ প্রসঙ্গে আমরা বলব ঋণদান বা খাদ্য বস্ত্র বরাদ্দ করলেই সমস্যার সমাধান হবে বলে মনে হয় না। ঋণের অর্থ খাদ্য বস্ত্র যথাযথ স্থানে পৌঁছালো কিনা, ঋণের সদ্ব্যবহার হচ্ছে কিনা সেদিকে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে। কেননা বাংলাদেশ মধ্যস্বত্বভোগী টাউটের অভাব নেই। এরা দিনকে রাত রাতকে দিন করে দিতে পারে। পরিশেষে চা শ্রমিকদের মজুরির বিষয়টিও বর্তমান আর্থিক অভাব-অনটনের দিনে বিবেচনার অপেক্ষা রাখে।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক