মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের সূচনা
মিত্রবাহিনীর মাত্র দুদিনের আক্রমণে পাকিস্তানের বিমান ও নৌশক্তি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, স্থলবাহিনীও আত্মরক্ষার জন্য ক্রমাগত পিছু হটছিল। সিদ্দিক সালিক জানিয়েছেন, “কমান্ডারদের ইচ্ছাকৃত আশাবাদের পাশাপাশি একেবারেই উল্টো ছিল সৈনিকদের অবস্থা। তাদের প্রশিক্ষণ পর্যায়, সমর উপকরণ এবং নৈতিক মনােবল নিমস্তরের।… কয়েকমাস ধরে তারা কোনাে বিশ্রাম পায়নি। তাদের অনেকেরই বুট আছে কিন্তু মােজা বা শােয়ার চৌকি নেই। সবচেয়ে খারাপটি হলাে, অপারেশনে যাবার ব্যাপারে। তাদের অনেকেরই মনের দিক থেকে সায় ছিল না (নিয়াজির আত্মসমর্পণের দলিল, পৃ. ১২৭)। এ অবস্থায় নিয়াজির বা উচ্চপদস্থদের মনােবল যাতে ভেঙে না পড়ে বা তাদের বাড়তি উৎসাহ জোগানাের জন্য ৫ ডিসেম্বর থেকে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আবদুল হামিদ নিয়াজিকে চীনা হস্তক্ষেপের মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে আসছিলেন। কিন্তু ৭ ডিসেম্বর, নিয়াজির সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী দুর্গ যশাের, যেখানে চার ব্যাটালিয়ন সৈন্য মােতায়েন করা হয়েছিল, শত্রুবাহিনীর মুখােমুখি হওয়ার আগেই সেই সৈন্যরা বাঙ্কার ছেড়ে অন্তর্হিত হয়ে যায়। ফলে প্রায় বিনাযুদ্ধে দেশের পশ্চিমাঞ্চল মিত্রবাহিনীর করায়ত্তে চলে আসে, একই সময়ে সিলেট-মৌলভিবাজার থেকেও পাকবাহিনী পিছু হটতে থাকে। পাকিস্তান বাহিনীর ক্রমাগত পিছু হটা দেখে ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল মানেকশ মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ শুরু করে দেন, তিনি। পাকবাহিনীকে উদ্দেশ্য করে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানাতে থাকেন : “তােমাদের বাঁচার কোনাে পথ নেই। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী।
তােমাদের ঘিরে ফেলেছে। তােমরা যে নিষ্ঠুর আচরণ করেছ, এর প্রতিশোেধ নেবার জন্য তারা প্রস্তুত হচ্ছে। দেরি না করে তােমরা আত্মসমর্পণ করাে। তােমাদের যুদ্ধ করার ক্ষমতা ও যুদ্ধাস্ত্রের শক্তি অকেজো হয়ে গেছে, এমনকি বাইরে থেকেও সাহায্য পাওয়ার সম্ভাবনা তােমাদের নেই। অতএব তােমরা অস্ত্র ত্যাগ করাে। এ ছাড়া তােমাদের বাঁচার কোনাে পথ নেই। একমাত্র পথ হচ্ছে সম্মিলিত বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করা।” চারদিক থেকে পাকবাহিনীর পরাজয়ের খবর শুনে গভর্নর আবদুল মালেক কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। তিনি জেনারেল নিয়াজির অভিমত উদ্ধৃত করে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাছে এক দুর্গত বার্তা পাঠান। তাতে তিনি উল্লেখ করেন, যশােরের বিপর্যয়ের ফলে এদেশের পশ্চিমাঞ্চলের পতন প্রায় সম্পন্ন এবং মেঘনার পূর্বদিকের পতনও কেবল সময়ের প্রশ্ন; এই অবস্থায় আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে যদি প্রতিশ্রুত বৈদেশিক সামরিক সহায়তা না পৌছায়, তবে জীবনরক্ষার জন্য বরং ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে আলােচনা শুরু করা বাঞ্ছনীয় (মূলধারা ‘৭১, পৃ. ১৮৪)। একদিকে গভর্নর মালেকের কাছ থেকে দুর্গত বার্তা, অন্যদিকে জম্মু ও কাশ্মির অঞ্চলে প্রত্যাশিত সাফল্য না পাওয়া (যাকে ভারতের সাথে দরকষাকষির মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন ইয়াহিয়া), চীনের তরফ থেকে সক্রিয় সহায়তা না মেলা—এসব ঘটনায় হতাশ ইয়াহিয়া আবারাে শরণাপন্ন হন হােয়াইট হাউজের এবং সেখান থেকে বার্তা পান, পাকিস্তান যাতে পূর্বাঞ্চলের প্রতিরােধ ব্যবস্থা যে কোনাে মূল্যে আরাে ক’দিন টিকিয়ে রাখে। একথার মধ্য দিয়ে মার্কিন সহায়তার ইঙ্গিত স্পষ্ট হলাে বটে, কিন্তু পাকিস্তানকে সহায়তা করার পথে খােদ যুক্তরাষ্ট্রেই ভিন্ন মতের অন্ত ছিল না।
“কী মানবিকতার যুক্তিতে, কী জাতীয় স্বার্থের বিবেচনা থেকে, মার্কিন প্রশাসনের পাকিস্তান নীতি নিয়ে সেখানকার গণপ্রতিনিধি ও সংবাদমাধ্যমগুলির সমালােচনা তখন তুঙ্গে। মার্কিন সিনেটে এবং হাউজ অব রিপ্রেসেনটেটিভে ডেমোেক্র্যাট দলীয় কোনাে কোনাে সদস্য পাকিস্তানি জান্তার গণহত্যা, নির্যাতন ও মানবতাবিরােধী নীতির প্রতি মার্কিন প্রশাসনের সমর্থন এবং জাতিসংঘের বিলম্বিত ও একদেশদর্শী ভূমিকার তীব্র সমালােচনা করেন। ৭ ডিসেম্বর, এডওয়ার্ড কেনেডি সিনেট-অধিবেশনে বলেন, After 8 months of escalating violence and military repression-now the administration tells us—that we should condemn, not the repression of Pakistan army, but the response of India towards an increasingly desperate situation on its eastern borders— Our Government and the UN must come to understand that the actions of Pakistan army on the night of March 25 unleashed the forces in South Asia that have led to war. বস্তুত উপমহাদেশের ঘােরতর সংকটের জন্য ভারতকে এককভাবে দোষী করা, ভারতের উন্নয়ন বরাদ্দ বন্ধ করা, সামরিক-স্বৈরাচার ইয়াহিয়াকে দরাজ-সহায়তা দান—প্রভৃতি বিষয়ে মার্কিন সরকারের মানবিকতাবর্জিত ‘যুদ্ধংদেহী নীতির কঠোর সমালােচনা নিক্সন-কিসিঞ্জারকে কোণঠাসা করে রেখেছিল। তাদের এই অস্বস্তিকর অবস্থার কিছুটা উপশম ঘটে ৭ ডিসেম্বর রাতে (উপমহাদেশে তখন ৮ ডিসেম্বর), সাধারণ পরিষদে সদস্য রাষ্ট্রগুলাের ভােটদান পর্ব অনুষ্ঠিত হওয়ার পর (মূলধারা, ‘৭১)।
৭ ডিসেম্বর রাতে, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে—ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি, উভয়পক্ষের সৈন্য প্রত্যাহার, ভারতে আশ্রিত শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন প্রভৃতি বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভােটগ্রহণ পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। উপমহাদেশীয় এই জটিল বিষয়কে খুব তাড়াহুড়ার মধ্য দিয়ে ভােটাভুটিতে উপস্থাপন করা হয়, বিধায় অনেক দেশ বিষয়ের মর্মার্থ অনুধাবন না করেই তার ভােট প্রয়ােগ করে। ফলে ১০৪-১১, এই বিপুল ভােটাধিক্যে ‘যুদ্ধবিরতি বিষয়ক প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। সােভিয়েত ইউনিয়ন, পূর্ব ইউরােপের কয়েকটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র, ভারত এবং বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানকারী দ্বিতীয় দেশ ভুটান প্রস্তাবের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং অন্য আরাে আটটি দেশ ভােটদানে বিরত থাকে। সাধারণ পরিষদের ভােটাভুটিতে পাকভারতের যুদ্ধবিরতি বা সীমান্তের সৈন্য প্রত্যাহার প্রসঙ্গটি রুশ-ভারত অবস্থানের বিপক্ষে গেছে বটে, তবে এই রায় কার্যকর করার এখতিয়ার যেহেতু জাতিসংঘের নেই, তাই বিষয়টি নিয়ে মস্কো-দিল্লির খুব উদ্বিগ্ন হবার কারণ ছিল না। তবে এই ভােটের প্রেক্ষিতে পাকিস্তানের সাথে যুগলবন্দি হওয়ার জন্য একটা হালকা যুক্তি যুক্তরাষ্ট্রের অনুকূলে চলে যায়। কিন্তু এই যুক্তিকে অবলম্বন করে স্বদেশ ও বিদেশের প্রবল জনমতকে উপেক্ষা করে। যুদ্ধে জড়িয়ে পড়াহহায়াইট হাউজের জন্য সহজ ব্যাপার ছিল না।
ওইদিন প্যারিসের দৈনিক ‘লু মানি’তে মন্তব্য করা হয়, চীন ও আমেরিকা মিলে সােভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের বিরুদ্ধে দ্বৈতসঙ্গীত চালিয়ে যাচ্ছে। এক কোটি শরণার্থী এবং দেশে অবরুদ্ধ ও হিংস্রতার শিকার কয়েক কোটি মানুষের ভাগ্য সম্পর্কে চীন বরাবরই নির্বিকার ও উদাসীন। ‘ওয়াশিংটন পােস্ট’ পত্রিকায় যােশেফ ক্রাফ্ট মন্তব্য করেন, ভারত-পাক সংকট সম্পর্কে নিক্সন প্রশাসনের বৈশিষ্ট্য হলাে, নৈতিক অন্ধতা ও রাজনৈতিক বাস্তববুদ্ধির অনুপস্থিতির এক অদ্ভুত মিলন। নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় বলা হয়, আমেরিকার নির্লজ্জ পাক-সমর্থনের ফলে সারা পৃথিবীতে মার্কিন ইজ্জত অনেকাংশে নষ্ট হয়েছে। জাতিসংঘে নিযুক্ত সােভিয়েত প্রতিনিধি চীনকে উদ্দেশ্য করে বলেন, সােভিয়েত ইউনিয়ন পাকিস্তানের ব্যাপারে নাক গলাতে যাবে না। কিন্তু নিরাপত্তা পরিষদ বাস্তব অবস্থাকে উপেক্ষা করে চলবে, সেটাও আমরা চাই না। সিদ্দিক সালিকের ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ (পৃ. ১৯২) গ্রন্থ অনুযায়ী, ওইদিন সন্ধ্যায় গভর্নর মালিক একান্তে বসে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন। নিয়াজিকে, একজন জেনারেলের জীবনে ওঠানামা আছে। যশ এক সময় তাকে আচ্ছাদিত করে, আরেক সময় পরাজয় তার মর্যাদাকে ধূলিসাৎ করে।… মালেকের বক্তব্য শেষ হওয়ার আগেই জেনারেল নিয়াজি শিশুর মতাে অঝাের কান্নায় ভেঙে পড়লেন। [বি. দ্র. : বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দানকারী প্রথম দেশ কোনটি? কোনাে বইয়ে পাই ভারত, কোনাে বইয়ে পাই ভুটানের নাম। মূলধারা ‘৭১সহ অনেক বিখ্যাত বই-বিবেচনায় ভারতেরই পাল্লা ভারী, ভুটানের প্রতি বইয়ের সমর্থন কম থাকলেও অনেক মুক্তিযােদ্ধা বলেছেন, ‘বইয়ে যা-ই থাকুক, আমরা জানি ভুটানই বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটিকে প্রথম স্বীকৃতি দিয়েছে।’ রাজনীতির মাঠে মত ও পথ নিয়ে আমাদের মধ্যে বিভক্তির অন্ত নেই, কিন্তু বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানকারী প্রথম দেশের নাম নিয়ে তাে আমাদের মধ্যে বিভক্তি থাকার কথা নয়। তাহলে ভারত-ভুটান বিষয়ে বিতর্ক কবে হবে শেষ?]
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সত্য অসত্য অর্ধসত্য-বিনয় মিত্র