নভেম্বরের শুরুতেই পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছিল যে, পূর্ব বাংলায় তাদের যে সামরিক শক্তি মজুদ আছে, তা দিয়ে ভারতবাংলাদেশের যৌথশক্তিকে মােকাবিলা করা সম্ভব নয়; এ পরিস্থিতিতে তারা চীন-মার্কিনসহ আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ বা জাতিসংঘের মাধ্যমে ‘যুদ্ধবিরতির কার্যকর উদ্যোগ কামনা করে যাচ্ছিল। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশল ছিল, চীনকে প্রভাবিত করে যদি তাকে সিকিম সংলগ্ন চুম্বি উপত্যকার মধ্য দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের উত্তর সীমান্ত বরাবর ভারতীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে সংঘর্ষে লিপ্ত করানাে যায় এবং সে নিজে যদি সপ্তম নৌবহরের জাহাজবাহিত বিমানের সাহায্যে বঙ্গোপসাগরের উপকূল ভাগ থেকে ঢাকা ও চট্টগ্রামের উপর বিমান। আচ্ছাদন বিস্তার করে নৌসেনা অবতরণের (মূলধারা ‘৭১, পৃ-১৪৫) বন্দোবস্ত করতে পারে, তাহলে উপমহাদেশীয় পুরাে সামরিক পরিস্থিতিকে পাকিস্তানের অনুকূলে নিয়ে আসা সম্ভব হবে। ৩ নভেম্বর, বেঞ্জামিন ওয়েলার্ট–পাকিস্তানে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত, ১৯৫৯ সালে সম্পাদিত পাক-মার্কিন দ্বিপক্ষীয় চুক্তির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, ওই চুক্তির শর্তানুসারে, পাকিস্তান যদি বহিঃশত্রু দ্বারা আক্রান্ত হয়, তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজের অস্ত্র ও সৈন্যদল সহযােগে পাকিস্তানকে সাহায্য করার ব্যাপারে অঙ্গীকারবদ্ধ। ওয়েলার্ট ইচ্ছে করেই ওই চুক্তিটির ভুল ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, দৃশ্যত ভারতের মনে ভীতি সঞ্চার করাই ছিল তার মূল উদ্দেশ্য, যাতে দেশটি পাকিস্তান সংক্রান্ত সমস্যা থেকে হাত গুটিয়ে নেয়া শুরু করে।
ওই চুক্তির একটা ধারায় বলা হয়েছিল, পাকিস্তান যদি কোনাে কমিউনিস্ট দেশ দ্বারা আক্রান্ত হয়, তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার সার্বিক সহায়তাকল্পে এগিয়ে আসবে’, যেহেতু ভারত কোনাে কমিউনিস্ট দেশ নয়, কাজেই ১৯৫৯ সালে সম্পাদিত পাক-মার্কিন চুক্তি ভারতের জন্য প্রযােজ্য হওয়ার কথা নয়। তারপরও নয়াদিল্লিকে সতর্কতামূলক ভূমিকায় যেতে হয়েছিল, কারণ তার আশঙ্কা ছিল, ওই চুক্তির ফাঁক-ফোকড় ধরে যুক্তরাষ্ট্র যদি আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ নিয়েই নেয়—যার পূর্ব প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে ওয়েলার্টের সাম্প্রতিক বক্তব্য, তাহলে তা প্রতিরােধ করার জন্য সম্ভাব্য সকল উপায় আগে থেকেই স্থির করে রাখলে পরবর্তী পর্যায়ে কাজে লাগবে খুব। ইন্দিরা গান্ধীর যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে নিক্সন প্রশাসনের অভাবনীয় শীতলতা প্রদর্শন, একই সময়ে ভারতকে ওয়েলার্টের হুমকি প্রদান, চীনকে ভারতের বিরুদ্ধে দাঁড় করাবার পাক-মার্কিন জোটের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা, এসব বৈরী পরিবেশ থাকা সত্ত্বেও, ফ্রান্স সফরকালীন অনুকূল সাংবাদিক সম্মেলনে ইন্দিরা গান্ধীর কণ্ঠে প্রকাশ পেয়েছিল দীপ্ত প্রত্যয়, পূর্ব বাংলার একমাত্র সমাধান স্বাধীনতা, শীঘ্রই হােক আর দেরিতেই হােক, এ স্বাধীনতা আসবেই (ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউন, ৯ নভেম্বর, ৭১)। একই সময়ে বিশ্বের সচেতন রাজনৈতিক মহল (কেবল ভুট্টো-ইয়াহিয়া ও তাদের ইয়ার বন্ধুরা ছাড়া) এবং প্রভাবশালী পত্রিকাগুলোেও সিদ্ধান্তে পৌঁছে গিয়েছিল, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আসন্নপ্রায়। ৬ নভেম্বর, ‘স্যাটারডে রিভিউ ম্যাগাজিন’-এ চেস্টার বাওয়েলস দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেন, ‘Without massive economic and military assistance from United States, it is unlikely that West Pakistan can reassert its authority over East Pakistan. For better, or for worse, the die has been cast; East Pakistan will eventually win its independence.’
বিশ্বখ্যাত পত্রিকা গার্ডিয়ান ৯ নভেম্বরের সম্পাদকীয় মন্তব্যে লিখেছিল, The West Pakistani Generals, in sort, have come to the end of their path of bungling violence. They can battle and lose or talk and quit. They cannot hang on.’ শরণার্থী-সমস্যা দূরীকরণার্থে পূর্ব বাংলায় পাকিস্তান নামক অপশক্তিকে পরাভূত করা ছাড়া অন্য কোনাে পথ নেই—এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সে প্রেক্ষিতে যথাযথ সৈন্য সমাবেশের কাজ সম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও নয়াদিল্লি আক্রমণাত্মক ভূমিকা গ্রহণ করতে অনিচ্ছুক ছিল এজন্য যে, জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের অন্যতম সদস্য হিসেবে আগ বাড়িয়ে যুদ্ধ শুরু করে দুর্নাম কুড়ােতে চাইছিল না সে, তাছাড়া এর আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া নিয়েও তার শঙ্কা ছিল ঢের। নয়াদিল্লি খুব করে প্রত্যাশা করছিল প্রথম আক্রমণটা যেন ইয়াহিয়ার দিক থেকে আসে, যাতে সে বলতে পারে আক্রান্ত হয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছি।’ (এ ধরনের কৌশলের অংশ হিসেবে ১৩ নভেম্বর পশ্চিম বাংলার বয়রা এলাকা থেকে ট্যাঙ্কসহ দুই ব্যাটালিয়ন ভারতীয় সৈন্য পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত অতিক্রম করে যশাের জেলায় অবস্থান নিয়েছিল। ১৯ ও ২১ নভেম্বর, দুবার পাকিস্তান বাহিনী শত্রুসেনার ওপর আঘাত হেনেছিল। কিন্তু দুবারই শত্রু বিতাড়নে ব্যর্থ হয়ে নীরবে ফিরে এসেছিল তারা; নয়াদিল্লির ধারণা ছিল, এই অনুপ্রবেশের ফলে পাকিস্তান নিশ্চয়ই তেতে উঠবে, ক্রুদ্ধ হয়ে বড় কিছু করে বসবে, আর তখনই…)। নয়াদিল্লির সেই প্রতীক্ষানীতি’ কাজ দিল অবশেষে, ২৩ নভেম্বর ইয়াহিয়া খান সারা দেশে জরুরি অবস্থা ঘােষণা করেন এবং ওই দিনই তক্ষশীলায় এক অনুষ্ঠানে, চীনা মন্ত্রীর উপস্থিতিতে জানান দেন, আগামী দশদিনের মধ্যে তিনি হয়তাে রাওয়ালপিন্ডিতে থাকবেন , যুদ্ধক্ষেত্রে থাকবেন।
ঠিক একই দিন, মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এক বেতার ভাষণে জাতির উদ্দেশে বলেন, মুক্তিবাহিনী এখন যে কোনাে সময়ে, যে কোনাে জায়গায় শত্রুকে আঘাত করতে পারে; এমন কি শত্রুর নিরাপদ অবস্থানের কেন্দ্রে অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে তাকে বিমূঢ় করে দিতে পারে।… অশ্রু ও রক্তের বিনিময়ে যে স্বাধীনতার জন্য আমরা লড়ছি, সে স্বাধীনতা লাভের দিনটি নিকটতম হয়েছে। কিন্তু তার জন্য আরাে আত্মত্যাগ, কষ্ট স্বীকার ও জীবন দানের প্রয়ােজন আছে।… ইতিহাস মানুষকে অন্তত এই শিক্ষা দিয়েছে যে, জনসাধারণের ইচ্ছাশক্তির পরাজয় নেই—এমনকি এক বিশ্বশক্তির সমরসম্ভার দিয়েও জনগণের মুক্তি সংগ্রাম দমন করা যায় না। …বাংলাদেশের জনসাধারণের অবিসংবাদী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজও পাকিস্তানের সামরিকচক্রের হাতে বন্দি হয়ে রয়েছে। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, তাকে মুক্ত করার একমাত্র উপায় হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে হানাদার সৈন্যদের নিষ্ক্রমণের সকল পথ রুদ্ধ করে দেয়া। তা করার শক্তি আমাদের আছে এবং আমরা তা-ই করতে যাচ্ছি…।’
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সত্য অসত্য অর্ধসত্য-বিনয় মিত্র