You dont have javascript enabled! Please enable it! মার্কিনি গণতন্ত্র : প্রেসিডেন্ট যেখানে স্বৈরাচারের প্রতিমূর্তি - সংগ্রামের নোটবুক
মার্কিনি গণতন্ত্র : প্রেসিডেন্ট যেখানে স্বৈরাচারের প্রতিমূর্তি
পৃথিবীর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলাের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শীর্ষ পর্যায়ের একটি। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় জনমতের মূল্য অপরিসীম। রাষ্ট্রনায়ক, যিনি মাত্র ক’জন পারিষদ দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকেন, তিনি কখনাে কখনাে ভুল সিদ্ধান্তের অনুবর্তী হতে পারেন। তার পার্শ্ববর্তী সীমিত সংখ্যক পারিষদও ভুল করতে পারেন বা নেতাকে কুমন্ত্রণা দিয়ে ঠেলে দিতে পারেন ভুলের আবর্তে। পৃথিবীর ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, একদা যিনি ছিলেন মহান শাসক, ক্ষমতার উত্তাপ দম্ভ ও স্বেচ্ছাচার বা পারিষদের কুমন্ত্রণায় পড়ে পরবর্তীকালে তিনি হয়ে উঠেছেন ভয়ঙ্কর স্বৈরাচারী; মানবিক বােধসম্পন্ন একজন রাষ্ট্রনায়ক তাঁর পারিষদের প্রভাবে ক্রমান্বয়ে স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছেন—এমন উদাহরণের অভাব নেই ইতিহাসে। একজন ব্যক্তি, তিনি যতই জ্ঞানী-গুণী-ধীমান হােন না কেন, বা গুটিকয় ব্যক্তিসমষ্টি—তাঁদের প্রত্যেকে পণ্ডিত হলেও, ভুলের বৃত্ত থেকে সারা জীবন মুক্ত থাকা তার বা তাদের পক্ষে কখনাে সম্ভব নয়। তাই রাষ্ট্রনায়ক ভুল করতে পারেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতৃবৃন্দও ভুল পথের পথিক হতে পারেন, কিন্তু ওই রাষ্ট্রের লাখ লাখ বা কোটি কোটি জনগণ সম্মিলিতভাবে ভুল। করেন না, বা কোনাে ভুল পথ ধরে হাঁটেন না। তাই জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থায় জনমতকে অপরিসীম গুরুত্ব দেয়া হয়ে থাকে; রাষ্ট্রের সকল সিদ্ধান্ত অনুবর্তিত হয় জনমতকে কেন্দ্র করে, জনমতের প্রভাবে কত রাষ্ট্রের কত সিদ্ধান্ত যে পরিবর্তিত হয়ে গেছে, এর সঠিক সংখ্যা নিরূপণ করা কঠিন। 
‘সিয়াটো’ ও ‘সেন্টো’ চুক্তির বদৌলতে চুক্তিবদ্ধ দুটি দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তান—কোনাে দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে একে অন্যের পাশে গিয়ে দাঁড়াবে, ভালাে কথা, কিন্তু চুক্তিবদ্ধ কোনাে একটা দেশ যদি কোনাে জাতি বিনাশে উদ্যত হয়, নারী নির্যাতন কিংবা ধর্ষণের মতাে ন্যক্কারজনক ঘটনায় প্রমত্ত হয়ে ওঠে, তাহলে চুক্তির দোহাই দিয়ে ওই চরিত্রহীন, যুদ্ধবাজ, রক্তখেকোকে সমর্থন দিয়েই যেতে হবে, তা সভ্য-সুশিক্ষিত-মানবিক বােধসম্পন্ন কোনাে রাষ্ট্রনায়কের পক্ষে শােভা পায়? হত্যাকারী, ধর্ষণকারীদের প্রত্যক্ষ সমর্থন জানিয়ে, ওদের পক্ষ হয়ে যুদ্ধ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে, ১৯৭১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সন যে কলঙ্কময় অধ্যায়ের সৃষ্টি করেছেন, তা মানবইতিহাসে অদ্বিতীয় ও অমােচনীয় ন্যক্কারজনক উদাহরণ হিসেবে পরিগণিত হয়ে থাকবে। ভুট্টো-ইয়াহিয়ার মতাে ঘৃণ্য নরপশুদের সাথে সেদিন তথাকথিত সভ্য দেশের দুই রক্তখেকো নিক্সন-কিসিঞ্জার শুধু সহযােগীই হননি—বাঙালি হত্যা, নারীধর্ষণ-লুণ্ঠন ইত্যাদি কুকর্মের ব্যাপ্তি ঘটাবার জন্য শত্রুকে বন্ধু বানিয়ে চীনকেও একই কাজে প্রবৃত্ত করাতে আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছে। মার্কিন আহ্বানে সাড়া দিয়ে মাঠে নামার প্রস্তুতি নিয়েও, সােভিয়েত মুগুরের ভয়ে চীন শেষপর্যন্ত লেজ গুটিয়ে পলায়ন করেছে, কিন্তু আমেরিকা বর্বরােচিত এই গণহত্যাকাণ্ডের সমর্থনে সক্রিয় যুদ্ধে অংশ নেয়ারও পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। কিন্তু আলাে আর অন্ধকার যেমন পাশাপাশি থাকে, তেমনি দানব কখনাে মানববর্জিত হয়ে থাকতে পারে না। পাকিস্তান নামক দানবের দেশে মানব ছিলেন মাত্র কয়েক জন, যারা জ্বলন্ত উনুনের ওপর বসেও ইয়াহিয়া-ভুট্টো নির্দেশিত গণহত্যাকে নিন্দা জানিয়েছেন, বাঙালি জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছেন।
অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যে দেশটি দীর্ঘদিন সংগ্রাম করে স্বাধীনতা লাভ করেছে, সাহিত্য-সঙ্গীতসহ শিল্পকলার প্রতিটা শাখাতে যে দেশের আকাশছোঁয়া সাফল্য আছে, সেই সভ্য দেশে দানবের চেয়ে মানবের সংখ্যা যে বহুগুণ বেশি—এর উজ্জ্বল উদাহরণ দেখা যায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়। হ্যাঁ, সে দেশের নিক্সন, কিসিঞ্জার নামক দানবেরা আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরােধিতায় নেমেছিলেন বটে, বঙ্গোপসাগর অভিমুখে সপ্তম নৌবহর পাঠিয়ে আমাদের নিশ্চিহ্নও করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না যুদ্ধকালীন অবস্থায় যে ব্যক্তিটি আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে যেন আমাদেরই প্রতিনিধি হিসেবে পাকবর্বরতাকে ধিক্কার জানিয়েছেন, আমাদের আন্দোলনের যৌক্তিকতাকে বিশ্বব্যাপী তুলে ধরেছেন, শরণার্থীদের সহায়তা দানের জন্য আন্তর্জাতিক সমাজকে উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন, সেই মহাজন, রবার্ট কেনেডি—তিনি কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরই অধিবাসী। জর্জ হ্যারিসন, বব ডিলান, রিঙ্গে স্টোর—যাঁদের সঙ্গীতানুষ্ঠানের প্রেক্ষিতে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ বিশ্বব্যাপী সাড়া জাগিয়েছিল, তারাও কিন্তু নিক্সন-কিসিঞ্জারেরই জ্ঞাতি ভাই। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে আশ্রিত এক কোটি শরণার্থীর জন্য যে দেশের জনগণ সবচেয়ে বেশি আর্থিক সহায়তা দান করেছেন, সে দেশটির নামও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। পৃথিবীর অনেক দেশের সরকারের ভাষা, আর জনগণ ও গণমাধ্যমের  ভাষা এক ও অভিন্ন হতে দেখা যায়।
কোনাে কোনাে দেশে তাে জনগণ বা প্রচারমাধ্যমের নিজস্ব কোনাে ভাষাই থাকে না, সরকারের কথাই চূড়ান্ত কথা, সেটিই জনগণের ভাষা, গণমাধ্যমের ভাষা (যেমন বর্তমানের চীন কিংবা কিউবা, আরবীয় দেশসমূহ, পূর্বতন সােভিয়েত ইউনিয়নসহ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহ)। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, জনগণ ও গণমাধ্যমের ভাষা ও চিন্তা সরকার নিয়ন্ত্রণ করে না, ভাষিক চিন্তায় উভয়ই স্বাধীন, ফলে মাঝেমাঝেই ওই দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটতে দেখা যায়। কিন্তু ১৯৭১ সালে, বিরল ব্যতিক্রম হিসেবে মার্কিনি জনগণ ও গণমাধ্যম, ভাষা বা চিন্তাগত দিক থেকে সরকারের প্রবল প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছিল। সরকারের অবস্থান ছিল ইয়াহিয়া-ভুট্টো নামক দানবের পক্ষে, আর প্রচারমাধ্যম ও সাধারণ জনগণ ছিল অত্যাচারিত, নিষ্পেষিত বাঙালি জাতির পক্ষে, তথা আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের পক্ষে। তাছাড়া সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদের অগণিত সদস্য, বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের প্রায় পুরাে অংশ বাঙালির স্বাধীনতার দাবিকে অকুণ্ঠচিত্তে সমর্থন জ্ঞাপন করে  গেছেন। কোনাে একটা বিদেশি ইস্যুকে কেন্দ্র করে আমেরিকানদের মধ্যে এমন সুস্পষ্ট বিভক্তি—ইতঃপূর্বে আর দেখা যায়নি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের বেশ ক’জন সদস্য পাকিস্তানি বর্বরতার বিরুদ্ধে সক্রিয় অবস্থান নিয়েছিলেন। এ প্রেক্ষিতে তারা নিক্সন-কিসিঞ্জারের নেতিবাচক ভূমিকাকে কঠোর সমালােচনা করতে পিছপা হননি। ১৭ মে প্রতিনিধি পরিষদে উত্থাপিত এক প্রস্তাবে কংগ্রেসম্যান গ্রস পাকিস্তানকে সামরিক ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করা থেকে বিরত থাকার জন্য ওয়াশিংটন প্রশাসনকে আহ্বান জানিয়েছিলেন। প্রস্তাবটি প্রতিনিধি পরিষদে দু’দিনব্যাপী আলােচিত হওয়ার পর, এর উপর বিশেষজ্ঞের মতামত দেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থশাস্ত্রের খ্যাতিমান অধ্যাপক রবার্ট ডম্যান। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে শশাচনীয় অর্থনৈতিক বৈষম্যের। চিত্র তুলে ধরে ডম্যান বলেছিলেন, যেহেতু এই দু’ভূখণ্ডের মধ্যে। ভৌগােলিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ভাষিক—কোনাে ক্ষেত্রেই সামান্য ঐক্য। নেই, তাই আজ হােক, কাল হােক এই ভূখণ্ড দুটি আলাদা হয়ে যাবেই। প্রতিনিধি পরিষদের বৈদেশিক সম্পর্ক বিভাগের সাব-কমিটির আহ্বায়ক।
কর্নেলিয়াস ই গ্যালেজার কলকাতায় এসে, বেশ ক’টি শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করে দেশে ফিরে গিয়ে ১০ জুন প্রতিনিধি সভায় বলেন, পাকিস্তান যা করছে, সেটি সুপরিকল্পিত গণহত্যা। আর দুঃখজনক সত্য এই যে, মার্কিন সরকার ওই হত্যাকারীদের মদদ দিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে যেসব হত্যাকাণ্ড ও নারী নির্যাতন ঘটে চলেছে, এর দায় মার্কিন প্রশাসন কিছুতেই এড়িয়ে যেতে পারে না। বিষয়টা আমাদের জন্য চরম লজ্জার ও গ্লানির। পরিষদের অন্য একজন প্রভাবশালী সদস্য রায়ান, ২ আগস্টে প্রকাশিত ‘নিউজ উইক’ পত্রিকায় প্রকাশিত পাকিস্তানি বর্বরতার চিত্র উপস্থাপন করে বলেন, সরকার বলছে ২৫ মার্চের পর থেকে পাকিস্তানকে সামরিক সহায়তা দেয়া হচ্ছে না, কিন্তু এটা সরকারের অসত্য ভাষণ, পাকিস্তানের স্বৈরশাসকের জন্য মার্কিনি সহায়তা এখন পর্যন্ত অব্যাহত আছে এবং আমাদের সরকার যেন সচেতনভাবই বাঙালি গণহত্যা-দায়ের কিছু অংশ নিজের কাঁধে তুলে নিচ্ছে। ৩ ডিসেম্বর, পাকিস্তান কর্তৃক ভারত আক্রান্ত হওয়ার পর, সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রেক্ষিতে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট এ ঘটনার জন্য ভারতকে দোষারােপ করে একটা বিবৃতি দেয়, তখন কংগ্রেসম্যান রােজেনথল, হেলেকটস্কি, গ্যালেজার প্রমুখ নিক্সন সরকারের কঠোর সমালােচনা করে বলেন, এই চলমান সংকটের বীজ সামরিক একনায়ক ইয়াহিয়া কর্তৃক গৃহীত ‘গণহত্যা-প্রক্রিয়ার মধ্যে প্রােথিত, ইয়াহিয়া যদি ‘৭০-এর নির্বাচনে বিজয়ী দলকে রাষ্ট্র পরিচালনার সুযোেগ দিতেন, তাহলে পাকিস্তানে এমন ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হতাে না, এক কোটি মানুষ নিঃস্ব হয়ে শরণার্থী হিসেবে ভারতে আশ্রয় নেয়ার প্রয়ােজন পড়ত না। ভারত এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে বাধ্য হয়েই, কারণ স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা ছাড়া ওইসব শরণার্থীর ভার থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য ভারতের সামনে বিকল্প কোনাে পথ নেই। 
এডওয়ার্ড কেনেডি—আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে যার ভূমিকা অবিস্মরণীয় ইতিহাস হয়ে আছে, পাকিস্তানি সামরিক জান্তা কর্তৃক বাঙালি নিধনযজ্ঞ শুরু হওয়ার ক’দিন পরই, ১ এপ্রিল সিনেট সভায় দাঁড়িয়ে জোরালাে কণ্ঠে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক সরবরাহকৃত অস্ত্র দিয়ে যে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করার কথা, সেই অস্ত্র এখন বাঙালি-নিশ্চিহ্ন করার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের উচিত এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানানাে এবং পাক সামরিক সরকারকে এ ধরনের বর্বরােচিত কাজ বন্ধ করার জন্য চাপ প্রয়ােগ করা। পাকিস্তানকে সামরিক সহায়তা দেয়া হচ্ছে। ‘—মার্কিন সরকারের এমন মন্তব্যের জবাবে সিনেটর ফ্র্যাঙ্কচার্চ, সিনেটর হার্ট, সিমিংটন, স্যাক্সবি প্রমুখ সরকারের অসত্য ভাষ্যের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়েন; ফ্র্যাঙ্কচার্চ জাহাজভর্তি অস্ত্র চালানের ‘বিল অব লােডিং’-এর কপি সিনেট অধিবেশনে তুলে ধরে সরকারি মিথ্যাচারের মুখােশ উন্মােচন করে দেন। তাদের কেউ কেউ, যেমন ফুস্প্রাইট এমন অভিমতও দেন, গৃহযুদ্ধে লিপ্ত কোনাে পক্ষকে সাহায্য করার অর্থ হচ্ছে, অন্য পক্ষটির বিপক্ষে যুদ্ধরত হওয়ার শামিল। সিনেটর চ্যালেন ওই যুদ্ধে আমেরিকা যাতে জড়িয়ে না যায়, সরকারকে সেই পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘ওতে আমাদের অর্জনের কিছু নেই, ওতে জড়ালে বরং হারাবার ভীতি আছে।’ পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর মার্কিন সরকার ভারতকে আগ্রাসী শক্তি বলে মন্তব্য করে এবং সরাসরি পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নেয়। এ প্রেক্ষিতে সিনেট সভায় রবার্ট কেনেডি তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এ যুদ্ধটি গত সপ্তাহে বা গত মাসে শুরু হয়নি, শুরু হয়েছে ২৫ মার্চ, পাকবাহিনী কর্তৃক বাঙালি নিধনযজ্ঞ শুরু হওয়ার পর। গত ক’মাস যাবৎ পাকবাহিনী পূর্ব বাংলায় যে ভয়াবহ তাণ্ডবলীলা চালিয়েছে, এটা বােধহয় স্মরণকালের বর্বরতম নৃশংসতা।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আমেরিকার প্রেসিডেন্টসহ সরকারি মহল চুপচাপ থেকেছে, আজ আট মাস পর নিন্দা জানাতে চাইছে হত্যা-ধর্ষণকারী পাকিস্তানকে নয়, ভারতের বিরুদ্ধে—যে ভারত তার পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্ত বরাবর অসহনীয় অবস্থা দীর্ঘদিন ধরে পরম ধৈর্যসহ মােকাবিলা করে এসেছে। নির্বাচনে জয়লাভ করার পর যখন একজন বিপুল জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতাকে জেলে ঠেলে দিয়ে তথাকথিত বিচারের সম্মুখীন করা হয়, যখন লাখ লাখ মানুষকে নির্বিচারে খুন করা হয়, এক কোটি মানুষকে ঘরছাড়া করা হয়, তখন কোথায় ছিল আমেরিকা ও তার প্রেসিডেন্ট? আসলে বাংলাদেশ এখন একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য। একে না মেনে উপায় নেই, একে স্বীকৃতি জানানাের এখনই মােক্ষম সময়। (এর ক’মাস আগে শরণার্থী শিবির পরিদর্শন শেষে কেনেডি মন্তব্য করেছিলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় আমেরিকার ইমেজ হচ্ছে। সামরিক নির্যাতনকারীদের অস্ত্র গােলাবারুদ দিয়ে সহায়তার ইমেজ, আমেরিকার ইমেজ স্বৈরতন্ত্রের পাশে দাঁড়ানোের ইমেজ, আমেরিকার ইমেজ সামরিক জান্তা, যারা জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে পদদলিত করে, তাদের সেবা প্রদানের ইমেজ)। আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালে মার্কিন গণমাধ্যমগুলাে তাদের সরকারি ভাষায় কথা বলেনি, কথা বলেছে নিজের ভাষাতে এবং তাদের এই সত্যকথন, অনুসন্ধানী রিপাের্ট আমাদের স্বাধীনতার সপক্ষে বিশ্ব জনমত গঠনে কার্যকর।
ভূমিকা রেখেছে। নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পােস্ট, টাইম ম্যাগাজিন, নিউজ উইক প্রভৃতি বিশ্বখ্যাত পত্রিকা পাকবাহিনী কর্তৃক গণহত্যা, লুটপাট, ধর্ষণ, ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী শরণার্থীদের মানবেতর জীবনযাপন ইত্যাদির চিত্র ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরেছে এবং এ নারকীয় ঘটনার জন্য পাক সামরিকচক্রকে দায়ী করে নিজের সরকারকে আহ্বান জানিয়েছে, ওই নরপিশাচদের সামরিক, আর্থিক ও নৈতিক—কোনাে প্রকার সাহায্যই যেন। প্রদান করা না হয়।  ২৪ মে, টাইম ম্যাগাজিন লিখেছিল, ‘Since the crackdown on the breakaway state of Bangladesh began late in March, at least 2,00,000 have died-almost all of them Bangalis. In addition, more than 1,500,000 Bengalis have fled to India.’ ২ আগস্ট, নিউজ উইক ম্যাগাজিনে লেখা হয়েছিল, ‘Week before the Yahya-Mujib meeting actually took place the President and his right-hand man Lt. General Tikka khan were already mapping out plans for Mujib’s arrest, the dissolution of Awami League and the slaughter of Bengali nationalists.’ | মুক্তিযুদ্ধে গেরিলাবাহিনীর ভূমিকা সম্পর্কে ১৬ জুলাই নিউইয়র্ক টাইমস। মন্তব্য করেছিল, —as the still disorganised Bengali autonomy movement appears to be gaining momentum, the guerillas have been avoiding frontal battles but have inflicted a sizeable number of casualties একটা সভ্য, সুশিক্ষিত রাষ্ট্র, যেখানে জনমত ও গণমাধ্যমের মতামতকে বিশেষ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়, সেখানে, ১৯৭১ সালে নিক্সন প্রশাসন গণমতকে উপেক্ষা করে ভয়ঙ্কর যুদ্ধংদেহী মনােভাব বজায় রেখেছিলেন এবং এর অপমানজনক ফলও পেয়েছিল, ৭ম নৌবহরের লেজ গুটিয়ে প্রত্যাবর্তন এবং তার জানিদোস্ত ইয়াহিয়া-ভুট্টোর শােচনীয় যুদ্ধপরাজয় হজম করার মাধ্যমে।
 
একজন আর্থার কে ব্লাড এবং তাঁর দিব্যদৃষ্টি
 
ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্থার কে ব্লাড ‘৭১-এর মার্চ ও এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত, পূর্ব বাংলার সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে একটা সুচিন্তিত প্রতিবেদন পাঠিয়েছিলেন মার্কিন সিনেটে। জনাব ব্লাড দীর্ঘদিন ধরে ঢাকায় কর্মরত বিধায় পূর্ব-পশ্চিম পাকিস্তানের দ্বন্দ্বের স্বরূপ তিনি প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে বিশ্লেষণ করেছিলেন। কিন্তু তাঁর বক্তব্যে মার্কিন সরকার কর্তৃক গৃহীত ‘পাকিস্তান নীতির প্রতিফলন ঘটেনি, বরং কোথাও  কোথাও দুইয়ের মধ্যে তীব্র মতান্তর পরিদৃশ্যমান হওয়ায়, সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ প্রতিবেদন-প্রেরণ করা সত্ত্বেও বেচারা আর্থার কে ব্লাডকে এপ্রিলের শেষদিকে ঢাকা থেকে ওয়াশিংটনে সরিয়ে নেয়া হয় এবং মার্কিন সরকার বাস্তবতাকে পাশ কাটিয়ে ভুট্টো-ইয়াহিয়ার চোখ দিয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে প্রত্যক্ষ করতে থাকে। প্রশ্ন হলাে, সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন কর্মকর্তা, সংশ্লিষ্ট দায়িত্বেরই অংশ হিসেবে গােপনীয় প্রতিবেদন পাঠিয়েছিলেন সিনেটে, তিনি তা জনসমক্ষে প্রচার করে দেননি, তাতে কল্পিত কিছুও বলেননি, বরং গােয়েন্দাদের চেয়েও অধিক দক্ষতায় সত্যনিষ্ঠ সতর্কতামূলক কথা বলেছেন, তবু তাকে, অনেকটা শাস্তি হিসেবেই ওয়াশিংটনে ফিরিয়ে নেয়া হলাে কেন? আসলে তখন মার্কিন প্রশাসন, বিশেষত নিক্সন-কিসিঞ্জার এতটাই স্বৈরতান্ত্রিক ও ‘পাকিস্তান প্রেমিক হয়ে উঠেছিলেন যে, নিজেদের মতের বাইরে, বিশেষত পাকিস্তান প্রশ্নে কোনাে ভিন্ন মতকেই তারা আমলে নিচ্ছিলেন না। আর্থার ব্লাড লিখেছিলেন, “পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা এখন অপরিহার্য।
অখণ্ড পাকিস্তানের কাঠামাের ভেতরে অর্থনৈতিক স্বায়ত্তশাসনের জন্য যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, পূর্ব পাকিস্তানি জনসাধারণের ওপর সামগ্রিক লাঞ্ছনার জন্য শীঘ্রই তা পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপান্তরিত হবে—‘বাংলাদেশ’ এখন শুধু সময়ের ব্যাপার। এখানকার বর্তমান সংঘর্ষের পেছনে, অর্থনীতি ও রাজনীতির সঙ্গে, সংস্কৃতি, ভাষা ও সামাজিক চালিকাশক্তিগুলাের প্রশ্ন নিবিড়ভাবে জড়িত হয়ে রয়েছে। এই প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য অত্যন্ত সীমিত–পূর্ব পাকিস্তানি উম্মার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সূত্রসমূহের মূল্যায়ন এবং পাকিস্তানের অখণ্ডতা বজায় রাখার জন্য কী ধরনের আন্তর্জাতিক উদ্যোগ গ্রহণ করা যায় তার পরামর্শ দেয়াই এর লক্ষ্য।” (বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিদেশীদের ভূমিকা : সােহরাব হাসান সম্পাদিত, পৃ. ১৭)। এই রিপাের্টে আর্থার ব্লাড মনগড়া কথা বলেননি, পাকিস্তানের অখণ্ডতা। বজায় রাখার কথাই জোর দিয়ে বলেছেন, তবে তার অপরাধ বােধহয় এটাই যে, এই অখণ্ডতা বজায় রাখার জন্য তিনি কেবল যুক্তরাষ্ট্রেরই নয়, আন্তর্জাতিক উদ্যোগ কামনা করেছেন। অনুমান করতে পারি, ওই সময়ের পাকিস্তানের চিত্রটি ধরে যদি তিনি কেবল যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগ নেয়ার কথা বলতেন, তাহলে বেচারা ব্লাড—চাকরি সম্পর্কিত এমন বিড়ম্বনায় হয়তাে পড়তেন না।  ‘শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগের নীতিমালা গত নির্বাচনে জনগণের দ্বারা প্রবলভাবে সমর্থিত হয়েছে। এই ঘটনা অর্থনৈতিক নীতির ওপর প্রদেশের কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে হস্তান্তরিত ক্ষমতার সংশােধনকেই জোরদার করেছে, যার প্রতিক্রিয়া হিসেবে ইয়াহিয়া সরকার একটি আতঙ্কের রাজত্ব কায়েম করতে যাচ্ছে, এর পুরাে চেহারা ধীরে ধীরে সবার কাছেই উন্মােচিত হবে।
পাকসেনারা স্বাধীনতা শুধু পিছিয়ে দিতে পারে; হত্যাকাণ্ডের প্রাথমিক ও মানবিক চেতনা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েও মার্কিন স্বার্থ হাসিল হবে বরং বাংলাদেশের স্বাধীনতার গুরুত্ব দ্রুত উপলব্ধির মাধ্যমে।… পাকিস্তানি সরকারের কাছে সব মার্কিন অর্থনৈতিক সাহায্য এই মুহূর্তেই বন্ধ করে দেয়া উচিত। পাক সরকারের কাছে এখন কোনাে মার্কিন অস্ত্র বিক্রয় করা উচিত হবে না, কারণ সেগুলাে নিরীহ জনসাধারণের হত্যাকাণ্ডে ব্যবহার করা হবে’ (পূর্বোক্ত, পৃ. ২১)। আর্থার ব্লাডের এই বিশ্লেষণ দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এবং যথার্থ, কিন্তু বলদর্পী নিক্সন-কিসিঞ্জার হয়তাে ভেবেছেন, মার্কিন অর্থ ও অস্ত্রসাহায্য কোথায় যাবে বা না যাবে, এটা বলার তুমি কে হে? ইয়ার বন্ধু পাকিস্তান থেকে পূর্ব বাংলা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে, আর তুমি সেই বিচ্ছিন্নতাকে সমর্থন করতে বলছাে, একটা চুনােপুটি হয়ে আমেরিকার বৈদেশিক নীতি নিয়ে নাক গলাচ্ছাে—বড়ই স্পর্ধা তােমার, তােমাকে আর ঢাকায় রাখা যাবে না, ঘরের ছেলেকে ঘরে ফিরিয়ে আনব। | পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক, সামাজিকসহ বিভিন্ন ধরনের বৈষম্যের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ এবং ‘৭০-এর নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আওয়ামী লীগের আত্মপ্রকাশের পর ইয়াহিয়া কর্তৃক অনির্দিষ্টকালের জন্য পার্লামেন্ট স্থগিতকরণের ফলে বাঙালিদের আন্দোলনের কথা উল্লেখ করে আর্থার ব্লাড তার রিপাের্টে বলেন, ‘মিলিটারি বলপ্রয়ােগের মাধ্যমে এই উত্তেজনা দমন করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই ঘটনায় মৃতের সংখ্যা ১৭২ জন বলে সামরিক কর্তৃপক্ষ উল্লেখ করে। এই রক্তাক্ত হত্যাকাণ্ডের পরও আওয়ামী লীগ স্বাধীনতা ঘােষণা থেকে বিরত থাকে।
৭ মার্চের বিশাল জনসভায় তবু মুজিব অখণ্ড পাকিস্তানের কথা বলেন।… একটা শান্তিপূর্ণ। মীমাংসার কথা আওয়ামী লীগ বারবার ঘােষণা করা সত্ত্বেও ২৫ মার্চ বৃহস্পতিবারের রাত্রে নিরীহ-নিরস্ত্র জনসাধারণের ওপর অস্ত্রসজ্জিত পাকসেনাদের লেলিয়ে দেয়া হয়েছে।… পাকসেনারা বাঙালি জাতিকে দু’মাস, ছয়মাস বা এক বছর দমন করে রাখতে পারে কিন্তু একটি সমগ্র জনগােষ্ঠীকে বিচ্ছিন্ন সামরিক শক্তির সাহায্যে দমিয়ে রাখার সম্ভাবনার ব্যাপারে ভিয়েতনাম থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তিক্ত অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে’ (পূর্বোক্ত, পৃ. ২৬)। হায় আর্থার ব্লাড, পাকিস্তান-প্রেমিক ও যুদ্ধবাজ নিক্সন-কিসিঞ্জারকে পাকশাসকদের অবিমৃশ্যকারিতা সম্পর্কে কতকিছুই বললেন, এর উপর ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকার লজ্জাজনক পরাজয়ের কথাও স্মরণ করিয়ে দিলেন, প্রেসিডেন্ট ও তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু তথা জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টাকে উপদেশ দান, সাথে অতীতের একটা ক্ষতকে উদাহরণ হিসেবে টেনে আনা, এরপর তিনি স্বপদ ও স্বস্থানে বহাল থাকেন কী করে? ‘কিছুকালের মধ্যেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা অপরিহার্যরূপে জরুরি হয়ে পড়েছে। এখন প্রশ্ন হলাে, স্বাধীনতা অর্জিত হতে আর কত রক্ত বয়ে যাবে? রাজনৈতিকভাবে এটা পরিষ্কার যে যত সময়ই লাগুক স্বাধীনতা আসবেই।’ এপ্রিলের শেষার্ধেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিষয়ে ব্লাডের এই প্রত্যয়ী আশাবাদ—তাঁর দূরদৃষ্টিসম্পন্ন অভিজ্ঞানেরই পরিচায়ক। এরপর ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক বিষয়ে তাঁর বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ, বাংলার স্বাধীনতা মার্কিন স্বার্থের বিরুদ্ধে যাবে, যদি আমরা সংকীর্ণ নীতিতে পরিচালিত হয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে চীন বা সােভিয়েতের মতাে বৃহৎ শক্তির অস্ত্রের দিকে ঠেলে দেই। বিস্তৃতভাবে বলতে গেলে বলতে হয় যে, বাঙালিদের স্বাধীনতায় বিলম্ব ঘটালে মার্কিন ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হবে—যেমন এখন হচ্ছে। যে সময়ে পাকিস্তান তার নাগরিকদের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে, সে সময়ে পাকিস্তানিদের কাছে ১৯৭০ সালের অক্টোবরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রের আমন্ত্রণ, এর উদ্দেশ্য যা-ই হােক না কেন, খারাপ ছাড়া ভালাে ফল বয়ে আনবে না।
এই আমন্ত্রণ মার্কিন সরকারের অবিলম্বে প্রত্যাহার করা উচিত। এখন থেকে পাকিস্তানকে সমস্ত সামরিক-অর্থনৈতিক সাহায্যও বন্ধ করে দেয়া উচিত, যাতে প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে অস্ত্র সংগ্রহ করা না যায়, যে পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব বাংলা থেকে অস্ত্র প্রত্যাহার না করে এবং বাঙালিদের স্বাধীন জাতি হিসেবে স্বীকৃতি না দেয়।’ (পূর্বোক্ত, পৃ. ২৬-২৭)। বাঙালি জাতির ওপর পাক-সরকারের অত্যাচার, শােষণ-নির্যাতনের স্বরূপ, স্বাধীনতার দিকে বাঙালির ক্রমিক অগ্রযাত্রা এবং এ যাত্রার উপসংহার, এ ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিন্দনীয় ভূমিকা এবং এর ফলাফল সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী—প্রভৃতি বিষয়ে এপ্রিল মাসেই আর্থার ব্লাড যে অখণ্ডনীয় আগাম মতামত প্রদান করেছেন, তা যুদ্ধবাজ নিক্সন-কিসিঞ্জারকে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ থেকে নিবৃত্ত করতে না পারলেও, আমাদের একজন প্রকৃত শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে সত্যভাষী ও ভবিষ্যভ্রষ্টা আর্থার ব্লাডকে অবশ্যই আমাদের মনে রাখা উচিত।

সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সত্য অসত্য অর্ধসত্য-বিনয় মিত্র