You dont have javascript enabled! Please enable it! ভারতীয় বাহিনীর সমর পরিকল্পনা - সংগ্রামের নোটবুক
ভারতীয় বাহিনীর সমর পরিকল্পনা
ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ শুরু করেছিল ৩ ডিসেম্বর রাত থেকে, নিজে আক্রান্ত হওয়ার পরে। অবশ্য এর আগে (মূলত অক্টোবর) থেকেই ভারতীয় সৈন্যরা মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে একাকার হয়ে সীমান্ত সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিল, এমনকি বাংলাদেশের অভ্যন্তরেও তারা বারবার প্রবেশ করেছিল। যেমন ৫-১০ নভেম্বরে এক নম্বর সেক্টরে বেলােনিয়ায় অবস্থানরত দুটি পাকিস্তানি ব্যাটেলিয়নের বিরুদ্ধে নিয়মিত বাহিনীর অভিযানকে সফল করার জন্য এক ব্রিগেডেরও অধিক সংখ্যক ভারতীয় সৈন্য এই সংঘর্ষে অংশগ্রহণ করে। অক্টোবর থেকে সীমান্ত সংঘর্ষে অংশগ্রহণের পর এটাই ছিল ভারতীয় বাহিনীর সর্ববৃহৎ ইউনিট। ১১ নভেম্বর বেলােনিয়া ভূখণ্ড পাকিস্তানি দখলমুক্ত হয়’ (মূলধারা ‘৭১, পৃ. ১৫২)। এমন আরাে একটা ঘটনা ঘটে ২১ নভেম্বরে, ভারতীয় মেজর জেনারেল বি এন সরকার এসে ডি পি ধরকে অবহিত করেন, “চৌগাছার সংঘর্ষে পাকিস্তানি সীমানার বেশ খানিকটা ভিতরে তিনটি ভারতীয় ট্যাঙ্ক অচল হয়ে পড়েছে এবং পাকিস্তানের সিগন্যাল থেকে তারা জানতে পেরেছেন, বিদেশি সাংবাদিকদের অকুস্থলে আনার ব্যবস্থা চলেছে। সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে ভারতীয় গােলন্দাজ বাহিনী ঘটনাস্থল থেকে প্রতিপক্ষকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য কামান দেগে চলেছে; স্থায়ী ব্যবস্থা হলাে, হয় সেগুলাে টেনে আনা, যা কর্দমাক্ত ভূমি বলে এ যাবৎ সফল হয়নি; নতুবা এর বিকল্প হলাে বিস্ফোরক ব্যবহার করে অচল ট্যাঙ্কগুলাে টুকরাে টুকরাে করে ফেলা, যদিও তার চিহ্ন থেকে যাবে।…
ডি পি ধর প্রথম বিকল্পের পক্ষে যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত দেন, একান্তভাবেই সম্ভব না হলে দ্বিতীয় পথ অগত্যা” (মূলধারা ‘৭১, পৃ.১৬৭) অবলম্বন করতে বলেন। লে. জেনারেল জ্যাকব-এর ‘স্যারেন্ডার অ্যাট ঢাকা’ গ্রন্থ অনুযায়ী পূর্ব বাংলা থেকে আগত শরণার্থী-প্রবাহ রােধ করার জন্য ইন্দিরা গান্ধী নাকি এপ্রিল মাসের মধ্যেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করার জন্য শ্যাম। মানেকশকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। মানেকশ প্রধানমন্ত্রীকে বুঝিয়েছিলেন, সামনে বর্ষাকাল, এ সময়ে সেনা-চলাচলে যথেষ্ট সমস্যা হবে। সৈন্য মােতায়েন ও অন্যান্য প্রস্তুতি গ্রহণ করার জন্য বেশ কয়েক মাস সময়ের প্রয়ােজন। ভালাে হয় তাঁকে যদি ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত সময় দেয়া হয় এবং সেক্ষেত্রে তিনি সাফল্যের ব্যাপারে শতভাগ সুনিশ্চিত। এ প্রস্তাবে ইন্দিরার সম্মতি পাওয়ার পর মানেকশ জ্যাকবকে ফোন করে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে বলেন। এরপর থেকে অতি সংগােপনে ভারতের যুদ্ধপ্রস্তুতির প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে থাকে (একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ—স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়, পৃ. ৩৭০)। বাংলাদেশের সীমান্ত অঞ্চলে মুক্তিযােদ্ধাদের যাতায়াত সুগম করে তােলার জন্য জুলাই-এর প্রথম থেকে ভারতীয় গােলন্দাজ বাহিনী পাকিস্তানের সীমান্ত ঘাঁটিগুলাে ধ্বংস করতে প্রবৃত্ত হয়।
সীমান্ত-সুরক্ষার জন্য পর্যাপ্ত শক্তি ও রসদ পাকবাহিনীর হাতে না থাকায় জুলাইয়ের শেষ দিকে শতকরা পঞ্চাশ ভাগেরও বেশি সীমান্ত-ঘাঁটির পতন ঘটে, এর ফলে মুক্তিযােদ্ধারা প্রায় বিনা বাধায় দেশের অভ্যন্তরে ঢুকে শত্রুপক্ষকে আঘাত হানার সুযােগ পেতে থাকে। এ সময় পাকিস্তান সেনানায়কদের মনে সন্দেহ জাগে, মুক্তিযােদ্ধারা বােধহয় ভারতীয় সহায়তা নিয়ে সীমান্ত এলাকায় একাধিক মুক্তাঞ্চল গঠন করার চেষ্টা করছে। এই অনুমানের ভিত্তিতে তারা সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলাে দখলে নেয়ার জন্য বেশিরভাগ সৈন্যকে সেখানে প্রেরণ করে, ফলে দেশের মূল ভূখণ্ডের উপর তাদের নজরদারি অনেকটা কমে যায়। এই সুযােগে দেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযােদ্ধারা সফল গেরিলা হামলা পরিচালনা করতে থাকে। মুক্তিযােদ্ধা কর্তৃক সংঘটিত সারা দেশব্যাপী সফল গেরিলা আক্রমণ প্রতিহত করতে ব্যর্থ হওয়ায় উদ্বিগ্ন পাক সরকার নতুন ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে বৃহত্তর পরিসরে যুদ্ধ শুরু করার ইঙ্গিত দেন ভারতকে এবং দম্ভ সহকারে বলেন, আসন্ন যুদ্ধে পাকিস্তান একা থাকবে না। তার সাথে কে কে থাকবে, সে খবর ভারত বা মুজিবনগর সরকারের অজানা ছিল না। সেপ্টেম্বর-পূর্ববর্তী সময়ে বাংলাদেশ সংক্রান্ত ভারতীয় নীতি ও কর্মসূচি পরিকল্পনা ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পালন করতেন পি এন হাকসার। তার চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর, একজন কেবিনেট মন্ত্রীর পদমর্যাদা দিয়ে ওই পদে (পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পলিসি প্ল্যানিং কমিটির চেয়ারম্যান) নিয়ােগ দেয়া হয় ডি পি ধরকে। দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েই তিনি মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, অস্ত্রশস্ত্র প্রদান, যুদ্ধের তীব্রতা বৃদ্ধি ইত্যাদি বিষয়কে সুসমন্বিত রূপ দেয়ার প্রয়াস পান এবং মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক গ্রহণযােগ্যতা বাড়াবার জন্য বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নিয়ে জাতীয় মাের্চা’ গঠনের উদ্যোগ নেন। তাঁর এই উদ্যোগ অনেক আওয়ামী-নেতার দৃষ্টিতে ভারত সরকারের ‘চাপ’ ও ‘হস্তক্ষেপ’ বলে বিবেচিত হওয়ায় তিনি জাতীয় মাের্চা’ গঠনের উদ্যোগ থেকে সরে আসেন, তবে তাঁর প্রভাবের কারণেই বেশ ক’টি দলের সিনিয়র নেতৃবৃন্দ নিয়ে গঠন করা হলাে ‘জাতীয় উপদেষ্টা কমিটি। 
যুদ্ধবস্থার প্রচলিত ধারা অনুযায়ী প্রতিরক্ষায় নিয়ােজিত একজন সৈন্যের বিরুদ্ধে আক্রমণকারী সৈন্যসংখ্যা তিনগুণ থাকতে হয়। উদ্রুত অঞ্চলে পাকিস্তানের তিন/চার ডিভিশন সৈন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামার জন্য ভারতের প্রয়ােজন ছিল ১০/১২ ডিভিশন সৈন্য। কিন্তু এত সৈন্যের সমাবেশ ঘটানাে তাে দূরের কথা, বাংলাদেশ সীমান্তে মােতায়েন করার জন্য নয়াদিল্লির হাতে তখন ৬/৭ ডিভিশন সৈন্যও ছিল না। পশ্চিম সীমান্ত থেকে সৈন্য সরিয়ে আনার উপায় নেই, কারণ সম্ভাব্য পাকিস্তানি আক্রমণ ওই দিক দিয়েই হওয়ার আশঙ্কা বেশি। উত্তর সীমান্তজুড়ে আছে চীন, তাকে মােকাবিলা করার জন্য। সেদিকে বিপুল সৈন্য রাখতেই হবে। তবে ভারতের অন্যতম ভরসার নাম-মুক্তিবাহিনী, যারা খুব প্রশিক্ষিত না হলেও দেশপ্রেমের দুর্বার টানে আমৃত্যু যুদ্ধ করতে প্রস্তুত। তাছাড়া বাংলাদেশের কয়েক কোটি সাধারণ মানুষের সমর্থন তাে আছেই, তা-ই বা কম কীসে?
“ভারতীয় রণপরিকল্পনার মূল কাঠামাে ছিল এ রকম,
(ক) দক্ষিণে দুই সমুদ্রবন্দরের প্রবেশপথে নৌ অবরােধ সৃষ্টি করে পাকিস্তানের সমস্ত সরবরাহ বন্ধ করা এবং পাকিস্তানি সৈন্যদের পশ্চাৎপসারণের পথ বন্ধ করে তাদের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার আতঙ্ক সৃষ্টি করা;
(খ) বিমানবন্দর, বড় বড় সেতু, ফেরি সংযােগপথ ইত্যাদি দখল বা বিনষ্ট করে বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থানরত পাকিস্তানি সৈন্যদের একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা;
(গ) বিভিন্ন যােগাযােগকেন্দ্র দখল করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সম্পূর্ণ যােগাযােগবিহীন করে আরও টুকরাে টুকরাে এবং নিষ্ক্রিয় করে ফেলা; (ঘ) এই পন্থায় পাকিস্তানের অধিকাংশ সৈন্য পরাভূত করার পর ঢাকার উদ্দেশ্যে দ্রুত অভিযান শুরু করা (দি লিবারেশন অব বাংলাদেশ : মে. জেনারেল সুকওয়ান্ত সিং, পৃ. ৬৮-৬৯, মূলধারা ‘৭১, পৃ-১০৮)। এই রণনীতি প্রণয়ন করার আগে বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধাদেরকে মাথায় রেখে পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে, এরা। দেশের বিভিন্ন স্থানে পাকবাহিনীর ওপর অতর্কিত হামলা চালাবে, শত্রুর মনােবল ভেঙে দেবে, তাদের পরিশ্রান্ত করে তুলবে, এরপর ওদেরই সহায়তা নিয়ে ভারতীয় বাহিনী মূল আক্রমণের পথে এগিয়ে যাবে। এ পরিকল্পনারই অংশ হিসেবে সেপ্টেম্বর মাস থেকে মুক্তিযােদ্ধাদের সামরিক গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়, তাদের অস্ত্র সরবরাহের ক্ষেত্রে পূর্বেকার দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দূর হয়, প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহ দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং বাংলাদেশ সেক্টর কমান্ডারদের মাধ্যমে নতুন মুক্তিযােদ্ধাদের দেশে পাঠানাে শুরু হয়।’ (মূলধারা ৭১, পৃ. ১১০)। 
এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আশাতীত সাফল্যের স্বাক্ষর রাখেন মুক্তিযােদ্ধারা। জুন থেকে আগস্ট মাসের মধ্যে তাদের আক্রমণে রেল ও সড়ক পথের ব্রিজ এবং অন্যান্য যুদ্ধযানের প্রভূত ক্ষতি সাধিত হয়, সেপ্টেম্বরঅক্টোবরে পাকিস্তানি নৌ-চলাচলে বেশ কটি সফল হামলার পর দখলদার বাহিনীর জন্য খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়ােজনীয় সামগ্রী সরবরাহের কাজ কঠিন হয়ে পড়ে। ১১ অক্টোবর তেজগাঁও বিমানবন্দরে মর্টার আক্রমণ, ১৩ অক্টোবর  টঙ্গির সন্নিকটে রেলগাড়িসহ রেলব্রিজের ধ্বংসসাধন, বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি অফিসে একের পর এক বােমা বিস্ফোরণ, টহলদার বাহিনী বা খােদ ক্যাম্পের ওপরই অতর্কিত সফল আক্রমণ—এসবের ফলে পাকিস্তান সৈন্যদের মনে এই আশঙ্কা জাগিয়ে তােলা হয় যে, এখন তারা নিরাপদ নয় কোথাও, যখন-তখন, যেখানে-সেখানে তাদের ওপর গেরিলা হামলা করার শক্তি ও দক্ষতা অর্জন করেছে মুক্তিবাহিনী। সম্মুখ সমরে পাকবাহিনী যত দক্ষই হােক, ঝােপ-ঝাড়, নদীনালাবেষ্টিত বঙ্গীয় ভূখণ্ডে অতর্কিত গেরিলা হামলা মােকাবিলা করার পদ্ধতি জানা ছিল না তাদের। একদিকে বাংলাদেশ ও ভারতীয় বাহিনীর পরিকল্পিত আক্রমণে সীমান্তর্ঘাটির ক্রমিক পতন (অক্টোবরের শেষ নাগাদ ৩৭০টি ঘাঁটির মধ্যে অস্তিত্ব ধরে রেখেছিল মাত্র ৯০টি) অন্যদিকে দেশের অভ্যন্তরে প্রতিরােধহীন মুহুর্মুহু গেরিলা হামলা, দখলদার বাহিনীর মনােবল ও প্রত্যাঘাত করার শক্তি বহুলাংশে নিঃশেষ করে দিয়েছিল। 
অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যে ভারত তার পরিকল্পনা মােতাবেক সৈন্য সমাবেশের কাজটি সেরে নেয় এবং মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে সমন্বয় রেখে বাংলাদেশকে পাঁচটি সেক্টরে ভাগ করে। সেক্টরগুলাে হলাে :
১. উত্তর সেক্টর (ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, ঢাকা)সদর দপ্তর পশ্চিম বাংলার শিলিগুড়ি : অধিনায়ক মেজর জেনারেল গুরবক্স সিং গিল, মুক্তিবাহিনীর ১১-এর সেক্টর কমান্ডার স্কোয়াড্রন লিডার হামিদুল্লাহ খান। এবং (এই সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন কর্নেল তাহের, কামালপুরের যুদ্ধে তাহের আহত হওয়ার পর হামিদুল্লাহকে এখানে নিয়ােগ দেয়া হয়), টাঙ্গাইলের কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন বাহিনী। উত্তর-পশ্চিম সেক্টর (রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, পাবনা, রাজশাহী)-সদর দপ্তর শিলিগুড়ি : অধিনায়ক লে. জেনারেল এম এল থাপান, মুক্তি বাহিনীর ৬ ও ৭ নম্বর সেক্টরের কমান্ডারগণ ও তাদের নেতৃত্বাধীন বাহিনী।
৩. পশ্চিম সেক্টর (কুষ্টিয়া, যশাের, ফরিদপুর, খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী)সদর দপ্তর কৃষ্ণনগর : অধিনায়ক লে. জেনারেল টি এন রায়না, মুক্তিবাহিনীর ৮ ও ৯নং সেক্টরের কমান্ডারগণ ও তাদের নেতৃত্বাধীন বাহিনী।
৪. পূর্ব সেক্টর (সিলেট, কুমিল্লা, নােয়াখালী, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম)-সদর দপ্তর আগরতলা : অধিনায়ক লে. জেনারেল সগত সিং, মুক্তিবাহিনীর ১, ২, ৩, ৪, ৫নং সেক্টরের কমান্ডারগণ ও তাদের নেতৃত্বাধীন বাহিনী।
৫. পূর্বাঞ্চল সদর, গৌহাটি : অধিনায়ক মেজর জেনারেল জি এম গিল, তিনি যুদ্ধে আহত হওয়ার পর মেজর জেনারেল নাগরা।
এই সমর পরিকল্পনা বা পরিচালনা করার ক্ষেত্রে ভারতীয় বাহিনী যেসব সুবিধা ভােগ করেছে, এর অন্যতম ক’টি হলাে :
১. পাকিস্তান বাহিনী যুদ্ধ করছে নিজের দেশ থেকে বারােশাে মাইল দূরবর্তী অঞ্চলে, যেখানকার প্রকৃতি ও পরিবেশ, যুদ্ধাঞ্চলের আপামর মানুষ—কোনােটাই তাদের অনুকূলে নেই। মুক্তিবাহিনীর সাথে লড়তে লড়তে পাকিস্তানি সেনারা ক্লান্ত, অবসন্ন; শক্তিশালী নতুন কোনাে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াই করার মানসিকতা ওদের নিঃশেষ হয়ে গেছে প্রায়। ভারত যদি বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানের নৌ ও বিমান যােগাযােগ বন্ধ করে দেয়, তাহলে পাকিস্তানিরা খাদ্য, যুদ্ধ-রসদসহ অতিপ্রয়ােজনীয় উপাদানের অভাবে দুর্বল হয়ে যাবে। কমাস ধরে হত্যা, লুণ্ঠন, নারী-নির্যাতন ইত্যাকার গর্হিত কাজে লিপ্ত হয়ে ইতােমধ্যে পাকসেনারা যুদ্ধ করার মতাে নৈতিক মনােবল হারিয়ে ফেলেছে। নতুন যুদ্ধে ভারতীয় সৈন্যদের সাথে যুক্ত হবে বাংলাদেশেরই হাজার হাজার নিয়মিত সৈন্য, স্বল্পকালীন ট্রেনিং গ্রহণকারী লক্ষাধিক মুক্তিবাহিনী, যারা দেশপ্রেম’ নামক শানিত অস্ত্রে অমিত বলীয়ান, আর আছে দেশের অভ্যন্তরস্থ কোটি কোটি জনতা, যাদের অস্ত্রপ্রশিক্ষণ না থাকলেও চিন্তায় ও মননে প্রত্যেকেই একেক জন মুক্তিযােদ্ধা। এসব অনুষঙ্গ, যার প্রতিটিই পাকিস্তান বাহিনীর চরম প্রতিকূলে বিধায়, এগুলাে ভারতীয় বাহিনীর জন্য পরম আশীর্বাদ বয়ে এনেছিল। 
[বি. দ্র. : বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর যুদ্ধসংশ্লিষ্ট অধিকাংশ ভারতীয় জেনারেল তাঁদের লেখা বই কিংবা গণমাধ্যমের সাথে সাক্ষাৎকারে মুক্তিবাহিনীর অবদানকে খাটো করে কেবল নিজেদের বীরত্বের বর্ণনা করে গেছেন। কেউ কেউ অবশ্য মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশংসাও করেছেন, তবে তা করেছেন ভাসা ভাসা বাক্যে। বাস্তবিক পক্ষে মুক্তিযোেদ্ধরা যদি কয়েক মাসব্যাপী গেরিলা হামলার মাধ্যমে পাক বাহিনীকে পরিশ্রান্ত ও ভয়ার্ত না করে তুলত, যদি ভারতীয় বাহিনীর আক্রমণ বা চলাচলের ক্ষেত্রে প্রয়ােজনীয় তথ্যাদি পরিবেশন না করত, তাহলে মাত্র দু’সপ্তাহের সক্রিয় যুদ্ধে পাকবাহিনীকে পরাভূত করা ভারতীয় বাহিনীর পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হতাে । আমাদের দেশেও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বই—যেগুলাে কোনাে সেনানায়ক বা যুদ্ধসংশ্লিষ্ট কোনাে ব্যক্তি দ্বারা প্রণীত, তাতে আত্মকথন ও আত্মপ্রশংসা এত বেশি যে, অনেকক্ষেত্রে সেগুলাে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সর্বজনীন ইতিহাস না হয়ে, হয়ে উঠেছে লেখককেন্দ্রিক খণ্ডিত ইতিহাস।

সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সত্য অসত্য অর্ধসত্য-বিনয় মিত্র