ওদের অপরাধ ওরা হিন্দু
যুদ্ধের সময় কোনাে একটা নির্দিষ্ট ধর্মাবলম্বীকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার ভয়াবহ প্রবণতা—যুদ্ধ-ইতিহাসে বারবার ঘটছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান নাৎসি বাহিনী ‘ইহুদি নিধনযজ্ঞে প্রমত্ত-পিশাচ হয়ে উঠেছিল। অনুরূপ হিংস্র ধর্মীয়-বিদ্বেষ দেখতে পাই ‘৭১ সালে; তখন পাকিস্তান বাহিনী বেপরােয়া হয়ে হিন্দু ধর্মানুসারীদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দেবার পরিকল্পনা করেছিল। পাক শাসক এবং তাদের অনুগত সেনাবাহিনী অন্ধভাবে বিশ্বাস করত যে, হিন্দু মাত্রই ভারতের দালাল এবং কাফের। এরা স্বধর্মচ্যুত আওয়ামী-নেতাদের প্রভাবিত করে পাকিস্তানের অখণ্ডতা বিনাশের জন্য ষড়যন্ত্র করছে এবং সে উদ্দেশ্যে হাত মিলিয়েছে পাকিস্তানের চির দুশমন ভারতের সাথে। তারা স্থির বিশ্বাসে উপনীত হয়েছিল, বাঙালির তথাকথিত স্বাধীনতা আন্দোলনকে দমন করতে হলে পূর্ব পাকিস্তানকে প্রথমে হিন্দুশূন্য করতে হবে, তারপর শায়েস্তা করতে হবে অহিন্দু আওয়ামী লীগার আর নাস্তিক্যবাদী কমিউনিস্টদেরকে। ফলে, ২৫ মার্চ কালােরাত থেকে নিদারুণভাবে হিন্দু নিধন শুরু হলাে, ওদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হতে লাগল, ওই সম্প্রদায়ভুক্ত কিশােরী-তরুণী-যুবতীদের ‘গণিমতের মাল গণ্য করে ভােগ্যপণ্য হিসেবে ব্যবহার করা শুরু হলাে। যুদ্ধকালীন নারী নির্যাতন সম্পর্কে ব্যাপক গবেষণা করে এম এ হাসান জানিয়েছেন, ওই সময়ে প্রায় সাড়ে চার লাখ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।
এদের মধ্যে ধর্ষিতা হয়েও দু’লাখ দু’হাজার পাঁচশ সাতান্ন জন দেশে থাকতে বাধ্য হয়েছেন, আর এক লাখ একত্রিশ হাজার দুশাে পঞ্চাশ জন ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর শরণার্থী হয়ে চলে গিয়েছিলেন ভারতে। ধর্ষিতাদের মধ্যে তিন ভাগের দু’ভাগ বিবাহিতা, বাকি এক ভাগ কুমারী। তখন পূর্ব বাংলার অধিবাসীদের মধ্যে হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছিলেন শতকরা দশভাগের কিছু বেশি। কিন্তু মােট ধর্ষিতাদের মধ্যে ৪২ ভাগই ছিলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী। এই হিন্দু নারীদের মধ্যে ৪৪ ভাগ ছিলেন কুমারী। অর্থাৎ হিন্দু নারী, বিশেষত কুমারীরাই বেশি পরিমাণে বর্বর পাকবাহিনীর ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন (যুদ্ধ ও নারী, পৃ. ৭৮-২১৩)। অধিকাংশ ধর্ষণ প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত থাকত কুলাঙ্গার রাজাকার, আলবদর বাহিনী। তারা পাকবাহিনীকে যুবতী নারীদের সন্ধান জানাত বা নিজেরাই যুবতীদের ধরে নিয়ে তুলে দিত পাকবাহিনীর হাতে। ধর্ষণ শেষে পাকবাহিনী অনেকের যােনিপথ কেটে দিয়ে হত্যা করত, কারাে স্তন কেটে দিয়ে উল্লাসে মেতে উঠত, কাউকে বিবস্ত্র অবস্থায় রাস্তায় ফেলে দিত। শহর এলাকায় বেশিরভাগ ধর্ষণই ঘটেছে পাকসেনাদের দ্বারা, আর গ্রাম পর্যায়ে এ কুকর্মে রাজাকার বাহিনীর সংশ্লিষ্টতা ছিল বেশি। [বি. দ্র. : যুদ্ধ মানেই নৃশংসতা, পৈশাচিকতা, লুঠতরাজ, গণহত্যা। যুদ্ধ। মানেই বিবেকনাশা বিভীষিকা। কিন্তু একাত্তর সালে পাকসেনাদের কাছে যুদ্ধের মানে ছিল স্পষ্টত দুটি—খুন এবং ধর্ষণ। তখন তারা যেন পণ করেই মাঠে নেমেছিল, কিশােরী-তরুণী-যুবতীদের নির্বিচারে ধর্ষণ করাে, আর অন্যদের খুন করাে। খুনের সংখ্যাগত দিকটি বিচার করলে এর চেয়ে বড় ধ্বংসযজ্ঞের উদাহরণ পাই ইতিহাসে, কিন্তু নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের ক্ষেত্রে মাত্র নয় মাসে পাকিস্তানিরা যে ভয়াবহ বর্বরতা দেখিয়েছে, যুদ্ধের ইতিহাসে এমন ন্যক্কারজনক, পাশবিক উদাহরণ আর একটিও নেই। বলা হয়ে থাকে, কোন জাতি কতটা সভ্য তা জানতে হলে, ওই জাতি নারীদের প্রতি কতটুকু সম্মান দেখায়, তা জানতে হবে আগে। জিন্নাহসৃষ্ট পাকপবিত্র পাকিস্তান রাষ্ট্রটির সভ্যতা-ভব্যতার সার্বিক চিত্রটি জানতে হলে আমাদের তাকাতে হবে একাত্তরের ইতিহাসের দিকে।
একাত্তরে নারী নির্যাতনের ওপর ব্যাপক গবেষণাকারী এম এ হাসানের ‘যুদ্ধ ও নারী’ গ্রন্থে প্রদত্ত তথ্যমতে, ওই নয় মাসে ধর্ষিতা হয়েছিলেন সাড়ে চার লাখ নারী (বিভিন্ন বই-পুস্তকে এ সংখ্যাটা দেখি দুই লাখ, এটা নিশ্চয়ই আনুমানিক সংখ্যা, তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে গবেষণালব্ধ সংখ্যা নয়)। হাসানের হিসাব ধরে, যদি অন্য আর একটা হিসাব করি, তাহলে দেখতে পাই বীভৎস চিত্র, মুক্তিযুদ্ধকালীন গড়ে প্রতিদিন ধর্ষিতা হয়েছেন (৪৫০০০০/৩৬৫ দিন) = ১৬৯৮.১১ জন নারী। আমরা সব সময়ই বলি বা লিখি, ত্রিশ লাখ প্রাণ আর দুই লাখ (?) মা-বােনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা। কী মারাত্মক ভুল কথা বলি আমরা? ইজ্জতের বিনিময়ে স্বাধীনতা, সেটা কেমনতর কথা? ইজ্জত কি বিনিময়যােগ্য প্রপঞ্চ? প্রাণ দান করা যায়, দেশের জন্য হাসতে হাসতে প্রাণ দেন বা দিয়েছেন অনেকেই। কিন্তু হাসতে হাসতে, স্বতঃস্ফূর্তচিত্তে কোনাে নারী অমানুষকে, দানবকে কি ইজ্জত দান করেন? এসব ধর্ষিতা নারী সানন্দে ইজ্জত বিনিময় করে স্বাধীনতা আনতে চেয়েছিলেন? তাহলে? আমাদের ওই -বােনের ইজ্জতের বিনিময়ে স্বাধীনতা আনেননি, তারা স্বাধীনতা আনতে চেয়েছেন অবশ্যই, তবে তা নিজের ইজ্জত বিলীন করে দিয়ে নয়। যুদ্ধের নয় মাস আমাদের মা-বােনের ইজ্জত হরণ করা হয়েছে, পাশবিক প্রক্রিয়ায়, পৈশাচিক হিংস্রতায়।
সেদিন আমরা আমাদের মা-বােনের ইজ্জত রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছি, আর সেই ব্যর্থতাকে আড়াল করার জন্য স্বাধীনতার সাথে ইজ্জতের বিনিময় তত্ত্ব জুড়ে দিয়েছি; এই ইজ্জতহরণ আমাদের মা-বােনদের কী দুঃসহ যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, এর প্রমাণ পাই ২৯ আগস্ট ‘৭১ তিউনেশিয়ার ‘লা প্রিসসি পত্রিকায় প্রকাশিত বৈনাশিক ক্লেশ’ শিরােনামযুক্ত খবরে : “চার মাস আটক রাখার পর পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যরা তিনশাে বাঙালি যুবতীকে মুক্তি দিয়েছে। তারা আত্মনাশী হতে পারে।… আত্মহননকামী তিনশাে যুবতীকে চার মাস ধরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পাঠান, পাঞ্জাবি ও বেলুচ সৈন্যরাসহ পশ্চিম পাকিস্তানি বিভিন্ন ইউনিটের লােকজন পালাক্রমে ধর্ষণ করে। সকলেই অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লে পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসার এদেরকে ব্যবহারের অযােগ্য বলে মনে করে। আর এ কারণেই তারা মুক্তি পায় (বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ. ৭৩-৭৪)। আরাে শােচনীয় একটি প্রতিবেদন ছেপেছিল যুক্তরাষ্ট্রের ‘টাইম ম্যাগাজিন, ২৫ অক্টোবর, ‘৭১ তারিখে, শিরােনাম ছিল হৃদয়স্পর্শী, পূর্ব পাকিস্তান : এমন কী আকাশও কাঁদে’, ‘৫৬৩ জন বাঙালি যুবতীকে পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন সেনাক্যাম্প থেকে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। এরা সবাই তিন থেকে পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা; সেনা কর্তৃপক্ষ ওদের গর্ভপাত করাতে চেয়েছিল। কিন্তু তা করতে যথেষ্ট দেরি হয়ে গেছে। এখন ওরা ব্যবহারের অযােগ্য হয়ে পড়ায় সামরিক কর্তৃপক্ষ ওদেরকে ছেড়ে দিচ্ছে। ওদের গর্ভে রয়েছে পাকিস্তান সৈন্যের সন্তান’ (বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ. ৭৫)]
সে সময় পূর্ববাংলার তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি হিন্দুধর্মাবলম্বী প্রাণভয়ে আশ্রয় নিয়েছিল ভারতে। যারা ভারতে যেতে পারেননি, এদের বেশিরভাগ হয় পাকবাহিনী বা রাজাকার-শান্তি কমিটির হাতে নিহত হয়েছেন, নতুবা প্রাণ রক্ষার্থে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছেন। প্রখ্যাত লেখক যতীন সরকার, ওই সময়ে তার স্ত্রী, শ্যালক, শ্বশুর প্রমুখের ধর্মান্তরিত হওয়া প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘ফুলবাড়িয়ায় গ্রামের বাড়িতে রাজাকারদের অত্যাচারে ও পাক সেনাদের দৌরাত্মে টিকতে না পেরে তারা ময়মনসিংহ শহরে চলে এসেছে। এবং এখানে এসে আমার স্ত্রীসহ পরিবারের সকলে মিলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে।… মুসলমান হওয়ার ফলে ময়মনসিংহ শহরে তারা নিরাপদে থাকতে পারবে।… সে সময়ে ময়মনসিংহ শহরে অবস্থানরত প্রায় সকল হিন্দুই ধর্মান্তর গ্রহণ করেছিলেন। বাংলাদেশের আরাে অনেক স্থানেই এ রকমটি ঘটেছিল। কিন্তু কাগজপত্রে সে সবের বিবরণ খুব কমই ধরে রাখা হয়েছে’ (পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু-দর্শন, পৃ. ৪২৫-৪২৭)। অন্য আরেকজন বিশিষ্ট লেখক, স্বরােচিষ সরকার, একাত্তরের বাগেরহাট’ গ্রন্থে জানিয়েছেন, বাগেরহাট জেলায় এ রকমের প্রচুর ধর্মান্তর হয়েছিল। এই ধর্মান্তরিত হিন্দুদের গরুর মাংস খাইয়ে তাদের মুসলমানত্বকে পাকা করা হতাে। মরে গেলে পােড়ানাের বদলে তাদের কবর দেয়া হতাে। হিন্দু-নির্যাতনের সনিষ্ঠ বর্ণনা পাই, সে সময়ে ঢাকায় কর্মরত, ফাদার আরডব্লিউ টিম-এর লেখায়, “পাক সেনাবাহিনী যখন গ্রামগুলােতে নির্বিচারে আক্রমণ চালায়, তখন তাদের সম্পূর্ণ আক্রোশ গিয়ে পড়ে হিন্দু তথা কাফের (অবিশ্বাসী)-দের ওপর।…
আমি ক্যাথলিক ত্রাণ সার্ভিসের ত্রাণ কর্মসূচির ফিল্ড কো-অর্ডিনেটর হিসেবে টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহ জেলা সফর করে এসেছি। আমি দেখলাম, হিন্দু গ্রামগুলাে লুট করা হয়েছে, তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে, শতাব্দীপ্রাচীন হিন্দু মন্দির মারাত্মকভাবে ধ্বংস করা হয়েছে এবং যেসব হিন্দু মুসলমান হতে রাজি হয়নি, তাদের ওপর নির্যাতনের ভয়াবহ ঘটনার কথাও শুনলাম। পাকিস্তানের সর্বোচ্চ খেতাবপ্রাপ্ত (তমঘা-ই-খিদমত) এবং টাঙ্গাইল জেলায় তিনবার শ্রেষ্ঠ ইউনিয়ন কাউন্সিল চেয়ারম্যান হিসেবে মনােনীত মধুপুরের একজন হিন্দুকে (অমূল্য বাবু) শেষ করার জন্য কালাে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।… তিনি মুসলিম লীগের প্রতি অনুগত হলেও, তাঁর একমাত্র ‘অপরাধ তিনি হিন্দু (বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিদেশীদের ভূমিকা, পৃ. ১১১, ১১৬)। বিশ্বখ্যাত সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের লেখায় পাই, হিন্দুদের হত্যালীলার যৌক্তিকতা সম্পর্কে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক গভর্নর লে, জেনারেল টিক্কা খান ১৮ এপ্রিল এক বেতার ভাষণে বলেছেন, পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানেরা, যারা পাকিস্তানের অভ্যুত্থানে নেতৃত্বস্থানীয় ভূমিকা। পালন করছিল, তাদের বাঁচিয়ে রাখার ব্যাপারে আমরা দৃঢ় নিশ্চিত। হিংস্র ও আগ্রাসী সংখ্যালঘুরা জীবন ও ধনসম্পদ ধ্বংস করার হুমকি দিয়ে বিপুল। সংখ্যাগরিষ্ঠদের দমন করেছে, বল প্রয়ােগ দ্বারা আওয়ামী লীগকে বাধ্য। করেছে হিংসাত্মক নীতি গ্রহণ করতে।’ পাকিস্তান সেনাদের হিন্দুবিদ্বেষের উদাহরণ প্রসঙ্গে মাসকারেনহাস লিখেছেন, পাকবাহিনীকে দেখে ভয় পেয়ে গ্রামের এক হাড্ডিসার তরুণ দৌড়ে পালাচ্ছিল। কয়েকজন জোয়ান তাকে ধরে এনে নাম জিজ্ঞেস করল।
তরুণটি বলল যে, তার নাম আবদুল বারী, সে ঢাকার নিউ মার্কেটে দর্জির কাজ করে। তার মুসলিম পরিচয়ের ব্যাপারে পাকসেনাদের সন্দেহ হচ্ছিল। একজন জওয়ান তার লুঙ্গি খুলে ফেলল, তারপর নগ্ন শরীরে সুস্পষ্ট চিহ্ন দেখা গেল, যা মুসলমানিত্বের আবশ্যিক প্রমাণ (বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিদেশীদের ভূমিকা, পৃ. ৩৬, ৩৮)। ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের সংবাদদাতা পিটার আর কান একটি জাতি এখন দ্বিধাবিভক্ত’ শিরােনামযুক্ত প্রতিবেদনে লিখেছেন, “…সেনাবাহিনী হিন্দুদের গ্রাম পুড়িয়ে দেয়। হিন্দুর বাড়ি লুট করতে লুটেরাদের উৎসাহিত করে। সেনাবাহিনীর নির্দেশে তাদের সহযােগীরা হাতুড়ি শাবল নিয়ে স্থানীয় মন্দির ভেঙে গুড়িয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়।… সেনাবাহিনীর একটি তালিকায় হিন্দুর সম্পত্তিকে ‘বিদেশী সম্পত্তি এবং আর অন্য তালিকায় শত্রু সম্পত্তি বলা হয়েছে। যাই বলা হােক না, তাদের সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে নিলামে চড়ানাে হবে” (বাংলাদেশ ডকুমেন্টস : প্রথম খণ্ড, পৃ. ৪১৯-৪২১)। পাকসেনা ও তাদের দোসরদের হিন্দুবিদ্বেষী তৎপরতা এমন পর্যায়ে পৌঁছে। যায় যে, ঢাকা শহরের ২১০টি স্থান বা রাস্তাঘাট—যার সাথে কোনাে হিন্দু। নামের যােগসূত্র আছে, সব নাম পাল্টে দিয়ে ইসলামি নামকরণের উদ্যোগ নেয়া হয়। শাঁখারি বাজার রােডের নামকরণ করা হয় ‘টিক্কা খান রােড’, ঢাকেশ্বরী রােডের নাম হয় মওলানা আকরম খাঁ রােড,’ অভয় দাস লেন হয় ‘কামরুন্নেসা রােড, সিদ্ধেশ্বরী লেন হয় হাফেজ মুনীর হােসেন লেন’ ইত্যাদি।
হিন্দু-ধর্মাবলম্বী সম্পর্কে পাক-দৃষ্টিভঙ্গির শােচনীয় চিত্র পাই ফজল মুকিমের ‘পাকিস্তানস ক্রাইসিস ইন লিডারশিপ’ গ্রন্থে। তিনি লিখেছেন, দেশবিভাগের পর পূর্ব পাকিস্তান থেকে হিন্দুরা ৭৫০ থেকে ৮০০ মিলিয়ন টাকা স্মাগল করে বা অন্য উপায়ে নিয়ে গিয়েছিল ভারতে ১৯৪৭ সালে। পূর্ববঙ্গের ১২১০টি হাইস্কুল এবং ৬৭টি কলেজ চলত হিন্দুদের টাকায়। এসব প্রতিষ্ঠানে হিন্দু শিক্ষকরা ভারতে প্রকাশিত বইপত্রের মাধ্যমে শিক্ষা দিত যা ছিল ইন্ডিয়ান প্রপাগান্ডায় ভরা। ফলে, পাকিস্তানি কোনাে চেতনা পূর্ববঙ্গের তরুণ জেনারেশনের মধ্যে জাগেনি, পরিণামে ‘ইস্ট পাকিস্তানি মুসলিমস’রা রূপান্তরিত হলাে বাঙালিতে। ফজল মুকিমের ভাষ্য অনুযায়ী বাঙালি আর হিন্দু—এ দুটোতে ভেদ নেই কোনাে, কাজেই পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের যারা বাঙালি তথা হিন্দু-ঘরানায় নিয়ে গেছে, সেই আসল ‘হিন্দু বা কাফেরদের নিশ্চিহ্ন করার প্রক্রিয়ায় সাচ্চা মুসলমান পাকসেনাদের পিছুটান থাকবে কেন?
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সত্য অসত্য অর্ধসত্য-বিনয় মিত্র