You dont have javascript enabled! Please enable it! সােভিয়েত ইউনিয়ন : মুক্তিকামী মানুষের প্রতীক - সংগ্রামের নোটবুক
সােভিয়েত ইউনিয়ন : মুক্তিকামী মানুষের প্রতীক
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই, ২ এপ্রিল, সােভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পােদগর্নি জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে চিঠি লিখে আহ্বান circus.com, ….extreme measures and use of armed force against the population of East Pakistan, has met with great alarm in the Soviet Union. We-appeal for the adoption of the most urgent measures to stop the bloodshed and repression against the population of East Pakistan and for turning to methods of a peaceful political settlement.’ | পূর্ব বাংলায় গণহত্যা সম্পর্কে উদ্বেগ জানানাের পর সােভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী কোসিগিন মস্কোয় নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত ডি পি ধরের সাথে এ বিষয়টি নিয়ে আলােচনা করেন এবং এর পর থেকে দেশটি কার্যত নীরব ভূমিকা পালন করতে থাকে। কিন্তু জুলাই মাসে কিসিঞ্জারের চীন সফরের পর চীনের ভারতবিরােধী স্পষ্ট ঘােষণা এবং ভারতীয় সীমান্তে চীনা আক্রমণের বিরুদ্ধে দিল্লিকে সহায়তা করার পূর্বপ্রতিশ্রুতি থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরে যাওয়া—এ দুটি বিষয়কে কেন্দ্র করে ঘনিষ্ঠ মিত্র ভারতের নিরাপত্তা বিষয়ে সােভিয়েত ইউনিয়ন উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। ১৯৬৯ সালে ‘সল্ট১’ চুক্তির প্রেক্ষিতে রুশ-মার্কিন—উভয় দেশের মারণাস্ত্র কমানাের সিদ্ধান্ত, বিশ্বশান্তির ক্ষেত্রে যে সুদূরপ্রসারী শুভসূচনা সৃষ্টি করেছে, একটা আঞ্চলিক বিষয় নিয়ে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা আবারাে বৃদ্ধি হােক—সােভিয়েত নেতৃত্ব তা চায়নি।
 
কিন্তু দিল্লির ক্ষমতাসীন মহল শক্তির ভারসাম্য রক্ষার জন্য, দৃশ্যত নিজের নিরাপত্তার জন্য সােভিয়েত সহায়তালাভে উন্মুখ হয়ে উঠেছিল। কারণ, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে সাহায্য করার কোনাে এক পর্বে পাকিস্তানের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে ওঠা অসম্ভব ছিল না এবং এই আশঙ্কাবােধ থেকে ভারত নিশ্চিত হতে চেয়েছে যাতে সম্ভাব্য যুদ্ধের প্রারম্ভে বা মাঝপথে সােভিয়েত সামরিক সরবরাহ মন্থর বা বন্ধ না হয়ে যায়। দ্বিতীয়ত, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ যদি পূর্বতন স্থিতাবস্থা বজায়ের উদ্দেশ্যে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব গ্রহণ করতে উদ্যত হয়, তবে সেখানেও যাতে সােভিয়েত ভূমিকা ভারতের পক্ষে নিশ্চিতভাবেই সহায়ক। থাকে (মূলধারা ‘৭১, পৃ-৬৮)। ১৯৬৯ সালে চীনের উত্তর সীমান্তে উসুরি নদী বরাবর এবং সিনকিয়াং প্রদেশের পশ্চিম দিক ঘেঁষে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বেঁধেছিল চীন ও সােভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ওই যুদ্ধের পর ভারতসহ কয়েকটি এশীয় দেশের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরের উদ্যোগ নিয়েছিল সােভিয়েত ইউনিয়ন। এর সূত্র ধরে ‘৬৯-এর এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সপ্তাহে দুদিন—শনি ও বুধবার রুশভারতের প্রতিনিধির মধ্যে নিয়মিত বৈঠক হতাে, তবে পরবর্তী পর্যায়ে নতুন পরিস্থিতির আলােকে বৈঠকে বসা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ওই বৈঠকে ভারতের হয়ে অংশ নিতেন মস্কোতে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত ডি পি ধর।
এবার মহাসঙ্কট ঘনীভূত হবার প্রাক্কালে নয়াদিল্লি সেই পুরনাে তত্ত্বকে নতুনভাবে উপস্থাপন করল এবং সেই মৈত্রীচুক্তির পুরনাে খসড়াকে নতুনভাবে রূপায়িত করার জন্য ডি পি ধরকেই দায়িত্ব প্রদান করা হলাে। ডি পি ধরের পর্যায়ক্রমিক আলােচনার প্রেক্ষিতে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরন সিং ৬ জুলাই মস্কো যান এবং প্রধানমন্ত্রী কোসিগিন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী গ্রোমিকোর সাথে আলােচনা করেন। পরবর্তী পর্যায়ে গ্রোমিকো ৮ আগস্ট দিল্লি আসেন এবং বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ সম্পন্ন করে যান। ৯ আগস্ট, বহির্বিশ্ব এবং খােদ ভারতেরই অধিকাংশ মন্ত্রী, রাজনীতিবিদ, কূটনীতিকের অজ্ঞাতসারে অতি গােপনে স্বাক্ষরিত হলাে ‘ভারত-সােভিয়েত মৈত্রী চুক্তি। কিসিঞ্জার কর্তৃক অভিহিত Bombshell এবং পাকিস্তান সরকার কর্তৃক অভিহিত ‘tantamount to dictating Pakistan”—চুক্তির নবম ধারায় স্পষ্ট করে বলা হলাে, ‘চুক্তিবদ্ধ দুই দেশের কারাে বিরুদ্ধে যদি বহিঃআক্রমণের বিপদ দেখা দেয়, তবে এই বিপদ অপসারণের জন্য উভয় দেশ অবিলম্বে পারস্পরিক আলােচনায় প্রবৃত্ত হবে এবং তাদের শান্তি ও নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার জন্য যথােচিত ব্যবস্থা অবলম্বন করবে।’ চুক্তির ১০ নং ধারায় বলা হয়েছে, ‘Each Contracting High Party further declares that no obligation be entered into between itself and any other state or states, which might cause military damage to the other party.’ এই মৈত্রী চুক্তিতে সােভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে স্বাক্ষর করেন সে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এ গ্রোমিকো, ভারতের পক্ষে স্বাক্ষর করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরন সিং।
ভারতীয় পত্রিকাগুলাে উচ্ছ্বাসভরে এই চুক্তিসংবাদকে বড় বড় হেডলাইন দিয়ে প্রকাশ করে; ‘দি টাইমস অব ইন্ডিয়া 64991n falcatata fcy TCT, INDIA AND RUSSIA SIGN 20-YEAR PEACE TREATY. MUTUAL CONSULTATION IN CASE OF AGGRESSION. FIRST AGREEMENT OF ITS KIND. ASSURANCE ON ARMS SUPPLIES. “The Times of India, News service. New Delhi, August 9, 1971, India and Soviet Union today signed a 20-year treaty of peace, friendship and co-operation envisaging immediate consultation to counteract any threat to the security of either country and to take appropriate effective measures’ to ensure peace.”  এই ‘মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরের পর, ভারত অনুভব করে যে, স্বাধীনতা সমর্থক মস্কোপন্থি দলগুলাের সমবায়ে ‘জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট গঠন করলে বাংলাদেশের জন্যে সােভিয়েত-সহায়তা পাওয়া অধিকতর সহজ হবে। এরপর অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে ইন্দিরা গান্ধীর বিশেষ দূত ডি পি ধরের সরাসরি হস্তক্ষেপে ‘জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট’-এর বদলে ঠুটো জগন্নাথ ‘জাতীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয় এবং মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থিদের প্রবেশের ক্ষেত্রে যে প্রতিবন্ধকতা আরােপিত হয়েছিল, তা তুলে নেয়া হয়। ভারতের সরকারঘনিষ্ঠ এবং মস্কোপন্থি হিসেবে পরিচিত দল সিপিআই এবং প্রশাসন কেন্দ্রের বাম, বিশেষত ডি পি ধরের সহায়তায় বামরা যখন মুক্তিযুদ্ধে সংশ্লিষ্ট হওয়ার প্রবেশাধিকার পেল, তাজউদ্দীন তখন ‘মুজিববাহিনী’র ক্রমবর্ধমান দৌরাত্ম হ্রাস করা এবং মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে রাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য সেখানে বেশি বেশি ‘বাম’ প্রবেশের সুযােগ সৃষ্টি করে দিলেন।
এতদিন চীনপাকিস্তান এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে আঁতাতের কারণে মুক্তিযযাদ্ধাদের সাহায্য প্রদানের ক্ষেত্রে ভারতের মনে যে দ্বিধা বা শঙ্কা কাজ করত, উল্লিখিত মৈত্রী চুক্তি সম্পাদনের পর ভারতের নিরাপত্তা ঝুঁকি হ্রাস পায়, বিধায় এ ব্যাপারে সর্বাত্মক সহায়তাদানে অনেক বেশি তৎপর হয়ে ওঠে। সােভিয়েত প্রশাসনও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালীন জার্মানি ও পশ্চিম ইউরােপ থেকে দখল করা হালকা অস্ত্রশস্ত্র ভারতের মাধ্যমে মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে তুলে দিতে থাকে। | এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, যদিও স্বাধীনতাযুদ্ধের শুরু থেকেই সােভিয়েত ইউনিয়নসহ অন্য সমাজতান্ত্রিক দেশগুলাে বাংলাদেশকে পরােক্ষ সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিল, তবে সেপ্টেম্বর মাসে ভারতের কোচিনে অনুষ্ঠিত সিপিআই-এর সম্মেলনের পর সেই সমর্থন দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হতে থাকে। ওই সম্মেলনে বিশ্বের বাইশটি দেশের কমিউনিস্ট পার্টি অংশ নিয়েছিল এবং সেখানে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। কমরেড আবদুস সালাম (বারীণ দত্ত)। তার মুখ থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাকবাহিনীর পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড, লুটপাট, নারী ধর্ষণ ইত্যাদি জঘন্য অপকর্মের কথা শুনে পরিস্থিতি এমন হয়ে উঠেছিল যে, সিপিআই আয়ােজিত ওই কংগ্রেসে অন্যসব প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’ই যেন মূল এজেন্ডায় পরিণত হয়ে গিয়েছিল। (পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু-দর্শন, পৃ. ৪৩৭)। এই সম্মেলনের মধ্য দিয়ে বিশ্বের সমাজতান্ত্রিক শিবির আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে নতুন ধারণা পায় এবং শােষিতের আন্দোলনে তারা আরাে সক্রিয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। লক্ষণীয় ব্যাপার হলাে, ভারত-সােভিয়েত মৈত্রী চুক্তির তাৎপর্য এবং এর ভবিষ্যৎ প্রভাব সম্পর্কে স্বাধীনতাকামী মুজিবনগর সরকার ও মুক্তিযােদ্ধাদের মনে সন্দেহ ও অবিশ্বাস সৃষ্টি করাতে গিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে সূক্ষ্ম চাল চালিয়েছিল, পরবর্তী পর্যায়ে সে চাল তাদের জন্যই বুমেরাং হয়ে দেখা দিয়েছিল।
চুক্তি স্বাক্ষরের পরপর ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকায় বলা হয়েছিল, ‘মার্কিন গােয়েন্দা সংস্থা সিআইএ এক গােপন সমীক্ষায় নিক্সনকে অবহিত করেছে যে, ভারত-সােভিয়েত মৈত্রী চুক্তি বাংলাদেশকে সাহায্য প্রদান থেকে ভারতকে নিবৃত্ত রাখবে।’ যুক্তরাষ্ট্রের এই উদ্দেশ্যমূলক অপপ্রচারে ভারতে অবস্থানকারী বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহল যখন দ্বিধাগ্রস্ত ও বিভ্রান্ত, তখন প্রেসিডেন্ট নিক্সন তার কৌশলের অংশ হিসেবে ইয়াহিয়া খানকে নমনীয় হবার পরামর্শ দেন (মূলধারা ‘৭১, পৃ-৭৬)। এ প্রেক্ষিতে ১৪ আগস্ট, যাকে দেশসেবার জন্য পাকিস্তানের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় খেতাবে ভূষিত করা হয়েছিল, মাত্র সতেরাে দিন পর সেই টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের পদ থেকে সরিয়ে নিয়ে সেখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতি রক্ষার্থে’ বাঙালি ডা. আবদুল মালেককে নিয়ােগ প্রদান করা হয়। সেইসাথে। ‘নির্দিষ্টভাবে অভিযুক্ত নয় এমন সব ‘দুষ্কৃতিকারীর জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘােষণা করা হয়, স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করতে ইচ্ছুক স্থানচ্যুতদের জন্য ‘অভ্যর্থনা কেন্দ্র’ খােলা হয়, ১১ আগস্ট শুরু হওয়া দেশদ্রোহী’ শেখ। মুজিবের বিচার প্রক্রিয়া অনির্দিষ্টকালের জন্য পিছিয়ে দেয়া হয়। বস্তুত এসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল মার্কিন প্রশাসনের ইঙ্গিতে, ভারত-সােভিয়েত মৈত্রী চুক্তি সম্পর্কে সংশ্লিষ্টদের মনে সন্দেহের ধূম্রজাল সৃষ্টি করার জন্য, যদিও নিক্সন-ইয়াহিয়ার এই অপচেষ্টা শেষপর্যন্ত সফলতার মুখ দেখতে পারেনি। 
[বি. দ্র. : আমাদের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে ভারত-সােভিয়েত মৈত্রী চুক্তির গুরুত্ব অপরিসীম। এ চুক্তি সম্পাদিত না হলে, চীন-মার্কিনকে উপেক্ষা করে ভারত কখনােই সর্বাত্মক যুদ্ধে লিপ্ত হতাে না। আবার এই চুক্তির কারণেই চীন যুদ্ধমাঠে নামতে গিয়েও নামেনি। সােভিয়েত সামরিকশক্তির বহর দেখে শুরুতেই পিছটান দিয়েছিল সে। মার্কিন নৌবহর, যা পারমাণবিক অস্ত্রসজ্জিত হয়ে ধেয়ে আসছিল বঙ্গোপসাগর অভিমুখে, সেটি লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যেত না, যদি না সেখানে সােভিয়েত যুদ্ধযান আগে থেকেই মােতায়েন করা হতাে। জাতিসংঘে বারবার উত্থাপিত যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব, কে ফেরাত যদি সােভিয়েত ইউনিয়ন ভেটো প্রয়ােগ না করত? ভেটো না দিলে মার্কিন-আজ্ঞাবাহী জাতিসংঘ নিশ্চিতভাবেই ‘যুদ্ধবিরতি কার্যকর করে। ফেলত। জাতিসংঘকে অবজ্ঞা করা—ভারত কিংবা মুজিবনগর সরকার, কারাে পক্ষেই সম্ভব ছিল না; যদি তা-ই হয়, তাহলে আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের পরিণতি কী হতাে, কল্পনা করতে পারি কি?

সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সত্য অসত্য অর্ধসত্য-বিনয় মিত্র