শান্তি কমিটি- রাজাকার – আলবদর সমাচার
বাঙালি জাতির ইতিহাস যেমন শৌর্য-বীর্যে-দেশপ্রেমিকে দীপ্তিময়, তেমনি এ ইতিহাসে বিশ্বাসঘাতক, বেঈমানের সংখ্যাও নিতান্ত কম নয়। ইংরেজ আমলে ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন, প্রীতিলতা প্রমুখের পাশাপাশি ইংরেজ তােষামােদকারীর যেমন অভাব ছিল না, তেমনি পাকিস্তান আমলে—এমনকি পাকবাহিনী কর্তৃক বাঙালি নিধনযজ্ঞ শুরু হওয়ার পরও, স্বজাতিবিনাশে পাক হানাদারশক্তিকে সর্বাত্মক সহায়তাদানের জন্য বাঙালি কুলাঙ্গারের অভাব দেখা যায়নি। পবিত্র ধর্মের নামে, তথাকথিত শান্তি বজায় রাখার নামে ওইসব বিশ্বাসঘাতক কখনাে ব্যক্তিগত উদ্যোগে, কখনাে নানা রকম সংগঠন সৃষ্টি করে পাক হানাদারবাহিনীকে প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য করেছে। কখনাে কখনাে এরা। নিজেরাই স্বজাতি নিধনে প্রবৃত্ত হয়েছে, স্বাধীনতা আন্দোলনের সমর্থক বা এর প্রতি সহানুভূতিশীল লােকজনের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে, লুটপাটে মত্ত হয়েছে, কিশােরী-তরুণী-যুবতী মেয়েদের ভােগের জন্য পাকবাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছে, সুযােগ পেলে নিজেরাও এমন অপকর্মে লিপ্ত হয়েছে। পবিত্র ধর্মের নামে, অখণ্ড পাকিস্তানকে রক্ষার নামে হেন কুকর্ম-পাপাচার নেই—যা তারা করেনি বা করতে সচেষ্ট হয়নি। যুদ্ধকালীন পাকবাহিনীকে সহায়তা করা বা তথাকথিত শান্তি রক্ষার নামে যেসব সংগঠন মুক্তিযুদ্ধবিরােধী তৎপরতায় লিপ্ত ছিল, এর মধ্যে রয়েছে— শান্তি কমিটি : মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার ক’দিন পরেই কিছু ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল পাকিস্তান সরকারকে সহায়তা করার জন্য এগিয়ে আসে। ৪ এপ্রিল, নূরুল আমিনের নেতৃত্বে গােলাম আযম ও খাজা খয়েরউদ্দীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর টিক্কা খানের সাথে দেখা করে তাকে সম্ভাব্য সকল প্রকার সাহায্যের আশ্বাস দেন।
দুদিন পর অর্থাৎ ৬ এপ্রিল গােলাম আযম ও হামিদুল হক চৌধুরী টিক্কা খানের সাথে দেখা করে পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লায় মহল্লায় তথাকথিত শান্তি বজায় রাখার উদ্দেশ্যে ‘নাগরিক শান্তি কমিটি গঠনের প্রস্তাব রাখেন। ৯ এপ্রিল, ঢাকায় ১৪০ জন সদস্য নিয়ে সর্বপ্রথম ওই কমিটি গঠিত হয়। পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ইতােমধ্যে পূর্ব বাংলায় গৃহীত পদক্ষেপ’-এর সমর্থনে মিছিল-মিটিং করে সংগঠনটি প্রাথমিক কার্যক্রম শুরু করে। ১৪ এপ্রিল, এ সংগঠনের নাম পরিবর্তন করে শান্তি কমিটি রাখা হয় এবং দেশের প্রত্যেকটি জেলা, মহকুমা, থানা থেকে ইউনিয়ন পর্যন্ত—সর্বত্র এর কার্যক্রম সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয়া হয়। রাজাকার নির্বাচন, নিয়ােগ ও নিয়ন্ত্রণই ছিল এ কমিটির মূল দায়িত্ব। মার্কিন কংগ্রেস সদস্য কর্নেলিয়াস ই গাললাজার ১০ জুন প্রতিনিধি পরিষদে বক্তৃতা দানকালে শান্তি কমিটি সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন, “আমি শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয়গ্রহণকারী শত শত লােকের সঙ্গে কথা বলেছি। কথা বলেছি ধনী, গরিব, শিক্ষিত, নিরক্ষর, স্বাস্থ্যবান ও অঙ্গচ্ছেদিত শরণার্থীদের সঙ্গে সকলের কাহিনী অনেকটা এই রকম : শান্তি কমিটির লােকেরা আসে। ঘরে পেট্রল ঢালে এবং আমরা পালাতে শুরু করতেই ঘরের মূল্যবান জিনিসপত্র লুটে লেগে যায়। আমরা প্রতিরােধ করলে পাকিস্তানি সৈন্যরা আমাদের গুলি করত। এই ‘শান্তি কমিটি’ কী? সুস্পষ্টভাবে এগুলাে স্থানীয় গুণ্ডাপাণ্ডাদের গঠিত এক দল। সেনাবাহিনী এদের অগ্রবর্তী দল হিসেবে প্রেরণ করে আগুন লাগানাে এবং লুটপাটের জন্য। পাকিস্তান সরকার বলেছে ‘দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার প্রয়ােজন হয়ে পড়েছে। তথাপি মনে হয়, সেনাবাহিনী সবচাইতে জঘন্য লােকদের নিয়ে একটি হামলাকারী সৈন্যদল গঠনের ব্যাপারে উৎসাহ। দিচ্ছে।’ (বাংলাদেশ ডকুমেন্টস : প্রথম খণ্ড, পৃ. ৫৪৭৫৫৩)।
রাজাকারবাহিনী :
পূর্ব পাকিস্তান আনসারবাহিনীর অধিকাংশ সদস্য মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যােগ দেয়ার প্রেক্ষিতে টিক্কা খান ১৯৫৮ সালের আনসার অ্যাক্ট বাতিল করে পূর্ব পাকিস্তান রাজাকার অর্ডিন্যান্স ‘৭১’ জারি করেন। এতে বলা হয়, আনসারবাহিনীর যেসব সদস্য পাকিস্তান সরকারের অনুগত আছে-তারা, এবং পূর্ব পাকিস্তানের সকল সক্ষম ব্যক্তিকে নিয়ে ‘রাজাকারবাহিনী গঠন করা হবে এবং উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দান করে ওদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়া হবে। ‘৭১-এর মে মাসে, খুলনার খান জাহান আলী। রােডের একটা আনসার ক্যাম্পে ৯৬ জন জামায়াত কর্মী নিয়ে ওই দলেরই পূর্ব পাকিস্তান শাখার সহকারী আমির মওলানা এ কে এম ইউসুফের নেতৃত্বে রাজাকারবাহিনী গঠিত হয়। ওই বাহিনীর সদস্যদের মূল নাম ছিল রেজাকার’ (যার অর্থ—যারা স্বেচ্ছায় কাজ করে), কিন্তু জনগণের মুখে মুখে শব্দটি পরিবর্তিত হয়ে রাজাকার’ রূপ ধারণ করে।
প্রাথমিক অবস্থায় ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতৃবৃন্দকে নিয়ে ১০টি জেলায় রাজাকারবাহিনী গঠিত হয়েছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের মাঠ ও ফিজিক্যাল কলেজের মাঠে রাজাকার বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেয়া হতাে। দেড় থেকে দুই সপ্তাহব্যাপী প্রশিক্ষণশেষে ওদের হাতে ৩০৩ রাইফেল তুলে দেয়া হতাে। কাজে নামার আগে পবিত্র কুরআন ছুঁয়ে প্রত্যেক রাজাকার শপথ নিত from this moment I shall faithfully follow the injunctions of my religion and dedicate my life to the service of my society and country. I shall obey and carry out all lawful orders of my superiors. I shall bear true allegiance to the constitution of Pakistan as formed by law and shall defend Pakistan, if necessary with my life.’ আলবদর বাহিনী : এটি গঠিত হয়েছিল রাজাকারবাহিনী গঠনের আগেই, ২২। এপ্রিল, ‘৭১ জামালপুরে। ইসলামী ছাত্রসংঘের ময়মনসিংহ জেলা শাখার সভাপতি মুহম্মদ আশরাফ হােসাইনের নেতৃত্বে আলবদরবাহিনীর জন্ম। এই বাহিনীর কার্যকলাপ সম্পর্কে ১৪ সেপ্টেম্বর, দৈনিক সংগ্রাম প্রবল উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিল, ‘আলবদর একটি নাম, একটি বিস্ময়; আলবদর একটি প্রতিজ্ঞা। যেখানে তথাকথিত মুক্তিবাহিনী, আলবদর সেখানেই। যেখানেই দুষ্কৃতিকারী আলবদর সেখানেই। ভারতীয় চর কিংবা দুষ্কৃতিকারীদের কাছে আলবদর সাক্ষাৎ আজরাইল।’ সারা দেশের ছাত্রসংঘের শাখাগুলােকে আলবদরবাহিনীতে পর্যায়ক্রমিক রূপান্তরিত করা হয়। বস্তুত এই বাহিনীর সক্রিয় সহযােগিতায় ১৪ ডিসেম্বর, ‘৭১ আমাদের বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছিল।
আল-শামসবাহিনী :
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসকারী বিহারি ও অন্যান্য কিছু অবাঙালিকে নিয়ে এই কুখ্যাত সংগঠনটি গড়ে উঠেছিল। পাকিস্তান রক্ষার নামে, মূলত বাঙালি জনগােষ্ঠীর ওপর অত্যাচার, নির্যাতন চালানাের জন্য এই সংগঠনের জন্ম। ২৫ মার্চের কালােরাত থেকে স্বাধীনতা-অর্জনের পূর্ব পর্যন্ত আল শামসবাহিনী স্বাধীনতাকামী বাঙালি জনগােষ্ঠীর ওপর ভয়াবহ নির্যাতন চালিয়ে গিয়েছিল। শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর, আল-শামস—এরা নামে ভিন্ন হলেও কার্যক্রম ছিল প্রায় অভিন্ন প্রকৃতির। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহায়কশক্তি হিসেবে কাজ করা, মুক্তিযােদ্ধা বা এদের সমর্থকদের গােপন খবর পাকবাহিনীকে পৌছে দেয়া, হত্যা-ধর্ষণ-লুণ্ঠন-নির্যাতন চালিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের জনগণের মধ্যে ত্রাসের সৃষ্টি করা, পাকিস্তানি সেনাকর্মকর্তাদের মনঃতুষ্টির জন্য যুবতী নারীসহ মদ ও অন্যান্য জিনিসের জোগান দেয়া ইত্যাদি। এসব অপকর্মের সাথে সংশ্লিষ্টরা—প্রায় প্রত্যেকেই ছিল জামায়াতে
ইসলামী, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামী প্রভৃতি ধর্মভিত্তিক দলের নেতা বা কর্মী। এদের বাইরে, এদেশের বুদ্ধিজীবীশ্রেণীর একাংশও পাকবাহিনীর দোসর হয়ে স্বজাতি-বিনাশকল্পে ঘৃণ্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। এসব কুলাঙ্গার, বেঈমান, ভণ্ডরা বাঙালি জাতিসত্তার কলঙ্ক, সুস্থ-সুন্দর দেহে যেন অনিরাময়যােগ্য দুষ্ট ক্ষতচিহ্ন।
[বি. দ্র. : যেসব কুলাঙ্গার স্বজাতি বা স্বদেশের বিনাশকল্পে বহিঃশত্রুকে সহায়তা করে, জাতীয় ইতিহাসে তারা ঘৃণিত, পরিত্যাজ্য, অস্পৃশ্য বলে বিবেচিত হয়। বিভীষণ, মীরজাফর, কুইসলিং—এমনই কটি নাম, যে নামগুলাে বিশ্বাসঘাতক’-এর সমার্থক শব্দে রূপ লাভ করেছে। আধুনিক ইতিহাসে দেখতে পাই, যে বা যারা গণহত্যার সাথে জড়িত, রাষ্ট্র বা আন্তর্জাতিক আদালত তাদের যথাযথ শাস্তি প্রদান করছে। কিন্তু, আলেকজান্ডার কথিত এই বিচিত্র দেশে’ ‘৭১-এর নরঘাতকরা এখন অবধি দণ্ডপ্রাপ্ত হয়নি। দেশে বা সমাজে কোথাও তারা ঘৃণিত’ বা ‘অস্পৃশ্য’ হিসেবে। প্রতিভাত হয়নি। হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ মানুষকে যারা হত্যা করেছে বা হত্যাকাণ্ড ঘটাতে সহায়তা করেছে, তাদেরকে যথাযথ বিচারের আওতায় আনতে না পারা, এটা তােমার-আমার পাপ’, মানবিকবােধসম্পন্ন সকল ব্যক্তির ব্যর্থতা, অপরাধও।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সত্য অসত্য অর্ধসত্য-বিনয় মিত্র