You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযােদ্ধা বাছাই-এ বর্ণবৈষম্য দূর হওয়ার পর - সংগ্রামের নোটবুক
মুক্তিযােদ্ধা বাছাই-এ বর্ণবৈষম্য দূর হওয়ার পর
কয়েকজন ভারতীয় শীর্ষ কর্মকর্তা, সেইসাথে মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের যথােপযুক্ত সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে মুক্তিযােদ্ধা নির্বাচনে আওয়ামী দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাব তিরােহিত হবার পর বাম রাজনীতিসম্পৃক্ত ছাত্রযুবক মুক্তি সংগ্রামে অংশ নেয়ার প্রবেশাধিকার পেল, এবং এর ফলে মুক্তিযােদ্ধাদের তৎপরতায় গতি, ব্যাপ্তি ও গুণগত মানের লক্ষণীয় পরিবর্তন ঘটতে থাকল। আগস্টের শেষদিকে দিল্লি প্রশাসন যখন অনুভব করল, পূর্ববাংলা থেকে আগত লাখ লাখ শরণার্থীকে স্বভূমে ফেরত পাঠানাের কার্যকর সমাধান কেবল স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা’র মধ্যেই নিহিত, তখন থেকে তারা বহির্বিশ্বে কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধির পাশাপাশি সমর পরিকল্পনায় বিশেষ গুরুত্ব আরােপ করে। এক্ষেত্রে ভারতকে বেশ ক’টি বিষয় ধীর-বিবেচনায় নিতে হয়, একদিকে কাশ্মির সীমান্তে পাকিস্তানের সম্ভাব্য আগ্রাসন ঠেকানাে, অন্যদিকে তিব্বত সীমান্তে চীনকে সামলানাে—এই দুটি বৈরী দিক মােকাবিলা করার জন্য সংশ্লিষ্ট সীমান্তে পর্যাপ্ত সৈন্য রাখার পর বাংলাদেশে অভিযান পরিচালনা করার মতাে যথেষ্ট সামর্থ্য নয়াদিল্লির আছে কি না। অনেক পর্যালােচনা-হিসাব-নিকাশের পর নয়াদিল্লির সামরিক প্রশাসন এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, ভারতের সৈন্য সমাবেশ ক্ষমতা এবং বাংলাদেশের বিজয় সুনিশ্চিত করার মধ্যে যে ব্যবধান, তা পূরণ করা সম্ভব একমাত্র মুক্তিবাহিনীর সাহায্যেই। কাজেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, সেপ্টেম্বর থেকে প্রতিমাসে কুড়ি হাজার মুক্তিযােদ্ধাকে যুদ্ধক্ষেত্রে নামানাে হবে।  ‘মুক্তিযােদ্ধা-বৃদ্ধি’র এই সিদ্ধান্ত আপাতদৃষ্টিতে সঠিক বলে পরিগণিত হলেও, এর মাধ্যমে প্রত্যাশিত ফল অর্জন করা কঠিন ছিল বৈকি। কারণ সাহস থাকা আর গােলা বা গ্রেনেড নিক্ষেপ করতে পারা—একজন যােদ্ধার জন্য গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হলেও, কৌশলী শক্তি, নিখাদ দেশপ্রেম, নৈতিকতা ইত্যাদিই বােধহয় তার প্রধান অস্ত্র।
কিন্তু মুক্তিযােদ্ধা-স্ফীতি’র নতুন সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে গিয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের নৈতিক মান যাচাই করা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সম্ভব ছিল না। নতুন যােদ্ধাদের দেশে পাঠানাে হতাে সেক্টর কমান্ডারদের মাধ্যমে, কিন্তু যােদ্ধা নিয়ােগের ক্ষেত্রে সেক্টর কমান্ডারদের হাতে ক্ষমতা ছিল খুবই সীমিত। তাছাড়া যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশের পর সেক্টর সংগঠন আর সাধারণ যােদ্ধার মধ্যে যােগাযােগ রক্ষা করা সহজসাধ্য ছিল না, বিধায় শত্রুর বিরুদ্ধে অধিকাংশ আক্রমণ বিচ্ছিন্নভাবে সংঘটিত হতাে। তাই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযােদ্ধাদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত ফল এবং প্রাপ্তির মধ্যে দুস্তর ব্যবধান পরিলক্ষিত হতে থাকে। জুলাই-এর প্রথম সপ্তাহ থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযােদ্ধাদের তৎপরতা শুরু হওয়ার পর, দেশের যুবসমাজ পাকবাহিনীর অন্যতম শত্রু হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে, তখন কেউ দেশের টানে, কেউ বা নিজের নিরাপত্তার জন্য ভারতে পালিয়ে আসে এবং শেষপর্যন্ত যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। একদিকে যােদ্ধা-সংখ্যা বাড়ানাের জন্য ভারতীয় উদ্যোগ, অন্যদিকে সীমান্তবর্তী যুবশিবিরে উপচে পড়া ভিড়—এমন অবস্থার প্রেক্ষিতে দৈহিক ও চারিত্রিক যােগ্যতা যাচাই-বাছাই না করেই হাজার হাজার যুবককে স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণ প্রদান করে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানাে হতে থাকে। ‘দেশের ভিতরে মুক্তিযুদ্ধের উপযােগী কোনাে রজনৈতিক সংগঠন থাকুক। অথবা না-ই থাকুক, মুক্তিযােদ্ধাদের পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত করার মতাে কোনাে কমান্ড-ব্যবস্থা তৈরি হােক বা না-ই হােক, সেসবের প্রতি দৃকপাত না। করায় অল্পসংখ্যক মুক্তিযােদ্ধার দ্বারা যে কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব ছিল, বাস্তব ক্ষেত্রে একই ফল সঞ্চারের জন্য তার চাইতে অনেক বেশি মুক্তিযােদ্ধা নিয়ােগ করতে হয়।
মুক্তিযােদ্ধাদের সংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমে পাক সৈন্যদের দুর্বল ও পরিশ্রান্ত করে চূড়ান্ত বিজয়ের পথ প্রশস্ত করা হয় বটে, কিন্তু এর ফলে প্রত্যাশিত স্বাধীনতার পর সামাজিক অস্থিরতার শক্তিও প্রবল হয়ে ওঠে। (মূলধারা ‘৭১, পৃ. ১১০)। | [বি. দ্র. : প্রয়ােজনীয় যাচাই-বাছাই ছাড়া ‘সংখ্যা-বৃদ্ধির জন্য অবাধে মুক্তিযােদ্ধা-নিয়ােগ, স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে অশুভ ফল বয়ে এনেছিল। নিয়মিত বাহিনী, মুজিবনগর সরকার কর্তৃক স্বীকৃত বাহিনী, মুজিববাহিনী, টাঙ্গাইল-ফরিদপুর-বরিশাল অঞ্চলে গড়ে ওঠা স্থানীয় বাহিনী—সব মিলিয়ে সংখ্যাগত বিশালতার কারণে এদের সম্পর্কিত তথ্যাদি সংরক্ষণ করার উপায় ছিল খুবই সীমিত। ফলে পাকসেনাদের আত্মসমর্পণের পর, ১৬ ডিসেম্বরের রাত থেকেই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিজয়ােল্লাসে মত্ত অগণিত তরুণযুবককে দেখা যায়, যাদের হাতে শােভা পাচ্ছিল চীনা একে-৪৭ রাইফেল ও স্টেনগান। এ জাতীয় অস্ত্র কখনােই কোনাে মুক্তিযােদ্ধাকে সরবরাহ করা হয়নি, এগুলাে ছিল পাকিস্তান বাহিনীর ফেলে যাওয়া অস্ত্র এবং উল্লসিত অস্ত্রধারীরা এতদিন নিরাপদ আশ্রয়ে বসবাস করে, অবস্থার সুযােগ নিয়ে তথাকথিত মুক্তিযােদ্ধা সেজেছে—এমন তথ্যাদি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পরও, মুক্তিযােদ্ধা নিয়ােগে ফাক ও দুর্বলতা থাকার কারণে ওইসব ভুঁইফোড়  আত্মাপহারী তরুণ, যুবকের দাবিকে তাৎক্ষণিকভাবে খারিজ করে দেয়া যায়নি। ইতঃপূর্বে রাজাকার, আলবদর হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী অনেক অচেনা মুখ রং বদল করে ওইসব তরুণের সাথে মিশে যায় এবং নিজেদের মুক্তিযােদ্ধা হিসেবে দাবি করে বসে। এসব নষ্ট, ভ্রষ্ট সুবিধাবাদীরা “কালক্ষেপণ না করে অন্যের গাড়ি, বাড়ি, দোকানপাট, স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি বিনামূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে দখল করার কাজে ব্যাপৃত হয়ে পড়ে। সুযােগসন্ধানী সিক্সটিনথ ডিভিশন’ (১৬ ডিসেম্বর এই বাহিনীর উদ্ভব বিধায়, ঢাকাবাসী তাদেরকে এমন নামেই ডাকত—লেখক) কর্তৃক সৃষ্ট এই ব্যাধি অচিরেই সংক্রমিত হয় মুক্তিযােদ্ধাদের একাংশের মধ্যে।
তারপর কে ‘সিক্সটিনথ ডিভিশনের লােক, কে যে মুক্তিযোেদ্ধা আর কে যে দল পরিবর্তনকারী রাজাকার—সব যেন একাকার হয়ে এমন এক লুঠপাটের রাজত্ব কায়েম হয় যে, ঢাকা শহরের নিয়ন্ত্রণ ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার সর্বাধিক জরুরি দায়িত্ব পালন করা ছাড়াও ভারতীয় সেনাবাহিনীকে পুলিশী ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যস্ত হয়ে পড়তে হয়” (মূলধারা ‘৭১, পৃ. ২১৮-১৯)। কিন্তু ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়া এই ‘লুঠপাট ও সম্পদ দখলের ঘৃণ্য-প্রবণতা পুরােপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি, বহিরাগত সীমিত ভারতীয় বাহিনীর পক্ষে তা সম্ভবও ছিল না; দেশের অন্য বড় বড় শহর—যেখানে ভারতীয় বাহিনীর উপস্থিতি ছিল না, সেখানে এমন অপকর্ম অবাধে চলতে থাকে। ফলে সদ্য শত্রুমুক্ত দেশটির অনেকের সম্পদ ও সম্পত্তি, তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি হওয়া সত্ত্বেও, বিজয় অর্জনের পরপরই ‘স্বদেশী তস্কর’ কর্তৃক লুষ্ঠিত হয়ে যায় এবং তাদের স্বাধীনতার আনন্দ, উচ্ছ্বাস—গােড়াতেই ছেয়ে যায় হতাশা ও বিষাদে।] 

সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সত্য অসত্য অর্ধসত্য-বিনয় মিত্র