মুজিবনগর সরকারের ভেতর অনৈক্যের সুর | তাজউদ্দীনের উপর অনাস্থা প্রস্তাব
মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদের অবস্থানকে মেনে নিতে পারছিলেন না অনেকেই। ওদের নানাবিধ চক্রান্ত ব্যর্থ করে দিয়ে ১৭ এপ্রিল, নতুন সরকার শপথ নিল বটে, কিন্তু তাজউদ্দীন-বিরােধিতা ক্ষণিকের জন্যও থেমে থাকল না। ভারতের ক্ষমতাসীন কংগ্রেস দলের দক্ষিণপন্থি অংশও তাজউদ্দীনের ব্যাপারে শীতল মনােভাব পােষণ করত এবং এর সূত্র ধরেই ২৪ জুন, ভারতীয় পররাষ্ট্র দপ্তরের যুগ্ম সচিব অশােক রায় বাংলাদেশের নির্বাচিত সকল জনপ্রতিনিধি নিয়ে বৈঠক করার জন্য তাজউদ্দীন আহমদকে অনুরােধ করেন। তাজউদ্দীনের স্বতঃস্ফূর্ত সম্মতির ভিত্তিতে ৫ ও ৬ জুলাই ওই বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। শিলিগুড়িতে অনুষ্ঠেয় ওই বৈঠকে, পাকিস্তানের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের প্রায় তিনশাে জন সদস্যের উপস্থিতিতে, প্রবাসী সরকারের কার্যক্রম নিয়ে আলােচনা করা হয় এবং এতে প্রধানত তাজউদ্দীন আহমদের ব্যর্থতার ক্ষেত্রগুলাে চিহ্নিত করে তার কঠোর সমালােচনা করা হয়। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদের ব্যর্থতার বয়ান দিয়ে খন্দকার মােশতাক আহমদ তাঁর পদত্যাগ দাবি করেন এবং মিজানুর রহমান চৌধুরী আরাে একধাপ এগিয়ে এসে ‘প্রধানমন্ত্রী’ ও ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক’ উভয় পদ থেকেই তাজউদ্দীন আহমদকে অপসারণ করার জন্য জোর দাবি জানান; শুধু তা-ই নয়, তিনি ওই বৈঠকে মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত নৈরাশ্যজনক চিত্র উপস্থাপন করে বলেন, ‘এর চাইতে দেশে ফিরে গিয়ে যুদ্ধ অথবা আপস করা ভালাে।’ সেনাধ্যক্ষ কর্নেল ওসমানীর বিরুদ্ধেও সমস্বরে অভিযােগ উত্থাপন করা হয় যে, তার অব্যবস্থাপনা ও অযােগ্যতার জন্যই মুক্তিসংগ্রামে প্রত্যাশিত অগ্রগতি অর্জন করা সম্ভব হচ্ছে না (মূলধারা ‘৭১, পৃ. ৪৮)।
ওই বৈঠকে তাজউদ্দীনের দৃঢ় অবস্থান ও যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা (বিজয়ের জন্য যে দীর্ঘ সংগ্রাম ও অশেষ ত্যাগ স্বীকারের প্রয়ােজন, তা সকল প্রতিনিধির পক্ষে সম্ভব না-ও হতে পারে, ফলে যােগ্যতর নেতৃত্বের উদ্ভব সেখানে ঘটবেই।…আমি নিজেও যদি সক্ষম না হই, তবে যােগ্যতর ব্যক্তির জন্য প্রধানমন্ত্রিত্বের পদ ছেড়ে দিতে হবেই। কিন্তু বিজয় বাংলাদেশের অনিবার্য।’) শােনার পর, উপস্থিত অধিকাংশের কাছে তা গ্রহণযােগ্য মনে হয়, ফলে তার বিরুদ্ধে যারা অবস্থান নিয়েছিলেন, তারা আপাতত চুপ করে যেতে বাধ্য হন। প্রথম পর্যায়ে, বলা যায় জুলাই মাস পর্যন্ত—মুক্তিবাহিনীতে যাতে বাম সংগঠনের কোনাে ছাত্র-যুবা প্রবেশ করতে না পারে, এ-ব্যাপারে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনগুলাে কড়া নজরদারি বজায় রেখেছিল। কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদ অনুভব করলেন, এই যুদ্ধে আমেরিকা ও চীন যেহেতু ইসলামাবাদকে সমর্থন করছে, তাই মুজিবনগর সরকারকে সমর্থন করার জন্য ভারতের পাশাপাশি সােভিয়েত ইউনিয়নকেও পাশে পাওয়া প্রয়ােজন। আর এই সমর্থন পেতে হলে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, এমনকি ন্যাপকেও যুদ্ধ সংক্রান্ত সকল বিষয়ে সংশ্লিষ্ট করা দরকার। এ প্রেক্ষিতে তাজউদ্দীন আহমদ, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত ডি পি ধরের উপস্থিতিতে সেনাধ্যক্ষ কর্নেল ওসমানীর সাথে জরুরি বৈঠকে মিলিত হন। এবং মুক্তিবাহিনীর দরজা ন্যাপ, কমিউনিস্ট বা ছাত্র ইউনিয়ন সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিতে সমর্থ হন। এরপরও সমস্যা কিছু থেকেই গেল, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধটি কেবল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই হচ্ছে, নাকি এতে অন্যান্য দলেরও অংশ আছে—এরকম একটি প্রশ্ন সামনে চলে এলাে। যুদ্ধকালীন অবস্থায় জাতীয় সরকার’ বা ‘জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট’ গঠনের বিষয়টি বারবার আলােচনায় আসতে লাগল।
কিন্তু সকলের সমন্বয়ে জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট খােলার দাবি সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে প্রবাসী সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামারুজ্জামান মন্তব্য করেন, ‘মুক্তি ফ্রন্ট গঠনের কোনাে দরকার নাই। সকলে বাংলাদেশ সরকার তথা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব মানিয়া নিলেই সমস্যা চুকিয়া যায়’ (সাপ্তাহিক মুক্তিযুদ্ধ, ১৮ জুলাই, ‘৭১)। ব্যাপারটা শেষপর্যন্ত ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিআই) মাধ্যমে ইন্দিরা গান্ধীর কানে যায়। এ প্রেক্ষিতে ইন্দিরার বিশেষ দূত ডি পি ধর কলকাতায় আসেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সমর্থক বিভিন্ন দলের সমবায়ে একটি জাতীয় ফোরাম গঠনের ব্যাপারে নয়াদিল্লির আগ্রহের কথা ব্যক্ত করেন। ভারত সরকারের উদ্দেশ্য এবং তাজউদ্দীনের আকাঙ্ক্ষা এক বিন্দুতে মিলে যাবার পর আওয়ামী লীগের ঐক্য বিরােধী অংশ চুপ করে যায়। ভারতের প্রভাবে ‘জাতীয় ঐক্যজোট-উপদেষ্টা কমিটি গঠিত হলাে বটে (৮ সেপ্টেম্বর), তাজউদ্দীনকে আহ্বায়ক করে এর সাথে সদস্য হিসেবে প্রযুক্ত করা হলাে খন্দকার মােশতাক, আওয়ামী লীগের বাইরে থেকে—মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী (ন্যাপ, ভাসানী), কমিউনিস্ট পার্টির মণি সিংহ, ন্যাপের অপর অংশ থেকে অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ, কংগ্রেসের মনােরঞ্জন ধর; তবে ওই কমিটিকে সবিশেষ কাজ করার সুযােগ না দিয়ে কেবল পরামর্শ প্রদানের মধ্যেই এর ভূমিকাকে বন্দি করে রাখা হলাে।
ওই কাগুজে কমিটির অন্যতম সদস্য, বড় পদে আসীন হয়েও যিনি ক্ষমতাবর্জিত—মওলানা ভাসানী, ১২ সেপ্টেম্বর অভিমত রাখলেন, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সঠিকভাবে জনযুদ্ধ পরিচালনার জন্য কেবল উপদেষ্টা কমিটি গঠন যথেষ্ট নয়, তজ্জন্য প্রয়ােজন হবে সর্বদলীয় জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠন করা (স্টেটসম্যান, ১৩ সেপ্টেম্বর, ‘৭১)। এর কদিন পরই, উপদেষ্টা কমিটি সম্পর্কে কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র মুক্তিযুদ্ধ প্রায় অনুরূপ অভিমত প্রকাশ করে, দেশবাসী একান্তভাবে আশা করেন যে, এই কমিটি নিছক কাগজপত্রে সীমাবদ্ধ না থাকিয়া সংগ্রামী শক্তিগুলাের ঐক্য সমন্বয়ের কার্যকর হাতিয়ারে পরিণত হউক।… সংযুক্ত কমিটি গঠনের ফলেই সংগ্রামী শক্তিগুলাের ঐক্যের সমস্যা দূরীভূত হইয়া গিয়াছে কিংবা দলীয় সংকীর্ণতা বা বিভেদ পন্থার শক্তি সম্পূর্ণরূপে পরাস্ত হইয়াছে, এ কথা মনে করা ভুল হইবে’ (সাপ্তাহিক মুক্তিযুদ্ধ, ১৯ সেপ্টেম্বর, ‘৭১)। কিন্তু উপদেষ্টা কমিটির ক্ষমতায়ন বা সংগ্রামী শক্তিগুলাের ঐক্যসাধন তাে পরের কথা, আওয়ামী-বহির্ভূত কোনাে নেতাকে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত কোনাে কমিটি গঠন করতেই নারাজ ছিলেন আবদুর রব সেরনিয়াবাত, শেখ আবদুল আজিজসহ অনেক নেতা। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই এই গ্রুপটি তাজউদ্দীন-বিরােধিতায় অবতীর্ণ হয়েছিল, মুক্তিযোেদ্ধাদের মধ্যে কমিউনিস্টদের প্রবেশাধিকার ঠেকাতে চেয়েছিল, প্রধানমন্ত্রী ও পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক—উভয় পদ থেকে তাজউদ্দীনকে সরিয়ে দেয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিল, মুজিবনগর সরকারকে গৌণ করে দিয়ে পুরাে আন্দোলনটাকে মুজিববাহিনীর নিয়ন্ত্রণে নেয়ার জন্য সর্বাত্মক প্রয়াস চালিয়েছিল। আমাদের অশেষ সৌভাগ্য যে, তাদের এই প্রচেষ্টাগুলাের কোনােটিই সফল হয়নি, যদি হতাে—তাহলে বাংলাদেশের ইতিহাস হয়তােবা ঢাকা পড়ত নিকষ কালাে অন্ধকারে।
তবে হ্যা, কিছু বিষয়ে সেরনিয়াবাত, শেখ ফজলুল হক মণি ও আওয়ামী লীগের গুটিকয় নেতা মুজিবনগর সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেও, স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তাঁরা যে সনিষ্ঠ, নিবেদিত ও দৃঢ়প্রত্যয়ী ছিলেন, এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই। তবে একজন ছিলেন। শােচনীয়ভাবে ব্যতিক্রম, খন্দকার মােশতাক আহমদ—আগাগােড়া তিনি ছিলেন তাজউদ্দীন-বিরােধিতায় সক্রিয়, এমনকি স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্বস্থানীয় পদে আসীন হয়েও, তিনি আন্দোলনের বুকে ছুরি চালানাের চেষ্টা করেছেন বারবার। স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আগরতলায় পালিয়ে গিয়েছিলেন মােশতাক, ওখান থেকে তিনি চেষ্টা করেছিলেন মক্কা শরীফে চলে যাওয়ার জন্য। কিন্তু যুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের মন্ত্রিসভায় তাঁর নাম অন্তর্ভুক্ত হতে যাচ্ছে, তাজউদ্দীনের কাছ থেকে এমন সংবাদ শুনে তিনি মক্কাগমন স্থগিত করে দেন এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদে আসীন হওয়ার পর তিনি তার অনুগামী মাহবুব আলম চাষীকে পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে বেছে নেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে গােপনীয় অবস্থান নিয়ে পিন্ডির সাথে যােগাযােগ স্থাপনে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন (বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস: ড. মােহাম্মদ হাননান, পৃ. ৩৬৯)। মােশতাকচক্রের ষড়যন্ত্রের কথা বলতে গিয়ে লরেন্স লিফশুলৎস লিখেছেন, ‘একাত্তরে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারে খন্দকার মােশতাক ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। লােকটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি চরম অনুরক্ত।
পররাষ্ট্র সচিব মাহবুব আলম চাষীকে নিয়ে তিনি একাত্তরের শেষের দিকে পূর্ব পাকিস্তান সংকট’-এর সমাধানের প্রশ্নে মার্কিন প্রস্তাব নিয়ে গােপনে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের সাথে যােগাযােগ করেছিলেন।” (বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত, পৃ. ৩৭২); মুক্তিযুদ্ধকে ভিন্ন গতিপথে প্রবাহিত করার জন্য মােশতাক আহমদ পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত যােশেফ ফারল্যান্ডের সহায়তায় বাঙালি হত্যার খলনায়ক ইয়াহিয়ার সাথেও যােগাযােগ স্থাপনে সচেষ্ট হয়েছিলেন। এ সম্পর্কে তকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার লিখেছেন, On September, Farland suggested to Yahia that we contact the Bangladesh’ foreign minister—we would tell him of Yahia’s willingeness to engage in secret talks—such was Yahia’s quandary that he agreed. (The White House Year, page 870). মুজিবনগর সরকার মােশতাকের অপতৎপরতা এক সময় টের পেয়ে যায়, তখন তার নির্ধারিত আমেরিকা যাত্রা (প্রবাসী সরকারের মুখপাত্র হয়ে জাতিসংঘে যাওয়ার কথা ছিল তার) থেকে তাকে বিরত রাখা হয়। এর কিছুদিন পর, মােশতাক-চাষীগং প্রচার করতে থাকে, ইয়াহিয়া সরকার বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার যে অভিযােগ এনেছে, এর সূত্র ধরে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। এ বিচারের অবশ্যম্ভাবী রায়—ফাঁসি। এমন অবস্থায় আমরা যদি স্বাধীনতাযুদ্ধের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকি, তাহলে বঙ্গবন্ধুকে নিশ্চিতভাবে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলতে হবে। এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা কী চাই? জীবিত বঙ্গবন্ধু, নাকি স্বাধীনতাকল্পে অনিশ্চিত যুদ্ধ? মােশতাক ভেবেছিলেন, বাঙালি যেহেতু অন্ধভাবে মুজিবভক্ত, তাই বঙ্গবন্ধু, নাকি স্বাধীনতা’ এরকম প্রশ্ন তুললে সবাই স্বাধীনতার দাবি পরিত্যাগ করে প্রিয় নেতার জীবন রক্ষার জন্য শােরগােল শুরু করবে, আর এতে মুজিবের মুক্তির বিনিময়ে প্রবহমান মুক্তি আন্দোলন স্থগিত হয়ে যাবে।
কিন্তু না, মােশতাক-চাষীর এ অপচেষ্টাটিও ব্যর্থ হলাে একসময় এবং মুজিবনগর সরকার এদের স্বাধীনতাবিরােধী অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হলাে পুরােপুরি। তখন মাহবুব আলম চাষীকে পররাষ্ট্র সচিবের পদ থেকে বরখাস্ত করা হলাে, কিন্তু খন্দকার মােশতাক শাস্তি থেকে বেঁচে যান অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের বিশেষ অনুকম্পায়। তবে স্বাধীনতাযুদ্ধের পরবর্তী দিনগুলােতে, তাকে কার্যত গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছিল। [বি. দ্র. : আওয়ামী লীগের জন্মলগ্নে খন্দকার মােশতাক আহমদ ছিলেন ওই দলের সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক আর শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন ‘জুনিয়র’ যুগ্ম সম্পাদক। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে খন্দকার মােশতাক যুক্তফ্রন্ট থেকে মনােনয়ন লাভে ব্যর্থ হন; তার এই মনােনয়ন না পাওয়ার পেছনে—শেখ মুজিবের হাত ছিল বলে তিনি সন্দেহ পােষণ করেন। ওই সময় তিনি আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন এবং বিজয়ী হন। ১৯৬৪ সালে খন্দকার মােশতাক আহমদ আবার ফিরে আসেন আওয়ামী লীগে, তবে নেতা হিসেবে তার জ্যৈষ্ঠতা বিসর্জন দিতে হয়। ততােদিনে শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র নেতা হয়ে ওঠেন, তাঁর পাশের স্থানে চলে আসেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এ এইচ এম কামারুজ্জামান, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী প্রমুখ। বস্তুত দলে নিজের এহেন অবনয়ন তিনি মেনে নিতে পারেননি। ‘৬৬-এর ৬ দফা আন্দোলনের সময় আওয়ামী লীগের ভেতরে দুটি ভাগ স্পষ্ট হয়ে ওঠে, পিডিএমপন্থিগণ (পাকিস্তান ডেমােক্রেটিক মুভমেন্ট—তারা আওয়ামী লীগ, তবে কঠিন কোনাে আন্দোলনে বিশ্বাসী নয়)–খন্দকার মােশতাকের নেতৃত্বে ছয় দফার বিপক্ষ অবস্থান নেয়। কিন্তু সুবিধা করতে না পেরে, ‘৭০-এর নির্বাচনের প্রাক্কালে মােশতাক আবারাে শেখ মুজিবের নেতৃত্বকে প্রশ্নহীনভাবে মেনে নেন। বস্তুত খন্দকার মােশতাক—যিনি শেখ মুজিবের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বারবার আবির্ভূত হয়েছেন, বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন, কিন্তু শেখ মুজিবের উদারতার সুযােগ নিয়ে প্রতিবারই পার পেয়ে গেছেন, শেষপর্যন্ত শেখ মুজিবকে উৎখাত করে তিনি তার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে সফল হয়েছেন।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সত্য অসত্য অর্ধসত্য-বিনয় মিত্র