সামরিক কর্মকর্তাদের বৈঠক
বাঙালি সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে চট্টগ্রামে অবস্থানরত ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম সর্বপ্রথম বর্বর পাকসেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন এবং সেটা শুরু হয় ২৫ মার্চ রাত পৌনে ন’টার মধ্যে, তথাকথিত ‘অপারেশন সার্চলাইট’ আরম্ভ হওয়ার প্রায় তিন ঘণ্টা আগেই। অতর্কিত আক্রমণে তিনি তার অধীন। অবাঙালি কমান্ডিং অফিসার ও বহু সৈন্যকে নিরস্ত্র বা হত্যা করেন। এরপর তিনি রেলওয়ে হিলের দিকে রওনা হয়ে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের সর্বোচ্চ পদবিধারী বাঙালি অফিসার লে. কর্নেল এম এ চৌধুরী এবং অষ্টম বেঙ্গলের মেজর জিয়াউর রহমানকে খবর পাঠান ক্যান্টনমেন্টে অবস্থানকারী সংখ্যালঘু অবাঙালি সৈন্যদের বন্দি করার জন্য। কিন্তু চৌধুরী কিংবা জিয়া রফিকের সে আহ্বানে সাড়া দেননি। জিয়া তখনও পাকিস্তানি কমান্ড মেনে সমুদ্রবন্দরের। দিকে যাচ্ছিলেন ‘সােয়াত’ জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস করার জন্য। একটু পরেই ২০তম বেলুচ রেজিমেন্টের তীব্র আক্রমণে এম এ চৌধুরীসহ হাজারখানেক বাঙালি সৈন্য অপ্রস্তুত অবস্থায় মারা যান। এ খবর শােনামাত্র জিয়া তার মত পরিবর্তন করেন, ফিরে আসেন যােলাে শহরের ঘাঁটিতে এবং অবাঙালি সৈন্যদের অঙ্ক্ষিত নিরস্ত্র করেন। এরপর ক্যান্টনমেন্ট বা শহরের দিকে না গিয়ে রাত সােয়া দুটোয় যাত্রা করেন কালুরঘাটের দিকে। দেশের অন্যান্য অঞ্চলে—গাজীপুরে মেজর সফিউল্লাহ, কুমিল্লায় মেজর খালেদ মােশাররফ, কুষ্টিয়ায় মেজর ওসমান চৌধুরী, যশােরে মেজর হাফিজ পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্ন প্রতিরােধ গড়ে তুললেও, ভারী অস্ত্র ও যােগাযােগের অভাবে সে প্রতিরােধ খুব স্থায়ী হয়নি। ইবিআর-এর বিদ্রোহী ইউনিটগুলাে ক্রমাগত পিছু হটতে থাকে এবং ওইসব ইউনিটের প্রধানগণ। পারস্পরিক যােগাযােগের ভিত্তিতে ৪ এপ্রিল সিলেটের তেলিয়াপাড়ার এক চা বাগানে মিলিত হন, প্রতিরােধযুদ্ধের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণ করার জন্য।
তেলিয়াপাড়ার বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বঙ্গবন্ধুর সামরিক উপদেষ্টা এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল এম এ জি ওসমানী, লে. কর্নেল এম এ রব, মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর খালেদ মােশাররফ, মেজর সফিউল্লাহ, মেজর কাজী নুরুজ্জামান, মেজর নুরুল ইসলাম, মেজর মমিন চৌধুরী প্রমুখ। তারা পারস্পরিক মতবিনিময়ের মাধ্যমে সমস্ত বিদ্রোহী ইউনিটের সমবায়ে সম্মিলিত মুক্তিফৌজ গঠন করেন এবং কর্নেল ওসমানীকে তা পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করেন’ (মূলধারা ‘৭১, পৃ. ১৫)। এ বৈঠকে সবাই অনুভব করেন যে, পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তুলতে হলে প্রশিক্ষিত জনবল যেমন দরকার, তেমনি দরকার ভারী অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদ। কিন্তু তা ভারত বা অন্য কোনাে দেশ থেকে সংগ্রহ করতে চাইলে স্বাধীন সরকার গঠন এর বিকল্প নেই। ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর বদান্যতায় এই সামরিকসভার সিদ্ধান্ত এবং আশু ‘চাহিদাবলী’র খবর তাজউদ্দীন আহমদের কানে পৌঁছতে খুব বেশি দেরি হলাে না।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সত্য অসত্য অর্ধসত্য-বিনয় মিত্র