পাকিস্তানের হস্তা পাকিস্তানিরাই
১৯৪০ সালের লাহাের প্রস্তাব—যার ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম, এর প্রস্তাবক একজন বাঙালি—শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক। দ্বিজাতিতত্ত্বের সূত্ৰজাত একই গােত্রভুক্ত দুই ভূখণ্ডের মানুষ—যারা সিকি শতক আগেও কাধে কাঁধ মিলিয়ে অভিন্ন লক্ষ্যে আন্দোলন করেছে, লক্ষ্য অর্জনের পর বছর খানেকও অতিক্রান্ত হয়নি, তাদের মধ্যে বিরােধ বেঁধে গেল; বারােশাে মাইল দূরবর্তী দুই ভূখণ্ড—যা কেবল ধর্মের সুতােয় আবদ্ধ, সেই সুতােতে পড়ল টান। পাকিস্তানের মােট জনসংখ্যার ৫৫% বাঙালি, অথচ রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে, সদ্য স্বাধীন দেশটিতে বাঙালির অংশীদারিত্বকে গুরুত্বই দেয়া হয়নি এবং বিস্ময়কর ব্যাপার হলাে, অধিকারবঞ্চিত বাঙালি নেতৃবৃন্দ জিন্নাহ-লিয়াকতের এই স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ‘টু’ শব্দটিও করেননি, এর কারণ কী? কারণ হতে পারে, প্রথমত, যেহেতু জিন্নাহর প্রায় একক নেতৃত্বেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা, তাই তার সিদ্ধান্তের বিরােধিতা করার মতাে হিম্মত কোনাে বাঙালি নেতারই ছিল না; দ্বিতীয়ত, দু-চারজন বাঙালি, যারা ক্ষমতার সীমিত অংশীদারিত্ব পেয়েছিলেন, তাদের কেউ-ই জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ ছিলেন না, তাই তারা জাতির চিন্তা বাদ দিয়ে নিজেদের ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য সব সময়ই পাকিস্তানি অপেক্ষাও বড় ‘পাকিস্তানি’ সাজার চেষ্টা করে গেছেন; তৃতীয়ত, জিন্নাহ কিংবা লিয়াকত আলী খান—এদের প্রায় সমপর্যায়ের দুজন নেতা, যারা বাঙালির হয়ে। প্রতিনিধিত্ব করেছেন, এঁদের একজন—হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী, যিনি নিজেই ছিলেন অবাঙালি এবং বাংলা ভাষার সাথে সম্পর্কহীন।
অন্যজন, এ কে ফজলুল হক—যার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল ধর্ম ও সম্প্রদায়ের ওপর নিবদ্ধ, জাতীয়তাবাদী চিন্তা থেকে তিনি ছিলেন যােজন যােজন দূরে। তাই দেখতে পাই, জিন্নাহ কিংবা লিয়াকত আলী খান অথবা নাজিমউদ্দীনবাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে যখনই কোনাে অন্যায্য সিদ্ধান্ত বা প্রস্তাব পেশ করেছেন, কোনাে দলের কোনাে নেতাই এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেননি, প্রতিবাদ এসেছে ছাত্রদের কাছ থেকে, সংস্কৃতিকর্মী বা শিক্ষা-সংস্কৃতি সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীদের কাছ থেকে। এঁরা রাজনৈতিক নেতাদের মতাে ক্ষমতা ও প্রাপ্তিতত্ত্ব দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন না, তাই কথিত ‘জাতির পিতা’ জিন্নাহর বিরুদ্ধে ‘না, না’ উচ্চারণ করতে তারা ভয় পাননি, ১৪৪ ধারা ভাঙতেও পিছপা হননি। নাজিমউদ্দীন-নূরুল আমীন, শেরে বাংলা, এরা বাঙালি হলেও বাংলা ভাষাকে তারা ‘ভাষা-মা’ হিসেবে চিন্তাও করতেন না, (সােহরাওয়ার্দী তাে বাঙালিই নন) ব্যস্ত থাকতেন ক্ষমতাবলয়ে থাকার জন্য, তবে ছাত্রশিক্ষক-সংস্কৃতি কর্মী-কবি-সাহিত্যিক, তারা মাতৃভাষা ও গর্ভধারিণী মাকে অভিন্ন দৃষ্টিতে দেখতে পেরেছিলেন বলেই সদ্যোজাত পাকিস্তান রাষ্ট্রে ‘রাষ্ট্রভাষা-বিষয়ক’ আন্দোলনটি এত তীব্র ও প্রবল হয়ে উঠেছিল। বস্তুত এঁদের জাতীয়তাবাদী চেতনার কাছে জিন্নাহ-নাজিমউদ্দীনের অস্ত্রসজ্জিত ধুরন্ধরতা, কৌশল, চালবাজি সবই তুচ্ছ হয়ে গিয়েছিল; তাই পাকিস্তানের ‘পিতা’, যিনি কথা ও আইনি প্যাচে মাউন্টব্যাটেন কিংবা নেহরু-প্যাটেলকে বােকা বানাতে পেরেছিলেন, তিনিই কি না বঙ্গীয় ছাত্র-যুবাদের জাতীয়তাবাদী। চেতনার কাছে হেনস্থার শিকার হয়ে গেলেন।
তাছাড়া পাকিস্তানি শাসকরা কূটকৌশলে পটু হলেও, ঐতিহ্য বা । সংস্কৃতিজ্ঞানে ছিলেন পুরােপুরি আনাড়ি। মহান কবি আল্লামা ইকবাল, বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করলেও অসংস্কৃত পাক শাসকচক্রের কাছে ছিলেন। উপেক্ষিত। সাহিত্য, সংস্কৃতি, ললিতকলায় পাকিস্তানি-দীনতার চরম। প্রতিফলন দেখা যায় জাতীয় সঙ্গীত ও রাষ্ট্রভাষা নির্বাচনের ক্ষেত্রে। যে দেশে ভাষার মর্যাদা নেই, ইকবালের মতাে মহান কবির সম্মান নেই, তারা বাঙালির। ভাষা ও তাদের কবিদের প্রতি আবেগের মর্ম কতটুকু বুঝবে? আবহমানকাল ধরে লালিত, চৈতন্যের গভীরে প্রােথিত সমন্বয়বাদী সংস্কৃতি, যা কালে কালে অতীশ দীপঙ্কর-চৈতন্য-লালন-রবীন্দ্র-নজরুল দ্বারা ক্রমশ ঋদ্ধির দিকে এগিয়ে গেছে, সেই উদার ও মানবিক সংস্কৃতি বাঙালির হৃদয়ের কতটুকু জায়গাজুড়ে আছে, এটা অসংস্কৃত-অমার্জিত, কেবল ক্ষমতাপাগল পাকশাসকদের উপলব্ধিতে আসার কথা নয়। বলদর্পী পাকশাসকরা অনুধাবন । করতে পারেননি যে, তারা যখন বাঙালির ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যে একটা করে পেরেক ঠুকেছিলেন, তখন পূর্ব ও পশ্চিমের বন্ধনের আস্তর আস্তে আস্তে আলগা হয়ে যাচ্ছিল। বস্তুত পাকিস্তানবিরােধী আন্দোলন, যার। সূচনাকারী—বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা, তাদের তৈরি করা পথে, সময়ের। দাবি মেনে একসময় এসে শামিল হলাে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন; তারা ভাষা ও সংস্কৃতিকেন্দ্রিক আন্দোলনকে ধীরে ধীরে নিয়ে গেল স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনের দিকে, যখন এই আন্দোলনকে সুসংহত ও একমুখী করার জন্য প্রয়ােজন দেখা দিল বলিষ্ঠ নেতৃত্বের, তখন, যেন সময়ের দাবি মেটাবার জন্যই রাজনীতির আকাশে দেখা দিল উজ্জ্বল এক নক্ষত্র—শেখ মুজিবুর রহমান।
পৃথিবীর ইতিহাসে স্বেচ্ছাচারী শাসকের কমতি নেই বটে, কিন্তু। ধারাবাহিকভাবে কাণ্ডজ্ঞানবর্জিত স্বৈরশাসকের সন্ধান পাকিস্তান ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যায় না, যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ একটা জাতির ভাষাকে বিলুপ্ত করে। দিতে চেয়েছে, ওই জাতির প্রাতঃনমস্য কবিকে নিষিদ্ধ করার পাঁয়তারা । করেছে, চেতনায় সদাভাস্বর কবির রচনাকে ইচ্ছেমতাে বদলে দেয়ার অপচেষ্টা। করে গেছে। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায়—যেখানে ভােটের মাধ্যমে নেতৃত্ব বাছাইরীতি সর্বসম্মতভাবে স্বীকৃত, সেখানে পাকিস্তানই বােধহয় একমাত্র দেশ, যেখানে ভােটের হিসেব চিন্তায় আনার রেওয়াজ নেই, যেখানে সেনা ও রাজনীতিকরা একাকার হয়ে সামরিক শাসন জারি করে, যেখানে যে কোনাে পদ যে কোনাে মুহূর্তে অন্যের দ্বারা দখল হয়ে যেতে পারে, যেখানে নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে ক্ষমতা অর্পণে তালবাহানা করা হয় এবং ন্যায্য পাওনা চাইতে গেলে অমানুষিক নির্যাতন বা মৃত্যুতে বিলীন হতে হয়। বাংলা ভাষায় ‘অতি’ দিয়ে অতিশয় অর্থযুক্ত কটা প্রবাদ আছে, ‘অতি চালাকের গলায় দড়ি’, ‘অতি লােভে তাঁতি নষ্ট’, ‘অতি দর্পে হত লঙ্কা’, ‘অতি বাড় বেড়াে না’—এসব নীতিকথাযুক্ত প্রবাদ বােধহয় পাঞ্জাবি ষণ্ডা’রা পড়েননি, পড়লে বুঝতে পারতেন যে, বাঙালির মাইর, দুনিয়ার বাইর’। ভোতা কোদালের ধার কম, তবে একবার ধার উঠলে তা যেমন তীক্ষতার সাথে কাজ করে, বাঙালি তেমনি অতি শান্ত, সহিষ্ণু জাতি-তবে একবার ক্ষেপে গেলে তারা কেমন ভয়ঙ্কর হতে পারে—ইতিহাসবিমুখ পাকশাসকচক্র তা অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছিল। তাই পিভি-লাহােরের শাসকচক্র—দমন-পীড়নে, অত্যাচার-নির্যাতনে বাঙালিকে যতই শৃঙ্খলিত করার চেষ্টা করেছে, বাঙালি ততই এগিয়ে গেছে স্বাধীন মানচিত্রের দিকে। প্রথমে বন্ধু, পরে পীড়নকারী শত্ৰু, সেই শত্রুকেও বন্ধু মানতে হয়, কারণ ধর্মের চাদর গায়ে জড়িয়ে যে জাতি ঘুমিয়ে পড়েছিল, তার ওপর দমন-পীড়ন বর্ষিত না হলে সেই ঘুম কবে ভাঙত, কে জানে।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সত্য অসত্য অর্ধসত্য-বিনয় মিত্র