পাকিস্তানে আবারাে উর্দি-শাসন
নবাগত সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল আগা মােহাম্মদ ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশে তাঁর প্রথম ভাষণে (২৬ মার্চ ‘৬৯) দৃঢ়কণ্ঠে বলেন, ‘শান্তিপূর্ণ এবং নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রয়াসে আইয়ুব সফল হননি।… সেনাবাহিনী আশা করেছিল, শুভবুদ্ধির জয় হবে। কিন্তু পরিস্থিতির এত অবনতি ঘটে যে স্বাভাবিক আইন প্রয়ােগ পদ্ধতি বা ব্যবস্থা প্রায় সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। সেনাবাহিনী এমন অরাজক অবস্থায় নীরব দর্শক হতে পারে না। তাদের কর্তব্য করতে হবে এবং দেশকে ধ্বংসের কবল থেকে রক্ষা করতে হবে।… সশস্ত্রবাহিনী জনগণের জন্যই; তাদের কোনাে রাজনৈতিক আকাক্ষা নেই, তারা কোনাে ব্যক্তি বা দলের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করবে না।… নিয়মতান্ত্রিক শাসন কায়েমের সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি করা ছাড়া আমার আর কোনাে আকাক্ষা নেই।’ (দৈনিক পাকিস্তান, ২৭ মার্চ ১৯৬৯)। লক্ষণীয় ব্যাপার হলাে, ইয়াহিয়া কর্তৃক সামরিক আইন জারি—পাকিস্তানের উভয় অংশে তেমন কোনাে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি। করেনি। আইয়ুবি দুঃশাসন থেকে মুক্তি পাওয়া জনগণ মন্দের ভালাে হিসেবে, অথবা ‘দেখা যাক কী হয় ভেবে ইয়াহিয়ার আগমনকে নীরবে স্বাগত জানালাে যেন। আইয়ুববিরােধী গণঅভ্যুত্থান, শেখ মুজিবের ৬ দফা, ছাত্রদের ১১ দফা দাবি—সব আন্দোলন ধীরে ধীরে মিইয়ে যেতে থাকে। এর প্রধান কারণ, নতুন সেনাশাসক সব রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন। কমরেড মােহাম্মদ ফরহাদের অভিমত, ক, আইয়ুবের সাথে “গােলটেবিল বৈঠকের পরে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল, তাতে জনসাধারণের একটা অংশের মধ্যে মার্শাল ল হওয়া অস্বাভাবিক নয়’—এই মনােভাব দেখা দিয়েছিল। জনগণের এই মনােভাব কাটিয়ে তাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে জমায়েত রাখার জন্য সুস্পষ্ট কর্মপন্থা নিয়ে কোনাে দলই কাজ করেনি।” খ, সামরিক শাসন ঘােষণার আকস্মিকতায় ব্যাপক মানুষ হতচকিত হয়ে পড়ে ইত্যাদি ইত্যাদি (ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, পৃ. ৯৯)।
তাছাড়া নতুন ফৌজি শাসকের মনােভাব ও কার্যপদ্ধতি বােঝার জন্য রাজনৈতিক দলগুলােরও বেশ কিছু সময়ের প্রয়ােজন ছিল। ইয়াহিয়া ক্ষমতা দখল করেছিলেন অনেকটা আইয়ুবি কায়দাতেই; কিন্তু আইয়ুবের ক্ষমতা দখল-সংক্রান্ত বক্তব্যে দম্ভ ছিল, জনসাধারণের প্রতি হুমকি ছিল; কিন্তু একই ব্যাপারে ইয়াহিয়ার ভাষা ছিল সংযত, নরম ও লাজুক। তাই বলদর্পী পুরনাে স্বৈরশাসককে হটিয়ে, কু-এর মাধ্যমে নতুন এক জেনারেল শাসনক্ষমতা কুক্ষিগত করে নিলেও জনতা—বিশেষত বাঙালিরা এটাকে ইতিবাচক অর্থেই গ্রহণ করেছিল এবং এর ফলে তারা যে ঠকেনি বা ভুল করেনি—এর প্রমাণ পাই বিশিষ্ট চিন্তাবিদ যতীন সরকারের লেখায়, ‘আসলে গণদুশমনদের হাত দিয়েও কখনাে কখনাে যে কিছু কিছু গণমুখী কাজ হয়ে যায়, এটিই বােধহয় সমাজ বিকাশের দ্বান্দ্বিক নিয়ম তথা ইতিহাস-বিধাতার পরিহাস। সেই পরিহাসের ফলেই ইয়াহিয়া তার রাজত্বের প্রথম দু’বছরে এমন কিছু রাজনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে বসে যেগুলাে পরিণামে বাঙালিদের মুক্তিসংগ্রামে অনেক পরিমাণে অবস্থানগত সুবিধা করে দেয়। যেমন—এই লােকটিই পশ্চিম পাকিস্তানের এক ইউনিট ভেঙে দিয়ে চারটি প্রদেশ পুনর্গঠন করে, আইয়ুবি মৌলিক গণতন্ত্রের পরােক্ষ নির্বাচনের বদলে সর্বজনীন ভােটাধিকারের ভিত্তিতে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করে এবং পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাসাম্যমূলক জনপ্রতিনিধিত্বের জায়গায় জনসংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের বিধান প্রবর্তন করে। পাকিস্তানের দু’অংশের সংখ্যাসাম্য বাতিল করে দেয়ার ফলে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের ৩১৩টি আসনের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের ভাগে পড়ে ১৬৯টি ও পশ্চিম পাকিস্তানের ১৪৪টি। আর এতেই সত্তরের নির্বাচনে বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে বেরিয়ে আসতে পারে।’ (পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু-দর্শন, পৃ. ৩০৩-৩০৪)।
৩০ মার্চ ‘৭০ ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে কিছু ‘আইনগত কাঠামাে আদেশ’ (লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার—এল. এফ. ও) জারি করেন এবং এর আওতায় নিম্নবর্ণিত পদক্ষেপ নেন : সাধারণ নির্বাচন সংক্রান্ত বিধান : ক. সর্বজনীন ভােটাধিকার, খ, ‘এক ব্যক্তি এক ভােট’ নীতি, গ, প্রত্যেক প্রদেশে জনসংখ্যার ভিত্তিতে আসনসংখ্যা বণ্টন। জাতীয় পরিষদের গঠন সংক্রান্ত বিধান : ক, জাতীয় পরিষদের আসন সংখ্যা ৩১৩; এর মধ্যে এলাকাভিত্তিক সাধারণ আসন ৩০০টি, মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত ১৩টি। সংবিধান প্রণয়ন সংক্রান্ত বিধান : এর আওতায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, পাকিস্তান হবে একটি ইসলামী প্রজাতন্ত্র; এখানে সকল নাগরিকের মৌলিক অধিকার ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত থাকবে; নতুন নির্বাচিত প্রতিনিধিবৃন্দ ১২০ দিনের মধ্যে নতুন সংবিধান অবশ্যই প্রণয়ন করবেন এবং তা করতে ব্যর্থ হলে প্রেসিডেন্ট জাতীয় পরিষদ ভেঙে দেয়ার ক্ষমতা প্রয়ােগ করতে পারবেন ইত্যাদি ইত্যাদি। এই আদেশনামায় ৫ অক্টোবর জাতীয় পরিষদের নির্বাচন এবং প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের তারিখ সুনির্দিষ্ট না করে সেটি ২২ অক্টোবরের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে বলে জানানাে হয়। পরে অবশ্য দুটো নির্বাচনের তারিখই পিছিয়ে যায় এবং সেগুলাে অনুষ্ঠিত হয় যথাক্রমে ৭ ও ১৭ ডিসেম্বর।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সত্য অসত্য অর্ধসত্য-বিনয় মিত্র