ছয় দফা স্বাধীনতার পথে প্রথম পদক্ষেপ
জন্ম থেকেই পাকিস্তান-রাজনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল ভারত-বিরােধিতা আর কমিউনিস্টদের কষে গাল দেয়া। দেশের ভেতরে যে কোনাে অপকর্মের পেছনে কার্যকারণহীনভাবে ভারত বা কমিউনিস্ট-সংশ্লিষ্টতা খোঁজা হতাে। বাঙালির সকল যৌক্তিক আন্দোলন, বলা হতাে—সবই হচ্ছে ভারতীয় দালাল এবং চরদের প্ররােচনায়। ছাত্র আন্দোলনের সূত্র ধরে আইয়ুববিরােধী প্রচারাভিযান যখন তুঙ্গে, তখন সরকারি সহায়তায় প্রথমে হিন্দু-মুসলমান, পরে বাঙালি-বিহারির মধ্যে ভয়াবহ দাঙ্গা বাধানাে হয়। এই দাঙ্গা প্রতিরােধকল্পে ইত্তেফাক পত্রিকার সম্পাদক তফাজ্জল হােসেন মানিক মিয়ার সভাপতিত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয় এবং ওই কমিটি কর্তৃক গৃহীত ইশতেহার ১৭ জানুয়ারির ইত্তেফাক, আজাদ ও সংবাদ পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় ‘পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও’ শিরােনামে প্রকাশিত হয়। পূর্ব বাংলার কুশলী নেতৃবৃন্দের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ওই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রশমিত হওয়ার পর, যেন ইচ্ছে করেই গণ্ডগােল বাধানাের অভিপ্রায় নিয়ে ইতঃপূর্বে স্থগিতকৃত শরীফ শিক্ষা কমিশনটি যাচাই-বাছাই করার জন্য বিচারপতি হামুদুর রহমানের নেতৃত্বে একটি নতুন কমিশন গঠন করা হয়। হামুদুর রহমান অযাচিতভাবে পূর্ব বাংলার ছাত্র নেতৃবৃন্দ সম্পর্কে বিরূপ ও অশালীন মন্তব্য করতে থাকেন; এর প্রেক্ষিতে ছাত্র আন্দোলন আবারাে দানা বাঁধতে থাকে। ঠিক একই সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণও আইয়ুবি অপশাসনের বিরুদ্ধে কথা বলা শুরু করেন।
এরই মধ্যে মৌলিক গণতন্ত্রীদের ভােটে ফাতিমা জিন্নাহকে হারিয়ে আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং নিজের অবস্থান শক্ত করার জন্য ‘কাশ্মীরের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আদায়ের নামে শােচনীয়। অবিমৃশ্যকারিতায় ভারত আক্রমণ করে বসেন। ১৭ দিনব্যাপী যুদ্ধে আইয়ুবের অর্জন তাে দূরের কথা, বরং ওই যুদ্ধের অপমানজনক পরিণতিই ধীরে ধীরে পতনের দিকে নিয়ে গিয়েছিল তাঁকে। পাক-ভারত যুদ্ধকালীন অবস্থার প্রেক্ষিতে বাঙালির জনচিত্তে নতুন চিন্তার উদ্রেক হয়। যুদ্ধকালীন ১৭ দিন বাঙালি সেনারা পশ্চিম অংশে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করলেও, পূর্ব বাংলা ছিল সম্পূর্ণভাবে অরক্ষিত এবং পশ্চিম পাকিস্তানসহ সারা পৃথিবী থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন; সে সময় ভারত যদিও পূর্ব বাংলার কোনাে অংশে আক্রমণ পরিচালনা করেনি, তবু ওই সময়ে রাষ্ট্রকর্তৃক পূর্বাংশের নিরাপত্তা বিধান না করার প্রশ্নটি বাঙালিকে নতুন করে ভাবিয়ে তােলে। বিশেষত নিজেদের সামরিক ও অর্থনৈতিক অসহায়ত্বের চিত্রটি নতুন আঙ্গিকে প্রতিভাত হয়ে ওঠে। এতদিন পূর্ব বাংলার জনগণ পশ্চিমাদের অপশাসন, শশাষণ ও অত্যাচারের স্বরূপটি প্রত্যক্ষ করেছে। এবার তাদের সামনে বড় হয়ে দেখা দিল নিরাপত্তার প্রসঙ্গটি। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চাকরি, জীবনের নিরাপত্তা—সবদিক থেকে বঞ্চনার শিকার বাঙালি জাতির প্রাপ্য অধিকার অর্জন ও ভাগ্য পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে অবশেষে উপস্থাপিত হলাে ঐতিহাসিক ছয় দফা, শেখ মুজিবুর রহমানের মাধ্যমে।
২১ ফেব্রুয়ারি ‘৬৬ আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে ৬ দফা কর্মসূচি আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমােদন লাভ করে এবং ১৮ মার্চ শেখ মুজিবের নামে আমাদের বাঁচার দাবী : ৬-দফা কর্মসূচীশীর্ষক একটি পুস্তিকা জনসাধারণের মধ্যে প্রচার করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। প্রকৃতপক্ষে ৬ দফা হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রথম স্মারক, যেখান থেকে বাঙালির মুক্তিসংগ্রাম নতুনভাবে গতিলাভ করেছিল। আর কোনাে বিষয়ের দিকে না তাকিয়েও বলা যায়, শেখ মুজিব এক পাকিস্তানে যে দুটি স্বতন্ত্র মুদ্রা ব্যবস্থার প্রস্তাব করেছিলেন, তা আর কিছুই নয়-বাংলাদেশে স্বাধীনতার লক্ষ্য থেকেই।’ (বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস : ড. মােহাম্মদ হাননান, পৃ. ১৩২)। ৬ দফা সম্পর্কে বিশিষ্ট রাজনীতিক অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ জানিয়েছেন, “৬ দফা পরিকল্পনা পেশের সময় শেখ মুজিব তাঁকে এবং রুহুল কুদ্সকে ডেকে বলেছিলেন, ‘আসলে এটা ৬ দফা নয়—এক দফাই, ঘুরিয়ে বললাম শুধু।…’৪৭ সালে কলকাতা থেকে এসেই শেখ মুজিব ‘পাঞ্জাবি খেদাও’-এর ডাক দিয়েছিলেন। তিনি এটা প্রকাশ্যেই করতেন। মুজিব যা বিশ্বাস করতেন, তা অবশ্যই করে ছাড়তেন, কখনাে নানা কৌশলে করতেন; কিন্তু কাজটা তিনি ঠিকই করে ছাড়তেন। ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদে মােজাফফর আহমদ কর্তৃক উত্থাপিত আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাব আওয়ামী লীগের বিরােধিতা সত্ত্বেও মুজিব তা প্রকাশ্যে সমর্থন করেছিলেন।” (সাক্ষাৎকার : অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ)। ৬ দফার পক্ষে সমর্থন আদায়ের জন্য শেখ মুজিব পূর্ব বাংলা চষে বেড়াতে লাগলেন। পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন মহল, যেমন আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আবদুল হাই চৌধুরী ছয় দফার আন্দোলনকে রাষ্ট্রবিরােধী তৎপরতা’ বলে অভিহিত করেন। ১৬ মার্চ রাজশাহীতে বসে স্বয়ং আইয়ুব খান বলেন, “ছয় দফা হিন্দু আধিপত্যাধীন যুক্তবাংলা’ গঠনের ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছু নয় এবং এটা বাস্তবায়িত হলে পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানেরা পশ্চিম বাংলার বর্ণ হিন্দুদের গােলামে পরিণত হবে।” তিনি হুমকি দিয়েছিলেন যে, ছয় দফা নিয়ে চাপাচাপি করলে অস্ত্রের ভাষায় উত্তর দেয়া হবে।
বস্তুত ছয় দফার সূত্র ধরে শেখ মুজিবসহ আওয়ামী লীগের অন্য নেতৃবৃন্দের ওপর চরম জুলুম ও নির্যাতন নেমে আসে। ছয় দফা সম্পর্কে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ভূমিকা ছিল রহস্যজনক। ভাসানী নিজেও পূর্ব পাকিস্তানের জন্য স্বায়ত্তশাসন দাবি করেন, কিন্তু তিনি আওয়ামী লীগের ছয় দফার কঠোর সমালােচনা করেন। তিনি ১৯৬৬ সালের ১২ জুন ছয় দফার পাল্টা ১৪ দফা কর্মসূচি ঘােষণা করেন।’ (বাংলাদেশের ইতিহাস ১৯৪৭-১৯৭১ : ড. মােঃ মাহবুবর রহমান, পৃ. ১৯৪)। ছয় দফার বিরুদ্ধে মওলানা ভাসানী খােলাখুলি অভিমত প্রকাশ করেন ১৯৬৭ সালের ৩০ নভেম্বর, রংপুরে, ন্যাপের বিশেষ অধিবেশনে তাঁর প্রদত্ত ভাষণে : পাকিস্তানের একচেটিয়া পুঁজিপতি গােষ্ঠীর সাথে বাঙালি পুঁজিপতি গােষ্ঠীর দ্বন্দ্বকেই ৬-দফার নামে স্বায়ত্তশাসনের লেবাস পরাইয়া হাজির করানাে হইয়াছে।… অবাঙালি আদমজি, দাউদের স্থলে কয়েকজন বাঙালি আদমজি দাউদ সৃষ্টিই যদি ৬-দফার লক্ষ্য হইয়া থাকে, তবে স্বায়ত্তশাসনের নামে বাংলার কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষ কোনােদিনই তার জন্য বুকের রক্ত ঢালিতে যাইবে না। কেননা, যে ৬-দফা কর্মসূচিতে বাংলার কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের অধিকারের কোনাে স্বীকৃতি নাই, স্বায়ত্তশাসনের নামে সেই ৬-দফা ভিত্তিক তথাকথিত স্বায়ত্তশাসনের অধিকার অনিবার্যভাবেই… শশাষণ-পীড়ন চালাইবার অধিকারে পর্যবসিত হইবে। (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৯৩)।
বাস্তবিকপক্ষে, শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের সমকালীন নেতৃবৃন্দ অপেক্ষা অনেক বেশি প্রাগ্রসর, দৃঢ়চিত্ত এবং স্বাধীনচেতা ছিলেন। নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে দলের সিনিয়র নেতৃবৃন্দ যখন গা বাঁচিয়ে চলতেন, স্পষ্টভাষী এবং প্রত্যয়ী শেখ মুজিবের সাথে তাদের তখন মতপার্থক্য দেখা দিত। ষাটের দশকে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের তথ্য অধিদপ্তরের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা শামসুজ্জামান চৌধুরী এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, ১৯৬৬ সালে করাচিতে ৬ দফা দাবি উত্থাপন করার সুযােগ না পেয়ে, ঢাকায় ফিরে এসে তিনি তার বাসভবনে ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দকে ডেকে পাঠান (১৩ এপ্রিল) এবং আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ সম্পর্কে হতাশা প্রকাশ করে বলেন, এঁদের অধিকাংশই মুসলিম লীগ থেকে এসেছে—হতাশ হয়ে, সুযােগ-সুবিধা না পেয়ে। তাদের দিয়ে ৬ দফার আদর্শ বাস্তবায়ন করা যাবে না। আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতাদের একটা বড় অংশ পাকিস্তানপন্থি বলে শেখ মুজিব এদিন তাঁর সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে জেলায় জেলায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব দখল করার জন্য ছাত্রলীগের তরুণ নেতাদের নির্দেশ দেন এবং ৬ দফার ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা করতে বলেন।’ (বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, পৃ. ১৩৩)। ৮ মে, নারায়ণগঞ্জ থেকে, পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা বিধির ৩২(১)ক ধারায় শেখ মুজিব, তাজউদ্দীনসহ বেশ ক’জন আওয়ামী লীগ নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। নেতৃবৃন্দের মুক্তির দাবিতে তাদের অনুসারীরা ৭ জুন সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয়। ওই ধর্মঘট বানচাল করার জন্য আইয়ুবি গুণ্ডাবাহিনী ও পুলিশি হামলায় কমপক্ষে ১০ জন নিহত হন। শত নির্যাতনের মুখেও শেখ মুজিব নির্দেশিত ছয় দফার প্রচার-প্রচারণা অব্যাহত রাখা হয় এবং এ দাবির গ্রহণযােগ্যতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে।
এদিকে ২০ জুন ‘৬৭ রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানের সংসদ চলাকালীন সরকারদলীয় নেতা খান আবদুর সবুর খান পুরনাে বিতর্ককে নতুন করে টেনে আনেন। তিনি বলেন, ইদানীং পূর্ব বাংলার সাংস্কৃতিক পুনরুজ্জীবনের অশুভ তৎপরতা লক্ষ করা যাচ্ছে। পহেলা বৈশাখ ও রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপনের নামে বিদেশি সংস্কৃতি অনুপ্রবেশ করে ইসলামী জীবনাদর্শের ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তানের মূলে আঘাত হানছে। বক্তৃতার এক পর্যায়ে তিনি বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ বাঙালি মনীষীকে ‘চক্রান্তকারী হিসেবে অভিহিত করেন। ২২ জুন সংসদ সদস্য ড. আলীম আল রাজীর এক প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে কেন্দ্রীয় তথ্যমন্ত্রী খাজা সাহাবুদ্দীন। জানান, রবীন্দ্রনাথের গানের প্রচার যথাসম্ভব কমিয়ে দেওয়া হয়েছে, তার যে রচনা পাকিস্তানি আদর্শের পরিপন্থী বিবেচিত হবে, সেগুলাের প্রচার ভবিষ্যতে সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেওয়া হবে।’ (পাকিস্তানি জাতীয় সংসদের রিপাের্ট, ১৯৬৭, পৃ. ১৯৪০)। পাকিস্তানের কয়েকজন মাওলানা এক বিবৃতিতে (৩০ জুন ‘৬৭) বলেন, পাকিস্তান সৃষ্টির প্রথম দিন হইতেই এই সকল সঙ্গীতের আবর্জনা হইতে রেডিও-টেলিভিশনকে পবিত্র রাখা প্রয়ােজন ছিল।’ (দৈনিক আজাদ, ১ জুলাই ‘৬৭)। রবীন্দ্র-বিষয়ে ওইসব নােংরা ও বিদ্বেষমূলক বক্তব্যকে সমর্থন জানিয়ে তখন বিবৃতি দিয়েছিলেন আবুল মনসুর আহমদ, ইবরাহিম খাঁ, তালিম হােসেন, ফররুখ আহমদ, মুজিবুর রহমান খান প্রমুখ। সাহিত্যিক। আর এসব অপপ্রচারের বিপক্ষে বিবৃতি দিয়েছিলেন ড. কুদরাতই-খুদা, জয়নুল আবেদিন, অধ্যাপক আবদুল হাই, হাসান হাফিজুর রহমান, মুনীর চৌধুরী, ড. আহমদ শরীফ, ড. নীলিমা ইব্রাহীম, সুফিয়া কামাল, শামসুর রাহমান, ড. আনিসুজ্জামান প্রমুখ প্রগতিশীল লেখক ও চিন্তাবিদ। বস্তুত সংস্কৃতিসেবীদের প্রবল বিরােধিতার মুখে তথ্যমন্ত্রী খাজা সাহাবুদ্দীন তার রবীন্দ্র-বিরােধী বক্তব্য প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন (৪ জুলাই ‘৬৭)।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সত্য অসত্য অর্ধসত্য-বিনয় মিত্র