ভারত বিভক্তি মওলানা আজাদের ভবিষ্যদ্বাণী
মহাত্মা গান্ধী, ভারতের স্বাধীনতা-আন্দোলনের প্রাণপুরুষ, জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ভারতবিভক্তিকে মেনে নিতে পারেননি। অবিভক্ত ভারতপ্রশ্নে মওলানা আবুল কালাম আজাদও ছিলেন গান্ধীর অনুসারী, কিন্তু স্বাধীনতাপাগল ভারতবর্ষে, যে কোনাে মূল্যে স্বাধীনতা চাই’—এমন হুজুগে সমাজে গান্ধী আজাদ হয়ে গেলেন খুবই সংখ্যালঘু। তাই একদিকে ইংরেজদের প্ররােচনা, সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেলের প্রবল উৎসাহ এবং নেহরুর নীরব সম্মতিজ্ঞাপন, অন্যদিকে পাকিস্তানের জনক হওয়ার নিমিত্তে মরণব্যাধিতে আক্রান্ত জিন্নাহর ব্যগ্রব্যাকুলতা—এসবের সূত্র ধরে শেষ পর্যন্ত ধর্মভিত্তিক দুটি রাষ্ট্র ভারতপাকিস্তানের জন্ম অনিবার্য হয়ে উঠল। পূর্ব বাংলা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বিধায় এটি যুক্ত হলাে মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমি পাকিস্তানের সাথে, আর হিন্দু অধ্যুষিত পশ্চিমবঙ্গ গেল ভারতের ভাগে। তৎকালীন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর প্রস্তাবে সেদিন কর্ণপাত করল না কেউ ‘বাংলাদেশ বিভক্ত করা যায় না। আমি এক যুক্ত ও বৃহৎ বাংলাদেশ গঠনের পক্ষপাতী। যদি বাংলাদেশ বিভক্ত হয় তাহলে তা সমগ্র বাঙ্গালির আত্মহত্যার সমতুল্য হবে। (স্বাধীন বঙ্গভূমি গঠনের পরিকল্পনা : প্রয়াস ও পরিণতি, অমলেন্দু দে, পৃ. ০৭)। উল্লেখ্য যে, বাংলা-বিভাজন সম্পর্কে তৎকালীন বিধানসভার সদস্যদের মনােভাব যাচাই করবার জন্য গােটা বাংলাকে ‘মুসলিমপ্রধান এলাকা ও ‘হিন্দুপ্রধান এলাকা’—এই দুই ভাগে ভাগ করে ১৯৪৭ সালের ২০ জুন ভােট গ্রহণ করা হয়। এতে মুসলিমপ্রধান এলাকায় পাকিস্তানের সাথে যােগদানের পক্ষে-বিপক্ষে ভােটের অনুপাত দাঁড়ায় ১০৭ ঃ ৩৪ এবং হিন্দুপ্রধান এলাকায় ভারতের সাথে যােগদানের পক্ষে-বিপক্ষে ভােটের অনুপাত দাঁড়ায় ৫৮ ঃ ২১।
মুসলিম প্রধান এলাকার যে ৩৪ জন সদস্য বাংলা-বিভাজনের পর পাকিস্তানের সাথে যােগ না দিয়ে ভারতের সাথে সংযুক্ত হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন—তারা সবাই ছিলেন কংগ্রেস দলীয় সদস্য। অন্যদিকে হিন্দুপ্রধান এলাকার যে ২১ জন বিধায়ক, ভারত নয়—পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হওয়ার জন্য ভােট প্রদান করেছিলেন, তারা সবাই ছিলেন মুসলিম লীগ দলীয় সদস্য। বাংলা-ভাগের ভােটাভুটিতে বাঙালির অন্যতম শীর্ষ নেতা শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক—কোনাে পক্ষেই ভােট দেননি, তিনি সচেতনভাবে ওই ভোেট-প্রক্রিয়া থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখেন। (বাঙালির ইতিহাস : ড. মােহাম্মদ হাননান, পৃ. ১৩২, ১৩৫)। সেদিন পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রগঠনের তুমুল বিরােধিতা করে মওলানা আজাদ বলেছিলেন, মুসলিম লীগ বর্ণিত পাকিস্তান পরিকল্পনাটির সম্ভবপর সমস্ত দিক থেকে আমি বিচার করে দেখেছি।… ভারতের মুসলমানদের ভাগে এর কী ফলাফল ঘটতে পারে একজন মুসলমান হিসেবে আমি তা যাচাই করে দেখেছি। পরিকল্পনাটির সমস্ত দিক বিচার করে আমি এই সিদ্ধান্তে পৌছেছি যে, এটি শুধু সারা ভারতের পক্ষেই নয়, বিশেষ করে মুসলমানদের পক্ষেও হানিকর। এবং বস্তুতপক্ষে এতে সমস্যা যত না মিটবে তার চেয়ে ঢের বেড়ে যাবে। | এ কথা স্বীকার না করে পারছি না যে, পাকিস্তান শব্দটাই আমার কাছে। অরুচিকর। এ থেকে মনে হয় পৃথিবীর কতকাংশ শুদ্ধ, বাকি সব অশুদ্ধ। শুদ্ধ অশুদ্ধ বলে এলাকা ভাগ করা ইসলাম বহির্ভূত; এর সঙ্গে বরং সেই গোড়া ব্রাহ্মণদের মিল বেশি, যা মানুষ আর দেশকে শুচি আর স্নেচ্ছে ভাগ করে।… অধিকন্তু এ রকম মনে হয় যে, পাকিস্তান পরিকল্পনার পেছনে রয়েছে একটা হার মানার লক্ষণ। ইহুদিদের জাতীয় বাসভূমির দাবির ছকে এটি খাড়া করা হয়েছে।… বাপ-দাদার কাছ থেকে যে সম্পদ আমি পেয়েছি, তা ছেড়ে দিয়েই শুধু তার একটা টুকরাে মাত্র নিয়ে খুশি হওয়া—আমার কাছে এটা নিশ্চিতভাবে কাপুরুষতা বলে মনে হয়।… বর্তমানের উন্মাদনা কেটে গেলে এবং ঠাণ্ডা মাথায় বিষয়টি বিবেচনা করার অনুকূল সময় হলে, আজকের সমর্থকেরা নিজেরাই পাকিস্তানকে মুসলিম স্বার্থের পক্ষে হানিকর বলে তা অগ্রাহ্য করবে।… ভারতের যা অবস্থা, তাতে কোনাে কেন্দ্রীভূত এবং একীভূত সরকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য।
তেমনি ভারত ভাগ করে দু’টি রাষ্ট্র গড়ার চেষ্টাও নিস্ফল হবে। এর পরই মওলানা আজাদের দ্ব্যর্থহীন উক্তি, ‘পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা মুসলমানদের জন্য আত্মহত্যা।’ নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আজাদের অমােঘ ভবিষ্যদ্বাণী, “অযােগ্য রাজনৈতিক নেতৃত্ব সামরিক শাসন ডেকে আনবে, যা নাকি অনেক মুসলমান রাষ্ট্রে ঘটেছে।… পাকিস্তানকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র (চলবে)। এ অবস্থায় পাকিস্তানের স্থায়িত্ব খুবই একটা চাপের মুখে পড়বে এবং কোনাে মুসলিম রাষ্ট্র থেকেই কার্যকরী সাহায্য পাওয়া যাবে না। অন্য রাষ্ট্রগুলাের কাছ থেকে শর্তসাপেক্ষে সাহায্য পাওয়া যেতে পারে, তবে পাকিস্তানের মূলমন্ত্র ও রাষ্ট্রকে এর জন্য প্রচুর মূল্য দিতে হবে।” | পাকিস্তান রাষ্ট্রের পূর্বাংশ অর্থাৎ পূর্ব বাংলার ভবিষ্যৎ তিনি যেন দিব্যদৃষ্টি দিয়ে দেখতে পেয়েছিলেন, ‘আরেকটা বিষয় মি. জিন্নাহর দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। সেটা হচ্ছে বাংলাদেশ। তিনি জানেন না, বাংলাদেশ বাইরের কোনাে নেতৃত্ব মেনে নেয় না। আজ কিংবা কাল তারা সে নেতৃত্ব অস্বীকার করবে।… বাংলাদেশের পরিবেশ এমনই যে, বাঙালিরা বাইরের নেতৃত্ব অপছন্দ করে এবং তখনই বিদ্রোহ করে, যখন তাদের অধিকার বা সুযােগ-সুবিধা বিশেষভাবে ক্ষুন্ন হওয়ার আশঙ্কা আছে। যতদিন জিন্নাহ ও লিয়াকত আলী জীবিত আছেন ততদিন পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রতি তাদের বিশ্বাস থাকবে। কিন্তু ওরা যখন থাকবেন না তখন যে কোনাে ছােটো ছােটো ঘটনায় ওদের মধ্যে অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠবে। আমি মনে করি পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে একসঙ্গে থাকা মােটেই সম্ভব নয়।… পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা, নিয়ম-কানুন, আচার-ব্যবহার পশ্চিম পাকিস্তান থেকে একেবারে আলাদা। পাকিস্তান সৃষ্টির প্রাক্কালে এখন ওদের মনে যে উষ্ণতা আছে, তা পরে ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাবে এবং বিরােধ ও প্রতিবাদ দানা বেঁধে উঠবে। তখন বাইরের শক্তিগুলাে এতে ইন্ধন জোগাবে ও একসঙ্গে এই খণ্ড আলাদা হয়ে যাবে।'(ভারত স্বাধীন হল : মওলানা আবুল কালাম আজাদ, অনুবাদ- সুভাষ মুখােপাধ্যায়, পৃ. ১৩৭-১৩৯)। বস্তুত বিজ্ঞ রাজনীতিক মওলানা আবুল কালাম আজাদের এই ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে ফলতে শুরু করল পাকিস্তান নামক অপরাষ্ট্রটি জন্ম নেয়ার পরপরই।
নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তান : অসঙ্গতি আর অসঙ্গতি
মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমির জিগির তুলে মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বে যে পাকপবিত্র (?) নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হলাে, সেই রাষ্ট্রের জনক মুখে ‘ইসলাম ইসলাম’ বললেও প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন ঘাের নাস্তিক। তিনি কখনাে নামাজ পড়তেন না, রােজা রাখতেন না। মহান সৃষ্টিকর্তা এবং পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কুরআন সম্পর্কে তাঁর না ছিল জ্ঞান, না ছিল আগ্রহ। বস্তুত দাদার আমল থেকে কনভার্টেট মুসলিম জিন্নাহ না বেশে, না জীবনাচরণে, না চিন্তা চেতনায়—কোনাে দিক থেকে সাচ্চা ধার্মিক তাে দূরের কথা, বরং ইসলাম ধর্মের মূল বিধি-বিধানকে উপেক্ষা করে চলতেন। ল্যারি কলিন্স ও দোমিনিক লাপিয়ের-এ দুজনের লেখা ‘ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট’ নামক বিশ্বখ্যাত গ্রন্থে জিন্নাহ সম্পর্কে আলােকপাত করা হয়েছে এভাবে, ভারতীয় মুসলমানদের অবিরােধী নেতা হওয়ার উপযুক্ত ছিলেন না জিন্নাহ। উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া ঠাকুরদাদার ইসলাম ধর্মটুকু ছাড়া আর কোনােকিছুর মধ্যেই তার মুসলমানী খানদান ছিল না। তিনি মদ্যপান করতেন, শুয়ােরের মাংস খেতেন। রােজ সকালে নিয়ম করে দাড়ি কামাতেন এবং যে নিয়মনিষ্ঠা নিয়ে এসব নিষিদ্ধ কাজ করতেন, সেই নিয়মনিষ্ঠা মেনেই শুক্রবার দিন মসজিদে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন। জিন্নাহর মানসচোখে যে জগতের প্রতিফলন হয়েছিল সেখানে ঈশ্বর বা কুরআনের কোনাে স্থান ছিল না। এমনকি তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ গান্ধীজীও পবিত্র কুরআন থেকে যতটুকু উদ্ধৃতি দিতে পারতেন, তিনি সেটুকুও পারতেন না। ভারতের লক্ষ লক্ষ মুসলমান জনসাধারণ বংশপরম্পরায় তাদের মাতৃভাষা উর্দুতে যে ভাব প্রকাশ করতে পারত, সেই উর্দু জবানে দশটা বাক্য গুছিয়ে বলার মুরদ বা যােগ্যতাও তার ছিল না।
তবু শ্রদ্ধাভক্তিতে গদগদ হয়ে ভারতের অসংখ্য উর্দভাুষী মুসলমান এই মানুষটিকেই তাদের সর্বজনশ্রদ্ধেয় নেতার আসনে বসিয়েছিল সেদিন।… সাধারণ মানুষকে রীতিমতাে হেয় জ্ঞান করতেন তিনি। ওদের ছেড়া ময়লা পােশাক, কোলাহলময় জীবনযাত্রা, এখানকার উৎকট গরম এ সবের কিছুই তার সইতাে না।’ (পৃ. ১১৯)। পাকিস্তানের অন্য নেতৃবৃন্দ যেমন লিয়াকত আলী খান, বগুড়ার মােহাম্মদ। আলী (প্রথম বিয়ে খ্রিস্টান রমণী, দ্বিতীয় বিয়ে নিজের বাসার কাজের মহিলা), ফিরােজ খান নুন (বিয়ে করেছিলেন খ্রিস্টান মহিলাকে), হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী (বিয়ে করেছিলেন রাশিয়ান মহিলাকে) তারা রাজনীতির মাঠে। গলা চড়িয়ে ধর্মের কথা বলতেন, কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে ধর্মকে ‘থােড়াই কেয়ার’ করতেন। সে-তুলনায় বাঙালি নেতৃবৃন্দ অনেক বেশি ধর্মপ্রাণ হলেও, তারা পাক-নেতাদের কাছে গণ্য হতেন ‘হিন্দুঘেঁষা’ কাফের হিসেবে। অন্যদিকে পাকিস্তান আন্দোলনে পূর্ব বাংলা এবং উত্তর প্রদেশের সামন্ত। অভিজাত মুসলিম সম্প্রদায় সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করলেও, ঘটনাচক্রে এর পুরাে কৃতিত্ব চলে যায় জিন্নাহর কজায় এবং এর ফলে যে। উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ওই আন্দোলনের সূত্রপাত ও বিকাশ, পাকিস্তান।
সৃষ্টিতে সর্বভারতীয় পর্যায়ের মুসলিম জনসংখ্যার সামগ্রিক প্রতিনিধিত্ব কিংবা আশা-আকাক্ষার কোনাে প্রতিফলন ঘটেনি।’ (বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস, প্রফেসর সালাহ্উদ্দীন আহমদ ও মােনায়েম সরকার প্রমুখ সম্পাদিত, পৃ. ২১)। | পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের ভূখণ্ডগত ব্যবধান ১২০০ মাইলের চেয়েও বেশি, যা একটি আধুনিক জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের সার্বিক বিকাশের জন্য অন্যতম অন্তরায়। তাছাড়া দুই পাকিস্তানের মধ্যবর্তী অংশজুড়ে ভারত রাষ্ট্রের ব্যাপ্তি। যাদের শত্রু হিসেবে বিবেচনা করে জন্ম নিল দ্বিখণ্ডিত মুসলিম দেশটি—তাদের দুই অংশের সর্বপ্রকার যােগাযােগের জন্য বিধর্মী ভারত প্রতিবন্ধক হয়ে রইল। পাকিস্তানের জন্মলগ্নে, মুসলিম জোশ সক্রিয় থাকায়, এ-বিষয়টি নিয়ে কেউ মাথা ঘামাননি, অথবা বলা যায়, মাথা ঘামাতে চাননি। কেউ। এর ফল শুভ হয়নি, পূর্ববঙ্গের বাঙালিরা যখনই ন্যায্য অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সক্রিয় হয়েছে, পাক শাসকচক্র গত্বাঁধা সুরে প্রচার করেছে, এ আন্দোলনের পেছনে ভারতের প্রত্যক্ষ মদদ আছে; এ-জাতীয় আন্দোলনকারী মাত্রই হিন্দু ভারতের দালাল’ এবং পাকিস্তান তথা ইসলাম ধর্মের ঘােরতর শত্রু।
পাকিস্তান রাষ্ট্রের জনক, যাঁকে শ্রদ্ধাভরে বলা হতাে কায়েদে আজম বা ‘পাকিস্তানের পিতা’ (হাস্যকর ব্যাপার এই যে, জিন্নাহর বােন ফাতেমা জিন্নাহকে একই সাথে বলা হতাে ‘মাদারে মিল্লাত’ বা ‘পাকিস্তানের মাতা’; ভাই-বােন কী করে একই জাতির পিতামাতা হয়—ব্যাপারটা খুব গােলমেলে বৈকি।) তিনি ছিলেন দাম্ভিক ও অহংকারী। পাকিস্তান জন্মের পর তিনি নাকি গর্ব করে বলেছিলেন—যা তার জীবনীকার ও ঘনিষ্ঠ সহচর এম, এইচ সয়িদের লেখায় পাওয়া যায় ‘Jinnah is on record to have claimed : I have won Pakistan with the help of my secretary and his typewriter. (The sound of fury. A political study of MA Jinnah, New Delhi, Document Press 1981, page 347).’ জিন্নাহ সাহেবের এ ধরনের একদেশদর্শী বক্তব্য পাকিস্তান-আন্দোলনকারী অন্য নেতৃবৃন্দকে চরমভাবে আহত করত। কিন্তু অন্যদের মতামতকে গুরুত্ব দেয়ার নজির জিন্নাহর অভিধানে নেই। তাই নতুন রাষ্ট্রের গভর্নর হওয়া মাত্র পুরাে স্বৈরাচারী কায়দায় নিজের খেয়াল-খুশিমতাে করাচিকে পাকিস্তানের রাজধানী হিসেবে ঘােষণা করেন। (পরবর্তীকালে এই ধারা অনুসরণ করেন জেনারেল আইয়ুব খান, তিনি নিজ প্রদেশের দুটি শহরে—প্রথমে রাওয়ালপিন্ডিতে, পরে।
ইসলামাবাদে দুবার রাজধানী স্থানান্তরিত করেছিলেন। কিন্তু কোনাে গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যের নিরিখেই করাচি কখনাে সমগ্র পাকিস্তানের রাজধানী হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না। কারণ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের বসবাস পূর্ব পাকিস্তানে, আবার সমগ্র পাকিস্তানের মধ্যে ঢাকাই সবচেয়ে বনেদি, বড় ও জনবহুল শহর, বিধায় ঢাকাকেই পাকিস্তানের রাজধানী করা অধিকতর যুক্তিসঙ্গত ছিল। কিন্তু অপরাষ্ট্র পাকিস্তানের কর্তাব্যক্তিদের মধ্যে না ছিল যুক্তিবােধ, না ছিল গণতান্ত্রিক মানসিকতা। | নতুন দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে যে গানটি নির্বাচিত করা হলাে, সেটি ফার্সি ভাষায় রচিত ‘পাকসার জামিন, সা’দ বাদ,’ গানের গীতিকার আবদুল হাফিজ জলন্ধরী (তিনি পাকিস্তানের বিখ্যাত কেউ নন)। রসাত্মক ব্যাপার হলাে, ওই ফার্সি ভাষা পাকিস্তানের কোনাে অঞ্চলেই চালু ছিল না। পুরােপুরি অপরিচিত, ভিনদেশি ভাষার একটা সঙ্গীতকে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে মর্যাদাদান—ওই দেশের রাষ্ট্রনেতাদের প্রজ্ঞার পরিচয় বহন করে না। তাছাড়া যে ভাষাটিকে রাষ্ট্রভাষার সম্মানে অভিষিক্ত করা হলাে, সেই উর্দু পাকিস্তানের কোনাে প্রদেশেরই প্রচলিত ভাষা নয়। প্রাদেশিক ভাষাগুলাে হলাে যথাক্রমে পাঞ্জাবি, সিন্ধি, বালুচি, পশতু এবং বাংলা। পাকিস্তানের শতকরা মাত্র দুই ভাগ লােক, যারা উর্দু ভাষাভাষী অন্য অঞ্চল থেকে আগত, সেই চরম সংখ্যালঘিষ্ঠের ভাষাটি কোনােভাবেই রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পাওয়ার কথা নয়। ভাষাভাষীর সংখ্যাগত বিচারে পুরাে পাকিস্তানের শতকরা ৫৫ ভাগ মানুষের মাতৃভাষা হলাে বাংলা। সে প্রেক্ষিতে অখণ্ড পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হওয়ার কথা বাংলা। কিন্তু অবিমৃশ্যকারী পাক শাসকগােষ্ঠী যুক্তির পথে না হেঁটে, বাঙালির চাওয়া পাওয়াকে ন্যূনতম গুরুত্ব না দিয়ে একচোখা নীতি অবলম্বন করে দেশ চালাতে লাগলেন।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সত্য অসত্য অর্ধসত্য-বিনয় মিত্র