বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ১৪ই ফেব্রুয়ারী, বৃহস্পতিবার, ২রা ফাল্গুন, ১৩৮০
এই মানসিকতার অবসান হোক
খবরগুলো বেশ বিচ্ছিন্ন। কোনটার সাথে কোনটার যোগাযোগ নেই। আপাতঃ দৃষ্টিতে তাই মনে হয় এবং হবার কারণও আছে যথার্থ। কিন্তু তবুও যেন একই সূত্রে গাঁথা। গতকালকের পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবর। চাটগাঁও বন্দরে শুল্ক কর্মচারীরা আকস্মিকভাবে একদিন ধর্মঘট পালন করেছেন। বন্দরে কর্মরত শুল্ক বিভাগীয় কোন কর্মচারী এদিন কাজে যাননি। অফিসে যারা উপস্থিত ছিলেন তাঁরা কলম ধরেন নি। অবশ্য তাদের এই ধর্মঘটের কোন কারণ জানা না গেলেও তাদের এই আকস্মিক ধর্মঘটে জাতির আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত হতে পারে বলে ধারণা করা যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, এতে দেশের সামগ্রিক দ্রব্য ঘাটতির পরিমাণও বেড়েছে। অচল হয়েছে ব্যাংকের লেনদেন, দেশি- বিদেশি মুদ্রার বিনিময় ও জাহাজ চলাচল ব্যবস্থা। যাহোক শেষটায় বিশেষ বৈঠক ও বিভাগীয় কর্মকর্তার অনুরোধে- আবেদনে তারা কাজে যোগ দিয়েছেন।
আরেকটি খবর ক’দিনের। ঘটেছে ঢাকার কমলাপুর স্টেশনে। পুলিশের সাথে রেল কর্মীদের একটা বসচা, তারপর সংঘর্ষ। পরিণামে ধর্মঘট। রেলকর্মীরা ছয় ঘন্টা কাজ করেননি। ছয় ঘণ্টা কোন রেল চলেনি। জাতীয় অর্থনীতিতে তাও ক্ষতির পরিমাণ বেশ কয়েক লক্ষ টাকা। যাহোক, শেষটায় আবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ। ধর্মঘট অপসারিত। এবং এ ধর্মঘটটাও ছিল একান্ত আকস্মিক। নিয়মিত ট্রেন চলবে। যাত্রীরা মালপত্রসহ স্টেশনে হাজির। কিন্তু দেখলেন রেলকর্মীরা কাজে গরহাজির। রেল চলছে না। কি ধরনের হয়রানি আর বিরম্বনার সামনে পড়লো তাঁরা সহজেই অনুমেয়।
আরেকটি ধর্মঘটের খবর। খবরটা ততটা প্রকাশ পায়নি। সরকার নিয়ন্ত্রিত একটি পত্রিকার প্রেস কর্মচারীরা গত পরশু হঠাৎ রাত দশটা থেকে চাকা বন্ধ করে বসলেন। কারণ কর্তৃপক্ষের বিনা অনুমতিতে ওরা ওদের নিজস্ব একটি খবর ছেপেছে আগের দিনের পত্রিকায়। সেজন্য কর্তৃপক্ষ ওদের কারও কারও কৈফিয়ৎ করেছেন। এটাই। কেন কৈফিয়ত তলব করা হলো। ব্যাস চাকা বন্ধ। শেষটায় কোনমতে একটা মীমাংসা হওয়ার কাজ চললো। পত্রিকাটা বেরোলো নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে।
কাজেই ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন হতে পারে। কিন্তু একই সূত্রে গাঁথা- এটা ঠিক। আর সেই সূত্রটি হচ্ছে একশ্রেণীর মানুষের কর্মবিমুখতা এবং অসহিষ্ণুতা। চাটগাঁর শুল্ক কর্মচারীদের যদি কোন ক্ষোভ থাকতো তারা কি পারতেন না আকস্মিক ধর্মঘট না করে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ব্যাপারটা মীমাংসা করতে? তাহলে তো জাতি আর ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা ক্ষতির সম্মুখীন হতোনা। রেলকর্মীরাও কি পারতেন না সেই একই পন্থা অবলম্বন করতে- ধর্মঘটের পথ পরিহার করতে? অথবা কৈফিয়ৎ তলবের প্রতিবাদে আকস্মিক ধর্মঘট এমন কথা তো কোনদিন শোনা যায়নি! ও পত্রিকার প্রেস কর্মীরা কি প্রার্থনা ঘটনাটা অন্যভাবে মীমাংসা করতে? পারতেন। কিন্তু অসহিষ্ণুতা আর কর্মবিমুখ মানসিকতার জন্য পারেননি। এই মানুষের মানসিকতা আজ গোটা জাতিকে গ্রাস করতে বসেছে। এ মানসিকতার হাত থেকে মুক্তি না পেলে আমাদের জাতীয় অস্তিত্ব টিকে থাকা মুশকিল হবে বলে আমাদের ধারণা। এমতাবস্থায় আজ গোটা দেশের প্রতিটি মানুষের বিষয়টি ভাববার এবং ভেবেচিন্তে কাজ করবার সময় এসেছে বলে আমরা মনে করি।
একদিকে আপোষ অন্যদিকে হুমকি
আরবদের তেলাস্ত্রের আঘাত সারাবিশ্বে সংকটের আবর্ত সৃষ্টি করেছে। এই সংকটের কবল থেকে উদ্ধারের জন্য তেল ব্যবহারকারী দেশগুলোর তাই তৎপরতা লক্ষিত হচ্ছে। তেল ব্যবহারকারী শিল্পোন্নত ১৩ জাতির জ্বালানি শক্তি সংক্রান্ত সম্মেলনের উদ্বোধন করতে গিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডঃ হেনরি কিসিঞ্জার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, কোনক্রমেই জ্বালানি সংকটের পৃথক-পৃথক সমাধান সম্ভব নয়। এ সমস্যা সমাধানে যদি যৌথ প্রয়াস ব্যর্থ হয় তাহলে সমগ্র বিশ্ব ব্যাপী এক সর্বনাশা প্রতিযোগিতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও মন্দাভাব উদয় হবে এবং তেল ব্যবহারকারী শিল্পোন্নত দেশগুলো সমূহ বিপদে নিপতিত হবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও সরাসরি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন যে, তেল সংকট নিরসনে বিচ্ছিন্ন চিন্তাভাবনা আর্থিক বিশৃঙ্খলা ও অর্থনৈতিক বিবাদের অবতারণা করবে। প্রেসিডেন্ট নিক্সন তেল সম্মেলনে অংশীদার প্রতিনিধিদের সম্মানে আয়োজিত এক নৈশভোজে সভায় তথ্য প্রকাশ করেন যে, যুক্তরাষ্ট্রসহ শিল্পোন্নত প্রধান প্রধান দেশগুলো বিশ্বের মোট জলের শতকরা পঁচাশি ভাগ তেল ব্যবহার করে। তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জ্বালানি ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের যে লক্ষ্য স্থির করেছে, তা কোনো বিচ্ছিন্ন নীতির প্রয়াস নয়। প্রেসিডেন্ট নিক্সন আরো বলেছেন, ভবিষ্যৎ মানবজাতিকে অর্থনৈতিক সংকট থেকে উদ্ধারের জন্য প্রচেষ্টা চালাতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৮০ সালের পূর্বে জ্বালানি ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্য স্থির করেছে তা নাকি অপরাপর দেশের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতার জন্য নয়, বরং অন্যান্য শিল্পোন্নত দেশগুলোর মঙ্গলের জন্যই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ প্রচেষ্টায় নেমেছে।
ওইদিকে, তেল আমদানিকারক দেশগুলোর মধ্যে যে ‘গ্রুপিং’ গড়ে উঠছে তার বিরুদ্ধেও অভিমত উচ্চারিত হয়েছে। এই ‘গ্রুপিং’ করে উঠলে তেল আমদানিকারক দেশের সঙ্গে তেল উৎপাদনকারী দেশের বিরোধ দেখা দেয়াটাই স্বাভাবিক।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জ্বালানি সংকট নিরসনের জন্য একদিকে একটা আপসকামী মনোভাব প্রকাশ করছে অপরদিকে আবার হুমকি দিতেও দ্বিধা করছে না। এই দু’মুখো নীতির ফলে জ্বালানি সংকটের সত্যিকারের কোনো সমাধানে পৌঁছানো যাবে কিনা সেটাও একটা প্রশ্ন। ১৩ জাতীয় সম্মেলনের প্রথম দিনের অধিবেশনটি খুব সুখপ্রদ হয়নি। ইউরোপীয় অর্থনৈতিক সংস্থা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যে প্রবল বাকবিতণ্ডা অনুষ্ঠিত হয়েছে, তাতেই বোঝা যায়, তেল ব্যবহারকারী দেশ ও তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে যদি একটা যৌথ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় তাহলে একটা সমঝোতায় হয়তো পৌঁছুনো সম্ভব হতে পারে। পেট্রোলিয়াম রপ্তানিকারক দেশ গুলোর সংস্থার (ওপেক) জেনারেল সেক্রেটারি বলেছেন, তেল সমস্যা সমাধানের উপযুক্ত স্থান ওয়াশিংটন নয়। জাতিসংঘের উদ্যোগেই তেল সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত। এই অবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিমুখী নীতির যে খুব একটা কার্যকর তা বলা যায় না।
ভুয়া তাঁতিদের সৃষ্টিকারক যারা তাদের নাম প্রকাশ করা হোক
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত হাজারো কেলেঙ্কারি হয়েছে তাঁতিদের সুতা বন্টনের ব্যাপারে। সুতার কারচুপি নিয়ে দেশের জাতীয় সংবাদপত্রগুলো এ পর্যন্ত বহু সংবাদ প্রকাশ করেছে। মাঝেমধ্যে আমরা নানা চাঞ্চল্যকর সংবাদ দেখেছি সুতার ব্যাপারে। গত পরশু দিনের এক সংবাদে প্রকাশ, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা কর্তৃক এ পর্যন্ত পনেরো কোটি টাকার সুতা তাঁতিদের মাঝে বন্টন করা হয়েছে। এই পনেরো কোটি টাকার সুতার মধ্যে নাকি দশ কোটি টাকার সুতা ভুয়া তাঁতিদের হাতে গিয়ে পড়েছে। সম্প্রতি ‘বিসিক’ আসল তাঁতিদের একটি নামের তালিকা প্রকাশ করেছে। এই নামের তালিকা প্রকাশের পরই এই মহাকারচুপি ধরা পড়েছে বলে সংবাদে উল্লেখ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে নাকি তিরিশ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত দল গঠন করা হয়েছে। তারা সঠিক তাঁতি বা তাঁতের হিসাব সংগ্রহ করছে। তদন্ত দলের কয়েকজন তাদের তদন্ত কাজ শেষ করে যে রিপোর্ট প্রদান করেছে তাতে জানা গেছে, শতকরা ৭৫ ভাগ তাঁতীই নাকি ভুয়া। ওদের আদৌ কোনো তাঁত নেই। ওদের সবাই বেশ প্রভাবশালী ব্যক্তি। যারা নামে-বেনামে সুতা নিয়ে চলেছিল। এছাড়া এমন ব্যক্তিদের নামে রেজিস্ট্রি হয়েছে যাদের অতীতেও তাঁত ছিল না, আজও নেই। তদন্ত দলের সবাই এখন রিপোর্ট পেশ করেন নি। সংবাদে বলা হয়েছে, এই রিপোর্ট পেশ হওয়ার কারণ হল- লোভ ও ভয়। ‘বিসিক’ এ পর্যন্ত পাঁচ হাজার তিনশত জন তাঁতীর নাম সংবাদপত্রে প্রকাশ করেছিল। তার মধ্যে প্রায় চার হাজার তাঁতীই নাকি ভুয়া। তাঁতিদের নামধাম চেয়ে ‘বিসিক’ ইতিপূর্বে যে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিল তাতে সাড়া দিয়ে ২০ হাজার দরখাস্ত বিসিকের দপ্তরে পৌঁছেছিল। কিন্তু পাঁচ হাজার তিনশত জনের নাম প্রকাশিত হবার পরেই ‘বিসিক’ কতৃপক্ষ তা বন্ধ করে দিয়েছেন। এবং তদন্ত দল গঠন করেছেন।
বস্তুতপক্ষে সুতা কেলেঙ্কারির বিষয়টি যে দেশের একটি সর্বজনবিদিত ব্যাপারে কথা অস্বীকার করা যাবেনা। উল্লেখিত এ সংবাদ যদি সত্য হয় তাহলে অন্য সবকিছু বাদ দিলেও যে সত্যটি দেশবাসীর সামনে সুস্পষ্ট হবে তা হল– ‘বিসিক’ একটি অসৎ ও অযোগ্য প্রতিষ্ঠান। ক্ষুদ্র শিল্প সংস্থায় যোগ্যতা ও সততা থাকলে এতদিন পর ভুয়া তাঁতিদের উচ্ছেদের কাজে তৎপর হতো না, বহু পূর্বেই সংস্থাটি তাদের নৈতিক দায়িত্ব ভেবে ওই কাজটি সমাধান করত। ভুয়া তাঁতি সৃষ্টির ব্যাপারে ক্ষুদ্র শিল্প সংস্থায় হাত নেই একথা সংস্থাটির কর্তাব্যক্তিরাও অস্বীকার করতে পারবেন না। নানা প্রকার পারিতোষিক ও কারসাজির মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে দেশে হাজার হাজার ভুয়া তাঁতি। তদন্ত দল গঠন করে মাঝে মাঝে আবহাওয়া ঠিক রাখা একটি দৃষ্টি আকর্ষণীয় চাল এটাও সত্য। সরকারের কাছে আমাদের সরাসরি বক্তব্য- যদি উল্লেখিত ব্যক্তিদের সংখ্যা বা হিসাব সত্য হয় তাহলে এর জন্য কারা দায়ী তা অবিলম্বে প্রকাশ করা হোক। ভুয়া তাঁতিদের মধ্যে প্রভাবশালীরাই বা কারা তাও প্রকাশ করা হোক। সর্বোপরি দেশের দুঃখী মানুষের বস্ত্র সংকটের সমাধানে বাস্তব পদক্ষেপ নিয়ে ভুয়া তাঁতিদের কবে থেকে জনগণকে মুক্তি দান নিশ্চিত করা হোক।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক