ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি সম্ভবত এভাবেই ঘটে বারবার। পাকিস্তানের অস্থির রাজনৈতিক পদযাত্রার মধ্যেই সুপ্ত ছিল ষড়যন্ত্রের বীজ। তার প্রথম বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল ৫০ সালে পিন্ডি ষড়যন্ত্র উদঘাটনের মধ্য দিয়ে। ৫১’সালে ষড়যন্ত্রের হিংসাত্মক বহিঃপ্রকাশ ঘটে লিয়াকত আলী খানের নিহত হওয়ার ঘটনায়। শেষমেষ ‘৫৮ সালে ক্ষমতা কুক্ষিগত হয় পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের মধ্য দিয়ে। ষড়যন্ত্রমূলক ঘটনাক্রমের এই ধারা অব্যাহত থাকে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক-সামরিক অঙ্গনেও। আর কর্নেল ওসমানী হয়তোবা ছিলেন বিরাজমান ষড়যন্ত্রমূলক ঘটনাক্রমে নির্মাতাদের একজন। মহান মুক্তিযুদ্ধের সর্বময় নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত থেকেও ইতিহাসে তিনি বিতর্কিত এক ব্যক্তি হিসেবেই চিহ্নিত থাকবেন এমনটা অনেকেই মনে করেন।
১৬ ডিসেম্বর ‘৭১। পরাজিত শত্রুর আত্মসমর্পণ এবং একই সঙ্গে যুদ্ধ জয়ের উল্লাসে উদ্ভাসিত এই দিনটির মহিমা। অথচ এই ঐতিহাসিক মুহূর্তের অজ্ঞাত এবং বিতর্কিত কারণে ঢাকায় অনুপস্থিত থাকলেন মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে যুদ্ধ জয়ের সবটুকু কৃতিত্বই একচেটিয়াভাবে দখল করে নিল মিত্রবাহিনী। এভাবে লাখ লাখ মানুষের আত্মত্যাগের ইতিহাস চাপা পড়ে গেল সহায়ক মিত্রশক্তির নিছক আনুষ্ঠানিকতায়।
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হলেও কর্নেল ওসমানী বাংলাদেশে আসেন ২২ ডিসেম্বর। ঠাঁই নিলেন মন্ত্রিপাড়ার ২৭ নম্বর বাড়িতে।আর সেখান থেকেই তিনি তার অগোছালো সশস্ত্র বাহিনীর অধিনায়কত্ব অব্যাহত রাখলেন। সশস্ত্র বাহিনীকে কেন্দ্র করে স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি তার স্বেচ্ছাচারী মনোভাবের প্রকাশ ঘটাতে থাকেন একের পর এক। প্রথমেই তিনি মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত মূল্যবোধের মূলে সজোরে আঘাত করেন। সশস্ত্র বাহিনীতে অভিজ্ঞ কর্মকর্তা নিয়োগের বিকল্প নেই-এই অজুহাতে তিনি প্রায় এক ডজন পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর সহযোগী বাঙালি অফিসার কে নিয়োগ প্রদান করেন স্বাধীন বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে। মুক্তিযুদ্ধে এদের অনেকেই পাকিস্তানীদের পক্ষে লড়াই করে মহিমান্বিত করেছেন মীর জাফর আলী খান ঐতিহ্য।
কর্নেল ওসমানীর গৃহীত এই উদ্যোগ প্রশ্নে সরকারও নীরব সমর্থন জুগিয়ে যায়। আর এভাবেই দেশের সবচেয়ে স্পর্শকাতর এই স্থানটিতে সরকারের নীরবতায় একটি বিভেদের জন্ম দেয়া হল স্বাধীনতা প্রাপ্তির প্রথম থেকে। নিয়োগপ্রাপ্তদের একজন হলেন লে. কর্নেল কে. এম. রহমান। তাকে দেয়া হলো সেনাবাহিনীর সরবরাহ ব্যবস্থার প্রধানের দায়িত্ব। অথচ তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকাতে পাকিস্তানের ১ নম্বর সামরিক আদালতের প্রধান কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেছেন। নিয়োগপ্রাপ্তদের অপরজন হলেন লে. কর্নেল ফিরোজ সালাউদ্দিন। তিনি ছিলেন রাজাকার বাহিনীর উপ-প্রধান। পাকিস্তানের প্রতি অনুগত এই ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি সামরিক সচিবের পদে নিযুক্তি দেওয়া হয়। এ রকমের তৃতীয় ব্যক্তি ক্যাপ্টেন হাকিম। তাকে দেয়া হলো সেনাবাহিনীর পুলিশ প্রধানের দায়িত্ব। অথচ এই ব্যক্তি যুদ্ধের নয় মাস পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩১ ফিল্ড রেজিমেন্টে চাকরিরত থেকে স্বজাতির বিরুদ্ধে লড়েছেন। তেলিয়াপাড়া, মনতলা ও আখাউড়া এলাকায় তার নিক্ষিপ্ত গোলায় নিহত হয়েছে শ’য়ে শ’য়ে শরণার্থী আর মুক্তিযোদ্ধা।
এই ধারায় সবচেয়ে ক্ষতিকর যে কাজটি সবার অলক্ষ্যে ঘটে গেল, তা হলো সশস্ত্র বাহিনীর গোয়েন্দা প্রধানের পদে এয়ার কমোডর আমিনুল ইসলামের নিযুক্তি। এই ব্যক্তি বাঙালি হয়েও ‘৭১’র অক্টোবর পর্যন্ত ঢাকায় পাকিস্তান আই.এস.আই’র পরিচালক পদে দায়িত্ব পালন করেন। অক্টোবরের শেষ ভাগে ভারতে পাড়ি জমান এবং সেখানে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাকে বাংলাদেশ মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত অন্তরীণ অবস্থায় রাখেন। যেহেতু তিনি বাংলাদেশে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের গোয়েন্দা বিভাগের সর্বময় কর্তৃত্বের নিয়োজিত ছিলেন, সেহেতু মার্চ পরবর্তী সময়ের খুন, গুম, হত্যা- পাকিস্থানিদের এ ধরনের তৎপরতা সম্পর্কে তার অবহিত থাকার যে অনুমান সর্বজনবিদিত রয়েছে, তা অনেকটাই সঙ্গতিপূর্ণ। এছাড়াও লে. আল ফরিদ ও লে. মোদাব্বের নামের দু’জন অর্ডিন্যান্স কোরের অফিসারকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তানি বাহিনীকে দেয়া তাদের কথিত সহযোগিতা প্রদানের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ সত্ত্বেও সরকারি সিদ্ধান্তের বাস্তবায়নে তাদের চাকরিকে পুলিশ বাহিনীর অধীনে ন্যস্ত করা হয়।
বলাবাহুল্য, এ ধরনের নিয়োগের প্রশ্নে কোনো নীতিমালার আশ্রয় নেয়া হয়নি। স্বাধীনতা প্রাপ্তির শুরুতেই সশস্ত্র বাহিনীর এই বিতর্কিত অগ্রযাত্রা স্বাধীনতার দীর্ঘকালের লালিত চেতনাকেই প্রকারান্তরে প্রশ্নবোধক করে তোলে। আর এ কারণেই এবং এখান থেকে সৃষ্টি হয় সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে কার বিভেদ।
পাকিস্তানের প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের মতোই বাংলাদেশে স্বাধীনতার ঠিক পরপরই একই ধারার একটি প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের সূচনা ঘটে কর্নেল ওসমানীর সার্কুলার রোডের আবাস ও দফতর ঘিরে। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর বঙ্গবন্ধু কর্নেল ওসমানীর প্রশ্নে এতটাই সম্মোহিত হয়ে পড়েন যে, তাকে সরাসরি পূর্ণ জেনারেলের পদে উন্নীত করেন আনুপার্বিক না জেনেই। ফলে জেনারেল ওসমানী ধরেই নেন যে, ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে তিনি আগের মতোই অবিকল্প এক মানুষ রয়ে গেছেন এবং সশস্ত্র বাহিনীর নেতৃত্ব তার ওপর অর্পিত থাকার কারণে তিনি একইভাবে শক্তিধর রাজনীতিক হিসেবে রাজনীতির অঙ্গনে বিচরণ করে চলেছেন। এ সময় তিনি এমন আশাও পোষণ করে থাকবেন যে, সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব তার ওপর বর্তানোর বিষয়টি একরকম বাধ্যতামূলক।
এদিকে যুদ্ধক্ষেত্রের প্রথম সারির অধিনায়করা এই প্রথমবারের মতো সরাসরি সর্বাধিনায়কের সান্নিধ্যে কাজ করার সুযোগ পেয়ে তার চরিত্রের আদ্যোপান্ত বুঝে ফেলতে শুরু করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের এক বিশাল ব্যক্তিত্বের অধিকারী হিসেবে খ্যাত জেনারেল ওসমানী যে অন্তঃসারশূন্য একজন অধিনায়ক, তা সহসাই প্রতীয়মান হয়ে উঠল সশস্ত্র বাহিনীতে তার অধিকাংশ অধস্তন অধিনায়কের কাছে।
পরিস্থিতির এ পর্যায়ে প্রথম সারির অধিনায়করা সশস্ত্র বাহিনীর নেতৃত্ব থেকে ওসমানীর বিদায়ের সম্ভাবনা আঁচ করতে পেরে নিজেদের অবস্থান সংহত করার কাজে মনোনিবেশ করলেন। জিয়াউর রহমান, শফিউল্লাহ, খালেদ মোশাররফ এরা তিনজনই তাদের নিজেদের পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধের ইউনিটগুলোকে ঢাকায় কেন্দ্রীভূত করার সিদ্ধান্ত নেন। জেনারেল ওসমানী তার অবর্তমানে সেনাপ্রধান কে হবেন সে বিষয়ে কোন স্থির সিদ্ধান্তে তখনো পৌঁছাননি।
তিনি কাউকেই অখুশি করলেন না এবং তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী জিয়ার ১ ইস্ট বেঙ্গল, সফিউল্লাহ’র ২ ইস্ট বেঙ্গল ও খালেদ মোশাররফের ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে ঢাকায় স্থায়ীভাবে নিয়োগের ব্যাপারে সম্মতি দেন।
সেনাপ্রধান হিসেবে ওসমানীর ইচ্ছানুযায়ী পরবর্তী সেনাপ্রধান মনোনয়নের ব্যাপারে তিনি এরপর তার মনস্থির করে ফেলেন এবং একেবারেই সাদামাটা ও শান্ত প্রকৃতির সফিউল্লাহকেই তিনি এ পদের জন্য যোগ্য বিবেচনা করলেন। তিনি প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হলে সেনাপ্রধান শফিউল না যে কখনোই তার অবাধ্য হবেন না, এ ব্যাপারে ওসমানী অনেকটাই নিশ্চিত।
এদিকে ততদিনে বঙ্গবন্ধু ওসমানীর স্বরূপ বুঝে ফেলেছিলেন। বিশেষ করে জানুয়ারির শেষার্ধে পিলখানায় প্রাক্তন ইপিআর সদস্যদের বিদ্রোহ এবং এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে জেনারেল ওসমানীর অপেশাদার আচরণ তাকে ভাবিয়ে তোলে। তা সত্বেও এপ্রিলে বঙ্গবন্ধু ও বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব অর্পণ করেন। এই নিয়োগের জন্য জেনারেল ওসমানী একেবারেই প্রস্তুত ছিলেন না এবং অপ্রত্যাশিত এই ঘটনায় আকস্মিকতায় তার তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এ সময় সশস্ত্র বাহিনী থেকে ওসমানীর বিদায়ের মধ্যদিয়ে একটি অধ্যায়ের অবসান হলেও অপর এক অধ্যায়ের সূচনা হলো তখন কুমিল্লাতে সবার অলক্ষ্যে।
সফিউল্লাহ দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই জিয়াউর রহমান কুমিল্লাতে ৪৪ ব্রিগেডের অধিনায়ক হিসেবে তার দায়িত্ব পালন শুরু করেন। চাকরিতে তিনি সফিউল্লাহর সিনিয়র। সরকারের সেনাপ্রধান নিয়োগ সংক্রান্ত সিদ্ধান্তে তিনি তীব্রভাবে আহত হলেন। কিন্তু প্রতিবাদ করলেন না। এর ফলে উন্মেষ ঘটল এক নতুন মেরুকরণ প্রক্রিয়ার। বঙ্গবন্ধু জেনারেল ওসমানীর সুপারিশের কারণেই সফিউল্লাহকে সেনাপ্রধান হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু যখন বুঝলেন, ওসমানীর সিদ্ধান্ত নির্ভুল হয়নি, তখন সেনাবাহিনীতে উপ-প্রধান পদ সৃষ্টি করে জিয়াউর রহমানকে সেই পদে বহাল করে ঢাকায় সেনাসদরে নিয়ে আসেন। কিন্তু তাতেও আহত জিয়ার অন্তর্জ্বালার উপশম হলো না। বরঞ্চ ঢাকায় বসে মেরুকরণ প্রক্রিয়ার কাজ আরো ক্রিয়াশীল করলেন তিনি।
ইতোমধ্যে বিমানসেনাদের বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছে ঢাকা সেনানিবাসের বিমান ঘাঁটিতে। সেনাবাহিনী দিয়ে সেই বিদ্রোহের অবসান ঘটানো হলেও অঙ্কুরেই তা পুরোপুরি বিনষ্ট হল না। পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ সম্পর্কে এই বিদ্রোহ ছিল যথেষ্ট ইঙ্গিতবহ, যা রাজনৈতিকভাবে কখনোই মূল্যায়িত হয়নি।
এই ঘটনার পরপরই ঢাকার ৪৬ ব্রিগেডের কমান্ডার কর্নেল জিয়াউদ্দিন অপর এক ঘটনার সূত্রপাত করলেন। প্রধানমন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে তিনি ২০ আগস্ট ৭২’এ সাপ্তাহিক হলিডে পত্রিকায় বঙ্গবন্ধু কে কটাক্ষ করে ‘হিডেন প্রাইজ’ শিরোনামে যে লেখাটি ছাপান, তার রেশ ধরে তিনি চাকরীচ্যুত হন। কর্নেল জিয়াউদ্দিনের প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শনের কারণে কর্নেল তাহেরও সেনাবাহিনী থেকে অব্যাহতি পান।
একই সঙ্গে দু’জন অধিনায়কের বিদায় সেনাবাহিনীকে আরো অস্থির করে তোলে। সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান জিয়াউর রহমান এ রকমই একটি সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। তিনি আহত সেনাবাহিনীর ক্ষতস্থান পূরণে তৎপর হয়ে উঠলেন। সেনানিবাস থেকে সেনানিবাসে ঘুরে বেড়ালেন। শ্রেণী নির্বিশেষে সবার সঙ্গেই কথা বললেন। সর্বত্র বিরাজমান অবস্থাকে একটি দুঃসময় হিসেবে অভিহিত করলেন। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেন তাদের দুঃসময়ের বন্ধু হিসেবে। সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে তিনি নিজেকে একমাত্র বিকল্প হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হলেন এ সময়ে এই কৌশলের মধ্য দিয়ে।
সূত্র – মেজর নাসির উদ্দিন – বাংলাদেশ বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তর