বাংলার বাণী
২১শে জানুয়ারী, ১৯৭৩, রবিবার, ৭ই মাঘ, ১৩৭৯ বঙ্গাব্দ
আওয়ামী লীগের ইতিহাস রচনা
রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী লীগ তার সুদীর্ঘ সংগ্রামী অগ্রযাত্রার মধ্য দিয়ে কেবল বাংলার মানুষের সাধারণ প্লাটফরমে পরিণত হয়েছে তা স্পষ্ট করে স্মরণ করাও সম্ভব নয়। বাংলাদেশের ইতিহাস ও জাতির অভ্যূত্থানের জন্যে আওয়ামী লীগ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তা যদি কেউ বাংলাদেশের কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনাকেও বিশ্লেষণ করতে যান তবে তা মতান্তরে আওয়ামী লীগেরই কোন সংগ্রাম বিপ্লবের বিশ্লেষণ হয়ে দাঁড়াবে। দেশ বিভাগের পর বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও তাঁর পুনর্গঠনের সবকিছুর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক কর্মকান্ড, এই মহান সুদীর সুদীর্ঘদিনের নেতৃত্বে বিচক্ষণতা, প্রজ্ঞা ও সাধনা।
স্বাভাবিক ভাবেই এই সংগঠনের ইতিহাস ঘটনা কর্মকান্ড বাঙালী জাতির ইতিহাস ও কর্মকান্ডেরই প্রতিফলন ঘটাবে। জাতির এমন এক দলিল রচনার প্রয়োজনীয়তা স্বাধীনতার পর থেকে বিশেষভাবে অনুভূত হয়ে আসছিলো। দেশের প্রয়োজনকে সামনে রেখে এই মহান সংগঠনের ইতিহাস রচনার দায়িত্ব নিয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রচার সাব-কমিটি। এক দফতর মারফত এই সাব-কমিটির আহ্বায়ক সম্পর্কে তাদের সংগ্রামী সংগঠনের ইতিহাস পর্যায় সহযোগিতার হস্ত সম্প্রসারণের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি যাদের নিকট আওয়ামী লীগের পুরাতন প্রচারপত্র কিম্বা পুস্তিকা, পোস্টার এবং বিভিন্ন আন্দোলনের উপর বিভিন্ন ঘটনার আলোকচিত্র আছে তা আওয়ামী লীগের প্রচার সাব-কমিটিতে পাঠিয়ে দেয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন।
দেশ বিভাগের পর থেকে জনগণের আশা, আকাঙ্ক্ষাকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগ সার্বিককূলের সকল ভ্রুকুটি অগ্রাহ্য করে জনগণ, মানুষের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে স্তরানুক্রমিকভাবে কর্মসূচী গ্রহণ করেছেন এবং সেই কর্মসূচীর ভিত্তিকে জনগণকে একতাবদ্ধ করে সেভাবেই চালিয়েছেন ‘মহাপরিক্রমশালী’ শাসক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে। এই স্তরানুক্রমিক আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে আওয়ামী লীগ তার কর্তব্য জনগণের সামনে রেখেছেন। দলিল আকারে তা লিপিবদ্ধও রয়েছে। এগুলো জাতির সম্পদ, আমাদের ভবিষ্যত রূপকল্প প্রণয়নের বাস্তব শিক্ষা। অতীতকে না জেনে, ঐত্যিহকে অবহেলা করে কোন জাতি বিশ্বে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। দুঃখজনক হলেও সত্যি আমরা আমাদের অতীতকে সংরক্ষণ করার কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করিনি। আওয়ামী লীগ প্রচার সাব-কমিটির এই উদ্যোগ সেদিক থেকে প্রশংসাহ।
উন্নত সকল জাতি বিশেষ করে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহে তাদের সংগ্রামী অতীত ও রাষ্ট্রীয় বিপ্লবের বিভিন্ন প্রামাণ্য দলিল প্রস্তুতিতে সবিশেষ আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়। রাশিয়ার বিপ্লবে সোস্যাল ডিমোক্র্যাট বিশেষ করে তার বলশেভিক গ্রুপ, চীনে মাও পরিচালিত কম্যুনিস্ট পার্টি, ভিয়েতনামের ওয়ার্কার্স পার্টি প্রভৃতির ইতিহাস সে দেশের সংগ্রামী ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায় না। বাংলাদেশেও তেমনি তার অতীত আন্দোলন, তার পরিণত রূপ স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং চরম লক্ষ্য সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অগ্রযাত্রাকে কোনভাবেই আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে কল্পনা করা যায় না। এই সংগ্রামী গণসংঠনের বিপ্লবী ভূমিকা, তার আত্মত্যাগ, নির্যাতন ভোগ অথচ সবকিছুর পরও স্বীয় লক্ষ্য পথে তার অবিচল আস্থা ভবিষ্যত বংশধরদের প্রেরণা জোগাবে।
আওয়ামী লীগ প্রচার সাব-কমিটির এই মহতী উদ্যোগ আমাদের মনে আগ্রহের সৃষ্টি করেছে। জনগণ অবশ্যই তাদের নিজস্ব পার্টির নেতৃত্বে সংঘটিত বাংলাদেশের বিপ্লবী আন্দোলন ও ঘটনা প্রবাহের প্রামাণ্য ইতিহাস গ্রন্থনায় উৎসাহ দেখাবেন। অতীতে যারা আওয়ামী লীগের কর্মকান্ডের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন বার্ধক্য এবং অত্যাচারের নিষ্পেষণে তাদের অনেকে হয়তো সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন। কিন্তু তাদের প্রিয় সংগঠনের ইতিহাস রচনায় নিজেদের অভিজ্ঞতা দিয়ে তারা সাহায্য করতে পারেন। পঁচিশের কালো রাত্রে হানাদার বাহিনীর আক্রমণে বিধ্বস্ত আওয়ামী লীগ অফিসের সকল দলিল পত্র হয় পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে অথবা তা চালান করা হয়েছে পিন্ডিতে। কিন্তু একটা কথা সেই স্থূলবুদ্ধিসম্পন্ন জেনারেলদের মাথায় ঢুকেনি, তা হলো বাংলাদেশের পঁয়ষট্টি হাজার গ্রামের প্রতি বাড়ীই আওয়ামী লীগের দপ্তর, প্রতিটি পরিবারের হেফাজতেই রয়েছে আওয়ামী লীগের অমূল্য সকল সম্পদ। সেগুলোকে একত্রিত করে, ঘটনা পরম্পরায় সাজিয়ে তৈরী হতে চলেছে আওয়ামী লীগের ইতিহাস—যা প্রকারান্তরে বিগত পঁচিশ বৎসরের বাঙালী জাতিরই সংগ্রামী ইতিহাস, তার ঐতিহ্য, তার গর্ব। উদ্যোক্তাদের আমরা এই সুকঠিন দায়িত্ব গ্রহণে অভিনন্দন জানাচ্ছি। জাতি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে আর বিশ্ব অবাক বিস্ময়ে অনুভব করবে একটি জাতির সংগ্রামী অনুভবকে অসাধ্য সাধনের দৃঢ় প্রচেষ্টাকে।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক