“বাংলাদেশের প্রধান গােয়েন্দা সংস্থা এনএসআই’-এর সে আমলে পুত্থানুপুঙ্খ বিবরণ ছাড়া মুজিব-বিরােধী অভ্যুত্থানের কোনাে বিশ্লেষণ সম্পূর্ণ হতে পারে না। এনএসআই এবং আগস্ট ঘটনাবলী—উভয়ের সাথে ভালােভাবে পরিচিত কিছু সূত্র দাবি করেছে যে, হয় এনএসআই অভ্যুত্থান আঁচ করার ব্যাপারে চূড়ান্ত অপদার্থতার পরিচয় দিয়েছে, নতুবা সংস্থাটির একটি উল্লেখযােগ্য অংশের যােগসাজশেই ঘটনাটা ঘটেছে। যদিও প্রথম বিবেচনাটি অবিশ্বাস্য নয়, দ্বিতীয় বিবেচনাটিই সত্যের বেশি কাছাকাছি। | মুজিবের মৃত্যুর অব্যবহিত পরের ঘটনাবলী ও নিয়ােগ বিবেচনা করে এবং সামরিক এবং বেসামরিক উচ্চ পর্যায়ের সূত্রসমূহের বক্তব্য শুনে মনে হয় যে, মুজিবকে ক্ষমতাচ্যুত করার অভ্যুত্থান পরিকল্পনায় এনএসআই-এর একটা অংশ অত্যন্ত নিবিড়ভাবে জড়িত ছিল। মুজিবের মৃত্যুর পর পরই মােশতাক এ বি এস সফদারকে (বর্তমানে সরকারি চাকুরি থেকে অবসরপ্রাপ্ত) এনএসআই-এর মহাপরিচালক নিযুক্ত করেন। তার অন্য সহকর্মীদের মতাে সফদারের চাকুরি জীবনের প্রতিও আমাদের ভালােভাবে নজর দেওয়া দরকার, বিশেষত আগস্ট অভ্যুত্থানের প্রেক্ষিতে। মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায়ের সূত্র এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কিছু তথ্য পরিবেশকের অভিযােগ মুজিব-বিরােধী চক্রান্তের সাথে সফদার ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন। এছাড়া মার্কিন দূতাবাসের স্টেশন চিফ ফিলিপ চেরির সাথেও মূল যােগাযােগ রক্ষাকারী হিসাবে তিনি কাজ করেছেন বলে জানা যায়। সাক্ষাৎকারে চেরি প্রথমে সফদারের সাথে দেখা হওয়ার কথা অস্বীকার করেন।
পাকিস্তানি পুলিশ অফিসার বিশেষ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। দক্ষিণ ভিয়েতনামে। পুলিশ বাহিনী হতে একই সময়ে ৪১৪ জন অফিসারের তুলনায় পাকিস্তানের দলটি বেশি ভারি মনে হয়, বিশেষ করে ভিয়েতনামে বিরাট মার্কিন উপস্থিতির কথা। বিবেচনায় রাখলে। এই পাকিস্তানি প্রশিক্ষণার্থীদের মধ্যে ৪০ জন ছিলেন বাঙালি অফিসার। প্রশিক্ষণের জন্য আগত লােকেরা সবাই হােমরা-চোমরা অফিসার ছিলেন এবং তখন না হলেও ভবিষ্যতে নিজ নিজ শাখায় তাঁরাই কর্তৃত্ব লাভ করেন। স্বাধীনতা। যুদ্ধ শুরু হবার সময় পাকিস্তানি মতাদর্শ ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার বিশ্বাসে দীর্ঘদিন। অঙ্গীকারাবদ্ধ বহু বাঙালি ‘ওপিএস’ প্রশিক্ষণার্থী তাদের পূর্ব পদে রয়ে যান।… ১৯৭১-এর ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে অর্থাৎ পাকিস্তানিদের নরমেধ যজ্ঞের ঠিক এক মাস আগে ওয়াশিংটনের ইন্টারন্যাশনাল পুলিশ একাডেমিতে সফদার ও তার সহকর্মী এসে উপস্থিত হলেন। এদিকে যখন ওয়াশিংটনের পাকিস্তানি। দূতাবাসসহ সারা বিশ্বের দূতাবাসগুলােতে বাঙালি কূটনীতিকরা স্বাধীন। বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘােষণা করছিলেন, তখন সফদার ও রহিম এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র উচ্চবাচ্য করে পুলিশ একাডেমিতে তাদের পড়াশােনা চালিয়ে যেতে লাগলেন। গ্রীষ্মে গৃহযুদ্ধ যখন তীব্র রূপ নিলাে তখন সফদার ও রহিম উভয়েই স্বেচ্ছায় পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের অধীনে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। সফদার এলেন গােয়েন্দা তৎপরতা ও বিদ্রোহ দমনের দায়িত্বে আর রহিম কুখ্যাত রাজাকার বাহিনীর সাংগঠনিক নেতৃত্ব গ্রহণ করলেন। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে মুক্তিবাহিনীর কিছু শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্ব জঘন্যতম অপরাধ ও অত্যাচারের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচার দাবি করলেন। এই দাবি মূলত পাকিস্তানি বাহিনীর বন্দি সিনিয়র অফিসারদের কেন্দ্র করেই করা হয়েছিল। সেই সাথে যেসব মুখ্য বাঙালি পুলিশ ও গােয়েন্দা কর্মকর্তারা মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান বাহিনীর সাথে দালালী করেছিলেন, তাদের বিচারেরও দাবি উঠেছিল। পাকিস্তানের বন্দিদশা হতে মুজিবের মুক্তির পর একটা ঘােষণা করা হয় যে, ১৯৪৪-৪৫-এ ফ্রান্সে ভিশির দালালদের মতাে এদের যুদ্ধাপরাধের বিচার হবে।
বােমা প্রস্তুত প্রশিক্ষণ স্কুল ছাড়াও আমি জানতে পেরেছি যে, নর্থ ক্যারােলাইনার ফোর্ট ব্যাগ-এর মনােবিজ্ঞান কর্ম তৎপরতা স্কুলে ‘আইপিএ’ স্নাতকরা ট্রেনিং গ্রহণ করছে। স্কুলটি ফোর্ট ব্র্যাগস্থ মার্কিন সেনাবাহিনীর সামরিক সহায়তা সংস্থার অধীন। এখানে যেসব বিষয়ে শিক্ষা দেয়া হয়, তার কয়েকটি শিরােনাম নিম্নরূপ : ক) বিদ্রোহী নাশকতা পদ্ধতি; খ) আভ্যন্তরীণ প্রতিরক্ষা এবং তার রক্ষণে মনস্তাত্ত্বিক কর্মতৎপরতার ব্যবহার গ) আভ্যন্তরীণ প্রতিরক্ষায় গােয়েন্দাবৃত্তির ভূমিকা। “মার্কিন নাগরিকদের কিছু চিঠি রয়েছে। সেই চিঠিগুলােতে এ মর্মে আভাস দেয়া হয়েছে যে, বিদেশে নির্যাতনে মার্কিন মদদ-এর নজির রয়েছে। …. আমার মনে হয়, আমি একটা কথা সুস্পষ্ট করতে পেরেছি; বিদেশে মার্কিনী সাহায্যের যা উদ্দেশ্য, আমাদের দেশ আজ তার থেকে ভিন্নতর ও বিচ্ছিন্ন কর্মতৎপরতায় জড়িত হয়ে পড়েছে। জন নিরাপত্তা সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক পুলিশ একাডেমির কর্মকাণ্ড আমাদের অন্যান্য কর্মসূচির প্রতি মূর্তিমান কটাক্ষ স্বরূপ। এ দু’টি সংস্থা ইউএস এইডের বিভিন্ন কার্যক্রম এবং কৃতিত্বের উপর ভয়াবহ রকমের কলঙ্ক চিহ্ন এঁকে দিয়েছে।… আমার স্থির বিশ্বাস এই যে, কংগ্রেসের নির্দেশে এই কার্যক্রম এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমসহ (বিদেশী পুলিশ ট্রেনিং সংক্রান্ত) বিভিন্ন কর্মতৎপরতা অবিলম্বে নিষিদ্ধ করার সময় এসেছে।” সাংবাদিক লরেন্স লিফসুজ-এর প্রকাশিত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বাংলাদেশের তরুণ লেখক আশফাক আলম স্বপন কর্তৃক রচিত ‘মুজিব হত্যার চক্রান্ত’ পুস্তক (ত্রিধারা প্রকাশন ঢাকা) থেকে এ অংশটি সংক্ষিপ্তাকারে গৃহীত ।-লেখক।]
সূত্রঃ মুজিবের রক্ত লাল – এম আর আখতার মুকুল