বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ১০ই ডিসেম্বর, মঙ্গলবার, ২৪শে অগ্রহায়ণ, ১৩৮১
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠান
গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠান উদযাপিত হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে ১৬তম সমাবর্তন অনুষ্ঠান এটা। এ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ৩৯টি সাধারণ এবং ১৫টি বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠান উদযাপিত হয়েছে। ১৯২২ সালে প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয় এবং সবশেষে অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭০ সালে। স্বাধীনতা লাভের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠান ছাড়া অন্য কোন বিশ্ববিদ্যালয়েও সমাবর্তন হয়নি। দেশের এবং দেশের বাইরের কয়েকজন প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ও সাহিত্যিককে ডিলিট উপাধি দেওয়ার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যে সমাবর্তন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন তা যেমন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তেমনি জাতীয় মর্যাদার ব্যাপারও বটে। সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ডিলিট উপাধি দেওয়া হবে ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, মরণোত্তর বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মরণোত্তর ডঃ কুদরত-ই-খুদা, ডঃ কাজী মোতাহার হোসেন, অধ্যাপক আবুল ফজল, হীরেন্দ্রনাথ দে ও ওস্তাদ আলী আকবর খানকে। এরা সবাই বিজ্ঞান, সাহিত্য ও সঙ্গীত জগতের পূজনীয় ব্যক্তি। উপমহাদেশের জ্ঞান, বিজ্ঞান, সাহিত্য, সঙ্গীতের ক্ষেত্রে এরা সবাই অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় এবং গর্বের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ ক্ষেত্রে যোগ্যতম ব্যক্তিদেরকে উপযুক্ত সম্মানে ভূষিত করছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তখন এই বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানের কথা ঘোষণা করেন এবং উল্লেখিত মহান ব্যক্তিদেরকে ডক্টর অফ লিটারেচার উপাধিতে ঘোষিত কর্মসূচী জানান তখন দেশের সুভা মন্ডলী এবং সচেতন মানুষ মাত্রই স্বাগত জানিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণকে সবাই আনন্দের সঙ্গে স্বাগত জানিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেশের সবচেয়ে প্রাচীন বিদ্যাপীঠ। উপমহাদেশের শিক্ষা সম্প্রসারণের ক্ষেত্রেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অতীত ঐতিহ্য রয়েছে। বহু জ্ঞানীগুণী, সাহিত্যিক, শিল্পীর জন্ম হয়েছে এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। জগৎ বিখ্যাত মানুষের পদচারণায় বিশ্ববিদ্যালয়ের একদা মুখর হয়েছিল। আজও সেই প্রাচীন ঐতিহ্যের কথা স্মরণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষাবিদ এবং বাংলার সুধীবৃন্দের বুক ভরে ওঠে। এই মহান শিক্ষায়তন থেকে অতীতেও বহু বিশ্ব বিখ্যাত বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক এবং শিল্পীদেরকে সম্মানসূচক উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছিল। ১৯৩৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ডক্টর অফ ল উপাধি প্রদান করেছিল। ওই একই সময়ে আরও যাদেরকে ডক্টর অফ ল ডিগ্রী প্রদান করা হয়েছিল তাদের মধ্যে অন্যতম যাঁরা ছিলেন তাঁরা হলেন বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, মুহাম্মদ ইকবাল ও শ্রী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বস্তুত্ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অতীতের স্মৃতি আজ অনেকখানি ম্লান হয়ে যেতে বসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছাত্র এবং পরিবেশের প্রতি মানুষের এতো কাল যে শ্রদ্ধাবোধ ছিল তা আজ নেই বললেই চলে। এহেন দুরবস্থার জন্য কারা দায়ী তা সঠিক করে বলা মুশকিল। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের মানদণ্ড যে আজ অনেকখানি নেমে এসেছে তা দেশের প্রতি সুধীজনই স্বীকার করবেন। শিক্ষকদের মান যেমন হ্রাস পেয়েছে তেমনি হ্রাস পেয়েছে ছাত্রদের মান এবং তার লেখাপড়ার মানদণ্ড। সর্বোপরি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর এতোকাল যে মর্যাদা বহন করত তা আজ সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলেছে। এতদসত্ত্বেও যখন আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কিছু জ্ঞানী গুণী ব্যক্তিদেরকে সম্মান সূচক ডিগ্রী প্রদান করতে দেখি তখন আনন্দিত হই। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ঐতিহ্য এবং মর্যাদার কথা ভেবে নিজেদের আত্মপরিচয়ের সন্ধান করি। আর এই ঐতিহ্যবাহী আত্মপরিচয়ের মাঝেই লুকিয়ে থাকে একটি জাতির গোটা জাতীয় মর্যাদা।
গ্রিসের রাজতন্ত্র বিলোপের পক্ষে রায়
গ্রিসের জনসাধারণ বিপুল ভোটাধিক্যে প্রায় দেড়শ বছরের পুরাতন রাজতন্ত্রকে বাতিল করে প্রেসিডেন্টের শাসনাধীন প্রজাতন্ত্রের পক্ষে রায় দিয়েছেন। গ্রিসে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে গত ৮ই ডিসেম্বর। সেখানে রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা হবে, না প্রজাতন্ত্র হিসেবে গ্রীক তার ভবিষ্যৎ পথে চালিত হবে এ নিয়ে জনসাধারণের মতামত নেয়া হয়েছে। ’৭৩ সালে সামরিক জান্তা ক্ষমতা দখল করার পর সেখানে প্রজাতন্ত্র কায়েম হয়েছে। প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবার পর আবার গ্রিস রাজতন্ত্রের পথে যদি ফিরে যেত তাহলে স্বাভাবিক নিয়মেই ইতিহাসের গতি যেত থেমে। এটা কোন অবস্থাতেই কাম্য হতে পারে না।
গণভোট সম্পর্কে জনসাধারণের পূর্বধারণা, রাজতন্ত্রের পক্ষে খুব কম লোকই ভোট দেবে এবং রাজা তার সিংহাসন হারাতে বাধ্য হবেন। আজকের ফলাফলে সে ধারণা যে অমূলক ছিল না তা প্রমাণিত হলো। এদিকে গ্রিসের তিনটি বিরোধীদল রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে অভিযানে নেমেছে। গত ১৭ই নভেম্বরের পার্লামেন্টের নির্বাচনে এই তিন দলীয় জোট দলটির শতকরা ৪৫টি ভোট পেয়েছিল। একে প্রধানমন্ত্রী কারমানলিসের পক্ষে বিপুল বিজয় বলে গণ্য করা হয়। কিন্তু গণভোটের সময় প্রধানমন্ত্রী কারমানলিসের দল নিরপেক্ষ ছিলেন। মিস্টার কারমানলিস গ্রিসের প্রেসিডেন্টের শাসনাধীন প্রজাতন্ত্রের পক্ষপাতী।
সামগ্রিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আগে থেকে এটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল যে, গ্রিসে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত নাও হতে পারে। তবে একথা খুব একটা জোর দিয়ে বলা যাচ্ছিল না। কেননা ভোটের আগে গত ১৫ দিনে লন্ডনের টেলিভিশন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দেখা গেছে ক্রমে ক্রমে রাজার দিকে জনসাধারণ ঝুঁকে পড়েছে। গত শনিবার রাজকীয় সংস্থার কার্যালয়ে বোমা বিস্ফোরিত হওয়ায় এ মূল্যায়নও তখন সন্দেহজনক বলে মনে হয়েছিল। এ বিস্ফোরণ জনসাধারণের বিক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
রাজার বিরুদ্ধে জনসাধারণের অভিযোগও কম নয়। সামরিক সরকার রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের যখন নির্বিচারে জেলে পাঠিয়েছে রাজা তখন নীরব ছিলেন। কোন প্রতিবাদই করেননি। নির্যাতনের স্টিমরোলারে পিষ্ট হয়ে অনেক শিল্পী, সাহিত্যিক, রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও ছাত্রকে দেশ ত্যাগ করতে হয়েছে। কিন্তু তবু নির্বাসিত রাজা মুখ খোলেননি। সেই রাজাকে যদি জনসাধারণ আবার ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় বসান তাহলে তা হতো ইতিহাসের নির্মম পরিহাস। গ্রিসের জনসাধারণ রাজতন্ত্র বিলোপের পক্ষে ভোট দিয়ে ইতিহাসের গতিকে যে সুনিশ্চিত ভাবে এগিয়ে নিয়েছেন এজন্য তারা অভিনন্দনযোগ্য।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক