সাক্ষাৎকারে তিনি এসব ঘটনাগুলাের কথা বলেন : কার্নেগি : আচ্ছা, ব্যাপারটা কী ছিল, আমাদের কি কোনাে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছিল না, নাকি আমরা কোনাে জরুরি বৃহত্তর নীতির স্বার্থে (আমাদের) পাকিস্তান নীতিকে ছােট করে দেখেছিলাম? কা : প্রথমত, আমার মনে হয় না, ওদের (কিসিঞ্জার ও নিক্সন) কোনাে পরিকল্পনা ছিল। দ্বিতীয়ত, আমার মনে হয় ওরা পরিস্থিতির গুরুত্ব খাটো করে দেখেছিল। তৃতীয়ত, নিক্সনের মহিলা শাসকদের বিরুদ্ধে কী যেন এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার ছিল। সােজা কথা, তিনি শ্রীমতী গান্ধীকে পছন্দ করতেন না, আবার ইয়াহিয়া খানের মতাে সামরিক জেনারেল তার বেশ পছন্দ ছিল। চার পাঁচ মাস সিদ্ধান্তহীনতার পর চীন বিষয়ে তাদের বিরাট সাফল্য এসেছিল। আমার মনে পড়ে নিক্সন ১০-১২ বার শ্রীমতী গান্ধীকে ঐ ‘কুত্তীটা’ বলে অভিহিত করেন। কথাবার্তার মেজাজটা ছিল এরকম ‘তার কিসে মঙ্গল, বেটী যদি তা বুঝতে পারত।’ অর্থাৎ তাদের মতাে করে তিনি তাঁর স্বার্থ বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিলেন আর তাই তিনি হলেন কুত্তী কিসিঞ্জার রজার্স আর সিসকোর কথা শুনে … শ্রীমতী গান্ধী বুঝতে পেরেছিলেন যে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি আসলে সম্পূর্ণ ভিন্নমাত্রার। শ্রীমতী গান্ধীর সফরকালীন একটা ভােজসভার কথা আমার মনে পড়ছে। নিক্সন বেশ ইনিয়ে-বিনিয়ে টোস্ট করেছিলেন, কিন্তু শ্রীমতী গান্ধী ছিলেন শীতল। এরপর হােয়াইট হাউসে ওই ‘কুত্তী’ কথাটা আরাে বেশি শােনা যেতে লাগলাে…। ৯ই জুলাই ১৯৭১ ইসলামাবাদ থেকে একটা পাকিস্তানি বিমানে কিসিঞ্জারের গােপনে পিকিং যাওয়ার কথা। নিক্সন প্রশাসনে কিসিঞ্জারের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এই প্রচেষ্টার উপর মারাত্মকভাবে নির্ভর করছিল আর সব প্রসঙ্গ তখন গৌণ। এই সময়ে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ পিকিং ও ওয়াশিংটনের মধ্যে যােগাযােগের একমাত্র সূত্র ছিল। নিক্সন এবং কিসিঞ্জারের খুব ঘনিষ্ঠ মহলের বাইরে আর কেউই চীন তৎপরতার কথা জানতেন না।
বিশেষ করে দক্ষিণ এশীয় নীতি নির্ধারণের সাথে যারা জড়িত ছিলেন, তাদের কেউই এ বিষয়ে কিছু জানতেন না। কালব-এর মতে চীনের সাথে কিসিঞ্জার-এর সম্পর্ক স্থাপনের কথা জানতেন এমন লােকের সংখ্যা গােটা যুক্তরাষ্ট্রে চার জনের বেশি ছিল না। পাকিস্তানের প্রতি পক্ষপাত কিসিঞ্জারের চীন নীতির একটা অত্যাবশ্যকীয় উপাদান…। বাঙালিরা ছিলেন গৌণ অনুষঙ্গ। কিন্তু পররাষ্ট্র মন্ত্রী দফতরের একজন কর্মকর্তা আরেকটি কার্নেগি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন যে, চীনের ছুতােটা তার বিশ্বাস্য মনে হয়নি। চীনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নীতি এ ধরনের কোনাে অনিবার্য সিদ্ধান্ত চাপাতে পারে বলে তার মনে হয়নি। আমাদের সবার মনে হয়েছিল যে (বাংলাদেশের সংকটের প্রতি) চীনের আচরণ একটু অদ্ভুত। সম্ভবত আমাদের মতাে ওরাও নিক্সনের সফরের আগ পর্যন্ত ইয়াহিয়াকে ঠিকঠাক রাখার কথা ভেবে এমন আচরণ করেছিল। জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের কিসিঞ্জার-এর সহকারী উইনস্টন লর্ড জোর দিয়ে কার্নেগি গবেষকদের কাছে বলেন যে, প্রশাসনের উঁচু মহলের ভেতর ছুতাে দাড় করাবার অভ্যেস তৈরি হয়ে গিয়েছিল। আমাদের (যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বে) চীনকে বােঝানাে জরুরি ছিল যে, আমরা সরকার হিসাবে নির্ভরযােগ্য এবং আমাদের উভয়ের বন্ধুকে (পাকিস্তানসহ) যথেষ্ট সম্মান করি।” দুদশক ধরে চীনের সাথে অহি-নকুল সম্পর্কের পর শুধুমাত্র রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধের সময় পাকিস্তানকে সমর্থন করলেই চীনের কাছে প্রমাণ হয়ে যাবে যে, ‘আমরা একটি নির্ভরযােগ্য সরকার—এই দুর্বোধ্য মূল্যায়ণ যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ভেতরে ও বাইরে সন্দেহবাদী। পর্যবেক্ষকদের কাছে ইসলামাবাদ সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার ছুতাে। মনে হয়েছে। এ সম্পর্ক পাল্টাবার কোনাে তাগিদ যুক্তরাষ্ট্র কখনাে অনুভব করেনি। চীনের ক্ষেত্রেও একই কাণ্ড হয়েছিল।…. কার্নেগি : আপনি কি এমন কোনাে ঘটনার কথা জানেন যেখানে পশ্চিম।
পাকিস্তানের সাথে পূর্ব পাকিস্তানের বা আওয়ামী লীগের কোনাে বােঝাপড়ার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করেছিল? কোলকাতায় এ ধরনের অন্তত আটটা যােগাযােগের খবর আমরা পেয়েছি।
প:দ: সূ:*: জি হ্যা, আমরা কোলকাতায় আওয়ামী লীগের সাথে যােগাযােগ করেছিলাম। আমরা কিছু বাঙালির সাথে যােগাযােগ করেছিলাম যারা এমন উচু পদে ছিলেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানের কাছে তারা গ্রহণযােগ্য ছিলেন, আর আমাদের কাছেও আলােচনার প্রতিনিধি হিসাবে আশাব্যঞ্জক মনে হয়েছিল। কিন্তু শেষ অবধি এরা কোনাে কাজে আসেননি।
কার্নেগি : ঠিক কত আগে যােগাযােগ করেছিলেন?
প: দ: সূ:: বলতে পারব না। বলব না! যারা দক্ষিণ এশিয়ার ঘটনাবলীর সাথে, বিশেষত পাকিস্তানের গৃহযুদ্ধের ঘটনাবলীর সাথে পরিচিত, তারা বহু বছর ধরে এক ধরনের ভাসাভাসা গুজব শুনে। এসেছেন যে, ১৯৭১-এ যুক্তরাষ্ট্র গােপন যােগাযােগ ও আলােচনায় মধ্যস্থতা করে। কিন্তু এসব ঘটনার অস্তিত্ব বা ধরন সম্বন্ধে কোনাে সুস্পষ্ট প্রামাণ্য সংবাদ পাওয়া যায়নি। পদস্থ মার্কিন কর্মকর্তাদের মধ্যে যারা এ সময়ের ঘটনাবলীর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন, তারা এ ব্যাপারে সবচেয়ে চুপচাপ থেকেছেন। কিসিঞ্জার নিজেই প্রকাশ্যে আকার ইঙ্গিতে বলেছিলেন যে, কিছু একটা চলছিল। সেজন্য একটা যােগাযােগ যে করা হয়েছিল সেটা স্বীকার করা হয়। কিন্তু ঠিক কী যে। ঘটেছিল, কারা জড়িত ছিলেন, সেটা আজ আট বছর (১৯৭৮) পরেও সরকারি দৃষ্টিতে অত্যন্ত গােপনীয়। ১৯৭৮-এও পদস্থ মার্কিন কর্মকর্তারা অন্যান্য বিষয়ের চাইতে এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি গােপনীয়তা অবলম্বন করে থাকেন। তারা বলেন, এ ঘটনা সংক্রান্ত দলিলপত্র এখনাে সরকারিভাবে গােপনীয়। কার্নেগি দলিল সন্দেহাতীতভাবে যেটা প্রমাণ করে তা হলাে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের একটা অংশের সাথে গােপন যোগাযােগ করা হয়েছিল।
এই যােগাযােগের উদ্দেশ্য ছিল স্বাধীনতা আন্দোলনকে বিভক্ত করে এমন একটা বােঝাপড়ায় আসা যেখানে স্বাধীনতা স্বীকৃত হবে না। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের একজন কর্মকর্তার সাথে কার্নেগির সাক্ষাৎকার অনুযায়ী ১৯৭১-এর জুনে গৃহযুদ্ধ শুরু হবার দু’মাস পর প্রথম যােগাযােগ করা হয়। ঠিক কীভাবে যােগাযােগ করা হয়েছিল, কিংবা কাদের মাধ্যমে করা হয়েছিল, সেটা নিয়ে খানিকটা রহস্য এবং বিভ্রান্তি আছে। তবে এটা পরিষ্কার যে, একই সাথে বেশ কয়েকটা পর্যায়ে বিভিন্ন যােগসূত্রের মাধ্যমে কিসিঞ্জার এগােচ্ছিলেন। পররাষ্ট্র দফতর, সিআইএ, প্রতিরক্ষা দফতর এবং জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের যেসব লােককে তিনি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করতেন তাদের উপরই কিসিঞ্জার নির্ভর করেছিলেন। যারা দক্ষিণ এশিয়া নীতির ব্যাপারে তার বিরােধিতা করতেন বলে তিনি জানতেন বা বিশ্বাস করতেন, তাদের অর্থহীন সব কাজে ব্যস্ত রেখে আড়াল করে ফেলা হলাে। গোপন আলােচনা ঠিক কীভাবে সংঘটিত হয়েছিল তা বুঝতে হলে দুটো ব্যাপার বুঝতে হবে। প্রথমত, উল্লেখিত প্রতিটি সংস্থার আমলাতন্ত্রে কিসিঞ্জার-এর নিজস্ব রাজনৈতিক গােষ্ঠী সম্বন্ধে উপলব্ধি। দ্বিতীয়ত, আমলাতন্ত্রে কে কে তার বিশ্বস্ত ছিল, আর কে ছিল না, সে সম্বন্ধে ধারণা। ঢাকাস্থ মার্কিন কনসাল জেনারেল ব্লাডের তারবার্তার পর পররাষ্ট্র দফতর প্রতিবাদ এবং তথ্য ফাঁসের আখড়া হয়ে উঠেছিল। নয়াদিল্লীর মার্কিন রাষ্ট্রদূত কেনেথ কিটিং দক্ষিণ এশিয়ার সংঘাতের প্রতি কিসিঞ্জারের পুরাে দৃষ্টিভঙ্গির কট্টর বিরােধী ছিলেন। স্পষ্ট করে কোনাে রূপরেখা দেয়া হলো না। একটা অসম্ভব কাজের দায়িত্ব গ্রহণ করে পররাষ্ট্র দফতরের কর্মচারীরা পাকিস্তান ও বাঙালি পক্ষের সাথে যােগাযােগ শুরু করলেন।
এগুলাে যে নীচু পর্যায়ের অর্থহীন চেষ্টা, সেটা পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ। বিলক্ষণ জানতেন, তা পররাষ্ট্র দফতরের কর্মচারীরা যাই ভেবে থাকুক না কেন। চীনের সাথে সম্পর্কে নাজুক ব্যাপারটি নিয়ে জেনারেলরা সরাসরি কিসিঞ্জারের সাথে যােগাযােগ রেখেছিলেন। তারা জানতেন বাংলাদেশ প্রশ্নে তাদের উপর কোনো মার্কিন চাপ নেই। ওয়াশিংটনের স্বতন্ত্র সূত্র ও কার্নেগি সূত্রে জানা যায়, গােটা দক্ষিণ এশিয়া সংকটের সমন কিসিঞ্জার-এর মূল দোসর ছিলেন হ্যারলড স্যানডার্স। তিনি কাজ করতেন জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদে তিনি কিসিঞ্জার-এর একজন অত্যন্ত বিশ্বস্ত সহকারী ছিলেন। মার্কিন পররাষ্ট্র নীতির ইতিহাসে স্যানডার্স ছিলেন বেশ কৌতূহলােদ্দীপক ব্যক্তি। তবে তার নাগাল পাওয়া কঠিন। ভদ্রলােক “মার্কিন সমাজতত্ত্ব ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে গােষ্ঠী-ধারণা : (১৮৬৩-১৯২৯)” শীর্ষক গবেষণা ১৯৬৩ সালে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট উপাধি পান। ১৯৫৯ সালে স্যানডার্স সিআইএ-তে যােগদান করেন। ১৯৬১ সালে সিআইএ তাকে হােয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদে পাঠায়। সেখানে পরবর্তী দশ বছর তিনি কাজ করেন। ১৯৭৩-এ কিসিঞ্জার পুনরায় যখন পররাষ্ট্র দফতরের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন তখন গোয়েন্দা সংস্থা থেকে খুব অল্প যে কয়েকজনকে পররাষ্ট্র দফতরে নিয়ে আসেন, তার মধ্যে স্যান্ডার্স একজন। কিসিঞ্জার তাকে পররাষ্ট্র দফতরের গােয়েন্দা ও গবেষণা বিভাগের পরিচালক পদে নিয়োগ করলেন। তবে এই দুজনের ঘনিষ্ঠতা দক্ষিণ এশীয় সংকটের সময়ই গাঢ় হয় বলে জানা যায়। ওয়াশিংটন সূত্রসমূহ অভিযােগ করেন যে, ১৯৭১ সালে কোলকাতায়। আওয়ামী লীগের মােশতাকপন্থী অংশের সাথে এই স্যানডার্সই যােগাযােগ রক্ষা করেন।
প্রসঙ্গত এখানে বলতে হয়, যেসব দলিলপত্রের সাহায্যে ব্যাপারটা মীমাংসা করা যেত, সেগুলাে আমরা ‘ফ্রিডম অফ ইনফরমেশন অ্যাক্ট-এর আওতায় চেয়ে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের সেসব দেওয়া হয়নি। স্যানডার্স-এর সাথে যােগাযােগ করা হলে তিনি কোনােরকম মন্তব্য করতে অস্বীকার করেন। মােশতাকের সাথে যােগাযােগের পর মার্কিন আমলাতন্ত্রের পাকিস্তান নীতি। বিরােধীদের যাতে এ ব্যাপারটায় না জড়ানাে হয় এবং তাদের যাতে কিছুই না জানানাে হয়, সে বিষয়ে খুব যত্ন নেওয়া হয়। শুধু যেসব যােগসূত্র সম্পূর্ণ বিশ্বস্ত বিবেচিত হয়েছিল, তাদেরই কাজে লাগানাে হয়েছিল। এই যে স্বাধীনতার প্রশ্নে আওয়ামী লীগকে দু’টুকরাে করার নাজুক যােগাযােগ কাজ চলছিল, স্বভাবসুলভ কায়দায় কিসিঞ্জার সে কথাটা মাত্র গােটা কয়েক লােককে জানিয়েছিলেন। ওয়াশিংটন সূত্রসমূহ অভিযােগ করেছে যে, এই কাজে সিআইএ এবং পররাষ্ট্র দফতরের বিশ্বস্ত যােগসূত্র ব্যবহার করা হয়। অভিযোগ খণ্ডন বা প্রমাণের জন্য সিআইএর যেসব দলিল আমাদের দরকার ছিল, সেগুলাে আমাদের দেওয়া হয়নি। আমাদের সূত্র অভিযােগ করেছে যে, পাকিস্তান আমলের সিআইএ চরদের মধ্যে যারা ১৯৭১-এ মােশতাক চক্রে ছিলেন, তাদের দিয়েই প্রথম যােগাযােগ শুরু ভারতে রাষ্ট্রদূত কিটিং-এর মতাে যে সব কূটনীতিবিদ কিসিঞ্জারের দক্ষিণ এশিয়া নীতির বিরােধী ছিলেন, যােগাযােগের আসল মতলব সম্বন্ধে তাদের ঘুণাক্ষরেও কিছু জানতে দেওয়া হয়নি। তথাকথিত ‘নিরপেক্ষতা’র ভড়ং বজায় রাখার উদ্দেশে কোলকাতার মার্কিন কনসাল জেনারেল গর্ডনকে থিয়েটার রােডস্থ বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের সদর দফতর হতে দূরত্ব বজায় রাখার নির্দেশ দেওয়া হলাে।
এদিকে কনস্যুলেটের রাজনৈতিক শাখার অধঃস্তন কর্মকর্তা জর্জ গ্রিফিনকে প্রাথমিক যােগাযােগের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল বলে পররাষ্ট্র দফতর এবং বাঙালি সূত্র আমাদের জানিয়েছে। গ্রিফিন ছিলেন স্যানডার্স-এর একজন ঘনিষ্ঠ সহকর্মী। ১৯৭৫-এ স্যানডার্স তাকে পররাষ্ট্র দফতরের গােয়েন্দা ও গবেষণা বিভাগের সহকারী হিসাবে নিয়ে। আসেন এবং দক্ষিণ এশিয়া শাখার প্রধান হিসাবে নিয়ােগ করেন। মার্কিন ও বাঙালি সূত্র আমাদের জানিয়েছে যে, ১৯৭১-এ স্যানডার্স ও কিসিঞ্জারের সাথে গ্রিফিনের সরাসরি যোগাযােগ ছিল এবং সেই সূত্রে তিনিও গোপন যােগাযােগ স্থাপনে অংশ নিয়েছিলেন।… তবে মনে হচ্ছে যে, কোনাে এক পর্যায়ে কিসিঞ্জার সকল মধ্যস্থতাকারীদের বাদ দিয়ে নিজে সরাসরি মােশতাক চক্রের সাথে যােগাযােগ করেন। মােশতাক চক্রের প্রতিনিধির সাথে তিনি ওয়াশিংটন বা ইউরােপে দেখা করেছিলেন, নাকি ১৯৭১-এর জুলাই-এ পিকিং ও ইসলামাবাদ যাবার পথে নয়াদিল্লীর সংক্ষিপ্ত সফরের সময় দেখা করেছিলেন সেটা কার্নেগির গবেষণায় স্পষ্ট হয়নি। তবে কার্নেগির গবেষকরা পররাষ্ট্র দফতরের গোয়েন্দা ও গবেষণা বিভাগের একজন পদস্থ কর্মকর্তার কাছে জানতে পারেন যে,
পঃ দঃ সূ। আমরা কদিন ভাবলাম কোলকাতায় আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে আলােচনায় বসা যাবে। দুঃখের বিষয়, পরে অক্টোবরে আমরা বুঝতে পারলাম ওরা সব অংশের প্রতিনিধিত্ব করতে পারছে। ওরাও বুঝতে পারছিল যে, ওদের পক্ষেও সব অংশের হয়ে কথা বলা সম্ভব নয় … এর চেয়ে বিস্তারিত কিছু বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
কার্নেগি। : কিসিঞ্জার তাে বলেছিলেন আলােচনা সফল হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু সে সময়ের উত্তেজনার কথা মনে করলে, উপযুক্ত লোেক ঠিক করার ব্যাপারে ঐক্যমতে পৌছাবার ব্যর্থতার কথা চিন্তা করলে অর্থাৎ সবদিক বিবেচনা করে আপনার কি মনে হয় কিসিঞ্জারের বক্তব্য বিশ্বাস্য ছিল? | পঃ দঃ সূঃ: দেখুন, আপনি আমাকে কিসিঞ্জারের কথার উপর মন্তব্য করতে বলছেন। … তিনি নিজেই তাে প্রতিনিধিদের সাথে সরাসরি কথা বলেছেন। সুতরাং আমাদের এ বিষয়ে কিছুই জানা নেই। কলকাতায় যােগাযােগের ব্যাপারে পররাষ্ট্র দফতরে একমাত্র জর্জ গ্রিফিনকেই সরাসরি জড়িত বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। বর্তমান লেখকরা তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে গেলে তিনি সতর্কতার সাথে ব্যাপারটি এড়িয়ে যান। ১৯৭৮-এ যখন প্রথম | তার সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়, তখন তিনি আমাদের এমন একটি ধারণা দিয়েছিলেন যে, কোলকাতায় একটা কূটনীতিক মদ্যপান পার্টির বাইরে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের সাথে সামাজিক বা রাজনৈতিক কোনােরকম যােগাযোগ তাঁর ছিল না। এ ধরনের কোনাে যােগাযােগের খবরও তিনি পাননি। ১৯৭৯-তে আবার তার সাথে যােগাযােগ করে আমরা তাঁকে জানালাম যে, কোলকাতাস্থ দূতাবাসের একজন পদস্থ কর্মকর্তা আমাদের বলেছেন যে, বাঙালি নেতৃত্বের একটি অংশের সাথে তিনিই (জর্জ গ্রিফিন) যােগাযােগের দায়িত্ব পালন করেছেন। এবার গ্রিফিন বললেন, তার তাে জানারই কথা। আমার মনে হয় না, আমার এ বিষয়ে খােলাখুলি কথা বলার এখতিয়ার আছে। শেষবার যখন খোজা নিয়েছি, তখনও তাে ব্যাপারটা গােপনীয় ছিল।’
তখন আমরা তাঁকে জানিয়েছিলাম যে, এসব পুরনাে জামানার ঘটনা’, গোপনীয় রাখার কোনাে মানে হয় না। উত্তরে গ্রিফিন বলেছিলেন, ‘তাতে কী, ঘটনার নায়করা তাে এখনাে জীবিত।’ এই যােগাযােগগুলাে ভীষণ নাজুক ছিল। এর কারণ আমরা আগেই বলেছি যে, অস্থায়ী সরকারের আসল নেতৃত্বকে পাশ কাটিয়ে এসব যোগাযােগ করা হয়। তখনকার অস্থায়ী সরকারের নেতৃত্বে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ। বাংলাদেশ আন্দোলনের সকল কর্মীদের মতাে পূর্ণ স্বাধীনতার ব্যাপারে তিনিও অনড় ছিলেন। ২৫শে মার্চের গণহত্যার পর এ বিষয়ে কোনাে আপােস তাদের কাছে গ্রহণযােগ্য ছিল না। কাজেই পাকিস্তানের সাথে আপোসকামী যে অংশটি ছিল, সেটি স্বাধীনতার দাবিও ছেড়ে দিতে রাজি ছিল—সেটাকে সমর্থন জানিয়ে বাঙালি নেতৃত্বে ভাঙন ধরাবার যে খায়েশ যুক্তরাষ্ট্রের ছিল, তার চাবিকাঠি ছিলাে পরম গােপনীয়তা ও সতর্কতা। কোনাে কোনাে সূত্র মনে করেন যে, সময় হিসাবে ১৯৭১-এর অক্টোবর নির্দিষ্ট করা হয়েছিল। এ সময় পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিসাবে মােশতাকের নিউইয়র্কে এসে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের কাছে বাংলাদেশের বক্তব্য তুলে ধরবার কথা। সে সময় এককভাবে কোনাে পূর্ব ইঙ্গিত ছাড়াই নিউ ইয়র্কে মােশতাক এমন একটা আপােসরফার ঘােষণা দিয়ে দিতে পারতেন, যাতে পূর্ণ স্বাধীনতা স্বীকৃত হতাে অবশ্য ব্যাপারটা তাজউদ্দিন নেতৃত্বের কাছে বিশ্বাসঘাতকতার সামিল হতাে। এ ক্ষেত্রে কোলকাতায় আওয়ামী লীগের বাকি নেতৃত্বের উপর মােশতাক নিঃসন্দেহে টেক্কা দিতে পারতেন। বাংলাদেশের ইতিহাসও অন্যরকম হতাে।
পরিকল্পনা যাই হােক, সেটা আর বাস্তবায়িত করা যায়নি। অক্টোবরেই মােশতাকের গােপন যােগাযােগ ধরা পড়ে যায়। এরপর তাঁকে কোলকাতায় একরকম অন্তরীণ রাখা হয়। তার নিউইয়র্ক সফর আর হয়ে উঠেনি। মার্কিন পক্ষে যারাই যােগাযােগ করে থাকুন আর যেভাবেই তা করে থাকুন দিল্লীতে রাষ্ট্রদূত কিটিং আর কোলকাতাস্থ কনসাল জেনারেল পৰ্ডনকে যােগাযােগের আসল উদ্দেশ্য সম্বন্ধে কিছুই জানানাে হয়নি। মার্কিন রাষ্ট্রদূত এবং বিশ্বাসের অযােগ্য অন্যান্য ব্যক্তিদের পাশ কাটিয়ে সিআইএ যােগাযােগ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সরাসরি হােয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদে কিসিঞ্জার এবং স্যানডার্স-এর কাছে সব … সংবাদ চলে যেতাে। এদিকে কোলকাতায় হােয়াইট হাউস-এর সরাসরি প্রতিনিধি হিসাবে যাকে চিহ্নিত করা হয়েছিল, সেই জর্জ গ্রিফিন এ সময় চট করে এক সংক্ষিপ্ত পাকিস্তান সফর শেষে ফিরে এলেন কোলকাতায়। জর্জ গ্রিফিন পদোন্নতি লাভ করলেন এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ের পরিচালক স্যানডার্স-এর (কট্টর কিসিঞ্জার সমর্থক) সহকারী হিসাবে নিযুক্ত হলেন।
ওয়াশিংটনে প্রেসিডেন্ট কার্টার প্রশাসন যখন ক্ষমতায় এল তখন কিসিঞ্জারের (প্রাক্তন পররাষ্ট্র মন্ত্রী) ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের মধ্যে মাত্র অল্প কয়েকজন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চাকুরিতে অবশিষ্ট রইলেন। এরা পদোন্নতিও লাভ করলেন। এদের মধ্যে সেই হ্যারলড স্যানডার্স অন্যতম। প্রেসিডেন্ট কার্টার-এর আমলে স্যানডার্স পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গােয়েন্দা বিভাগ থেকে পদোন্নতি লাভ করে নিকট প্রাচ্য এবং দক্ষিণ এশিয়া বিভাগে সহকারী মন্ত্রী নিযুক্ত হলেন।… | ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে মুজিব নিহত হলেন। ততদিনে জাতীয় নিরাপত্তা বিভাগের ১৯৭১ সালের দক্ষিণ এশিয়ার নীতি নির্ধারকরা পররাষ্ট্র দফতরের বড় বড় কর্মকর্তা হয়ে গেছেন। ১৯৭৩-এ উইলিয়াম রজার্সের প্রস্থানের পর জাতীয় নিরাপত্তা বিভাগ এবং পররাষ্ট্র দফতরকে কেন্দ্র করে পররাষ্ট্র নীতি নির্ধারণে যে দ্বন্দ্ব ছিল, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে কিসিঞ্জার-এর নিয়োগের পর তার অবসান হলাে। এক বছর পর ১৯৭৪-এর শরতে মুজিব বিরােধী কিছু ব্যক্তি ঢাকাস্থ কূটনৈতিক মিশনের সাথে যােগাযােগ করেন বলে উচ্চ পর্যায়ে দূতাবাস সূত্রে জানা গেছে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশে সম্ভাব্য ক্ষমতা বদলে যুক্তরাষ্ট্রের মনােভাব যাচাই করে দেখা। এই খবরটা পররাষ্ট্রমন্ত্রী মহােদয়ের দফতরে এবং গোয়েন্দা বিভাগে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। অর্থাৎ ওয়াশিংটনে বসে কিসিঞ্জার, স্যানডার্স এবং গ্রিফিন খবরটা জানতে পারেন। কিসিঞ্জার এবং স্যানডার্স-এর সাথে সাক্ষাৎকারের ব্যাপারে যােগাযােগ করা হলে কিসিঞ্জার এবং স্যানডার্স দুজনেই এ মর্মে বলেছেন যে, শেখ মুজিবুর রহমানের উত্থাত সম্বন্ধে তারা আগে থেকেই অবহিত ছিলেন। অথচ এ সম্পর্কে কিছু জানতেন কিনা এই প্রশ্নের উত্তরে এরা ইতিপূর্বে কোনাে মন্তব্য করতে অস্বীকার করেন।
সূত্রঃ মুজিবের রক্ত লাল – এম আর আখতার মুকুল