ও জেনারেল, মাই জেনারেল
মোফাজ্জল করিম
১৯৭২ সালের ১০ এপ্ৰিল আমি তৎকালীন যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে উপসচিব হিসেবে যোগদান করি। ঐ মন্ত্রণালয়ের অধীনে তখন আল্লার দুনিয়ার তাবৎ যোগাযোগ বলতে যা বোঝায় তার সবই ছিল; সড়ক, রেলপথ, জাহাজ, বন্দর, বিমান, ডাক, তার ইত্যাদি সব। আমার ভাগে পড়ল জাহাজ ও বন্দর। আমি ডেস্ক অফিসার। জাহাজের খবর নেয়ার দায়িত্ব আমার। জীবনে কোনোদিন গয়নার নাওয়ের চেয়ে বড় কোনো জলযান আমি দেখিনি। এখন আদার বেপারি থেকে এক গুঁতোয় জাহাজের খবর নেয়ার চাকরি।
প্ৰথমে দিন একটা টেলেক্স-বার্তায় দেখলাম ‘বিল অব লেডিং’ কথাটা লেখা আছে। ভাবলাম ছাপার ভুল-বিল অব লোডিং হবে। ঐদিনই বিকেলে নিউ মার্কেটের বইয়ের দোকানে ডিকশনারি অব শিপিং খুঁজতে গেলাম। মিলল না। বুঝলাম, কপালে দুঃখ আছে।
সৰ্প হয়ে যে দংশন করেছিল। সেই সরকারই ওঝা হয়ে ঝাড়ল মাত্র দুদিনের মাথায়। মন্ত্রিসভায় বিরাট ওলট-পালট হয়ে গেল। যোগাযোগ মন্ত্রণালয় ভেঙ্গে খান খান হয়ে হলো তিন টুকরো- (১) সড়ক, রেলপথ ও বন্দর, (২) জাহাজ চলাচল, অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন ও বিমান এবং (৩) ডাক, তার ও টেলিফোন। মন্ত্রী যথাক্রমে ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, জেনারেল মহম্মদ আতাউল গণি ওসমানী এবং মোল্লা জালালউদ্দিন। তিন মন্ত্রণালয়ের বাটোয়ারানামায় আমার নাম লেখা হলো দ্বিতীয়টিতে।
১৩ এপ্রিল সকালে মন্ত্রী এলেন দপ্তরে। তখনকার দ্বিতীয় নয়তলা দালানের অষ্টম ও নবমতলার কিয়দংশে আমাদের মন্ত্রণালয়। মন্ত্রীর কামরা নয়তলায়। তার ওপরে আকাশ। সরকার মন্ত্রী মহোদয়কে নিঃসন্দেহে খুব উচুতে স্থান দিয়েছিলেন। ঘটনাচক্ৰে মন্ত্রীর কামরার ঠিক নিচের কামরায় আটতলায় বসতাম আমি। অর্থাৎ আমার মাথার ওপরে শব্দার্থেই ছিলেন মন্ত্রী।
প্রথম দিনে মন্ত্রী এসেই ঘুরে ঘুরে সব কামরায় গেলেন। হাত মেলালেন পিয়ন-চাপরাশি থেকে শুরু করে আমাদের সকলের সঙ্গে। তিনি একাই ঘুরলেন একজন সঙ্গী নিয়ে। পরনে আদ্দির সাদা পাঞ্জাবি ও আলীগড়ি কাটের পাজামা। মাথায় কাল রামপুরি টুপি আর সেই কাল টুপির সঙ্গে কনট্রাস্ট হিসেবে তার তুষারধবল সুবিশাল ট্রেড মার্ক গোঁফ-জোড়া, যে গোঁফের কারণে আড়ালে-আবডালে কেউ কেউ তাকে ডাকত জেনারেল মোচমানী বলে। কথায়-বার্তায় বিনয়ে বৈষ্ণব।
খৰ্বকায় ওসমানী সাহেবের খড়ের আঁটির মতো দুই বান্ডিল গোফ ছাড়া বাদ বাকি চেহারা ছবি দেখে জেনারেল বলে মনেই হতো না। তার উচ্চতা নিয়ে তিনি একটি কাহিনী অনেককেই শুনিয়েছেন। কিংস কমিশনের মৌখিক পরীক্ষায় বোর্ডের একজন পরীক্ষক তাকে বলেছিলেন, মি. ওসমানী, তুমি কি তোমার এই খর্বাকৃতি অবয়ব সম্বন্ধে অবহিত আছ? ওসমানী সাহেব বললেন, হ্যাঁ, আছি। ঐ প্রশ্নকর্তা আবার বললেন, এই ছোটখাট শরীর নিয়ে তুমি কী করে বিশালদেহী পাঞ্জাবী, সিন্ধী, পাঠানদেরকে কম্যান্ড করবে? তরুণ ওসমানী জবাব দিলেন, স্যার, আমার খর্বাকৃতি সম্বন্ধে আমি যেমন সচেতন আছি, তেমনি আমি অবগত আছি নেপোলিয়ন বোনাপার্টি থেকে আমি দুইঞ্চি লম্বা।
আমরা ভেবেছিলাম মন্ত্রী বোধহয় সব অফিসারকে নিয়ে পরিচিতি সভা গোছের কিছু একটা করবেন। কিন্তু তিনি তা করলেন না। প্রথমদিন থেকেই শুরু করলেন কাজ-কর্ম। আমরা ফাইল পাঠাতে শুরু করলাম। নিতান্ত সাদামাঠা দু’-একটা ফাইল ব্যতীত বাকীগুলো আর ফেরত আসে না। খুব জরুরি বিষয় তৎকালীন সচিব জনাব নূরুল কাদের খান (মরহুম) নিজেই ফাইল নিয়ে আলাপ করতে যেতেন মন্ত্রীর সঙ্গে।
এদিকে আমি পানি থেকে একলাফে উঠে গেলাম আকাশে। দায়িত্ব পেলাম, বাংলাদেশ বিমান, বেসামরিক বিমান চলাচল অধিদপ্তর (তখন ওটা অধিদপ্তরই ছিল), বিমান বন্দর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা সেল, প্রশাসন ইত্যাদির। তখন মন্ত্রণালয়গুলোতে অফিসারদের সংখ্যা এখনকার মতো এত বেশি বেশি ছিল না। আমাদের একেকজনের প্লেট ছিল তাই টুব-টুব।
সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই মন্ত্রী সব ব্যাপারেই মোটামুটি সড়গড় হয়ে গেলেন। ফাইল ও ফেরত আসতে লাগল হুড়মুড় করে। যে ফাইলই আসে তাতেই আমরা হুমড়ি খেয়ে পড়ি। কারণ? কারণ মন্ত্রী শুধু স্বাক্ষর করে ফাইল ফেরত পাঠান না, লম্বা নোট লেখেন। লম্বা বলে লম্বা। হাতে লিখে প্যারার পর প্যারা। কখনো দু’তিন পৃষ্ঠা। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, নোটের শুরুতেই হয়ত লিখলেন ‘ইয়েস’ এবং সেটাতেই একটা অনুচ্ছেদ নম্বর দিলেন বসিয়ে। তারপর সেই এক শব্দের অনুচ্ছেদের পরে আরেকটি অনুচ্ছেদ এবং সেটা শুরু ‘বাট’ (কিন্তু) শব্দ দিয়ে। তারপর উপ-অনুচ্ছেদ, তস্য উপ-অনুচ্ছেদ, এবিসিডি, রোমান ওয়ান, টু, থ্রি ইত্যাদির ছড়াছড়ি। হাতের লেখা যেমন তেমন, কিন্তু কাটাকাটিতে ভরতি। আবার কবি জীবনানন্দর মতো লাইন টেনে টেনে মার্জিনে নিয়ে গিয়ে ওখানেই কিছু কিছু সংযোজনী, সংশোধনী। মন্ত্রী মহোদয়ের আসল সিদ্ধান্ত বা নির্দেশটা যে কী তা বুঝতে প্রায়শই আমাদের গলদঘর্ম হতে হত। রীতিমতো যেন প্ৰাচীন মিশরীয় শিলালিপি পাঠোদ্ধারের জন্য গবেষণা। প্ৰায় প্ৰত্যেকটি নোটে থাকত নানাবিধ উপদেশ ও দিক-নির্দেশনা। তার সবই যে বিষয়ানুগ হতো না তা নয়। তবে একথা ঠিক, সবগুলোতেই মাননীয় মন্ত্রীর অভিজ্ঞতার ছাপ থাকত এবং সেইসঙ্গে তার মন্ত্রণালয়ের সকলের যাতে কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি পায় তার জন্য আন্তরিক চেষ্টা।
তখন ইংরেজীতেই বেশিরভাগ চিঠিপত্র, নোট ইত্যাদি লেখা হত। আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, ব্রিটিশ ভারতের কিংস কমিশনপ্রাপ্ত অফিসার, আজীবন সাহেবী কায়দা-কানুনে অভ্যস্ত জেনারেল ওসমানীর জন্য তাতে সুবিধাই ছিল। ইংরেজী লিখতেন জলের মতো, বলতেন অনর্গল। লেখা এবং বলা দু’টোতেই সাহেবী ঢং। তবে লেখাটা ছিল ভিক্টোরিয়ান ষ্টাইলের। কখনো কখনো এক বাক্যে নোটের আধাপৃষ্ঠা কাভার। দেদার কমা, সেমিকোলন, ড্যাশ ইত্যাদিতে সজ্জিত হয়ে বাক্যগুলো ছিল বুটিদার শাড়ির জমিনের মত। কখনো কখনো যখন বাংলা লিখতেন সে বাংলা ছিল বেশ মজার। দেখলেই বোঝা যেত ইংরেজির কষ্টকর অনুবাদের মতো করে লেখা বাংলা। একবার এক নথিতে লিখলেন; ‘হাশিয়াতে আমার নির্দেশ দেখুন’। ভাগ্যিস, নথিটি ছিল আমার শাখার। অন্য কারো হাতে পড়লে হয়ত ‘হাশিয়া’ শব্দের অর্থ খুঁজতে সেমিনার ডাকতে হত। শব্দটি আমাদের সিলেটের গ্রামাঞ্চলে ব্যবহৃত হয়, অর্থ কিনারা। মন্ত্রী মহোদয় ইংরেজী ‘মার্জিন’ শব্দের পরিবর্তে লিখেছিলেন ‘হাশিয়া”। তার বাংলা বানানজ্ঞানের জন্যও, আর যাই হোক, তিনি খুব একটা প্ৰসিদ্ধ লাভ করেননি। শ স ষ এবং ন ণ-এর স্বেচ্ছাচারী ব্যবহার ছিল সর্বত্র।
ইংরেজী চিঠি লিখতেন খুব চমৎকার। তার সাহেবী উচ্চারণের জন্য ষ্টেনো টাইপষ্টরা সকলেই নাকানি-চুবানি খেত। ফলে বেশিরভাগ চিঠিই লিখতেন নিজের হাতে। সে সব চিঠির কায়দা-কানুনও ছিল অন্যরকম। সম্বোধনটা কী রকম হবে, শ্রদ্ধা বা শুভেচ্ছা জানাবেন কী বলে, চিঠির পৃষ্ঠার ডান-বায়ের ‘হাশিয়াতে’ জায়গা ছাড়তে হবে কতটুকু, খামের ওপরে প্রাপকের নাম কীভাবে লেখা হবে ইত্যাদি খুঁটিনাটির ব্যাপারে তিনি ছিলেন দারুণ খুঁতখুঁতে। বিশেষ করে পত্র প্রাপকের নামের বানান, ডিগ্রি-ডাগ্রির উল্লেখ, পদবী প্রভৃতি সঠিক ও নির্ভুল না হলে রীতিমতো ফাঁসির আদেশ হয়ে যেত সংশ্লিষ্ট টাইপিষ্ট বা কর্মকর্তার। আর মন্ত্রী মহোদয় চিঠিও লিখতেন বটে। অজস্র চিঠি । এর বেশিরভাগই বিভিন্ন মানুষের জন্য সুপারিশ করে। আর না হয় উন্নয়নমূলক কাজ-কর্মের ব্যাপারে। বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধা, প্রাক্তন সৈনিক, এলাকাবাসী দরিদ্র ব্যক্তিদের চাকরি-বাকরি, চিকিৎসা, জমি-জমা সংক্রান্ত বিষয়ে হরদম চিঠি লিখতেন।
সাক্ষাৎ প্ৰাথীদের জন্য তার অবারিত দ্বার ছিল ঠিকই, তবে তা ২৭, মিন্টো রোডের বাসায়। যারা দেখা করতে আসতেন তারা বেশিরভাগই হয় মুক্তিযোদ্ধা, না হয় অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক, আর না হয় নিজ এলাকার দরিদ্র মানুষ। কালো টাকার মালিক ব্যবসায়ী, শিল্পপতি কিংবা টাউট কিসিমের নেতা-ফেতারা বড় একটা ধারেকাছে ভিড়তে সাহস পেত না। আর সত্যি কথা বলতে কী, এ ধরনের মানুষকে তিনি ভালো চোখে দেখতেন না। সবচেয়ে বড় দুর্বলতা ছিল মুক্তিযোদ্ধা শহীদ পরিবার এবং সাবেক সৈনিকদের জন্য। আর চিরকুমার ওসমানী সবচেয়ে অস্বস্তি বোধ করতেন বোধ হয় মহিলাদের উপস্থিতিতে। কথা-বার্তায় তখন ফুটে উঠত কেমন একটা লাজুক ভঙ্গিমা। সেইসঙ্গে সারাক্ষণ ‘এটিকেট’ সচেতনতা।
জেনারেল ওসমানীর দেশপ্রেম, সততা ন্যায়পরায়ণা, সময়ানুবর্তিতা ছিল প্ৰবাদ প্রতিম। এসব গুণে কোনটি কম তা বলা মুশকিল। সিদ্ধান্ত গ্ৰহণে সবকিছুর ওপর স্থান দিতে হবে দেশের স্বাৰ্থ-এই নীতিতে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ অবিচল। কেউ তাকে এ ব্যাপারে অথবা অন্য যেসব তিনি বিশ্বাসী ছিলেন তা থেকে বিন্দুমাত্র টলাতে চাইলে তার রসগোল্লার মত বড় চোখ দুটি মুহুর্তে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের চোখের মত জুলে উঠত। আর সেইসঙ্গে দাঁত দু’পাটির কিড়মিড় শব্দসহযোগে অজস্র ইংরেজী খিস্তি-খেউড়ের অকুণ্ঠ ব্যবহার। শুনে আমাদের কান গরম হয়ে যেত। রেগেমেগে প্রায়ই বলে বসতেন, ‘ইফ আই হ্যাভ টু এগ্রি টু দিস দেন আই শ্যাল রাইট নাও আস্ক বঙ্গবন্ধু টু টেক মাই জব ব্যাক’। এমনিভাবে মুখে মুখে কতবার যে মন্ত্রিত্বে ইস্তফা দিয়েছেন। শোনা যায়, দু’একবার লিখিত ইস্তফাপত্ৰও দাখিল করেছিলেন তিনি বাকশাল ইসুতে শেষমেষ মন্ত্রিত্ব ও সংসদ সদস্যপদ ছেড়ে দেয়ার আগেই।
অনেক বিষয়েই চট করে রেগে যেতেন তিনি। এর একটি ছিল সময়ানুবর্তিতার লজঘন । এ ব্যাপারে জেনারেল সাহেব বোধ হয় ব্রিটিশদেরও হার মানাতেন। যাকে বলে, ‘মোর ক্যাথলিক দ্যান দ্য পোপ অব রোম হিমসেলফ’। একবার তার এক নির্বাচনী মিটিংয়ে তিনি গেছেন এক গ্রামে। মিটিং হবে অপরাহ্ন তিনটা না চারটার দিকে যেন। তিনি তো কাঁটায় কাঁটায় ঠিক সময়ে গিয়ে হাজির। কিন্তু লোকজন কেউ তখনো আসেনি বড় একটা। গ্রামের মানুষের সময়জ্ঞান তো আর অত টনটনে নয় তার মত। তার ওপর সময়টাও বড় বেখাপ্পা। যা হোক, বাংলাদেশে এসব বিষয়ে আমরা সকলেই মোটামুটি অভ্যস্ত। কিন্তু জেনারেল ওসমানী বলে কথা। তিনি অল্প কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে রেগেমেগে চলে গেলেন সভাস্থল ত্যাগ করে। যাওয়ার সময় নাকি বলে গেলেন, যাদের সময়জ্ঞান নেই মোটেই তাদের ভোটের আমার দরকার নেই।
১৯৭৩ সালের একটা ঘটনায় আমরা টের পেলাম ওসমানী সাহেব কী রকম দৃঢ়চেতা। ঐ বছর আগস্ট মাসে ভারত থেকে একটা প্রতিনিধি দল আসে আমাদের সঙ্গে বিমান চলাচল চুক্তি স্বাক্ষর করতে। ওরা আসার আগে আমরা মন্ত্রী মহোদয়ের সঙ্গে বার বার বৈঠক করে আমাদের ‘ব্ৰিফ’ চূড়ান্ত করি। এর অনেকগুলো বিষয় ছিল উভয়পক্ষের জন্য খুবই জরুরি। আমরা জানতাম ওগুলোতে কোনো পক্ষই ছাড় দেবে না। তবুও মন্ত্রী মহোদয় আমাদের বলে দিলেন একেবারে কঠিন অচলাবস্থা সৃষ্টি হলে কতদূর পর্যন্ত আমরা ছাড় দিতে পারব। আর ঐ শেষ অবস্থার নামও শিখলাম তার কাছ থেকেঃ ওটা নাকি ‘ডিগ-ইন’ পজিশন। সামরিক পরিভাষা। অর্থাৎ পিছু হটতে হটতে ঐ স্থানে পৌঁছার পর মাটিতে গর্ত খুঁড়ে বন্দুক তাক করে বসে থাক, শত্রু তোমাকে খতম করুক তবু আর পিছু হটা যাবে না।
লড়াই যখন শুরু হলো অর্থাৎ ভারতীয় দলের নেতা, তাদের যুগ্মসচিব মি. খোসলা এবং আমাদের নেতা যুগ্মসচিব মকসুদ আলী যখন বিনাযুদ্ধে আর সুঁচ পরিমাণ ভূমিও ছাড় দিতে নারাজ তখন ড. আলী আমাকে কানে কানে বললেন, যাও মন্ত্রীকে গিয়ে অবস্থা জানিয়ে এস,. আর এখন কী করা যায় শুনে এস। আমি গেলাম পাশের কামরায় মন্ত্রীর কাছে, অনেকটা করদ রাজ্যের রাজদূতের মত। গিয়ে বললাম ভারতীয়রা কিছুতেই মানছে না আমাদের প্রস্তাব। এখন কী করব? ‘শুনি বিবরণ ক্ৰোধে তিনি কন…’। দূতহত্যা নিতান্তই রাষ্ট্রাচার বিরোধী, নইলে সেদিন আমার সশরীরে বেরিয়ে আসা সম্ভব ছিল না। তবে আমাদের প্রতিপক্ষের উদ্দেশ্যে যেসব শব্দাবলী প্রয়োগ করলেন তা কহন্তব্য নয়।
এমন সময় মন্ত্রীর একান্ত সচিব ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী ছুটতে ছুটতে এসে জানাল ভারতীয় ডেপুটি হাই কমিশনার জে এন দীক্ষিত আসছেন মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে। স্পষ্টতই বোঝা গেল চুক্তিজট এবং আমাদের বিতণ্ডার খবর পৌঁছে গেছে ভারতীয় দূতাবাসে। তার মানে, পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে উঠেছে। মন্ত্রীর ওপর এখন পড়বে কূটনৈতিক চাপ। মন্ত্রী তো একেবারে ‘নট নড়ন চড়ন, নট ইষ্টেট নাথিং, অবস্থান নিয়ে আছেন। তা হলে কী করা যায়? কে যেন এসে বলল দীক্ষিত বাবু লিফট থেকে বের হয়ে পিএস ইফতেখারের রুমে গিয়ে ঢুকেছেন।
এসব ক্ষেত্রে আমার ‘শোল মাছের এক লাফ’ বুদ্ধি দেখেছি খোলে ভালো। আমি সাহস করে মন্ত্রীকে বললাম সেই মুহূর্তে কেটে পড়তে, যাতে মিঃ দীক্ষিতের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ না হয়। মন্ত্রী তাই করলেন। টেবিলের ওপর থেকে রামপুরি টুপিট তুলে নিয়ে মাথায় বসিয়ে, দু’চারটি জরুরি কাগজ বগলদাবা করে পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে সোজা চলে গেলেন। মাঝখানের সিঁড়ির দিকে। যেতে যেতে বলে গেলেন আমাদের অবস্থান থেকে একতিলও না সরতে। যেন বড়ইবাড়ি বিডিআর ফাঁড়ির জওয়ানদের প্রতি সেক্টর কমান্ডারের নির্দেশ। …সেবার সাতদিন যমে-মানুষে টানাটানির পর খোসলা সাহেবের দল চুক্তি স্বাক্ষর না করেই আলোচনার টেবিল থেকে দৌড়াতে দৌড়াতে চলে যায় তেজগাঁ বিমানবন্দরে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স-এর ফ্লাইট ধরতে। আমরা পিছু পিছু গিয়ে কত সাধলাম তাদের আলোচনার টেবিলে ফিরিয়ে আনতে, কিন্তু সকলি গরল ভেল। মন্ত্রী মহোদয়কে যখন ঘটনা জানালাম তখন তিনি দাঁত কিড়মিড় করে ঐ পুরানো কথাই আবার উচ্চারণ করলেন; ‘লেট দেম গেট……। ইফ আই হ্যাভ টু এগ্রি…..’। ইত্যাদি।
স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে ওটাই ছিল ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রথম কোনো ব্যর্থ আলোচনা। জেনারেলের দৃঢ়তার জন্য আমাদেরকে, তার ভাষায়, ‘ডটেড লাইনে’ স্বাক্ষর করতে হয়নি। আরো উল্লেখ্য, পরের বছর অর্থাৎ ১৯৭৪ সালে আমরা যখন উচ্চ পর্যায়ের হস্তক্ষেপে দিল্লী যাই এই আলোচনা আবার শুরু করতে, তখনও জেনারেল সাহেবের একই কথা, ভাঙ্গিও কিন্তু মচকাইও না। সুখের বিষয়, দিল্লীতে ভারতের তৎকালীন বিমান মন্ত্রণালয়ের সচিব প্ৰবীণ আইসিএস অফিসার মি. সায়গলের নেতৃত্বাধীন দলকেও আমরা ছাড় দেইনি, আমাদের দাবিগুলো অক্ষুন্ন রেখেই আমরা চুক্তি স্বাক্ষর করি। সেবারও আমাদের দলপতি ছিলেন ড. শেখ মকসুদ আলী। তিনি ছিলেন একজন মৃদুভাষী অথচ নীতির প্রশ্নে আপোষহীন ও সৎ সিভিল সারভেন্ট।
১৯৭২ সালের ৪ জানুয়ারি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের জন্ম। ভারতীয় বিমান বাহিনী থেকে পাওয়া একটিমাত্র ডাকোটা এরোপ্লেন (প্রথম বিমান ফ্লাইট ৪ ফেব্রুয়ারী, ১৯৭২ এবং একটি ট্রেনিং ফ্লাইটের সময় ১০ ফেব্রুয়ারি ওটা বিধ্বস্ত হলে ক্যাপ্টেন নাসির হায়দারসহ কয়েকজন মারা যান) এবং পিআইএ থেকে আগত বাঙ্গালি কর্মকর্তা-কর্মচারী-পাইলট-প্রকৌশলী নিয়ে হাঁটি হাঁটি পা পা করে এর যাত্রা শুরু। ঐ ডাকোটা এয়ারক্রাফটটি দুর্ঘটনায় বিধ্বস্ত হওয়ার পর ভারত থেকে দু’টি পুরনো এফ-২৭ পাওয়া গেল। ‘৭২-এর জুন মাসে টেম্পলউড কোম্পানি থেকে একটা বোয়িং-৭০৭ এয়ারক্রাফট লিজ নিয়ে প্রথম ঢাকা -লন্ডন ঢাকা আন্তর্জাতিক রুটে জাতীয় পতাকাবাহী বিমান উড়ল আকাশে। ক’দিন পর অস্ট্রেলিয়া দিল দুটি পুরানো এফ-২৭ এবং ডাচ সরকারের অনুদানে ঐ ধরনের আরো দুটি নতুন বিমান কেনা হলো ফোকার কোম্পানি থেকে। এভাবে যখন বিমান কেবল ডানা মেলতে শুরু করেছে তখন স্বভাবতই সরকারের উৎকণ্ঠা এয়ারলাইনটি উড়তে না উড়তেই যেন মুখ থুবড়ে না পড়ে। জেনারেল সাহেবের নাওয়া-খাওয়া হারাম বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের চেষ্টায়। তিনি শুরু থেকেই সবকিছু নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিলেন। নিজের নিয়ন্ত্রণে মানে মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে। ছোট বড় সব সিদ্ধান্তই দেবে মন্ত্রণালয়। ফলে শিশু বিমান কেবল হামাগুড়ি দিতে থাকল, দু’পায়ে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শিখল না। এ ব্যাপারে তখনকার বিমান সচিব জনাব সুলতানুজ্জামান খান (জনাব নূরুল কাদের খানকে মাস তিনেকের মধ্যেই সরিয়ে দেয়া হয় মন্ত্রণালয় থেকে) মন্ত্রীকে যথেষ্ট বোঝাতে চাইলেন, কিন্তু ফলাফল শূন্য। মন্ত্রীর ধারণা, সূতো একটু ছেড়ে দিলে ভো-কাট্টা হয়ে যাবে ঘুড়ি। মন্ত্রীর ভাষায়ঃ ‘ইফ ইউ লিভ ইট উইথ দেম, দে উইল কুক দ্য গুজ’। আমরা লক্ষ করলাম, মন্ত্রী মহোদয় ভীষণ সন্দেহপ্রবণতায় ভোগেন। হয়ত বিমানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্বন্ধে কোনও গোয়েন্দা সংস্থাও তার কাছে বেশি বেশি লাগিয়ে থাকবে।
একবার হলো কী, বিমানের এক সিনিয়র কর্মকর্তা আমার কাছে ছুটতে ছুটতে এলেন। কী ব্যাপার? না আমেরিকা থেকে তারবার্তা এসেছে-তার বড় ভাই মৃত্যুশয্যায়। তাকে আজ রওয়ানা হতে হবে ভাইকে শেষ দেখা দেখতে। এই ভাইটি তাকে পড়াশুনা করিয়েছেন, মানুষ করেছেন।
তখন নিয়ম ছিল, বাইরে যেতে হলে মন্ত্রীর অনুমতি লাগবে। (ভালো কথা, আজকাল নাকি ব্যক্তিগত প্রয়োজন বাইরে যেতে চাইলে চরফ্যাশনের একজন পিয়নের নথিও প্রশাসনিক সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে যায় অনুমোদনের জন্য। এরূপ ব্যবস্থাপনায় পিয়ন পদের মর্যাদা দেখে যেমন ঈর্ষা লাগে তেমনি এ ধরনের ছোট-খাট বিষয়ে অনাবশ্যক দীর্ঘসূত্ৰতাও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ব্যস্ত রাখার আমাদের কূটকৌশল দেখেও অবাক হতে হয়)। যা হোক, জেনারেল ওসমানীর আবার কাউকে বিদেশ যেতে দিতে ভীষণ এলাৰ্জি ছিল। আমরা তাই বাইরে যাবার ‘কেস’ গুলো প্রচলিত নীতিমালার আলোকে খুব যাচাই-বাছাই করে দেখতাম। তা ঐ অফিসারের নথিটি মানবিক কারণে আমি তক্ষুণি যুগ্ম সচিব ও সচিবের কাছে হাতে হাতে গিয়ে সই করিয়ে নিলাম। তারপর নিজেই গেলাম মন্ত্রী মহোদয়ের কাছে। এদিকে ঐ আবেদনকারী অফিসার সাশ্রুনয়নে আমার কামরায় বসে আছেন। মন্ত্রী মহোদয়ের মুড দেখলাম খারাপ না। আমি খুব তরিবতের সঙ্গে বিষয়টি বললাম। ও আল্লা। মন্ত্রী দেখি কোথায় সহি করবেন তা না আমাকে বললেন, প্লিজ সিট ডাউন।
লেট আস ট্রাই টু ভেরিফাই দ্য কেস। আমি মনে মনে খুব ক্ষুব্ধ হলাম। একটা লোকের ভাই মারা যাচ্ছে ১২ হাজার মাইল দূরে, আর এই হুজুর কেস ভেরিফাই করতে বসলেন। আমি সাহস করে বললাম, কিন্তু স্যার, ওর ভাইটি যদি ইত্যবসরে পটল তোলে? তিনি বললেন, মরার হলে তো ভাই আমেরিকা পৌঁছার আগেও মরতে পারে। বলতে বলতে লাল টেলিফোন তুলে তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব জনাব কিবরিয়ার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলেন। লক্ষ্মৌয়ি ও সিলেটি শরাফতির সঙ্গে মিলিটারি ও কূটনৈতিক সার্ভিসেস রাষ্ট্রাচারের ভিয়েন দিয়ে দীর্ঘ কুশলাদি বিনিময়ের পর (পাঞ্জাবীরা এ ব্যাপারে খুব বৈষয়িক। তারা বিবি-বাচ্চাদের খোঁজ-খবর নেয়ার পর মাল-মবায়েশিয়া, ডাঙ্গর অর্থাৎ সয়সম্পত্তি, গবাদিপশু ইত্যাদিও খায়-খয়রিয়াত জিজ্ঞেস করে। উল্লেখ্য, পাঞ্জাবে আগে-এখন জানি না, খুব মহিষ চুরি হত। সংঘবদ্ধমহিষ চোরদের যারা প্রতিরক্ষণ করত তাদের বলত রসাগীর অর্থাৎ আসল রাশিটা থাকত তাদের হাতে)। তিনি বললেন, কিবরিয়া, ইন ওয়ান অব মাই আউটফিটস দেয়ার ইজ এ চ্যাপ কলড. । হি টেলস আস দ্যাট হি হ্যাজ গট এ টেলিগ্ৰাম ফ্রম দ্য স্টেটস। … প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে বললেন, একটু খোঁজ নিন তো ব্যাপারটা সত্যি কিনা। বাট সুয়্যরলি দিস শুড বি ডান ডিসক্রিটলি এ্যান্ড আ লিটল কুইকলি বাই আওযার মিশন ইন ওয়াশিংটন। মন্ত্রী মহোদয়ের এ ধরনের গোয়েন্দাগিরি আমার ভালো লাগল না। বেচারার ভাই মারা যাচ্ছে বিদেশে আর উনি গোয়েন্দা লাগাচ্ছেন তার পিছে। তাছাড়া বিমানের কর্মচারীদের বিদেশ যেতে টিকেট বাবদ সরকারি-বেসরকারি কোনো খরচই লাগে না, যেহেতু এসব সিনিয়র অফিসাররা ইন্টারলাইন ট্রাভেলের সুবিধা পান। যা হোক, কী আর করা। ‘বস ইজ অলওয়েজ রাইট’। এই থিয়োরি তো চাকরিতে ঢুকেই মুখস্থ করেছি। মন্ত্রী বললেন, ফাইলটা তার কাছে রেখে আসতে এবং ঐ অফিসারকে বলতে যে দু একদিনের মধ্যে আদেশ জারি হয়ে যাবে। মন্ত্রী আজ ব্যস্ত তাই আজ আর হলো না। তবে অফিসারটি যাত্রার প্রস্তুতি নিতে পারেন।
দু’দিন পর মন্ত্রী হঠাৎ ফোন করলেন আমাকে। করিম, ক্যান ইউ প্লিজ শাট ডাউন ইওর শপ ফর এ মিনিট এন্ড কাম টু মাই অফিস? ছুটতে ছুটতে গেলাম মন্ত্রীর রুমে। ঢুকতেই তিনি আমাকে চেয়ার দেখিয়ে বসতে বললেন এবং একটি ট্যালেক্স বার্তা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, রিড ইট। দেখি বার্তাটি এসেছে বাংলাদেশ দূতাবাস ওয়াশিংটন থেকে। তার সারমর্ম হচ্ছে, অমুকের বড় ভাই অমুকের খোঁজ নিয়েছি আমরা তার বাসায় লোক পাঠিয়ে। তিনি বহাল তবিয়তে আছেন। তবে আমরা খোজ নিচ্ছি দেখে তিনি কিছুটা আপসেট হয়ে যান।
এবার টেলেক্স- বার্তা পড়ে আমার তো পুরো সেটআপই আপসেট হওয়ার দশা। জেনারেল শুধু মৃদু হাসলেন এবং বললেন ‘বেটাকে এবার মাফ করে দিলাম। কিন্তু ভবিষ্যতে তার পশ্চাদ্দেশে কষে লাগানোর জন্য একটি পদাঘাত তোলা রইল’ নথিতে বিশেষ কিছু না লিখে শুধু লিখলেন, ইট ইজ অলওয়েজ গুড টু গেট থিংস চেকেড্ এ্যান্ড দেন বি স্যুয়র। হ্যা, স্বীকার করি, সন্দেহ প্রবণতার বাতিক ছিল জেনারেল ওসমানীর। কিন্তু নিরাপদ নিশ্চিতকরনের প্রয়োজনে তাকে প্রায়শই অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। তার সেনাজীবনে যেমন এই নিরাপত্তা সংক্রান্ত ব্যবস্থা গ্ৰহণ নিয়ে অনেক গল্প আছে, মন্ত্রী হয়ে বিমান, বিমানবন্দর, জাহাজ, সমুদ্রবন্দর ইত্যাদিতেও এর প্রয়োগ নিয়ে তার বাড়াবাড়ি সকলকে ব্যাতিব্যস্ত করে তুলেছিল। কিন্তু এও ঠিক, স্বাধীনতার পর এ সকল নতুন নতুন সংস্থায় একজন কড়াকড়ি না করলে এগুলোর অস্তিত্ব আঁতুড়েরই হয়তো বিপন্ন হয়ে পড়ত।
নিয়ম-কানুন-শৃঙ্খলার প্রয়োগে তাকে কোনো স্বজনপ্রীতি বা দলীয়প্রীতির প্রশ্ৰয় দিতে দেখিনি কখনো। তখন ব্যাঙের ছাতার মতো ট্রাভেল এজেন্সি ব্যবসা গজিয়ে উঠছে চারদিকে। সদ্য স্বাধীন দেশ, লোকজনের বিদেশ যাত্ৰা হঠাৎ করে বেড়ে গেছে বলেই এ ব্যবসার রমরমা। অনেক ঠক-জোচ্চোর ঢুকে পড়েছে এই ব্যবসায়। মন্ত্রী মহোদয় আইন করে দিলেন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়া কেঊ এই ব্যবসা করতে পারবে না। কড়া কড়া শর্ত লাগিয়ে দিলেন অনুমতিপ্ৰাপ্তির জন্য। ফলে প্ৰায় সব দরখাস্তই তার কাছে গিয়ে না হয়ে আসে। একবার এক দরখাস্ত পেলাম, দরখাস্তকারীর গ্রামের নাম দয়ামীর। মন্ত্রী সাহেবের গ্রামের লোক বা আত্মীয়-টাত্মীয় হবে । নথি পাঠিয়ে অপেক্ষায় থাকলাম দেখি এই পরীক্ষায় মন্ত্রী পাস করেন কিনা। এটাও না হয়ে এল। মন্ত্রী দশে দশ পেলেন পরীক্ষায়। এমনি অসংখ্য উদাহরণ আছে।
তার কাছে কোনো ফাইল একদিনের বেশি কচিৎ পড়ে থাকতে দেখেছি। অফিসে অনাবশ্যক আডডা বা ফালতু দর্শনার্থীর ভিড় ছিল না বলে টেবিলে নাক ডুবিয়ে কাজ করতেন নিরিবিলি বসে। ‘প্লিজ ডিসকাস’ বা “আলাপ করুন’ বলে নথি ফেরত দিতেন খুব কম। আলোচনা করতে হলে সংশ্লিষ্ট অফিসারকে ডেকে নিতেন অফিসে।
আমার আবার কখনো কখনো তার বাসায় (২৭নং মিন্টো রোড) ডাক পড়ত অসময়ে। আমার আস্তানা ছিল কাছেই, বেইলি রোডের সার্কিট হাউসে। আমি হয়ত রাত ৮টা/৯টায় অফিস থেকে ফিরেছি। পরিশ্রান্ত হয়ে। হয়ত কেবল খেয়ে-দেয়ে উঠেছি, এমন সময় ফোন। স্যার বলছেন? তার বাসায় তার অতি বিশ্বস্ত এন.সি.ও সাত্তার যে ছিল তার ফ্রেন্ড, ফিলসফার এ্যান্ড গাইড-এর গলা। স্যার, মিনিস্টার সাহেব কথা বলবেন। আমি তখনই বুঝতাম আজ রাত দুপুর পর্যন্ত আরাম হারাম হয়ে গেল। তবে তার আমন্ত্রণটি ছিল মন-কাড়া। করিম? হাউ আর ইউ? হাউ ইজ ম্যাডাম? হাউ আর দ্য চিলড্রেন ডুয়িং—করিম? উড ইউ মাইন্ড ইফ আই সেনড ডাউন মাই রামশ্যাকল কার ফর ইউ আই উড বি গ্ৰেইটফুল ইফ ইউ উড কাম টু মাই প্লেস ফর এ ফিউ মিনিটস টু ডিসকাস ওভার এ কাপ অব কফি হোয়াট আই থিংক কোয়াইট আরজেন্ট— । ২৭ নম্বরের দোতলার সিঁড়ি দিয়ে উঠে বাঁ দিকের প্রথম ঘরটা ছিল তার বেডরুম। বাহুল্যবর্জিত, তবে সাহেবী কায়দায় সাজানো গোছানো বিছানার পাশেই টিপয়ের ওপর দামী ডক্যান্টার। আরেক পাশে ছোট বুক শেলফে সুন্দর করে সাজানো পুঁথি-পুস্তক, ছোট্ট একটি ওয়ার্ডরোব। ডিক্যান্টার শুধু সাজানোর জন্যই, এর কোনো ব্যবহার ছিল না।
এখানে বলা উচিত, জেনারেল ওসমানীকে কখনো মদ্য স্পর্শ করতে দেখিনি। অনেকে হয়ত জানেন না, জেনারেল সাহেব নামাজ-কালাম পড়তেন, প্ৰায় প্রতিদিন কোরান শরীফ পাঠ করতেন। তবে সবই নীরবে, লোকচক্ষুর আড়ালে।
সিঁড়ির ডান দিকের ঘরটি ব্যবহার করতেন অফিস কামরা হিসেবে। একদিন রাতে তার আহ্বানে গিয়ে দেখি জেনারেল ঐ ঘরে বসে এক মনে কাজ করছেন। গরমের দিন। জেনারেলের গায়ে শুধু একটি হাতাকাটা গেঞ্জি। টেবিলের নিচ দিয়ে দেখা যাচ্ছে লুঙ্গি গুটানো উরু পর্যন্ত। ঘরটিতে এয়ার কন্ডিশনার নেই। মাথার ওপরে ঘটাং ঘটাং করে শুধু একটা শব্দায়মান ফ্যান চলছে জোরে জোরে। সামনের ফাইলটি শেষ করে শুরু করলেন শরাফতি। তুমি সারাদিন অফিসে কাজ কর, এমনকি ছুটির পরও অফিসে থাক তিন চার ঘন্টা। তোমার কাজের চাপ বেশি। তোমার বেগম সাব নিশ্চয়ই আমাকে শাপান্ত করেন। কিন্তু কী করব বোঝই তো…ইত্যাদি। তবে ভাষা সেই ইংলিশ। সিলেটি বা বাংলা কোনোটাই না। ভাবখানা, বাড়িতে এসেছে তাতে কী হয়েছে? তুমি তো আফটার অল সিভিল সার্ভিসের একজন অফিসার এবং আমিও তো আলীগড় ইউনিভার্সিটির গ্র্যাজুয়েট তথা ব্রিটিশ আর্মির কমিশন্ড অফিসার। অতএব……। অতএব, চা খাবে না কফি? সঙ্গে চিকেন টিক্কা আর আমার কুকের নিজের বানানো চিলি সস্। কয়েক টুকরো গাঁজর, টমেটো দু’টুকরো, দু’টুকরো অষ্টগ্রামের পনীর আর হাউ উড ইউ লাইক টু স্লাইসেস অব টমেটো অলসো। ভাত খেয়ে এসেছ তাতে কী হয়েছে। ইউ আর এ ইয়ংম্যান। ইউ নো, হুয়েন আই ওয়াজ ইন দ্য জাঙ্গলস্ অব বাৰ্মা ডিয়োরিং দ্য সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ার, ওয়ান্স ইট সো হ্যাপেন্ড…।
ব্যস খুলে গেল স্মৃতির দুয়ার, শুরু হলো গল্পের আসর। বার্মার জঙ্গল থেকে তরাইনের বাঘ শিকার (‘দ্যাট ম্যাজেষ্টিক ক্রিয়েচার’) তার বাবার চাকরিস্থল শিলং-গৌহাটির গল্প, ‘সোলেন হেডেড’পাকিস্তানি ড্রাংক জেনারেলদের কাহিনী এমনি এক গল্প থেকে আরেক গল্প। যেন আরব্যরজনীর পাতা উল্টিয়ে চলেছেন এক গল্পদাদু কিংবা অনেক অচেনা বন্দরের কাহিনী শোনাচ্ছেন এক এইনশন্ট মেরিনার। আমি মোহাবিষ্ট শ্রোতার মতো শুনছি আর ভাবছি, আশ্চৰ্য, এই লোকটিকে না আমরা কত ভয় পাই, ভাবি লোকটা কী কাঠখোট্টা। জেনারেল গল্প বলতে বলতে কখনো চোখদু’টো বিস্ফারিত করছেন, কখনো ঠোঁট বাঁকাচ্ছেন কাউকে নকল করতে, কখনো হাসছেন মৃদু মৃদু। এক ফাঁকে হঠাৎ যেন স্বপ্ন ভেঙ্গে ফিরে এলেন বাস্তবের জগতে। সরি, করিম। আই হ্যাভ ডাইগ্রেসড টু মাচ। সরি ফর দ্যাট। একচুয়েলি আই ওয়ান্টেড টু ডিসকাস দ্য লিজিং অব দ্য নিউ বোয়িং ৭০৭, এ্যান্ড লুক এ্যাট মি, হোয়াট এ্যাম আই ডুয়িং বাই দ্য ওয়ে, হোয়াট ডু ইউ রিয়ালি মিন বাই ড্রাই লিজিং?– তার আকাশী নীল রংয়ের পুরোনো মার্সিডিস বেনজ গাড়িটি যখন আমাকে বাসায় নামিয়ে দিল, সার্কিট হাউস তখন গভীর ঘুমে নিমগ্ন।
১৯৭৩ -আর আগষ্টে তো ইন্ডিয়ানরা এসে তম্বি-তন্বা করে চলে গেল। আমরাও জেনারেলের শেখানো ‘শির দেগা, নাহি দেশ আমামা’ মন্ত্রের বলে মোটামুটি ভালই মোকাবেলা করলাম তাদের। কিন্তু তার আগের মাসে অর্থাৎ জুলাইয়ের ২ থেকে ১৯ তারিখ পর্যন্ত ১৭টি দিন কিন্তু ছিল অন্যরকম হিসাব-কিতাব। তখনো ছিল বিমান চলাচল চুক্তি নিয়ে আলোচনা। এবার প্রতিপক্ষ নেদারল্যান্ডস। একদিকে একটি সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ, আনাড়ি দল যারা টেস্ট খেলা তো দূরের কথা, কোন ফাস্ট ক্লাস ম্যাচেও নামেনি কোনোদিন, আরেকদিকে অস্ট্রেলিয়া। ফলে আলোচনার টেবিলে আমাদের নাকানি-চুবানি খাওয়া একটা স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল। নেদারল্যান্ডস দলের ব্রেটি লি ছিল ঐ দলের মিঃ ফিনেস্ট্রা নামের এক তরুণ আইনজীবী। আমার চাকরি জীবনে পরেও তার মতো এমন তুখোড় নিগোশিয়েটর খুব কম দেখেছি। যা হোক, এই দলটির সঙ্গে আমাদের দর কষাকষি দাঁড়াল অনেকটা ক্যাট এ্যান্ড মাউসের মত। তবে বিরাট ফায়দা হলো একটা-১৭ দিনে আমরা সবাই শিখলাম অনেককিছু। যেন ইন-সার্ভিস ট্রেনিং কোর্স করলাম একটা মন্ত্রণালয়ের সবাই। যার ফলে এরপর ইন্ডিয়া বা অন্য প্রতিপক্ষরা, জেনারেল ওসমানীর ভাষায়, ‘কুডন্ট্ টেক আস ফর এ রাইড’।
কিন্তু ঘটনা একটা ঘটে গেল ঐ জুলাই মাসেই। ডাচরা যখন প্রথম ন’তলা দালানের শীর্ষতম তলার সম্মেলন কক্ষ থেকে ১৭দিন আমাদের এই নিচে ফেলে দেবার চেষ্টা করছিল তখন আমার টেবিলে জমে ওঠে ফাইলের পাহাড়। (আমার এক অধঃস্তন সহকর্মী তার বিশেষ উচ্চারণের কারণে ‘ফাইলস হ্যভ পাইলড আপ’ বলতে পারত না, বলত ‘পাইলস হ্যাভ ফাইলড আপ’। আমি এর বাংলা করে বলতাম। ‘অৰ্শরোগের ওপর ফাইল খোলা হয়েছে’। প্রায়ই নথিতে সে লিখত, আমরা এই পত্রের ‘কফি’ (কপি) বিমানে পাঠাতে পারি। বিরক্ত হয়ে একদিন আমি লিখলাম রোজ রোজ ‘কফি’ না পাঠিয়ে মাঝে মাঝে চা পাঠাবেন। কফির দাম বেশি। একদিন অফিসে তার মুখে তার মামার ‘হেনীতে পাউন্টেন ফেনের’ দোকানের গল্প শোনার পর হাসির চোটে আর কাজকর্ম করতে পারিনি আমরা।
আসলে ঐ দিনগুলোতে আমি সকাল ন’টার দিকে অফিসে গিয়ে ঢুকতাম আলোচনা কক্ষে, আর বেরোতাম রাতে। ঐ কামরাতেই খাওয়া-দাওয়া হত। ফলে খুব জরুরী নথি ছাড়া নথি দেখা হতো না। আমার পি.এ. লক্ষ্মীকান্তকে বলা ছিল মন্ত্রী বা সচিবের কাছ থেকে যেমন নথি আসবে বা যেগুলো জরুরী ভিত্তিতে তাদের কাছে যাবে সেগুলো যেন সে অবশ্যই আমার নজরে আনে। সে তা করতও বটে। আমি রাতে বাসায় ফেরার সময় লালসালু কাপড়ে বেঁধে ঐসব নথি নিয়ে গিয়ে পরদিন ফেরত আনতাম। কিন্তু লক্ষ্মীকান্তের বেখেয়ালিতে একটা অতি জরুরী ফাইল প্রায় দশদিন চাপা পড়ে যায় আমার টেবিলে। ঐ নথিতে মাননীয় মন্ত্রী কিছু নির্দেশ দিয়েছিলেন বাংলাদেশ বিমানের শ্রমিক-কর্মচারীদের দাবি-দাওয়ার ওপর। এর কয়েকটি ছিল তাদের অনুকূলে। প্রসঙ্গত, কিছু কিছু বিষয়ে বিমানের শ্রমিক ইউনিয়নের সঙ্গে আমার মতানৈক্য ছিল বলে তারা তাক্কে তক্কে ছিল আমাকে বিপদে ফেলার জন্য। মন্ত্রীর ফাইল দশদিন আমার টেবিলে পড়ে থাকায় এরা গিয়ে মন্ত্রীকে বলল, আমি নাকি এন্টি গভর্নমেন্ট, এন্টি স্টেট, এন্টি আওয়ামী লীগ…। মন্ত্রী যখন ফাইলের খোজ করলেন তখন ডাচরা চলে গেছে। আমি ফাইল খুঁজে বের করে তড়িঘড়ি ব্যবস্থা নেয়ার উদ্যোগ নিলাম। কিন্তু তার আগেই বোমা ফেটে গেছে। মন্ত্রী কনভিনস্ড হয়ে গেছেন আমি সত্যি রাষ্ট্রদ্রোহী, সত্যি দেশদ্রোহী, সত্যি…।
আমার সহকর্মী মাহে আলম তখন সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব। সে আমাকে জানাল আমার মন্ত্রী অবিলম্বে আমাকে তার মন্ত্রণালয় থেকে সরাতে বলেছেন তৎকালীন যুগ্ম-সচিব, সংস্থাপন মন্ত্রণালয় জনাব এটিএম সাইদ হোসেনকে ডেকে নিয়ে গিয়ে। আরো বলেছেন, আমাকে শুধু বদলিই নয়, ‘এত বড় রাষ্ট্রদ্রোহী, সরকার বিরোধী অফিসারকে আজই পি.ও নাইন-এর আওতায় চাকরি থেকে বহিষ্কার করার ব্যবস্থা নিন’ শুনে তো আমার হাত-পা ঠাণ্ডা।
ঐ সময়ে আমার ‘বস’ সচিব জনাব সুলতানুজ্জামান খান সাত দিনের জন্য গিয়েছিলেন পূর্ব জার্মানী। উদ্দেশ্য, ঐ সরকারের সঙ্গে জাহাজ চলাচল চুক্তি স্বাক্ষর করা। তার অবর্তমানে আমি কাউকে খুঁজে পেলাম না যে বিষয়টি বলব। একমাত্র বুদ্ধিদাতা গণেশ মন্ত্রীর একান্ত সচিব ইফতেখার। ও বলল, করিম ভাই, ওল্ড ম্যানের সঙ্গে আপনি দেখা করে বুঝিয়ে বলেন ব্যাপারটা। আমি রাজি হলাম, কিন্তু ওল্ড ম্যান রাজি হলেন না। একটা রাষ্ট্রদ্রোহীর সঙ্গে দেখা করা যায়? মাথা খারাপ? ইফতেখার তখন মন্ত্রীর জানী দোস্ত মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রবের শরণাপন্ন হল। জেনারেল রবের মতো এমন বিশাল হৃদয় পরোপকারী মানুষ খুব কমই দেখেছি। তিনি বিষয়টি বুঝিয়ে বললেন মন্ত্রীকে। মন্ত্রী নাকি সব শুনলেন, বললেন না কিছু। পরে বলল চিলে কান নিয়ে গেছে, আর অমনি দৌড়াতে শুরু করলে চিলের পেছনে? ডোন্ট উওরি ইয়ংম্যান, রিল্যাক্স। এদিকে ইফতেখারের মারফত উপ-সচিবদের ব্যক্তিগত নথির স্তুপ আনাতে শুরু করেছেন জেনারেল, উদ্দেশ্য, আমার পরিবর্তে একজন যোগ্য লোককে বেছে নেয়া। কিন্তু কোনটাই তার পছন্দ হয় না। ‘নো, নান ক্যানম্যাচ দ্যাট ব্লাডি গাই’। শুনলাম, এন.এস.আই, ডি.এফ.আই. ঘাঁটাঘাঁটি করেও নাকি আমার বিরুদ্ধে কিছু পাওয়া যাচ্ছে না। আমি অপেক্ষা করছি সচিবের ফিরে আসার। নীরবে কিনে চলেছি সময়। একেকটা দিন কাটছে একেটা বছরের মত। আট-ন’দিন পর সচিব জনাব সুলতানুজ্জামান খান ফিরলেন অফিসে। আমি তাকে জানালাম কী যন্ত্রণায় কাটছে আমার দিন। সব শুনে তিনি একটি সিগ্রেট ধরিয়ো অভ্যাসমতো প্ৰথমেই একটা সুখটান দিলেন, মুখে কিছু বললেন না। কিছুক্ষণ পরে তিনি মন্ত্রীর কাছে গেলেন ওপরের তলায়। প্ৰায় ঘন্টাখানেক পরে তিনি ফিরে এলে আমি পড়ি কি মরি করে ঢুকলাম তার ঘরে। শুনলাম ঝড় থেমেছে।
পরে ইফতেখারের কাছে শুনেছি সচিব নাকি মন্ত্রীকে বলেছেন, ওকে যদি এখান থেকে সরান তা হলে আমাকেও সরিয়ে দিন। বিনা দোষে একজন অফিসারের বিরুদ্ধে আপনি এরকম ব্যবস্থা নিতে পারেন না। আল্লাহকে ধন্যবাদ, সুলতানুজ্জামান সাহেবের এই দৃষ্টান্ত পরবর্তী জীবনে আমি নিজেও অনুসরণ করেছি জুনিয়র সহকর্মীদের আপদে-বিপদে।
জেনারেল সঙ্গে এই ‘লাভ এ্যান্ড হেইট’। সম্পর্কের পরবর্তী পর্যায়ে ঘটল আরেক কাণ্ড। মন্ত্রী দেখি আমার সব কাজেই শুধু দারুণ সন্তুষ্টই নন, কথাবার্তা আচার-আচরণে কেমন বিগলিত বিগলিত ভাব।
এরপর যখন ভারতীয়রা এল এবং আমরা খুব’ ‘পলাইটলি বাট ফার্মলি’ তাদের মোকাবেলা করলাম, মন্ত্রীর আস্থা তখন আরো বেড়ে গেল।
পরের বছর অর্থাৎ চুয়াত্তর সালের জুন মাসের দিকে হঠাৎ করে এফ-২৭ রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারটা খুব নাজুক হয়ে দাঁড়াল। সবগুলো এয়ারক্রাফট বসে যাওয়ার যোগাড়। জরুরি ভিত্তিতে কোন এয়ারলাইনের সঙ্গে চুক্তি না করলে বিপদ। মন্ত্রী তখন তার পাকস্থলী সংক্রান্ত চেকআপের জন্য সি-এমএইচ-এ ভর্তি হয়েছেন। তার পাশের কামরায় গলব্লাডার অপারেশনের পর সুস্থ হয়ে উঠছেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ.জি. মাহমুদ, বিমানের পরিচালক (অপারেশনস)। এক শনিবার বিকেলে সচিব আর আমি নথিপত্র নিয়ে গেলাম সিএমএচ-এ। মন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা হলো বিষয়টি নিয়ে। আলোচনায় এ.জি. মাহমুদ সাহেবও এসে শরীক হলেন। সিদ্ধান্ত হলো বিমানের ম্যানেজার (প্রকৌশল) হুমায়ুন কবীর এবং বিমানে কেএলএম-এর কারিগরি উপদেষ্টা মিঃ টেমস পরবতী ফ্লাইটে যাবেন সিঙ্গাপুর। পরবতী ফ্লাইটে মানে থাই এয়ারওয়েজের ফ্লাইটে, মঙ্গলবার দুপুরে। জেনারেল আমার দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, এ্যান্ড সেন্ড দিস জেন্টেলম্যান অলসো উইথ দ্য টিম। শুনে আমি হকচকিয়ে উঠলাম। আমি? আমি কেন? এসব কারিগরি বিষয়ের আমি কী বুঝি? ফিসফিস করে পাশে বসা সচিবকে আমার অনীহার কথা বললাম। তিনি বললেন, চুপ কর। মন্ত্রী কী বলছেন শোন। আমি সাহস করে মন্ত্রীকেই বললাম, স্যার, বিষয়টি পুরো টেকনিক্যাল। আমি তো এসব নেগোশিয়েশনের কিছুই বুঝব না। আমার বোধহয় না যাওয়াই উচিত। মন্ত্রী রুলিং দিলেনঃ নো ইউ উড গো এজ মাই রিপ্রেজেন্টেটিভ।
আমি এর আগে পাকিস্তানের চাকরি করা ব্যতীত কখনো বিদেশে যাইনি। ফলে একদিনের মধ্যে পাসপোর্ট করে, কোনও রকম করে দুদিনের ভেতর এক জোড়া কোট-প্যান্ট ঠিকঠাক করে, আমার সেই আমলের লম্বা বাবরি চুল পাইলট করে মন্ত্রীর প্রতিনিধি হয়ে ছুটিলাম সিঙ্গাপুর।
এর মধ্যে শোনা যাচ্ছিল আমাকে ডি.সি হয়ে যেতে হবে কোনো জেলায়। (উড়, উড় শোনা যায় তপতী সেনের নাকি বিয়ে; নরেশ গুহ।) আমার মোটেই ইচ্ছা ছিল না। কারণ আমার স্ত্রী তখন ঢাকায় অধ্যাপনায়রত, বাচ্চারা পড়ে স্কুলের নিচের ক্লাসে। এদেরকে ঢাকা থেকে লাগেজ বানিয়ে কোথাও সঙ্গে টেনে নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। কিন্তু হঠাৎ করেই সরকারের শনির দৃষ্টি পড়ল আমার ওপর। বরিশালের ডি.সি শামসুদ্দিন সাহেবের স্ত্রী কবি জাহানারা বেগম সড়ক দুর্ঘটনায় আকস্মিকভাবে মারা যাওয়ার পর ওখানে ডি.সি. হিসেবে আমাকে পাঠানোর কথা উঠল। শুনে জেনারেল সাহেব ছুটে গেলেন সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের কাছে এবং ওটা ঠেকিয়ে দিলেন। আমি খুশি হলাম। যদিও আমি তাকে কিছুই বলিনি বদলির ব্যাপারে। কিন্তু নভেম্বর চুয়াত্তরে যখন কুষ্টিয়া যাওয়া আদেশ হলো আমার, তখন জেনারেল ফেল মারলেন, উনি আর কিছুতেই ঠেকাতে পারলেন না। ১৬ নভেম্বর বিকেলে আদেশ পেয়ে ১৯ নভেম্বরই আমাকে কুষ্টিয়া রওনা হতে হলো বিমান মন্ত্রণালয়ের উপসচিবের দায়িত্ব ছেড়ে। বিদায় নেয়ার সময় জেনারেল আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে রাখলেন কিছুক্ষণ। মুখে বললেন, আই উইশ ইউ ওয়েল, মাই বয়। গড ব্লেস ইউ। তার কামরা থেকে চলে আসার সময় ভুল দেখলাম কিনা জানি না, মনে হলো জেনারেলের চকমকি জ্বলা ব্যাঘচোখের কোণে পানি।
এপিটাফঃ তার কাছ থেকে শেখার ছিল অনেক কিছুই-দেশপ্ৰেম, সততা, নিষ্ঠা, নিয়মানুবর্তিতা, অনেক কিছুই। হয়ত শেখার চেষ্টা করেছি, কিন্তু ঐ মাপে পৌঁছা অসম্ভব না হলেও নিঃসন্দেহে দুরূহ।
যখনই সিলেটে হযরত শাহজালাল (র.) এর মাজার জিয়ারত করতে যাই, জেনারেলের কবরের পাশে গিয়ে অবশ্যই দাঁড়াই কিছুক্ষণ। জিয়ারত করি তার কবর। কেন জানি মনে হয়, তিনি আমার সামনেই বসে আছেন। এবং আমার কাছে সব সময়ই, এমনকি আজ তার মৃত্যুর এতদিন পরেও, শুধু নেপোলিয়নই নয়, সারা দুনিয়ার অনেক অনেক জেনারেলের চাইতে সেই ছোট মানুষটিকে অনেক বেশি দীর্ঘকায়, অনেক বড়মাপের মানুষ মনে হয়। ইচ্ছে হয় হুইটম্যানের কবিতাটির শিরোনাম বদলিয়ে ‘ও জেনারেল, মাই জেনারেল’ করে পুরো কবিতাটিই নিবেদন করি তার উদেশে।