You dont have javascript enabled! Please enable it! 1973.06.16 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | গণ ঐক্যজোটের প্রতি সংগ্রামী অভিনন্দন | থাইল্যান্ডে সামরিক সরকার বিদায় নিলেন | অপরিচ্ছন্নতার বিরুদ্ধে অভিযান | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা: ১৬ই অক্টোবর, মঙ্গলবার, ২৯শে আশ্বিন, ১৩৮০

গণ ঐক্যজোটের প্রতি সংগ্রামী অভিনন্দন

গত পরশুদিন ত্রিদলীয় গণ ঐক্য জোটের পক্ষ থেকে আহূত এক সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে ঐক্য জোট গঠনের আদর্শ ও কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। সাংবাদিক সম্মেলনের আগের দিন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর নীতি-আদর্শ অনুমোদন করেছেন। ত্রিদলীয় জোটের নেতা বঙ্গবন্ধু নিজে। আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির নির্বাচিত সদস্যগণ কেন্দ্রীয় গণ ঐক্য জোটের সদস্য মনোনীত হয়েছেন। দেশের সর্বত্র আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ঐক্যজোট গঠিত হবে বলেও ঘোষণা করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় মূলনীতি গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদী আদর্শের ভিত্তিতে ঐক্য জোট গঠিত হয়েছে। ত্রিদলীয় জোটের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যদি ঐক্য জোটের আদর্শ ও কর্মসূচির প্রতি কোন দল আনুগত্য স্বীকার করে সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে চায় তাহলে তাদেরকে জোটভুক্ত করে নেওয়া হবে। এক্ষেত্রে প্রত্যেকটি দলের স্ব স্ব দলীয় আদর্শ ও কর্মসূচির ভিত্তিতে কাজ করে যাবার অধিকার অক্ষুণ্ন থাকবে।
দেশের সকল শ্রমজীবী, মজুর, কৃষক মধ্যবিত্ত, বুদ্ধিজীবী, যুব ও ছাত্র শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে দেশব্যাপী সংগ্রাম পরিচালনা করার দৃপ্ত শপথ গ্রহণ করেছে গণ ঐক্যজোট। এ পাঁচটি দাবিকে সামনে রেখে তারা সংগ্রাম করছে। এই পাঁচটি দাবির মধ্যে প্রথম দেশকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি থেকে মুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। দেশে বর্তমানে যে ডাকাতি, রাহাজানি, গুম, খুন, রাজনৈতিক সন্ত্রাস অব্যাহত রয়েছে তার বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন শুরু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। দেশের সকল যুব শক্তিকে সংগঠিত করে গ্রামে গ্রামে, মহল্লায়-মহল্লায় প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। অন্য এক প্রস্তাবে দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি রোধ করার জন্য মুনাফা শিকারি, মজুতদার, চোরাকারবারি প্রভৃতি সমাজবিরোধী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। শিল্প ও কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির উপর যেহেতু আমাদের জাতীয় অগ্রগতি নির্ভরশীল সেহেতু এর উন্নয়নের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। জনগণের অন্নবস্ত্রের সংকট নিরসনের জন্য স্বাধীন ও স্বনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তোলার পক্ষপাতী ঐক্যজোট। দেশের কৃষক ও শ্রমিকদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে ঐক্যজোট কৃষি ও শিল্প আন্দোলন জোরদার করার কথা সর্বাগ্রে বিবেচনা করেছে। এছাড়া সমাজকে দুর্নীতির কবল থেকে মুক্ত করার জন্য প্রতিটি ক্ষেত্রে জোর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্তও নেয়া হয়েছে। কোন দেশের প্রশাসনযন্ত্রকে কলুষমুক্ত ও সমাজবাদী কাঠামোতে পরিণত করার কথা গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করেছে। প্রশাসনযন্ত্র যে অতীত আমলের জের হিসেবে দুর্নীতি আমলাতান্ত্রিক, সাম্রাজ্যবাদী ও গণ বিরোধী মনোভাব বিদ্যমান রয়েছে সেগুলি দূর করে প্রশাসনযন্ত্রকে গণমুখী করার জন্য ঐক্য জোট আন্দোলন শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বস্তুতঃপক্ষে প্রস্তাবিত ঐক্য জোটের আন্দোলন কর্মসূচি নতুন সমাজ গঠনের পক্ষে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সুদুরপ্রসারী। দেশের সকল মেহনতী মানুষের সঙ্গে ছাত্র, যুব ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের একাত্মতা সৃষ্টি করে উল্লেখিত দাবীসমূহঃ এর ভিত্তিতে যদি ঐক্যজোট বাস্তব অপরিকল্পিত আন্দোলন পরিচালনা করতে পারে তাহলে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন সার্থকতার সোপানে পৌঁছতে পারে। আমরা বহু পূর্বেই ঐক্য জোট গঠনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে মতামত ব্যক্ত করেছিলাম। দেরিতে হলেও তার এই শুভ গঠন কে আমরা স্বাগত জানাই। নতুন সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্য ও দৃঢ় ও মজবুত হোক এটাই আমাদের কামনা। তাদের সদিচ্ছা বাস্তবায়িত হবে সেটাই আমাদের আশা। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠাকল্পে গঠিত যে গণ ঐক্যজোট তার প্রতি রইল আমাদের সংগ্রামী অভিনন্দন।

থাইল্যান্ডে সামরিক সরকার বিদায় নিলেন

ছাত্রদের প্রবল বিক্ষোভের মুখে থাইল্যান্ডের সামরিক সরকার পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। নয়া শাসনতন্ত্র অবিলম্বে কার্যকরী ও দেশ দ্রোহীতার দায়ে অভিযুক্ত বিরোধীদলীয় ১৩ জনকে মুক্তির দাবিতে সপ্তাহব্যাপী সংগ্রামের শেষদিনে ছাত্র সেনাবাহিনীর রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ শুরু হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে থাই মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করেছেন।
গত ১৩ই আগস্ট ভোরের দিকে বিক্ষোভকারী ছাত্র জনতা ব্যাংকের কেন্দ্রস্থলে একটি সরকারি ভবনে আক্রমণ চালায়। বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে সেনাবাহিনী এম, এস, ১৬ রাইফেল ও কাঁদুনে গ্যাস ব্যবহার করলে তারা আরও দুটি ভবনে আগুন ধরিয়ে দেয়। প্রাথমিক খবরে জানা যায়, সংঘর্ষে ১৮০ জনের মৃত্যু ও ২শত জন আহত হয়।
ছাত্র জনতা ও সেনাবাহিনীর মধ্যে একদিনের সংঘর্ষের পর ফিল্ড মার্শাল কির্তিকাচরণ পদত্যাগ করলে রাজা ভূমিবল জাতির উদ্দেশ্যে এক টেলিভিশন ভাষণে বলেছেন, পরিস্থিতি যাতে আরো অবনতির দিকে না যায় সেদিকে লক্ষ্য রেখে ফিল্ড মার্শাল কির্তিকাচরণ প্রধান মন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। তার স্থলে নয়া প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হয়েছেন থামাসাক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও রাজার সাবেক প্রিভি কাউন্সিলর সানিয়া থামাসাক।
থাইল্যান্ডের ছাত্র-জনতার প্রচন্ড বিক্ষোভের মুখে সামরিক সরকারের পতনকে নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ বলে চিহ্নিত করা যায়। ঘটনার বিস্তারিত খবর জানা না গেলেও এ কথা বলা চলে যে গণতান্ত্রিক শক্তির সম্মিলিত আন্দোলনের বিজয় সূচিত হয়েছে সেখানে। কেননা গণতন্ত্রের প্রধান শত্রু সামরিক সরকার সেখান থেকে বিদায় নিয়েছে। একাত্তর সালে ফিল্ড মার্শাল কির্তিকাচরণ এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করার সঙ্গে সঙ্গেই শাসনতন্ত্র বাতিল করে দেয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে ফিল্ড মার্শাল কির্তিকাচরণ সেখানে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির শিরোমণি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আশীর্বাদপুষ্ট কির্তিকাচরণ সেদিন ভেবেছিলেন যে জেল, জুলুম আর বুলেটের মাধ্যমে ছাত্র-জনতার কন্ঠে স্তব্ধ করে দেওয়া যাবে। তাই তিনি শাসনতন্ত্রকে এক কলমের খোঁচায় উড়িয়ে দিয়ে পরবর্তী পর্যায়ে ঘোষণা করেছিলেন আগামী ছিয়াত্তর সালে শাসনতন্ত্র দেয়া হবে। সেদিন কিন্তু সামরিক সরকার প্রধান ভাবতে পারেননি একদিন তাকে ভেসে যেতে হবে ছাত্র-জনতার রুদ্ররোষে।
ছাত্র-জনতার প্রচন্ড বিক্ষোভের মুখে আজ সেখানে শুধুমাত্র সামরিক সরকারের পতনই ঘটেনি আগামী অক্টোবরে শাসনতন্ত্র হবে বলেও ঘোষণা করা হয়েছে এবং ১৩ জন বন্দী ছাত্রকে মুক্তি দিতে হয়েছে। আমরা আগেই বলেছি যে থাইল্যান্ডের ছাত্র-জনতার প্রচন্ড বিক্ষোভের পর যে, থাইল্যান্ডের ছাত্র-জনতার প্রচন্ড বিক্ষোভের পর যে পরিস্থিতি সূচনা হয়েছে সেখানে সে সম্পর্কে কোনো সুস্পষ্ট অভিমত যাওয়া না গেলেও এ কথা বলা যায় যে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনৈতিক দিগন্তে একটা পরিবর্তনের আভাস পরিলক্ষিত হচ্ছে। আর এ পরিবর্তনে অগ্রনায়ক হলেন থাইল্যান্ডের সংগ্রামী ছাত্র জনতা। তাদের আমরা জানাই আন্তরিক অভিনন্দন।

অপরিচ্ছন্নতার বিরুদ্ধে অভিযান

গত রোববার মুক্তিযোদ্ধা সংসদের উদ্যোগে ঢাকায় পরিচ্ছন্ন দিবস পালিত হয়েছে। এতদ উপলক্ষে তারা ঢাকার কয়েকটি অপরিচ্ছন্ন পথ ও এলাকা পরিষ্কার করেন। পরিচ্ছন্নতার অপর নাম পবিত্রতা আর পবিত্রতা মূল অর্থ হচ্ছে শাশ্বত সুন্দর। অর্থাৎ যা সুন্দর তা পবিত্র, কলুষতা মুক্ত। যে নিজে সুন্দর সে সৌন্দর্যের পূজারী। যে সৌন্দর্যের পূজারী সে সততার অধিকারী। শুধু তাই নয় তিনি শিল্পী, তিনি প্রেমিক, তিনি স্রষ্টা, তিনি বলা যায় পূর্ণ মানবীয় গুণের অধিকারী-একজন আদর্শ মানুষ। আর যিনি আদর্শ মানুষ তিনি নিঃসন্দেহে গভীর জ্ঞান, বুদ্ধিমত্তা, মননশীল দৃষ্টিভঙ্গি ও দায়িত্ব এবং কর্তব্য বোধসম্পন্ন ব্যক্তি।
মুক্তিযুদ্ধা ভাইয়েরা নিঃসন্দেহে আদর্শবাদী দেশ প্রেমিক। এবং এর প্রত্যক্ষ প্রমাণ আমরা আমাদের জাতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় উপলব্ধি করেছি। দেশবাসী তাদেরকে তাই অন্তরের গভীরতম প্রদেশ থেকে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানিয়েছে, জাতি তাদেরকে জানিয়েছে সালাম। সেই সঙ্গে গোটা জাতি তাদের কাছে প্রত্যাশা করেছে দেশ পুনর্গঠনে তারা একটা বিশেষ ভূমিকা পালন করবেন। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, গত গ্রীষ্মের ছুটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ভাইয়েরা বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে কৃষক শ্রমিক ভাইদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধি কল্পে কাজ করেছেন। শুধু তাই নয়-তাদেরকে আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ ও মিল কারখানাতে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার জন্য প্রাথমিক জ্ঞানদানেও প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেন। এক্ষণে মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়েরাও পরিচ্ছন্ন অভিযান এর মাধ্যমে সামাজিক কাজে অংশগ্রহণ করলেন। যুবসমাজের দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ নিঃসন্দেহে উৎসাহব্যঞ্জক এবং প্রশংসনীয় উদ্যোগ।
শুধু ঢাকা শহর নয় দেশের বিভিন্ন শহর বন্দর গ্রাম এলাকার সর্বত্র আবর্জনায় ভরে গেছে। যুদ্ধের দীর্ঘ ন’মাস প্রতিটি রাস্তাঘাট, পুকুর-ডোবা, নর্দমা ইত্যাদি সহ আবাসিক ও বাজার এলাকায় ইত্যাদি কমবেশি আবর্জনায় অপরিচ্ছন্ন হয়ে গেছে। এর ফলে শুধু যে স্থানগুলো অপরিষ্কার হয়ে রয়েছে তা নয়, এই অপরিচ্ছন্নতার জন্য নানা রোগব্যাধি ক্রমান্বয়ে প্রসার ঘটেছে যা আমরা দেখেও বুঝতে পারিনি। এবং বাহ্যিক এই অপরিচ্ছন্নতার জন্য মানসিক দিক থেকেও অনেক কলুষতা আমাদের সমাজ জীবনকে সংক্রামিত করে ফেলেছে। কিন্তু সমাজ থেকে এই বাহ্যিক এবং মানসিক আবর্জনাকে যেকোনো মূল্যে দূর করতেই হবে। নচেৎ একটা সুন্দর, সুখী, নিকলুষ সমাজ গড়া সম্ভব হবে না। আর এই সুখী-সুন্দর পবিত্র সমাজ ও দেশকে গড়ে তোলার দায়িত্ব কেবল মুক্তিযোদ্ধা এবং ছাত্র ভাইদেরই নয়, দেশের প্রতিটি নাগরিকের। আমরা যেন সবাই পরিচ্ছন্নতার মাঝ দিয়ে জীবনকে সুন্দর ও মহৎ করে গড়ে তুলতে পারি এটাই হোক প্রতিটি মানুষের অনুভব।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন