ইন্দিরাজী কি এবার মনস্থির করবেন?
বাঙলাদেশের শরণার্থীদের সমস্যা আলােচনার জন্য প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী কলকাতায় এসেছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী-সহ রাজ্য সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে দফায় দফায় আলােচনা সেরে ফিরে গেছেন দিল্লিতে। এইসব আলােচনার ফলে কেন্দ্রীয় সরকার শরণার্থী সমস্যাকে নতুন কোনাে দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করবেন কিনা কিংবা এই সমস্যা সমাধানের জন্য নতুন কোনাে পথের সন্ধান করবেন কিনা তা জানা যায়নি। যা জানা গেছে—তা মূলত পুরােনাে কথা। কেন্দ্রীয় সরকার শরণার্থীদের দায়িত্ব নিজেরা নিতে ইচ্ছুক, বাঙলাদেশের শরণার্থীদের পশ্চিমবঙ্গ থেকে সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাবে কেন্দ্র সম্মত হয়েছে, এই রাজ্যের শরণার্থী শিবিরগুলাের ভার কেন্দ্র থেকে পুরােপুরি নেওয়ার জন্য রাজ্য সরকারের প্রস্তাবও কেন্দ্র। বিবেচনা করে দেখবে।
কিন্তু কেবল এইভাবে শরণার্থী সমস্যার কোনাে সমাধান কি সম্ভব? পাকিস্তানি ফৌজের বীভৎসতম অত্যাচারের ফলে বাঙলাদেশে আজ যে মর্মান্তিক ঘটনাবলী ঘটছে মানব-ইতিহাসে তার তুলনা খুব বেশি পাওয়া যাবে না। ব্যাপকতম গণহত্যা আর নিষ্ঠুরতম ধ্বংসকাণ্ডের ফলে সে দেশ আজ প্রায় শ্মশান। আধুনিকতম অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি পশুশক্তির হাত থেকে পরিত্রাণের আশায় ৬০ লক্ষ নরনারী ও শিশু স্বদেশ ত্যাগ করে সর্বহারা হয়ে আশ্রয় নিয়েছেন এসে ভরতের মাটিতে। চরম দুর্গতির মধ্যে, রােদ-বৃষ্টিমাথায় নিয়ে মাঠে-ঘাটে-পথে বাসা বেঁধেছেন তারা। সঙ্গে এসেছে কলেরার মহামারী।
দেশবিভাগের পর প্রায় সিকি শতাব্দী কাটতে চললাে কিন্তু সেই বিভক্ত শরীরের ক্ষত পশ্চিমবঙ্গে আজও শুকোয়নি। সর্বস্তরে সেই ক্ষতচিহ্ন আজও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে অতীতের এক শােচনীয় ট্র্যাজেডির কথা। সেদিনের উদ্বাস্তুর চাপে এ রাজ্যের অর্থনীতি আজো বিপর্যস্ত, রাজনীতি ঘােলা জলের আবর্তে ভ্রান্ত, সমাজদেহ পচন আর অবক্ষয়ে জারাজীর্ণ। এই অবস্থার মধ্যে নতুন করে অর্ধ কোটি শরণার্থীর বােঝা এই রাজ্যের ঘাড়ে চেপে বসলে, পশ্চিমবঙ্গের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামাের যে ভগ্নাবশেষটুকু দাঁড়িয়ে রয়েছে আজ তাও ভেঙে গুড়িয়ে চুরমার হয়ে যাবে। রাজনীতিক্ষেত্রে তার পরিণাম কল্পনা করা কঠিন নয়। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষীণ জীবনীশক্তি আজ কণ্ঠতালুতে এসে ঠেকেছে। এই রাজ্যের যদি মৃত্যু ঘটে তবে তার চিতাভষ্মের উপর বাকি ভারতবর্ষের সমৃদ্ধির রাজপ্রাসাদ নিশ্চয়ই গড়ে তােলা যাবে না ।
কেন্দ্রীয় সরকারি কর্তারাও সে কথা না বােঝেন তা নয়। সেই জন্যই কথা উঠেছে শরণার্থীদের অন্য রাজ্যে সরিয়ে নিয়ে যাবার। কিন্তু বাস্তবে সে পরিকল্পনা কার্যকর করা সম্ভব হবে কতটুকু? কতদিন? জমি জোগাড় করতে লাগবে কত কাল? ৬০ লক্ষ মানুষকে সরিয়ে নিয়ে যাবার মতাে যানবাহনের ব্যবস্থা হবে। কিভাবে?
একথাটা পরিষ্কার করে বােঝা দরকার, সমস্যা সমাধানের এটা সত্যিকারের পথ নয়। আজকের শরণর্থীদের সমস্যা অতীতের উদ্বাস্তুদের সমস্যার থেকে চরিত্রগতভাবে স্বতন্ত্র। শরণার্থীরা স্বাধীন, সার্বভৌম বাঙলাদেশের নাগরিক ; বিদেশি দখলদার পাকিস্তানি ফৌজের অত্যাচারে স্বদেশ ত্যাগ করে আসতে তারা বাধ্য হয়েছেন। তারা যাতে বাঙলাদেশে ফিরে যেতে পারেন সেই আবহাওয়া এবং অবস্থা বাঙলাদেশের সৃষ্টি করেই কেবল এ সমস্যার সমাধান হতে পারে।
কিভাবে শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের উপযুক্ত আবহাওয়া সৃষ্টি হতে পারে? দখলদার পাকিস্তানি ফৌজকে বাঙলাদেশ থেকে বিতাড়ন করেই একমাত্র সেই আবহাওয়া সৃষ্টি করা সম্ভব। স্বাধীন বাঙলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতিদানের প্রশ্নটা তাই একান্ত জরুরি হয়ে উঠেছে দানের পর বাংলাদেশকে বিদেশি দখল থেকে মুক্ত করার জন্য বাঙলাদেশ সরকারকে ব্যাপকভাবে সমস্ত রকমের সাহায্য দেওয়া আন্তর্জাতিক আইনের দিক থেকে অনেক সহজ হবে ভারতের পক্ষে। এ ব্যাপারে অনেক বিলম্ব হয়ে গেছে ; এখনও ইন্দিরাজী মনস্থির করতে না পারলে ভারতের পক্ষে তা হবে আত্মঘাতী।
সূত্র: সপ্তাহ, ১১ জুন ১৯৭১