You dont have javascript enabled! Please enable it! 1973.08.10 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | মুক্তির পথে নমপেন | পরিকল্পনাটি যথার্থ বাস্তবায়িত করুন | নিক্সনের কি চীনা জুজুর ভয় না ভীমরতি ধরেছে? | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
১০ই আগস্ট, শুক্রবার, ১৯৭৩, ২৫শে শ্রাবণ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

মুক্তির পথে নমপেন

নমপেনের সরকারী বাহিনী এখন বিমানবন্দর আগলাতে ব্যস্ত। দেশের কেন্দ্রীয় বেতার ট্রান্সমিটার কেন্দ্র মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা আক্রান্ত। সে বেতার কেন্দ্রের পতন হবার আর বেশী দেরী নেই। বিমানবন্দরে তৈরী বিমান। যে কোন মুহুর্তে সরকারী কর্মকর্তারা সে বিমানে পাড়ি জমাবেন। হয়তো বা হংকং-এ অথবা সরাসরি আমেরিকায়। বিদেশী দূতাবাসগুলোর কিছু কিছু কর্মকর্তা ইতিমধ্যেই নমপেন ছেড়েছেন। যেখানেই মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ চালাচ্ছেন সেখান থেকে অস্ত্রশস্ত্র ফেলে ছুট দিচ্ছে সরকারী বাহিনী। ওদিকে লননল সরকারের মুখ্য মদদদার প্রেসিডেন্ট নিক্সন প্রচন্ড চাপের সম্মুখীন। আমেরিকার সুপ্রীম কোর্ট কম্বোডিয়ায় বোমাবর্ষণের ব্যাপারে নিম্ন আদালতের একটি রায় অনুমোদন করেছেন। নিয়ম অনুসারে সু্প্রীম কোর্ট সেই রায় অনুমোদন করবার মুহূর্ত থেকেই কম্বোডিয়ায় মার্কিন বোমাবর্ষণ বন্ধ করবার কথা।
মার্কিনী বোমাবর্ষণ বন্ধ হয়নি। নিশ্চিত পরাজয়ের মুখে এখন তাদের নিজেদের বোমাবর্ষণে নিজেরাই মৃত্যুবরণ করছে। সারা নমপেন শহরে সরকারবিরোধী প্রচারপত্র ছড়ানো হয়েছে। নমপেনে সরাসরি যুদ্ধ শুরু হলে নগরবাসীদের কর্তব্য সম্বন্ধে নানা নির্দেশ সে সকল প্রচারপত্রের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধারা প্রদান করেছে। শহরের মধ্যে প্রবেশ করেছে তারা। খন্ড খন্ড সংঘর্ষের খবরও পাওয়া যাচ্ছে। খোদ পেন্টাগনের কর্মকর্তারা নাকি মনে করতে শুরু করেছে যে আগামী পনেরোই আগস্টের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা নমপেন দখল করবে।
ইতিমধ্যেই যে সকল এলাকা মুক্ত হয়েছে সে সকল স্থানে লননলের অভিজ্ঞ রাজকর্মচারীদের দিয়ে নয়, মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়ে প্রশাসনিক কাজকর্ম শুরু করে দেওয়া হয়েছে। সেখানকার মুক্তি সংগ্রামের অধিনায়ক প্রিন্স সিহানুক নিজেও একবার এই মুক্ত এলাকাসমূহ পরিদর্শন করে গেছেন। বিদেশী সাংবাদিকদের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি ভবিষ্যত কম্বোডিয়ায় রাজনৈতিক গতি-প্রকৃতিরও একটা ছবি তুলে ধরেছেন। লননলের সামরিক শাসন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে যাঁতাকলে পিষ্ট কম্বোডিয়ার মানুষ আজ মুক্তির মুহূর্ত গুণছেন।
আমরা মুক্তি সংগ্রামের সেই বীর যোদ্ধাদের জানাই সংগ্রামী অভিনন্দন। শান্তি, প্রগতি এবং স্বাধীনতার এ অগ্রাভিযান অব্যাহত থাকুক। এমনিভাবে দিকে দিকে বেজে উঠুক সাম্রাজ্যবাদের মৃত্যুঘন্টা। কম্বোডিয়াকে কেন্দ্র করে সারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্রের যে জাল বিস্তার করেছিলো নমপেনের মুক্তি সে ষড়যন্ত্র জালকে সঙ্কুচিত করবে কিন্তু তার অবসান ঘটবে না। প্রেসিডেন্ট নিক্সন নিজেই বলেছেন কম্বোডিয়ায় বোমাবর্ষণ বন্ধ করা হলেও অস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত থাকবে। এ অস্ত্র সরবরাহ তিনি করবেন কাদের কাছে? মুক্ত কম্বোডিয়াবাসীকে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে অতঃপর আগাতে হবে। জনমানুষের শান্তি, সমৃদ্ধি এবং প্রগতির পথে বাঁধা আসবে, নানা নতুন ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত চলবে কিন্তু তাকে অতিক্রম করে এ অগ্রাভিযানকে অব্যাহত রাখবার শক্তি ও চেতনা সংগ্রামী কম্বোডিয়াবাসীদের রয়েছে বলে আমরা আশা করি।

পরিকল্পনাটি যথার্থ বাস্তবায়িত করুন

গত বুধবার ভোগ্যপণ্য সরবরাহ সংস্থার কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন—সারাদেশে ন্যায্যমূল্যে কাপড় বিক্রয়ের জন্যে পাইকারী বিক্রেতা হিসেবে সংস্থা অবিলম্বে একটি সিদ্ধান্ত কার্যকরী করতে চলেছে। দেশের মিল থেকে উৎপাদিত কাপড় ও টিসিবি কর্তৃক আমদানী করা কাপড় এই ভোগ্যপণ্য সরবরাহ সংস্থার মাধ্যমে বিক্রি করা হবে। জানা গেছে, ইতিমধ্যেই উক্ত সংস্থা ৬৩ লাখ ২৩ হাজার ৬শত ৪৯ গজ কাপড় স্থানীয় মিল থেকে সংগ্রহ করেছে। এছাড়া আমদানী করা ৬ হাজার ২শত বেল কাপড়ও সংগৃহীত হয়েছৈ। এই সমস্ত কাপড় জেলা ও মহকুমা প্রশাসক কর্তৃক নির্ধারিত বিক্রেতাদের মাধ্যমে ও ভোগ্যপণ্য সরবরাহ সংস্থার নিজস্ব দোকানের মাধ্যমে সরাসরি জনগণের নিকট বিক্রি করা হবে বলে জানানো হয়েছে। এ ব্যাপারে সংস্থার বিক্রির সঠিক তারিখ পূর্বাহ্নেই প্রচার করে জনসাধারণকে জানাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ পর্যন্ত সংগৃহীত সকল কাপড় যাতে করে সুষ্ঠুভাবে জনগণের মাঝে বন্টন করা যায় তার জন্যে ভোগ্যপণ্য সরবরাহ সংস্থার চেয়ারম্যান জনসাধারণের সহযোগিতা কামনা করেছেন।
বস্তুতঃপক্ষে, জনসাধারণের মাঝে সুষ্ঠুভাবে কাপড় বন্টনের জন্যে উল্লেখিত এ সরকারী উদ্যোগ বেশ আশাপ্রদ। দেশবাসীর এই মৌলিক এবং মর্মান্তিক চাহিদা মেটানো আজ সরকারের একটি নৈতিক দায়িত্ব। পূর্বাপর সরকার এ ব্যাপারে তার আন্তরিকতা দেখিয়েছেন। কিন্তু সরকারী আন্তরিকতা নানা প্রতিকূল কারণে বাঁধাপ্রাপ্ত হয়েছে। বিশেষ করে চাহিদার পরিমাণে তা স্বল্প হলেও যে সমস্ত কাপড় এ পর্যন্ত আনা হয়েছে দেশে তার বন্টন ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করতে সরকার ব্যর্থ হয়েছেন। ভোগ্যপণ্য সরবরাহ সংস্থা কর্তৃক দেওয়া উল্লেখিত সংবাদে আমরা আশান্বিত হলেও দেশবাসীর মনে নিশ্চিত বিশ্বাস জন্মেছে সাধারণ মানুষ ঐ কাপড় ন্যায্যমূল্যে পাবেনা। এক হাতের মাধ্যমে জনগণ কাপড় পাবে বলে সরকার আশার কথা জানালেও সাধারণ ভুক্তভোগী মানুষের ধারণা, ঐ ন্যায্যমূল্যের কাপড় চার পাঁচজন মধ্যস্বত্ব ভোগীর মাধ্যমে তাদের হাতে গিয়ে পৌঁছুবে। এবং কাপড়ের দাম বৃদ্ধি পাবে। ভোগ্যপণ্য সরবরাহ সংস্থা কাপড় বন্টনের ব্যাপারে এবার যে সিদ্ধান্ত বা কর্মসূচীর কথা ঘোষণা করেছেন তা আশাপ্রদ হলেও বন্টন কলুষমুক্ত করতে হবে। যাতে করে দেশের অসংখ্য ভুক্তভোগী মানুষ ন্যায্যমূল্যে কাপড় পায় তার সুনিশ্চিত ব্যবস্থা করতে হবে। ভোগ্যপণ্য সরবরাহ সংস্থা কর্তৃপক্ষ কাগজী ভাষার কর্মতৎপরতার চেয়ে বাস্তব পদ্ধতির তৎপরতা বৃদ্ধি করে কর্মসূচী সফল করবেন বলেও আমাদের বিশ্বাস।

নিক্সনের কি চীনা জুজুর ভয় না ভীমরতি ধরেছে?

বয়স ভারী হলে নাকি কারো কারো ভীমরতিতে ধরে। আর একবার কোনক্রমে ভীমরতিতে পেলে ব্যস, আর কথা নেই, তিনি তখন আর ভারী বয়সের থাকেন না, একদম অল্প বয়েসী হয়ে যান। এক কথায় যাকে বলে ‘বুড়ো’ ‘ছেলে’ হয়ে যায়। অবশ্য বয়স বা বাহ্যিক গঠনে নয়, বিশেষ করে মনের দিক থেকে। আর তাই দেখি ষাট সত্তর বছরের বুড়ো তেরো চৌদ্দ বা পনেরো ষোল বছরের তরুণীকে সোৎসাহে বিয়ে করতে এগিয়ে আসেন। এইতো, গত পরশুর কাগজেই খবর বেরিয়েছে ইরানের শাহ তৃতীয় পাণি গ্রহণ করেছেন। বলা বাহুল্য, নতুন স্ত্রীর বয়স নাকি তাঁর তুলনায় খুবই কম। সে না হয় একদিক গেলো। কিন্তু তার চেয়েও আরেকটি মজার খবর বেরিয়েছে দু’একটি দৈনিকে। ছোট্ট খবর। ‘নিক্সনের চোখে ট্রাউজার বনাম গাউন।’
ঘটনাটা ঘটেছে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মূল কেন্দ্রস্থল আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ভবনে—হোয়াইট হাউসে। সেখানে একটি অনুষ্ঠান ছিলো। অনুষ্ঠানের মূল বিষয় সম্পর্কে খবরে কিছু জানা না গেলেও যে খবরটুকু জানা গেছে তা বড্ডো রসালো। এবং যেহেতু প্রাসঙ্গিক খবরের পরিবর্তে এই রসালো খবরটিই জানা গেছে সুতরাং এই খবরটিকেই মূল খবর বললে বোধকরি একদিক থেকে ভুল হয় না।
হোয়াইট হাউসের উক্ত অনুষ্ঠানে ট্রাউজার পরিহিতা জনৈকা সাংবাদিককে লক্ষ্য করে তিনি বেশ খানিকটা মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘যখনই আমি কোন তরুণীকে ট্রাউজার পরিহিতা অবস্থায় দেখি তখনই আমার চীনের কথা মনে পড়ে যায়।’ কথাটা নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা চীনারা সাধারণতঃ ট্রাউজার পরে। এক সময় চীনের সঙ্গে তাঁর দেশের সম্পর্ক ছিলো দা-কুমড়া। তবে ইদানীং তা বদলে গিয়ে বেশ খানিকটা মিল মহব্বত গড়ে উঠেছে। এবং এই মিল-মহব্বত স্থাপনের জন্য তিনি নির্বাচনের পূর্বে চীন সফর করেন। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার কথা তাঁর নির্বাচনী ঘোষণাতেও অন্তর্ভুক্ত ছিলো। তাই তিনি তাঁর কথা রক্ষা করেছেন, নির্বাচনেও জয়ী হয়েছেন। কিন্তু তাঁর সে নির্বাচনের ব্যাপারে ওয়াটারগেট কেলেংকারী সম্পর্কে যেসব তথ্য বেশ কিছুদিন থেকে সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে তাতে তাঁর সেই পরিকল্পনার মধ্যে চীন জুজুরও হাত ছিলো কিনা কে জানে। অথবা চীনাদের পিংপং রাজনীতির চালে ঘোল খেয়ে অসাধু পথে নির্বাচনী বৈতরণী পার হবার জন্যেই তিনি ওয়াটারগেট কেলেংকারীর নায়ক হয়েছেন কিনা তাই বা কে বলবে? যাই হোক আমরা অবশ্য রাজনীতির অত শত গভীর তলদেশে যেতে চাইছিনা। তবে হোয়াইট হাউসের সেই ছোট্ট ঘটনাটির খবর পড়ে এ কথা বোধকরি সবার মনেই প্রশ্ন জাগবে তিনি ‘স্বাভাবিক’ আছেন কিনা? তাই বলছিলাম, নিক্সন সাহেব যেভাবে তরুণীদের পোশাকের প্রতি গভীর মনোযোগী হচ্ছেন তাতে সকলের মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক—নিক্সন সাহেব কি তাহলে ওয়াটারগেট কেলেংকারীতে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন? অথবা তাঁর মনে কি চীনা জুজুর ভয় আছে? যার ফলে ট্রাউজার পরা মহিলা দেখলেই চীনের কথা মনে পড়ে যায়? না কি তাঁর ভীমরতি ধরেছে?

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন