বাংলার বাণী
১২ই আগস্ট, রবিবার, ১৯৭৩, ২৭শে শ্রাবণ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
শুধু আলোচনা এবং প্রস্তাব গ্রহণে কাজ হবেনা
মুক্তির আন্দোলন চলছে এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকার নানা দেশে। সংগ্রাম সেখানে ঔপনিবেশিকতা, বর্ণবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে শান্তি, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র এবং প্রগতির স্বার্থে। দিন যতই গড়িয়ে চলছে, মুক্তি সংগ্রাম ততই তীব্রতর হচ্ছে। বিজয়ের লক্ষ্য অর্জনে এগিয়ে চলেছে মুক্তি সেনানীরা। প্রতিক্রিয়ার দূর্গ আঘাতের পর আঘাতে দুর্বল হয়ে পড়ছে। কিন্তু এ দুর্বলতা, ক্ষেত্রবিশেষে তাদের চূড়ান্ত পরাজয় স্বার্থ চক্রান্ত থেকে তাদের বিরত রাখতে পারেনি। দক্ষিণ আফ্রিকা-রোডেশিয়ার বর্ণবাদী সরকারকে পরোক্ষ সাহায্য এবং সমর্থন জানিয়ে চলেছে গণতন্ত্রের নামাবলী আঁটা অনেক পাশ্চাত্য শক্তি, এ্যাঙ্গোলা-মোজাম্বিকের মুক্তি সংগ্রামের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ ত্রাস সৃষ্টির কূট ষড়যন্ত্রে মদদ জুগিয়ে চলেছে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি সমূহ। অটোয়া কমনওয়েলথ সম্মেলনে সেই সাম্রাজ্যবাদী, বর্ণবাদী এবং ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামরত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে তাই আমাদের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে বাস্তব এবং কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের আবেদন রেখেছেন।
যে রোডেশীয় সরকারের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিলো আয়ান স্মিথের একতরফভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা এবং কৃষ্ণাঙ্গদের উপর সংখ্যালঘিষ্ঠ শ্বেতাঙ্গদের প্রভুত্ব কায়েমের পর পরই; সেই অবরোধ কার্যকরী হয়নি। বৃটেন স্বয়ং লঙ্ঘন করেছে সে ঘোষণা। অটোয়ায় কমনওয়েলথ সম্মেলনে সেই রোডেশিয়ার সঙ্গে আবার আলোচনায় বসবার প্রস্তাব যে বৃটেনের নিকট থেকেই আসবে তাতে আর আশ্চর্যন্বিত হবার কি আছে। বঙ্গবন্ধু কিন্তু সরাসরি সে প্রস্তাবের বিরোধিতা করে তাঁর বক্তব্য রেখেছেন। তিনি বলেছেন আলোচনার নামে সেখানকার মানুষের উপর অত্যাচার এবং নির্যাতন চলতে দেয়া যেতে পারেনা। প্রস্তাব রেখেছেন রোডেশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত করতে। বলেছেন মোজাম্বিক-এ্যাঙ্গোলা-দক্ষিণ এশিয়ার সকল রাজবন্দীর মুক্তির প্রশ্নে কমনওয়েলথকে তার প্রভাব বিস্তার করতে।
কেউই চায়না কমনওয়েলথ শুধু একটা আলোচনার ফোরাম হিসেবেই টিকে থাকুক। আজকের দুনিয়ায় বিরাজমান নানা সমস্যার ব্যাপারে তাকে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। এ শুধু সদস্য রাষ্ট্রগুলোর প্রশ্নেই নয় প্রয়োজনবোধে কমনওয়েলথের মাধ্যমে বিশ্বসংস্থাগুলোকে প্রভাবিত করতে হবে। শান্তি সংগ্রামে, মুক্তি স্বাধীনতাও প্রগতির স্বার্থে যদি কমনওয়েলথ এতটুকু অবদান রাখতে পারে তবেই এই সংস্থাটির টিকে থাকার সার্থকতা থাকতে পারে। বঙ্গবন্ধু কমনওয়েলথ সম্মেলনের বিভিন্ন আলোচনায় এই বিশেষ দিকটি তুলে ধরবার চেষ্টা করেছেন। শান্তিবাদী প্রগতিশীল রাষ্ট্রনায়কেরা তাঁকে অকুণ্ঠ সমর্থন প্রদান করেছেন। প্রতিক্রিয়ার শক্তিগুলো বার বার তাঁর বিরোধিতা করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন অথবা একটা আপোষ মীমাংসায় আসতে বাধ্য হয়েছেন। কমনওয়েলথে প্রগতি এই শক্তিবৃদ্ধি লক্ষণীয়। লক্ষণীয় প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে, সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতা ও বর্ণবাদের বিরুদ্ধে অধিকতর সোচ্চার প্রতিবাদ। আফ্রিকার মুক্তিকামী মানুষের বিরুদ্ধে, ল্যাটিন আমেরিকার প্রগতিশীল আন্দোলনের বিরুদ্ধে এবং এশিয়ায় উত্তেজনা বজায় রেখে সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ হাসিলের যে চক্রান্ত চলেছে আর যে হঠকারিতা এবং উগ্র জাতীয়তাবাদী ষড়যন্ত্র সেই চক্রান্তকে এগিয়ে নিয়ে যাবার মদদ যোগাচ্ছে তার প্রতিরোধে আজ প্রগতিশীল শক্তি সমূহকে ঐক্যবদ্ধভাবে সতর্কতার সঙ্গে অগ্রসর হতে হবে। মুক্তিকামী প্রগতিশীল মানুষের বিজয় অবশ্যম্ভাবী। আন্তর্জাতিক ফোরামসমূহের দায়িত্ব রয়েছে সেই বিজয়কেই ত্বরান্বিত করার। এ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে আন্তর্জাতিক ফোরাম হিসেবে যে কোন সংস্থার টিকে থাকবার প্রয়োজনও একদিন শেষ হয়ে যাবে।
পাট, খাদ্য এবং অর্থমন্ত্রীর আশ্বাস
ইউরোপ এবং আমেরিকায় বাংলাদেশের পাটের বাজারে নাকি ‘উজ্জ্বল সম্ভাবনা’ রয়েছে। গত পরশু আমাদের অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ঢাকা বিমান বন্দরে সাংবাদিকদের কাছে এ তথ্য প্রকাশ করেছেন। অর্থমন্ত্রী মহোদয় ওয়াশিংটনে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের ২০ জাতি কমিটির বৈঠকে যোগদান শেষে ঢাকা ফিরে এসেছেন। তিনি রাজধানী ঢাকার মাটিতে পা দিয়েই সাংবাদিকদের কাছে মুখ খুলেছেন যে, কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলো বাংলাদেশের পাট কিনতে আগ্রহী, এমনকি, অধিক মূল্য দিয়ে কিনতেও নাকি তাদের কোন ওজর-আপত্তি নেই। বেশ ভালো কথা। সুখের সংবাদ। তবে বাংলাদেশের পাট ক্রয় সম্পর্কে নাকি কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলো কিছু কিছু শর্ত আরোপ করেছে। প্রথমতঃ তারা সময়মতো সরবরাহ চায়। দ্বিতীয়তঃ অর্থমন্ত্রী মহোদয় আমাদের অবগতির জন্যে জানিয়েছেন যে, বাংলাদেশের পাট ও পাটজাত দ্রব্যের মান আরো উন্নত করা না হলে ভারতীয় পাট ও পাটজাতদ্রব্যের সাথে বিশ্ব বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা যাবেনা। অর্থমন্ত্রী মহোদয় বাংলাদেশের খাদ্য সমস্যা নিয়েও নাকি বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেছেন। খাদ্য সমস্যা সমাধানকল্পে বিভিন্ন দেশের আশ্বাস পাওয়া গেছে বলে তিনি জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, খাদ্যে উদ্বৃত্ত দেশগুলোর কাছ থেকে আরো তিন লাখ টন খাদ্যশস্য পাওয়া যাবে। তবে কোন্ দেশ এই সাহায্য দিচ্ছেন, সে সম্পর্কে তিনি কিছুই বলেন নি।
যাই হোক, অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের প্রদত্ত তথ্য থেকে আমরা আবার নতুন করে জানলাম যে, বিদেশে বাংলাদেশের পাটের বাজার রয়েছে। অর্থমন্ত্রী মহোদয় বিদেশে পাটের এই চাহিদাকে ‘উজ্জ্বল সম্ভাবনা’ বলে অভিহিত করেছেন। এ বিষয়ে আমাদেরও কোন সন্দেহ নেই। আমরাও বিশ্বাস করি, বিদেশে বাংলাদেশের পাটের সমাদর রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের পাট যাতে বিদেশে পর্যাপ্ত পরিমাণে রপ্তানী হতে পারে এবং আমরা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সক্ষম হই, সেজন্যে কি কার্যকর ব্যবস্থা অবলম্বন করা দরকার নয়? বিদেশে আমাদের পাটের শুধু চাহিদা থাকলেই তো হবে না, বিদেশের বাজারে যাতে আমরা বিপুল পরিমাণ পাট সরবরাহ করতে পারি সে চেষ্টাও করতে হবে। এবং আমাদের পাট যদি বিশ্ব বাজারে প্রতিযোগিতা করে টিকে না থাকতে পারে, তাহলে পাট দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করাটা একটা দুর্লভ ব্যাপারে পরিণত হতে বাধ্য। সেজন্যে বলতে চাই যে, বিদেশে পাটের সম্ভাবনা রয়েছে বললেই সমস্ত দায়িত্ব চুকেবুকে যাবে না। পাট উৎপাদনের প্রতি যেমন তীক্ষ্ম নজর রাখতে হবে, ঠিক তেমনি বিদেশে পাট রপ্তানীর ব্যাপারটির প্রতিও সদা সতর্ক থাকতে হবে। পাট ও পাটজাত দ্রব্যের মানোন্নয়নের জন্যে কোন চেষ্টা চরিত্র না করে কেবল বিদেশে আমাদের পাটের বাজার রয়েছে—এ ধরনের গালভরা বুলি দিয়ে কোন লাভ হবে না। অর্থমন্ত্রী মহোদয় অবশ্য আমাদের বিরাজিত খাদ্য সমস্যা সম্পর্কেও নাকি বিভিন্ন বিদেশী প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেছেন। কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলো বাংলাদেশের ঘাটতি খাদ্য পূরণের জন্যে সাহায্য দেবে বলে আশ্বাস দিয়েছে। আমাদের অর্থমন্ত্রী মহোদয় সেই আশ্বাসবাণীর বার্তাই আমাদের জন্যে বয়ে নিয়ে এসেছেন। এবং তিনি বিদেশী সাহায্যপ্রাপ্তি সম্পর্কেও ব্যক্তিগতভাবে গভীর আশাবাদ প্রকাশ করেছেন। আমরা সবাই কমবেশী আশাবাদী। তাই আশার কুহক আমাদের তেমন হতাশ করেনা। সম্ভবতঃ সে জন্যেই অর্থমন্ত্রী আমাদের এই বলে আশ্বস্ত করেছেন যে, বন্যা নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনা সহ বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্যে বিশ্বব্যাংক আমাদের আর্থিক সাহায্য দিতে কার্পণ্য করবে না। অর্থমন্ত্রী মহোদয় বিশ্বব্যাংক প্রধান মিঃ ম্যাকনামারার সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন। সব কিছুতেই অর্থমন্ত্র মহোদয় আমাদের আশ্বাসবাণী শুনিয়েছেন। জানিনা, এই আশ্বসের উপর নির্ভর করেই আমাদের বাঁচোয়া কিনা। কারণ, আশ্বাস আমরা বহু শুনেছি। বড়ো বড়ো বুলিও আমরা অনেক হজম করেছি। সেজন্যেই বিদেশে পাটের যেন একটা গতি হয় এবং খাদ্য ঘাটতির সংকট যেন আমরা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হই, অর্থমন্ত্রী মহোদয় কি সেইদিকে এবার একটু দিব্যদৃষ্টি দেবেন?
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক