বাংলার বাণী
ঢাকা : ১৭ই নভেম্বর, রোববার, ১৯৭৪, ৩০শে কার্ত্তিক, ১৩৮১ বঙ্গাব্দ
যৌথ নদী কমিশনের বৈঠক
শীতের সঙ্গে সঙ্গে দেশের উত্তরাঞ্চলের নদীপ্রবাহ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে শুরু করেছে। ক’মাস আগেই গেল বন্যার সর্বনাশা তান্ডব। আর সেই সঙ্গে ফসল আর অগুণতি প্রাণহানি। অথচ এগারো দফা বৈঠক সেরেও যৌথ নদী কমিশন ফারাক্কা অথবা দু’দেশের জল সমস্যার কোনো বাস্তব সর্বসম্মত কর্মসূচী গ্রহণ করতে পারলো না। দিল্লীর সর্বশেষ যে বৈঠকটি মুলতবী রাখা হয়েছিল তাই আবার শুরু হয়েছে ঢাকায়। উদ্দেশ্য যে করেই হোক একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হবে। কারণ বিগত মে মাসে বাংলাদেশ এবং ভারতের দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক শেষে প্রকাশিত যুক্ত ঘোষণায় চুয়াত্তর সাল শেষ হবার আগেই ফারাক্কা বাঁধ চালু করার কথা বলা হয়েছে।
যৌথ নদী কমিশনের এতগুলো বৈঠক হওয়া সত্ত্বেও তাদের কর্মকান্ডের অগ্রগতি সম্পর্কে (যদি তা অবশ্য আদৌ হয়ে থাকে) কিছু জানা যায় নি। জনসাধারণকে এমনি অজ্ঞ রাখার প্রবণতা থেকে সৃষ্টি হয়েছে নানা রকম জল্পনা-কল্পনা। একে কেন্দ্র করে নিজ নিজ মতলব হাসিলের প্রচেষ্টাও যে কোনো কোনো মহলের মধ্যে লক্ষ্য করা যাচ্ছে না তা নয়।
দায়িত্বশীল জাতীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বরাবরই আমাদের জল সমস্যাকে দু’টি মিত্র দেশের সমস্যা হিসেবে বলে আসছেন। সেই মনোভাব নিয়েই যৌথ নদী কমিশন গঠন এবং পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা অব্যাহত রাখা হয়েছে। অথচ সমস্যা সমাধানে কোনো প্রকার বাস্তব অগ্রগতি সম্পর্কে তথ্যের অভাব ও দীর্ঘসূত্রিতার ফলে তা এখন ‘ইস্যু’ হিসেবে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে।
আমরা এ ব্যাপারে সরকারের সতর্ক দৃষ্টি আশা করছি। পাকিস্তান আমলে এটাকে পুরোপুরিভাবেই রাজনৈতিক ‘ইস্যু’ হিসেবে ব্যবহার করার ফলে উত্তরাঞ্চলের লক্ষ লক্ষ কৃষিজীবী মানুষের স্বার্থ অবহেলিত হয়েছে। স্বাধীনতাত্তোরকালে বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দু’দেশের সাধারণ কৃষিজীবী মানুষের স্বার্থকে সামনে রেখে এই সমস্যার একটা সমাধানের জন্য আমরা দাবী জানিয়ে এসেছি। বিশেষজ্ঞদের রিপোর্ট অনুসারেই বাংলাদেশের সার্বিক প্রয়োজন এবং কলকাতা ও ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় এলাকার প্রয়োজন অনুযায়ী যথেষ্ট জল গঙ্গা দিয়ে প্রবাহিত হয়না। তাই বাংলাদেশ-ভারত যুক্ত ঘোষণায় দু’দেশের প্রয়োজন মেটানোর জন্য শুষ্ক মৌসুমে অধিকতর জল প্রবাহের সুপারিশ করা হয়েছে। যৌথ নদী কমিশনের উপর দায়িত্ব ছিল এই জল প্রবাহ বৃদ্ধিকল্পে কোনো উপায় খুঁজে বের করা।
সেটা আজতক সম্ভব হয়নি। চলতি বৈঠকেও তা সম্ভব হবে কি না সে সম্পর্কেও কিছু আভাস পাওয়া যায়নি। পত্র-পত্রিকায় কমিশনের দু’দেশের পক্ষ থেকে দু’টি ভিন্ন ধরনের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে বলে খবর বেরিয়েছে। বাংলাদেশ শুষ্ক মৌসুমের জন্য ভারতীয় এলাকায় একটি ‘রিজার্ভার’ নির্মাণ এবং ভারত ব্রহ্মপুত্র নদকে গঙ্গার সঙ্গে সংযুক্তিকরণের জন্য খাল খননের প্রস্তাব দিয়েছে বলে পত্র-পত্রিকায় যে খবর বেরিয়েছে সে সম্পর্কে কমিশনের তরফ থেকে কোনো প্রকার মন্তব্য করা না হলেও একটা কথা বিশ্বাস করবার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, রাজনৈতিক পর্যায়ে নীতি নিধারণে যে আন্তরিকতাপূর্ণ সহযোগিতা লক্ষ্য করা গেছে কমিশন পর্যায়ে তা বেশ খানিকটা শিথিল।
স্মরণ করা যেতে পারে, শুধু ফারাক্কা সমস্যার সমাধানই নয় বরং দু’দেশের জল সমস্যার ব্যাপকতর ক্ষেত্রে একটা দীর্ঘস্থায়ী সমাধান খুঁজে বের করার উদ্দেশ্যেই যৌথ নদী কমিশন গঠন করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল বাংলাদেশ এবং ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় এলাকায় সাংবাৎসরিক বন্যা নিয়ন্ত্রণ এবং শুষ্ক মৌসুমে প্রয়োজনীয় জল সরবরাহের নিশ্চয়তা বিধানকল্পে দু’দেশ মিলে ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করার কথা। কিন্তু ফারাক্কা নিয়েই কমিশনের মাসের পর মাস নিষ্ফল বৈঠক ব্যাপকতর পরিকল্পনা গ্রহণের ব্যাপারেই জনমনে অনাস্থার মনোভাব সৃষ্টি করে চলেছে।
আমরা যৌথ কমিশন এবং জাতীয় নেতৃবৃন্দের দৃষ্টি এদিকে আকর্ষণ করছি এই আশা নিয়ে যে, তারা যত শীঘ্র সম্ভব দু’দেশের বাস্তব স্বার্থ এবং বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক দৃঢ়তর করার জন্যই বাংলাদেশ-ভারত যুক্ত ঘোষণার আলোকে ফারাক্কা সমস্যা সহ জল সমস্যার অন্যান্য দিকের সমাধানে অধিকতর গুরুত্ব প্রদান করবেন।
পশু কাটা নিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য
লাঙ্গলটানার জন্য কোনো কৃষককে যদি এক জোড়া সাধারণ বলদ বর্তমানে দেড় থেকে দু’হাজার টাকায় খরিদ করতে হয়, সঙ্গত কারণেই তাহলে মনে প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক যে, কৃষির ঢিমে তালে চলা গতি একেবারে থেমে যেতে এবং বাংলার অমূল্য গোসম্পদ নির্বংশ হতে খুব বেশী দেরী বোধ হয় আর হবে না। বলদ টানা কাঠের লাঙ্গলের উপর বাংলার কৃষি সর্বাংশে নির্ভরশীল এ কথা কে না জানে? অথচ এমন একটা সময় আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে যখন লাঙ্গল টানার জন্য বলদ জোগাড় করা একেবারে দুষ্কর হয়ে পড়বে। সত্তুর সালে উপকূলীয় ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে দশ লাখ মানুষের সাথে কয়েক লাখ গবাদি পশু বঙ্গোপসাগরের পানিতে ভেসে যায়। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাপ বা তা পূরণের আগেই এলো স্বাধীনতা যুদ্ধ। মুক্তিবাহিনী অথবা পাক মিলিটারী, পক্ষ-বিপক্ষ যে যেখানেই ছাউনী ফেলেছে, উদর পূর্তির প্রয়োজনে তারা পাইকারীভাবে গবাদি পশু হত্যা করেছে। এরপর সাম্প্রতিককালের ভয়াবহ বন্যায় দেশের চৌদ্দটি জেলার মানুষকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেয়ার সময় বন্যাকবলিত ঐ সমস্ত অঞ্চলের গবাদি পশুগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার প্রশ্ন উঠলেও তা সম্ভব ছিল না। কারণ মানুষকে আগে বাঁচাতে হয়েছে। অসংখ্য গরু, মহিষ, ভেড়া, ছাগল তাই বানের পানিতে ভেসে যায়।
মাত্র চাটি বছরের মধ্যে দেশের অমূল্য পশু সম্পদের উপর এমনি ধরনের ব্যাপক আঘাত সম্ভবতঃ ইতিপূর্বে আমাদের জানা মতে আর আসেনি। সময় ও কর্মসূচীর অভাবে তার ক্ষতিপূরণও সম্ভব হয়নি, তদুপরি খাদ্য হিসাবে সপ্তাহের ছয়দিনই আমরা অসংখ্য পশু কেটে চলেছি এবং বলা বাহুল্য গোমাংসই রসনার সেরা, উপাদেয় ও সহজলভ্য বস্তুতে পরিণতি লাভ করেছে আমাদের কাছে, সুতরাং চতুষ্পদ প্রাণীকূলের মধ্যে গো-সম্পদের উপরই অত্যাচারের মাত্রা চলেছে সমধিক এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মড়ক ও আমাদের রসনার উপাদান হওয়ার জন্য এক কথায় বলতে হয়, গো-সম্পদের এক চরম দুর্দিন চলেছে বর্তমানে বাংলাদেশে এবং আমাদের আশংকা হয় প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে লাখ লাখ পশু বিনষ্ট হওয়ার পরও যদি পশু কাটার বর্তমানের এই গতি আরো দু’টো বছরও অব্যাহত থাকে এক জোড়া বলদ আজ দু’হাজার টাকাতেও পাওয়া যাচ্ছে, তখন চার হাজার টাকা দিলেও পাওয়া যাবে কিনা দুষ্কর। দশ টাকা সেরের গরুর মাংস তখন ত্রিশ টাকাতে উঠলেও যাদের বিচলিত হবার কিছু থাকবে না তাদের কথা বাদ দিলাম, বলদটানা লাঙ্গলের উপর নির্ভরশীল চাষীর অবস্থা কি দাঁড়াবে এবং কৃষির ভবিষ্যতই বা কি হবে ঠিক এ মুহূর্তে সেই দুর্দিনের কথা কিছুটা আঁচ করতেও যেন আজ ভয় পাচ্ছি।
এই অমূল্য সম্পদ রক্ষা ও তাদের বংশ বৃদ্ধির ব্যাপারে বাংলাদেশে একটা গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর আছে। জানিনা বর্তমানে তাদের কাজটা কি? তবে বাংলার অমূল্য পশু সম্পদ বৃদ্ধির কথা না হয় বাদই দিলাম। তাদেরকে রক্ষা করার ব্যাপারে এই দপ্তরের কর্মকর্তাদের কোনো মাথা ব্যথা যে নেই এই তিনটি বছরে তাদের কার্যকলাপে তা পরিষ্কার হয়ে গেছে। প্রয়োজনীয় একটা ব্যাপক কর্মসূচী তারা গ্রহণ করেননি এবং এখনো তা করা হচ্ছে না। কবি জসীম উদদীন সম্প্রতি এ ব্যাপারে প্রশ্ন তুলে পশু কাটার উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করে পশু হত্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে কার্যোপযোগী ব্যবস্থা অবলম্বনের জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। আমরা মনে করি, একদিকে প্রাকৃতি বিপর্যয় ও মড়ক, অপরদিকে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্তব্য পালনে সম্পূর্ণ অনীহা ও ব্যর্থতা তদুপরি পশু হত্যার যে হিড়িক চলছে, তাতে সব কিছু মিলিয়ে বাংলাদেশের পশু সম্পদের ভবিষ্যত সম্পূর্ণ অনিশ্চয় হয়ে পড়েছে এবং একদিকে এ সম্পদের বৃদ্ধির ব্যাপারে প্রয়োজনীয় কর্মপন্থা ও পশু কাটা নিয়ন্ত্রণের যুগবৎ কর্মসূচী ছাড়া অন্য কোনো পথ খোলা নেই আপাততঃ আমাদের কাছে। কারণ গত চার বছরে গবাদি পশু সম্পদের যে ক্ষতি হয়ে গেছে নতুন করে সে ক্ষতিপূরণের জন্য সময়ের ও কর্মসূচীর প্রয়োজন বলে সেই পার্থিত সময়ে নিরিখে ঠিক বর্তমান মুহূর্তে পশু কাটা নিয়ন্ত্রণ সর্বোতভাবে অপরিহার্য।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক