বাংলার বাণী
৩১শে আগস্ট, শুক্রবার, ১৯৭৩, ১৪ই ভাদ্র, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
সচেতন শ্রমজীবী মানুষের প্রতিরোধ
মওলানা ভাসানী আহুত হরতাল সফল হতে পারেনি মেহনতি মানুষের তীব্র প্রতিরোধের মুখে, সফল হতে পারেনি ভাসানী পন্থী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির হীন চক্রান্ত। হরতালের এই পরিণতিতে পিঠটান দিয়েছেন স্বয়ং মওলানা, টঙ্গীর শ্রমিক সমাজের দৃঢ় প্রত্যয়ের মুখে হাত গুটিয়ে বসেছেন পার্টির সেক্রেটারী জেনারেল কাজী সাহেব। রাজী সাহেবের কিন্তু সেই বালাই নেই। সঙ্গে তরুণ কর্মী মেনন সাহেবকে নিয়ে জনসভার স্থলে প্রেস ক্লাবের ছোট্ট কুঠরীতে এক প্রেস কনফারেন্স ডেকে হরতাল ‘সফল’ হওয়ার নানা ফিরিস্তি বয়ান করেছেন তিনি। একটা কথা অবশ্য সত্যি যে গত ঊনত্রিশ তারিখে আহুত হরতালের দিনে বিত্তবান সম্প্রদায়ের প্রাইভেট কার খুব একটি চলাচল করতে দেখা যায়নি; বাস এবং ট্রাক মালিকেরা শ্রমিকদের সকল দাবী অগ্রাহ্য করে তা গ্যারেজে তুলে রাখা শ্রেয় মনে করেছেন। দোকান-পাট, কাঁচা-বাজার, অফিস-আদালত, কোর্ট-কাচারী-ব্যাংক, বি.আর.টি.সি’র বাস, রিক্সা, বেবি ট্যাক্সি সম্পূর্ণ স্বাভাবিকভাবে তাদের কর্মতৎপরতা চালু রেখেছে। সবচাইতে যা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো তথাকথিত এই বামপন্থীদের হরতালের স্বপক্ষে তেজগাঁ-টঙ্গী-পোস্তগোলা-ডেমরা-নারায়ণগঞ্জ প্রভৃতি শিল্পাঞ্চলের একটি শিল্প কারখানাও সমর্থনের হাত সম্প্রসারিত করেনি। একটি কলের চাকা বন্ধ ছিলো বলে এমনকি ন্যাপ নেতারাও তাদের প্রেস কনফারেন্সে দাবী করতে পারেননি।
মেহনতি মানুষের এই সুদৃঢ় প্রতিরোধকে অভিনন্দন জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি এবং বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট পার্টির নেতৃবৃন্দ। জনগণ যে সুশৃঙ্খলভাবে এবং সচেতনতার সঙ্গে এই গণবিরোধী হরতালকে প্রতিহত করেছে তা সত্যি অভিনন্দনযোগ্য। ঊনত্রিশ তারিখে হরতাল প্রতিরোধকারী জনসাধারণ এবং সরকারের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সমূহ যে ধৈর্য এবং সহিষ্ণুতার পরিচয় দিয়েছে তাও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ঢাকা এবং সিলেট সহ কোন কোন স্থানে ভাসানী ন্যাপ এবং অন্যান্য উগ্রপন্থী দল উপদল হরতালকে কেন্দ্র করে যে সন্ত্রাস সৃষ্টির অপচেষ্টা চালিয়েছিলো তাও জনসাধারণের সচেতন প্রতিরোধে নস্যাৎ হয়েছে।
জনসাধারণ বিশেষ করে দেশের শ্রমজীবী মানুষ ভাসানী ন্যাপের ডাককে যেভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে তা বামপন্থী বলে পরিচয় দানকারী এই রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কি প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে তা জানা না গেলেও এটা আজ দিবালোকের মতো স্বচ্ছ হয়ে গেছে যে শ্রমজীবী মানুষের সমর্থনহীন এই দল আর যাই হোক বামপন্থী হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেবার সঙ্গত কোন অধিকার রাখেনা। তবে এদের আসল চরিত্র কি? তাও জবাব পাওয়া গেছে হরতালের দিনের এক ঘটনায়। বেলা আনুমানিক দশটার সময় ভাসানী ন্যাপের কেন্দ্রীয় অফিস থেকে এক দল লোক লাঠি এবং অন্যান্য অস্ত্র হাতে সাম্প্রদায়িক শ্লোগান দিয়ে রাস্তায় চলাচলকারী যানবাহনের চালকদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। একজন রিক্সাচালক মারাত্মকভাবে আহত হয় আর সেই সঙ্গে উৎকটভাবে প্রকাশ হয়ে পড়ে হরতাল আহ্বানকারীদের কুৎসিত চেহারা।
মওলানা ভাসানীর চক্রান্ত সফল হতে পারেনি কিন্তু এখানেই তার গণবিরোধী পরিকল্পনার অবসান ঘটবে এটা আশা করা বৃথা। অন্ধকারে সরীসৃপরা নতুন দংশন হানার চক্রান্তজাল বুনে যাবে। আর সে চক্রান্ত সম্পর্কে সতর্ক থেকে দেশপ্রেমিক প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলসমূহকে ঐক্যবদ্ধভাবে আগামীদিনে সংগ্রামী কর্মধারা অব্যাহত রাখতে হবে। বঙ্গবন্ধুর মহান প্রচেষ্টায় উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার যে পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে তার বাস্তবায়নে অন্তরায় সৃষ্টি করবার লোকের অভাব হবেনা। আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের দেশী যোগসাজশকারীরা নতুন করে তাদের কূটপরিকল্পনা প্রণয়ন করবে আর এই দেশী বিদেশী সকল চক্রান্তকে প্রতিহত করবার একমাত্র উপায় সচেতন জনগোষ্ঠীর ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন। যেভাবে প্রতিক্রিয়াশীলদের অতীত সকল অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে আমরা আশা করি আগামীদিনেও জনগণের সক্রিয় প্রতিরোধের মুখে তাদের যে কোন গণবিরোধী তৎপরতা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।
জরুরী ভিত্তিতে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হোক
চট্টগ্রাম বন্দরে বিদেশ থেকে আমদানী করা প্রায় ৭৫ হাজার টন মাল পড়ে আছে। এর মধ্যে খাদ্যশস্যের পরিমাণ ১১ হাজার ১শ’ ৪১ টন। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারী থেকে আগস্ট মাসের মধ্যে উল্লেখিত মাল আমদানী করা হয়েছে বলে স্থানীয় একটি দৈনিকে প্রকাশিত খবর অনুসারে জানা যায়। বার্তা প্রতিষ্ঠান এনার উদ্ধৃতি দিয়ে দৈনিকটি জানাচ্ছে চট্টগ্রাম পোর্ট ট্রাস্ট সূ্ত্রে জানা গেছে, আমদানীকৃত এসব পণ্য দ্রব্যের মধ্যে রয়েছে ১ হাজার ৪শ’ ২৪ টন সিমেন্ট, ২ হাজার ৮শ’ ৭৮ টন তুলা, ৩৩ হাজার ২শ’ ৫৯ টন কয়লা, ৫ হাজার ৬৭ টন ত্রাণ সামগ্রী, ২ হাজার ৯শ’ ১৭ টন টিসিবির পণ্য, ২ হাজার ১শ’ ৬৪ টন ওয়াপদার পণ্য এবং ৩শ’ ৯৪টি যানবাহন। ১৯ কোটি টাকা মূল্যের যানবাহনগুলোর মধ্যে রয়েছে ৪৯টি বেবী ট্যাক্সি, ৫৪টি ল্যান্ড রোভার, ৪১টি মাইক্রোবাস ও ৪৭টি জীপ এবং এছাড়া আরো রয়েছে সরকার কর্তৃক আমদানীকৃত ১শ’টি বাস, বিএডিসি’র ৫টি ট্রাক, আনরবের ২২টি ল্যান্ড রোভার ও ১টি জীপ এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান কর্তৃক আমদানী করা বিভিন্ন ধরনের ৭৫টি যানবাহন। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, বন্দরে পড়ে থাকা উক্ত মালের মধ্যে ২৯ হাজার ২৭ টন পোর্ট শেডে এবং ৩৩ হাজার ৫শ’ ১৯ টন উন্মুক্ত স্থানে পড়ে রয়েছে বলে প্রকাশিত সংবাদে উল্লেখ করা হয়েছে।
বাংলাদেশের সর্বত্র এখন খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ইত্যাদি সমস্যার সাথে সাথে যোগাযোগের অব্যবস্থা এবং বন্যা প্লাবিত এলাকায় ত্রাণ সামগ্রীর অভাব প্রকট হয়ে উঠেছে। আর সেই কারণেই নিত্যনৈমিত্তিক আমরা খবরের কাগজের পৃষ্ঠায় খবর দেখছি বিভিন্ন এলাকায় জনগণ অনাহার অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন, বস্ত্রের অভাবে ছেঁড়া কাঁথা, চট পরিধান করছেন, গৃহনির্মাণ সামগ্রীর অভাবে বাসস্থানের অভাব দূরীকরণের প্রকল্প হাতে নেয়া যাচ্ছে না কিংবা ন্যায্যমূল্যের দোকানে টিসিবি’র কাপড় নেই, বন্যা দুর্গত এলাকায় আজও ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছেনি, প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদির অভাবে বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা নেই, ফলে মিল কারখানা বন্ধ, শহর অন্ধকার ইত্যাকার খবর। অথচ বন্দরে যে সব দ্রব্য পড়ে আছে তা উল্লেখিত সমস্যাবলী নিরসনের প্রেক্ষিতেই যে আমদানী করা হয়েছে সেকথা উল্লেখের অবকাশ রাখে না। তাহলে কেন এগুলোকে এমনি করে ফেলে রাখা হয়েছে?
যোগাযোগের অব্যবস্থার জন্যে এগুলোকে যথাস্থানে পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না বলে এর আগে খবর বেরিয়েছিলো। আমরাও জানি পরিবহনের অভাব রয়েছে যথেষ্ট। কিন্তু তবু বলতে দ্বিধা নেই, যুদ্ধোত্তর বিগত দু’বছরের মধ্যে যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থার যতখানি উন্নয়ন ঘটেছে তা নেহায়েত অনুল্লেখযোগ্য নয়। সুতরাং এক্ষণে আমাদের মনে হয় বন্দরে পড়ে থাকা পণ্যগুলো স্থানান্তরের কাজে কিছুটা অবহেলাই বিশেষ করে নতুন সমস্যার সৃষ্টি করছে। সুতরাং আমাদের বক্তব্য, বর্তমান সমস্যাসংকুল পরিস্থিতিতে পুনর্গঠনমূলক কাজের সময়ে যুদ্ধকালীন জরুরী পরিস্থিতি বিবেচনা করে সকলে আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করলে অবশ্যই সমস্যার নিরসন ত্বরান্বিত হবে। কাজেই সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আমাদের বক্তব্য প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে আমদানীকৃত উল্লেখিত পণ্যগুলোর সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণ এবং বন্টনের কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। নচেৎ বহু কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রারই অপচয় ঘটবে। তাতে দেশের ও জনগণের এতটুকু উপকার হবেনা। এতদসংক্রান্ত কাজে জনগণকেও বৈপ্লবিক চিন্তাধারা ও আন্তরিকতা পূর্ণ মন নিয়ে সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাজে সহযোগিতা করতে হবে।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক