You dont have javascript enabled! Please enable it! একাত্তরে ২টি চাঞ্চল্যকর ঘটনার প্রথমটি মুজিব বাহিনী গঠন - সংগ্রামের নোটবুক
একাত্তরে ২টি চাঞ্চল্যকর ঘটনার প্রথমটি মুজিব বাহিনী গঠন
কোনাে কোনাে গবেষকের মতে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যখন চরম পর্যায়ে, তখন ২টি চাঞ্চল্যকর ঘটনা মুজিবনগর সরকারকে স্তম্ভিত করেছিল। এই ২টি ঘটনার কর্মকাণ্ড হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক নেতৃত্বদানকারী মুজিবনগর সরকারের সম্পূর্ণ অজান্তে। আশ্চর্যজনকভাবে এর প্রথমটি তৎকালীন ভারত সরকারের গােপন উদ্যোগে সংঘটিত এবং অত্যন্ত আকস্মিকভাবেই পুরাে ব্যাপারটি মুজিবনগর সরকারের গােচরীভূত হয়। এ সময় সর্বপ্রথম ৮নং সেক্টর থেকে মুজিবনগর সরকারের সচিবালয়ে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে এ মর্মে এক সংবাদ এসে পৌছায় যে, বাংলাদেশের একদল সশস্ত্র যুবককে হালকা ধরনের সংঘর্ষের পর আটক করা হয়েছে। গােপনে প্রেরিত সংবাদে আরও বলা হয় যে, পূর্ণ ট্রেনিংপ্রাপ্ত এসব যুবক অত্যাধুনিক অস্ত্র বহন করছে এবং এরা দেশের আরও অভ্যন্তরে আস্তানা গেড়ে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে আগ্রহী। এঁরা নিজেদের ‘মুজিব বাহিনীর সদস্য হিসাবে দাবি করেছে। সঙ্গে সঙ্গে কোলকাতায় অবস্থানকারী। ভারত সরকারের কন্ট্রাক্ট পয়েন্ট’ নাথ বাবুকে যােগাযােগ করা হলে, তিনি ভারত সরকারের পক্ষে অবিলম্বে এদের ছেড়ে দেয়ার অনুরােধ জানান। বিরাজমান পরিস্থিতিতে এই অনুরােধ রক্ষা করা হয়। সে রাতেই ৮ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর (পরবর্তীকালে মেজর জেনারেল) এম এ মঞ্জুরকে নির্দেশ পাঠানাে হলাে ‘মুজিব বাহিনী’র এসব সদস্যদের ছেড়ে দেয়ার জন্য। স্বল্প দিনের মধ্যে মুজিবনগর সরকারের উর্ধ্বতন মহলে পুরাে ব্যাপারটা পরিষ্কার হলাে। সে আমলে সমগ্র পশ্চিম বাংলা ও বিহারের অঞ্চল বিশেষে ভয়াবহ ও রক্তাক্ত নকশাল আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে ভারত সরকারের মনে এ মর্মে আশঙ্কা হয়েছিল যে, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব বাঙালি জাতীয়তাবাদী শক্তির হাত থেকে উগ্র বামপন্থীদের কবজায় চলে যেতে পারে।
তাই এর সম্ভাব্য মােকাবেলায় দ্বিতীয় পন্থা হিসাবে ভারত সরকার অত্যন্ত সঙ্গোপনে এই ‘মুজিব বাহিনী’র সৃষ্টি করেছে। এদের ট্রেনিং-এর দায়িত্বে ছিলেন মেজর জেনারেল ওবান। ইনি শিখ সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন। এ সময় মুজিব বাহিনীর নেতৃবৃন্দ ছিলেন বয়সে নবীন এবং অনেকেই সবেমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় পরিত্যাগ করেছেন। একাত্তরে এঁদের প্রধান কার্যালয় ছিল আগরতলা। মুজিবনগর সরকারের অজান্তেই এ সময় গড়ে উঠেছিল আগরতলা-দিল্লী যােগাযােগ। উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদী দর্শনে আপুত এদের চিন্তাধারার সূতিকাগার হচ্ছে ১৯৬৯-১৯৭১ সালে ঢাকার ইকবাল। হলে (সার্জেন্ট জহুরুল হক হল)। রাজনৈতিক দিক থেকে এরা ছিলেন উচ্চাভিলাষী। এবং এঁদের কর্মকাণ্ড ছিল প্রবাসী সরকারের আওতার বাইরে। ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামের বক্তব্যে ঐতিহাসিক তথ্য ‘মুজিব বাহিনী’ গঠনের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামের বক্তব্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রের’ পঞ্চদশ খণ্ডে প্রকাশিত ব্যারিস্টার ইসলামের এতদ্‌সম্পর্কিত বিবৃতির অংশ বিশেষ এখানে উপস্থাপিত করা হলাে। আমিরুল ইসলাম তাঁর বক্তব্যে বলেছেন :  .. আমাদের সাথে ভারত সরকারের কথা হয়েছিল তারা এক লাখ গেরিলাকে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দিবে। এছাড়া একটি বেতার স্টেশন চালুর ব্যাপারেও ভারত সরকার প্রতিশ্রুতি দেন। এদিকে ভারত সরকারের বিভিন্ন এজেন্সির লােক আমাদের সাথে যােগাযােগ রক্ষা করছে। কখনাে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, কখনাে সামরিক লিয়াজো আমাদের কাছে আসছে। এসব বিষয়ে সমন্বয় সাধনের জন্য বাংলাদেশ মন্ত্রিসভা মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সাক্ষাতের সিদ্ধান্ত নেয়। মিসেস গান্ধীর সাথে দেখা করার জন্য সব মন্ত্রী দিল্লী যান। দেখা করে তারা কোলকাতায় ফিরে আসেন। এ সময় ওসমানী রাজনৈতিক সচেতন ছেলেদের প্রশিক্ষণ দেয়ার প্রস্তাব করেন। রাজ্জাক, তােফায়েল প্রস্তাব নিয়ে আসেন, তাদের দায়িত্ব দিলে তারা ভালাে ছেলে রিক্রুট করে দিতে পারে। ওসমানী তাদের প্রস্তাবে উৎসাহ প্রকাশ করেন। তিনি আমার পাশের ঘরে থাকতেন।
বালিগঞ্জে তার অফিস ছিল। তার অফিস তখনাে ভালােভাবে গড়ে ওঠেনি। তিনি আমাকে একটা ‘অথরাইজেশন লেটার লিখে দেয়ার অনুরােধ করেন। আমি তা লিখে টাইপ করে দিয়ে দিলাম। ‘ওসমানী তার পক্ষ থেকে রাজ্জাক, তােফায়েলকে রিক্রুট করার অধিকার দিয়ে দিলেন। এই চিঠির সুযােগ গ্রহণ করেই শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক, তােফায়েল আহম্মদ, আ স ম আবদুর রব ‘মুজিব বাহিনী’ নামে আলাদা বাহিনী গড়ে তােলেন। ‘ভারতের দুইটি স্থানে মুজিব বাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। জেনারেল ওবান এই প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন। আজ পর্যন্ত আমি বুঝে উঠতে পারছি না ‘মুজিব বাহিনী’ নামে এই আলাদা বাহিনীর কোনাে প্রয়ােজন ছিল কিনা। তবে যদুর জেনেছি, ভারতীয় গােয়েন্দা সংস্থা-এর সাথে শেখ মণির লবি ছিল। তাঁদের বুঝানাে হয়, যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে বর্তমান আওয়ামী লীগ সে সময় নেতৃত্ব দিতে অসমর্থ হবে। অথবা এই নেতৃত্ব কোনাে প্রকার আপােষ করতে পারে। তাকে আরাে বুঝানাে হয়, যে যুব শক্তি স্বাধীনতার উন্মেষ ঘটিয়েছে, তারাই কেবলমাত্র সঠিক নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হবে। প্রয়ােজনে এই নেতৃত্ব আওয়ামী লীগের বিকল্প হিসাবে কাজ করতে পারবে। তাছাড়া বাংলাদেশ স্বাধীন হলে এই নবশক্তি চীন বা নকশালপন্থীদের বিরুদ্ধে স্বাধীন ও সার্বভৌম সরকার প্রতিষ্ঠায় সহযােগিতা করবে। পরে আরাে জেনেছি, ভারত সরকার এই সিদ্ধান্ত মেনে নেয়; যার অর্থ হলাে : ‘এক বাক্সে সব ডিম না রাখা।  ‘বিএসএফ’-এর (বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স) রুস্তমজী ‘মুজিব বাহিনী গঠনের তীব্র প্রতিবাদ করেন। কিন্তু তার প্রতিবাদ শেষ পর্যন্ত গ্রাহ্য হয়নি। সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার হলাে, ভারত সরকার মুজিব বাহিনী গঠন সংক্রান্ত এই সিদ্ধান্ত মুজিবনগর সরকারের কাছে গােপন রাখে। তাজউদ্দিন ভাইসহ আমাদের অনেককেই এই সিদ্ধান্ত পীড়া দেয়।
জাতি যখন সম্পূর্ণভাবে একটি নেতৃত্বের পিছনে ঐক্যবদ্ধ ও আস্থাবান, তখন যুব শক্তিকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করা বা বিভেদ সৃষ্টির প্রচেষ্টা মুক্তিযুদ্ধের যেমন সহায়ক হয়নি, তেমনি পরে দেশ পুনর্গঠনের কাজেও অন্তরায়। হিসাবে কাজ করেছে। ‘আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে এর চেয়ে বড় বিপর্যয় (সেট ব্যাক) আর কিছু হতে পারে না। আমাদের এমপি, এমএনএ ও নেতাদের মনােনীত ছেলেদের মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। ওসমানীর প্রত্যাশিত ‘সােনার ছেলে’ পাওয়া গেল মুজিব বাহিনীর নেতৃবৃন্দ তাঁকে এই সুযােগ দেননি। ওসমানীর প্রাথমিক ধারণা ছিল তারা (যুব নেতৃবৃন্দ) হয়তাে তাদের দায়িত্ব পালন করেননি। কিন্তু পরে তিনি জানতে পারেন, এই দায়িত্বের ভার নিয়ে তারা অন্য দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত ছিলেন…। দ্বিতীয় ঘটনা কথিত মার্কিনী ষড়যন্ত্র সম্পর্কিত এবার অভাবনীয় এবং অচিন্তনীয় দ্বিতীয় ঘটনার কথা। এই ঘটনার প্রস্তুতি ও আয়ােজন হয়েছিল ভারত এবং নির্বাসিত মুজিবনগর উভয় সরকারের অগােচরে। অনেকের মতে, ভারত সরকার স্বীয় তৎপরতায় ঘটনার প্রস্তুতি সম্পর্কে অবহিত হলে মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ-এর নিকট বিদেশে প্রেরিত সংশ্লিষ্ট তারবার্তার কপি এবং এতদসম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য হস্তান্তর করে। প্রদত্ত তথ্যে এ মর্মে বলা হয় যে, আলােচ্য ঘটনার প্রথম পক্ষ হচ্ছে মুজিবনগর সরকারের আভ্যন্তরীণ কোন্দল দক্ষিণপন্থী উপ-দলীয় নেতা পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মােশতাক আহম্মদ ও পররাষ্ট্র সচিব মাহবুব আলম চাষীসহ বেশ কজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং দ্বিতীয় পক্ষ হচ্ছে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার-এর পক্ষে দিল্লী ও কোলকাতাস্থ মার্কিন দূতাবাসের সিআইএ প্রধান ফিলিপস চেরি।
পশ্চিমা সাংবাদিক লরেস লিফসুজ তার রচিত ‘বাংলাদেশ : দি আনফিনিশড রেভলিউশন’ নামের চাঞ্চল্যকর গ্রন্থে বহু মার্কিনী দলিলের ভিত্তিতে এ কথাটাই প্রমাণের চেষ্টা করেছেন যে, মুক্তিযুদ্ধের সময় কোলকাতায় উভয় পক্ষের মধ্যে। বৈঠকগুলােতে আলােচনার বিষয়বস্তু শুধুমাত্র একটা এবং তা হচ্ছে বাংলাদেশের পর্ণ স্বাধীনতার পরিবর্তে ছ’দফার ভিত্তিতে কনফেডারেশন সৃষ্টির মাধ্যমে পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার লক্ষ্যে অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ করা।  এক্ষণে পাঠকদের বিশেষ করে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের সমীপে সাংবাদিক লরেনস লিজ-এর রচিত আলােচ্য গ্রন্থ থেকে প্রয়ােজনীয় অংশের উদ্ধৃতি দেয়া বাঞ্ছনীয় হবে। | ১৯৭৭ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বর নিউইয়র্ক থেকে নাইজেরিয়ার রাজধানী লাগােস-এ অবস্থানরত চেরির সঙ্গে টেলিফোনে লিফসুজ যে সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছিলেন প্রথমেই তার কথা। কিন্তু প্রাসঙ্গিক বিধায় এখানে ফিলিপস চেরির সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেয়া হলাে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভ্যানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন সমাপ্তির পর ভদ্রলােক নেদারল্যান্ড-এর রাজধানী দি হেগ-এ অবস্থিত আন্তর্জাতিক আইন বিদ্যায়তনে পড়াশােনা করেন।
১৯৫৯ সালে ফিলিপস চেরি মার্কিন গােয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-তে যােগদান করেন। চাকুরি জীবনের প্রথম বছরগুলােতে চেরির পােস্টিং হয় আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে। এসবের মধ্যে তিনি ১৯৬২ সালে সলসবেরিতে এবং ১৯৬৪ সালে ছিলেন নাইরােবিতে।  এদিকে নানা ঘটনা পরম্পরায় ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ দিবাগত রাতে তৎকালীন পূর্ব বাংলায় আকস্মিকভাবে পাকিস্তানি সৈন্যরা গণহত্যা শুরু করলে আপামর জনসাধারণ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এ সময় হানাদার বাহিনীর দখলকৃত এলাকা, ভারতে অবস্থিত শরণার্থী শিবির এবং মুজিবনগর সরকারের অভ্যন্তরে মার্কিন বিরােধী মনােভাব তীব্র আকার ধারণ করে। কেননা পাকিস্তানের মাধ্যমে চীনের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করার উদগ্র বাসনায় মার্কিন প্রশাসন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রকাশ্যেই অপর পক্ষ পাকিস্তানকে মদদ দিতে থাকে।  এরই মােকাবেলায় ভারতের নয়াদিল্লী এবং কোলকাতায় সিআইএ-র অফিস দুটি ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হয়। এ দুটি সম্প্রসারিত সিআইএ অফিসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদের দায়িত্ব গ্রহণের জন্য ১৯৭১ সালে অভিজ্ঞ সিআইএ এজেন্ট ফিলিপস চেরির আগমন হয় নয়াদিল্লীতে। অবশ্য পরিস্থিতির মােকাবেলায় অধিকাংশ সময়ই তিনি অবস্থান করেন কোলকাতায়। (একাত্তরে কোলকাতায় রুশ গােয়েন্দা সংস্থা কেজিবি’র প্রতিনিধি ছিলেন ঝানু এজেন্ট গুরগনভ)। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে ১৯৭৪ সালের আগস্ট মাসে এই ফিলিপস চেরিকেই সিআইএর ঢাকা স্টেশনের দায়িত্বে পাঠানাে | হয় এবং তিনি ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত এই দায়িত্বে বহাল ছিলেন।

সূত্রঃ মুজিবের রক্ত লাল – এম আর আখতার মুকুল