বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ১৩ই সেপ্টেম্বর, শুক্রবার, ২৮শে ভাদ্র, ১৩৮০
চিলির শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম ব্যর্থ হতে পারে না
আহ্বানটা ছিল সিনেটের। চিলির সিনেটের। যে সিনেট প্রেসিডেন্ট আলেন্দের সবকটি প্রগতিশীল কর্মসূচিকে বানচাল করার জন্য তাদের ‘গণতান্ত্রিক’ অধিকার প্রয়োগ করেছে। এই সেদিনও একটা ব্যর্থ অভ্যুত্থান ঘটে যাবার পর প্রেসিডেন্ট যখন দেশকে একটা বিপর্যয়ের মুখে থেকে রক্ষা করতে নব্বুই দিনের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণার অনুমোদন চেয়ে ছিলেন তখনও তা প্রত্যাখ্যান করে। আর একই সঙ্গে চলতে থাকে সারা দেশে প্রতিক্রিয়াশীল ফ্যাসিস্ট সংগঠনসমূহের ধ্বংসাত্মক এবং হিংসাশ্রয়ী কার্যকলাপ। ট্রাক মালিকরা গোটা পরিবহন ব্যবস্থা অচল করে দেয়; খাদ্যদ্রব্য স্তূপীকৃত হতে থাকে রাজধানীতে। কলকারখানায় উৎপন্ন দ্রব্য, ভোগ্য পণ্য মওজুত হতে থাকে কিন্তু তা পৌছিয়ে দেওয়া যাবে কেমন করে সাধারণ মানুষের কাছে। একের পর এক ব্যবস্থা গৃহীত হতে থাকলো পণ্য চলাচল স্বাভাবিক করে তোলার।
কিন্তু হায় হতোস্মি। কোনোটিতেই কাজ হলোনা। নিজেদের ট্রাক বিকল করে, ইঞ্জিন নষ্ট করে তবুও সরকারকে জনগণের কাছে অপ্রিয় করে তোলার অপচেষ্টা রইল অব্যাহত।
চিলির ‘গণতন্ত্রের’ ধারক ও বাহক সিনেট এই সেদিন আহ্বান জানিয়েছেন দেশের সরকারকে। আহ্বান জানিয়েছে তারা দেশে ‘গণতন্ত্র’ রক্ষার জন্য। গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত সরকারের কার্যক্রমের বিরোধিতা করে যারা সেই সরকারের দেশরক্ষা দপ্তরের কাছে আহ্বান জানিয়েছিল চিলিতে ‘গণতন্ত্র’ রক্ষার জন্য তাদের আহবানেই সাড়া দিতে হয়তো গত এগারোই সেপ্টেম্বর চিলির সামরিক বাহিনীর ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট আলেন্দেকে। ঘোষণা করা হয়েছে নবগঠিত এই সামরিক জান্তা তাদের নিজেদের আদর্শকেই তুলে ধরবে -শাসনতন্ত্রের আদর্শ নয়।
চিলির এমন একটা অবাঞ্চিত পরিণতি কিছুদিন হল অনেকেই আশঙ্কা করেছিলেন। বিদেশি হস্তক্ষেপ সেদেশে ক্রমান্বয়ে প্রকট হয়ে উঠছিল। প্রতিক্রিয়াশীল একে একে ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটা রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থান ঘটানোর লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছিল। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ যে চিলিতে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানোর ব্যাপারে সবচাইতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে এটা আর বিতর্কিত বিষয় নয়। চিলির প্রতিবেশী রাষ্ট্র আর্জেন্টিনার জননেতা পেরন সুস্পষ্টভাবেই সে অভিযোগ তুলেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টও স্বীকার করেছে যে, তারা এই অবদানের কথা পূর্ব থেকেই জানতো। প্রেসিডেন্ট আলেন্দেকে হত্যা করা হয়েছে। আর সেই ঘৃণ্য হত্যাযজ্ঞ সমাধানের পর সামরিক জান্তা আত্মহত্যার অপবাদ ছড়িয়ে ডাঃ আলেন্দের চরিত্রে দূর্বলতার কলঙ্ক লেপনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মেক্সিকোতে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত বলেছেন, প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে হাজার হাজার নর-নারীকে নৃশংসভাবে মারা হয়েছে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে করা হয়েছে গ্রেফতার। যারা বন্দি হয়নি তাদের বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করা হয়েছে। সারা দেশে গড়ে উঠেছে প্রতিরোধ আন্দোলন। চিলির শ্রমিক সমাজ পথে নেমেছে। খণ্ড-খণ্ড লড়াই। এ লড়াই একদিন ব্যাপকতর রূপ লাভ করবে।
শাসনতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সমাজতন্ত্রের উত্তরণের যে শান্তিপূর্ণ পদ্ধতি ডাঃ আলেন্দে চিলিতে গ্রহণ করেছিলেন গণতন্ত্রের মুখোশ পরে তাকে নস্যাৎ করা হলো। কায়েম করা হলো সামরিক একনায়কত্ব। সমাজতন্ত্রীদের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক নীতি অনুসরণের অপবাদ ছড়িয়ে যেসব গণতন্ত্রীরা স্বাধীন বিশ্বের মহিমা প্রচার গোটা দুনিয়া সে বেড়াচ্ছেন ঘটনার পর তারা কি বলেন আমরা তার অপেক্ষায় রইলাম। আমরা বিশ্বাস করি, বন্ধু বিহনে ঢুকিয়ে মানুষের চেতনাকে দাবিয়ে রাখা যায় না। চিলির শ্রমজীবী মানুষের জয় অবশ্যম্ভাবী। আজ হোক কাল হোক ডাঃ আলেন্দের স্বপ্ন ল্যাটিন আমেরিকার দীর্ঘাকৃতি দেশটিতে বাস্তবায়িত হবেই হবে। শান্তি ও সমাজতন্ত্রের সংগ্রাম প্রতিক্রিয়াশীলদের সামরিক বিজয়ের কাছে মাথা নত করবে না। এ সংগ্রাম চীনের জনগণের -এ সংগ্রাম গোটা বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের।
ভিয়েতনামের বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব জিল্লুর রহমান-এর নেতৃত্বে ছয় সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল সম্প্রতি হ্যানয়-এর উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেছেন। ভিয়েতনাম শান্তি পরিষদের আমন্ত্রণে এই প্রতিনিধিদলটি হ্যানয় যাত্রা করেছেন। ঢাকা ত্যাগ করার পূর্বে প্রতিনিধি দলের নেতা জনাব জিল্লুর রহমান বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের কাছে বলেছেন -‘আমাদের এই সফর দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক আরো নিবিড় করবে। আমরা ভিয়েতনামের সংগ্রামী জনগণের জন্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর শুভেচ্ছা ও ভালবাসা বহন করে নিয়ে চলেছি।’ প্রকৃত প্রস্তাবে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের এই ভিয়েতনাম সফর একটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার। বিশ্ব ইতিহাসের ঘটনা প্রবাহের মধ্যে ভিয়েতনামের সংগ্রামী নাম সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সংগ্রাম ও ত্যাগের মহান আদর্শ ভিয়েতনাম। ভিয়েতনামের মাটি আর মানুষ সংগ্রামের জ্বলন্ত প্রতীক। বহুকাল ধরে তারা সংগ্রামের প্রদীপ্ত শিখায় জ্বলছে। ভিয়েতনামের মানুষ আজ একটি আগুনের ফুলকি। বিশ্বের সকল নির্যাতিত ও নিপীড়িত মানুষের সংগ্রামী আদর্শ ভিয়েতনাম। ভিয়েতনামের সংগ্রাম ও মুক্তি আন্দোলন যে কত বেশি সুদূরপ্রসারি এবং কত বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা আমরা অনুধাবন করেছি আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের কালে। মার্কিন সমর্থন মার্কিন সাহায্যপুষ্ট দামাল সৈন্য বাহিনী কর্তৃক ভিয়েতনামের মানুষের উপর যে চরম নির্যাতন চালানো হয়েছিল তা ইতিহাসে বিরল। মার্কিন বিমানবাহিনী ভিয়েতনামের উপর যে লক্ষ লক্ষ টন বোমা বর্ষণ করেছে তার তুলনা ইতিহাসে নেই। মানবতার প্রতি এমন অপমান ও অপরাধ বিশ্বে কোনদিন সংঘটিত হয়নি। বাংলাদেশের উপর যেদিন পাকিস্তানি বর্বর সৈন্যবাহিনী চরম আঘাত হানে সেদিন ঘাতক পশুশক্তির বর্বরতা আমরা হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছি। ভিয়েতনামের মতো আমরাও আমাদের মুক্তি সংগ্রামের দিনে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছি সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক পশু সৈন্য বাহিনীর পৈশাচিকতা। লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। নারী-শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে নিধন করা হয়েছে। ভিয়েতনামের যুদ্ধেও তেমনি মানবেতর অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। ভিয়েতনামে মার্কিন বর্বরতা তুলনাহীন। বিশ্বের সকল মুক্তি সৈনিকের বৈপ্লবীক আদর্শ ভিয়েতনামের মানুষের ত্যাগ, ধৈর্য ও লক্ষ্য অর্জনের পণ। বাংলাদেশ থেকে যে প্রতিনিধি দলটি ভিয়েতনাম সফরে গেছেন তারা সেই মহান বিপ্লবী আদর্শ ও মুক্তিসংগ্রামের ঐতিহাসিক জাতিকে নিজেদের অভিজ্ঞতা মিলিয়ে দেখে আসতে সক্ষম হবেন। ভিয়েতনামের মানুষের সঙ্গে আমাদের প্রতিনিধি দল মিলিত হবেন। তাদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করবেন। ইতিপূর্বে ভিয়েতনামে আমাদের সরকারের প্রতিনিধিরা গিয়েছেন। আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের পক্ষ থেকেও ভিয়েতনামের মানুষের সঙ্গে সংহতি ঘোষণা করা হয়েছে। আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধুও বীর ভিয়েতনামীদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছেন। আমরা আমাদের প্রতিনিধি দলের সফল সফর কামনা করি। প্রতিনিধিদলের মাধ্যমে আমরা আবার আমাদের সংহতি ঘোষণা করি ভিয়েতনামের বীর জনগণের সঙ্গে। তাদের দেশ গড়ার পদ্ধতি ও প্রেরণা আমাদের দেশ গড়ার সংগ্রামে সহায়ক হবে বলে আমরা মনে করি। প্রতিনিধিদল সেই অভিজ্ঞতা নিয়েই ফিরবেন।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক