বাংলার বাণী
ঢাকা: ২৭শে সেপ্টেম্বর, শুক্রবার, ১০ই আশ্বিন, ১৩৮১
জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ
বাঙালি জাতি এমন একটি বিশ্ব গড়ে তুলতে অঙ্গীকারবদ্ধ যেখানে সকল মানুষের শান্তি ও ন্যায়বিচারের আকাঙ্ক্ষা মূর্ত হয়ে উঠবে। জাতিসংঘের ২৯ তম অধিবেশনে ভাষণ দানকালে উদান্ত কন্ঠে বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
শান্তি স্বাধীনতা ও প্রগতির অগ্রসেনানী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ঐতিহাসিক ভাষণের উল্লেখ করেন যে, বিশ্বব্যাপী অস্ত্র প্রতিযোগিতা, ক্ষুধা, দারিদ্র্য, বেকারত্ব, ও মানুষের দুঃখ-দুর্দশাকে গভীরতর করে তুলেছে।
তিনি আবেগময় কণ্ঠে বলেন, আজ বিশ্বের দেশ গুলি পরস্পর বৈপরীত্যের মধ্যে নিজেদের পছন্দের স্থির করার তাগিদ পাচ্ছে। আমাদের স্থির করতে হবে আমরা কি পারমাণবিক যুদ্ধের হুমকি চূড়ান্ত ধ্বংসের আশঙ্কা জড়িত বিশ্বের দিকে, ক্ষুদা, বেকারত্বের দরুন অকল্পনীয় মাত্রার মানবিক দুর্দশা কবলিত বিশ্বের দিকে সীমাহীন দারিদ্র্যের দিকে এগিয়ে যাব অথবা এই বিজ্ঞান ও কলাকৌশল যুগের মহান অবদান এবং মানুষের স্বজন শীলতা, পারমাণবিক আশঙ্কামুক্ত আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কলাকৌশল ও সম্পদের অংশীদারিত্ব নির্ভর এক উন্নততর ভবিষ্যৎ গড়ার দিকে যেখানে সৃষ্টি হবে সুকুমার জীবনের ন্যূনতম পরিবেশ। শান্তি, স্বাধীনতা, মৈত্রী ও সমঝোতার পরিবেশ গড়ে তুলতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন অর্থনৈতিক সংকট নিরসন। এ বক্তব্যকে বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, অধিকতর দরিদ্র দেশ সমূহের ভবিষ্যৎ আরো খারাপ। দরিদ্র দেশগুলোর জন্য খাদ্যশস্য সরবরাহকারী শিল্পোন্নত দেশগুলো এখন তাদের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। ফলে জিনিসপত্রের দ্রুত মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। মূল্য বৃদ্ধি ও বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতির দরুন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের প্রচেষ্টাও ব্যাহত হচ্ছে। এতে করে সেইসব দেশগুলোও নিজস্ব সম্পদ এর সমাবেশ ঘটানোর ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। পরিণামে দেখা যাচ্ছে চরম দারিদ্র ও বেকারত্ব দেশগুলি যদি এই পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য তৎপর না হয় তবে মানবিক দুঃখ-দুর্দশা এমন এক চরম পর্যায়ে পৌঁছাবে ইতিহাসে যা কখনো ঘটেনি।
বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে যে বক্তব্য রেখেছেন তা বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোর জন্য আলোকবর্তিকা স্বরূপ। বঙ্গবন্ধু ইতিপূর্বে আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোট-নিরপেক্ষ সম্মেলনে ভাষণদানকালে ও ঘোষণা করেছিলেন যে, বিশ্ব আজ দুই ভাগে বিভক্ত। একদিকে প্রাচুর্য অন্যদিকে দারিদ্র্য। দারিদ্র্যের নিষ্ঠুর কষাঘাতে বিশ্বের বৃহত্তম জনসংখ্যার নিপীড়িত।
অতীত ইতিহাস থেকে একথা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, উন্নত দেশগুলোর শুধু নিয়েছে দেয়নি কিছুই। উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে কাঁচামাল নিয়ে গেছে পানির দরে আর সেই কাঁচামালও সাহায্যে পণ্য তৈরি করে বিক্রি করেছে সোনার দরে এখনো সেই একই অবস্থা চলছে। এ নিয়ে জাতিসংঘের বিশেষ অধিবেশন বসেছে। আলোচনা হয়েছে। কিন্তু সমস্যার সমাধান এখনো হয়নি।
একদিকে এ অবস্থা অন্যদিকে আবার যুদ্ধ আর মারণাস্ত্রের হুমকি। খাদ্যের অভাবে, আশ্রয়ের অভাবে বিশ্বের বৃহত্তম জনসংখ্যার যেখানে মৃত্যুপথযাত্রী সেখানে কোটি কোটি টাকা খরচ করে নির্মিত হচ্ছে পারমাণবিক অস্ত্র। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর থেকে গোটা বিশ্বের যে চেহারা হয়েছে তাতে আজ আর কোন দেশকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার কোন উপায় নেই। মধ্যপ্রাচ্যের মাটিতে যুদ্ধের আগুন জ্বলে উঠলে তার তাপ এসে বাংলাদেশেও লাগে। বিশ্বের সকল দেশেই আজ তাই একের উপর অন্যের নির্ভরশীল। স্বাভাবিকভাবেই সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত বাংলাদেশও সেই বিশ্ব পরিবারের একজন সদস্য।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ অকৃপণভাবে সাহায্য সহযোগিতা করেছেন। স্বাধীনতার পরেও করেছেন। সাহায্য করেছেন জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা গুলো। এজন্য বাংলাদেশের মানুষ কৃতজ্ঞ। যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ পেয়েছে বঙ্গবন্ধুর ভাষণেও।
বাংলাদেশ একটা রক্তাক্ত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের পর পরই ঘোষণা করেছে শান্তিপূর্ণ সহ অবস্থান ও জোট নিরপেক্ষ নীতির কথা। সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব কারো সঙ্গে শত্রুতা নয় এই নীতি বাস্তবায়িত করতে গিয়ে এবং এ উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তি ও স্থিতিশীলতার প্রতি লক্ষ্য রেখে বাংলাদেশ পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনা বৈঠকে বসেছে। মুক্তি দিয়েছে ১৯৫ জন পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীকে। পরস্পরের মধ্যে সৃষ্টি করেছে সমঝোতার পরিবেশ। বাংলাদেশ সমগ্র বিশ্বের মানব জাতির কল্যাণ কামনা করে মনেপ্রাণে। জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করার পর বিশ্বের অন্যান্য দেশের প্রতি বাংলাদেশের দায়িত্ব ও কর্তব্য বেড়ে গেছে আরও অনেক। বাংলাদেশ এ দায়িত্ব ও কর্তব্য থেকে পিছপা হবে না এ ব্যাপারে আমরা সুনিশ্চিত। কিন্তু বাংলাদেশের যেমন দায়িত্ব রয়েছে তেমনি বাংলাদেশের প্রতি দায়িত্ব রয়েছে বিশ্বের অন্যান্য দেশের এবং বিশেষ করে জাতিসংঘের।
যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনৈতিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই মুদ্রাস্ফীতি, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ঊর্ধ্বগতি এবং সর্ব শেষে বন্যার কবলে পড়ে সমস্যা ও সংকটের মধ্যে নিমজ্জিত খাদ্য আমদানি করতে বাংলাদেশকে ব্যয় করতে হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার সিংহভাগ। এমনই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের জন্য আজ সর্বাগ্রে প্রয়োজন আন্তর্জাতিক সাহায্য ও সহযোগিতা।
পরিশেষে জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত ভাষণের ভাষাতেই আমরা বলবো যে, বিশ্বের অন্যান্য দেশ সহ “জাতিসংঘের সম্মুখে আজ এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। একটি ন্যায্য আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য তাঁকে সমগ্র যুক্তি-বুদ্ধি একসঙ্গে কাজে লাগাতে হবে। এমন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন জাতিসংঘ আর কখনো হয়নি।”
কর্তাদের মনকষাকষি, মান-সম্ভ্রম
কচুক্ষেতে জল বিদ্যুৎ দুটোই এসেছে। হাফ ছেড়েছেন সেখানকার মানুষ। এর আগে সাহেব সুবাদের মন-কষাকষির ফলে সেখানে জল বিদ্যুৎ দুটোই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তার আগেও এমন হয়েছে। আর হঠাৎ করে জল বিদ্যুৎ বন্ধ হয়ে যাবার ফলে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে আম জনসাধারনের।
অভিযোগে প্রকাশ, হাউসিং সেটেলমেন্ট এর এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার বিদ্যুৎ বিভাগীয় এক্সিকিউটিভকে কচুক্ষেত কলোনিতে বিদ্যুৎ সরবরাহের অনুরোধ জানাতে গিয়ে লিখেছিলেন, “ইউ স্যুড সী দা ম্যাটার”। এটা বিদ্যুৎ বিভাগীয় এক্সিকিউটিভ আহত করেছে। তিনি বলেছেন, চিঠির ভাষা সংশোধন করতে। ‘স্যুড’ এর বদলে ‘প্লিজ’ লিখলেই নাকি সবকিছু মিটমাট হয়ে যেত। অজ্ঞাত কারণে বিদ্যুৎ বিভাগের এক্সজিকিউটিভের মনোবাসনা পূর্ণ হয়নি। আর তাই কচুক্ষেতের অধিবাসীদের দুর্ভোগ। হঠাৎ করে বিদ্যুৎ বিভ্রাট, জল বন্ধ।
সংশ্লিষ্ট এক্সিকিউটিভদ্বয় অবশ্য পরবর্তীকালে এ অভিযোগ অস্বীকার করেন। হয়তো বা অভিযোগটি আদৌ সত্য নয়, কিন্তু সরকারি অফিসগুলোতে এমনই যে কত ঘটনা ঘটে চলেছে তার ইয়াত্তা নেই। একই অফিসে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ফাইল নড়তে বছর পেরিয়ে যাবার ব্যাপারটা তো আজকাল নিয়ম-রীতিই হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে কাজ ডান হাতে সেরে বা হাতে সহকর্মীর কাছে অতি সহজেই ঠেলে দেয়া যায় তার জন্য গাঁট হয়ে বসে থাকেন সব কর্তারা। কখন পিয়ন আর্দালি আসবে সে অপেক্ষায় ফাইলের ওপর ফাইল চাপা পড়ে।
আসলে এসবই একটা মানসিক রোগ যা সংক্রামক এর মত শুধু ছড়িয়ে পড়েছে। কেউ ওর ছোঁয়াচ এড়াতে পারে না। চাইলেও একবার-দুবার হাস্যস্পদ হবার পর সবাই সেই পুরনো কায়দায় গা এলিয়ে দেয়।
এছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন বিভাগের কাজের মধ্যে সুষ্ঠু সময়ের অভাব। দুটো বিভাগ হয়তো পারস্পরিক আলোচনা এবং সমঝোতার মাধ্যমে কোন কাজে অগ্রসর হলে অনেক কম খরচে এবং কম সময়ে তার সম্পাদন করা সম্ভব ছিল। কিন্তু সেই একই কাজ দুটি বিভাগ বিচ্ছিন্নভাবে শুরু করে শুধু অর্থ এবং সময়ের অপচয় করবে অথচ একবারও কেউ অন্য বিভাগের সাথে কথাটি পর্যন্ত কইবে না। এখানেও সেই অদ্ভুত মানসিকতা। ওয়াসা, ওয়াপদা, মিউনিসিপালিটি প্রভৃতি সংস্থার পালাক্রমে রাস্তা খননের ছবি তো হরহামেশাই ঢাকার আদিবাসীদের চোখে পড়ছে।
পুরান এই মানসিকতার অন্ততঃ নতুন এই দেশটিতে অবসান ঘটবে বলে আমরা আশা করেছিলাম। কিন্তু চারদিকে যে দো-দুলকি চাল তাতে আমাদের সে আশা সফল হওয়ার কোনো লক্ষণ তো আমরা দেখতে পাচ্ছি না। ‘অফিশিয়াল অর্ডার’ এ ব্যাপারে কোন কাজে আসবে না। সরকারি কর্মচারী বিশেষ করে উর্দ্ধতন কর্মকর্তারা যদি মানুষের প্রতি তাদের দরদ আর আন্তরিকতা নিয়ে এগিয়ে না আসে তবে এ অবস্থার এতোটুকু পরিবর্তন হওয়া সম্ভব নয়। আমরা উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের শুভবুদ্ধি এবং চেতনা জাগ্রত হবার ইচ্ছেই পোষণ করতে পারি।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক