তদানীন্তন বিডিআর প্রধান মেজর জেনারেল অব. খলিলুর রহমানের সাক্ষাৎকার
প্রশ্ন : আপনি কখন শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যু খবর পান?
উত্তর : ১৯৭৫ সালে আমি বি ডি আর এ ছিলাম মহাপরিচালক হিসেবে। ঐ। দিন (১৫ আগস্ট, ‘৭৫) খুব ভােরে গােলাগুলির আওয়াজ আসে। আমার বাসা পিলখানা বি, ডি, আর হেড কোয়ার্টারসে। তখন হােম মিনিস্টার ছিলেন মনসুর আলী সাহেব। তিনি আমার ঘুম ভেঙে যাবার কিছুক্ষণের মধ্যেই টেলিফোন করেন। টেলিফোনে তিনি আমাকে জানান যে, কিছু বিভ্রান্ত পােশাকধারী লােক রেডিও হাউস দখল করেছে বা করার চেষ্টা করছে। আপনি ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। তারপর আমি আমার লােকদের রেডিও, হাউস যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেবার কথা বলি। তবে সেদিকে যাবার আগে বিরাজমান অবস্থা জানা প্রয়ােজন তাই যাবার আগে আমার কাছে আবার জিজ্ঞাসা করতে বলে দিয়েছিলাম আমার লােকদের। তবে তখনও বুঝতে পারিনি যে, বঙ্গবন্ধু ইতিমধ্যেই নিহত হয়েছেন। তখনও সকাল হয় নাই। বেলা উঠল আমি শেভ-টেভ করে অফিসে গেলাম। আমি অবস্থা বােঝার জন্য খবর নিতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পরে টেলিফোন এল (তখন ব্রিগেডিয়ার) দস্তগীর সাহেবের বাসা থেকে তিনি তখন চিটাগাংয়ের ব্রিগেড কমান্ডার। তার স্ত্রী বললেন যে, দস্তগীর সাহেব শুনেছেন যে বঙ্গবন্ধু নিহত হয়েছেন। পােশাকধারী কিছু লােক তার বাসায় গিয়ে গােলাগুলি করেন। দস্তগীর সাহেব নাকি বেতারে গিয়ে ঘােষণা করতে চান তারা (তৎকালীন) সরকার ও সংবিধানের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছে। দস্তগীর সাহেব টেলিফোনে আমার মতামত জানতে চান। তাকে আমি বললাম ঢাকার খবর একটু ভাল করে নিয়ে আমি আমার মতামত জানাব। আমি তখন ৩২ নাম্বার রােড বঙ্গবন্ধু হত্যার খবর কনফার্ম করার জন্য আমার ফোর্সকে বলি। জানা গেল বঙ্গবন্ধু নিহত হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার খবর সাময়িকভাবে আমাদের অভিভূত করে ফেলল। আমি ব্যক্তিগতভাবে অতটা ভাবিনি। এরপর অতদূর যাবে চিন্তা করিনি। এরপর আবার দস্তগীর সাহেব টেলিফোন করেন। আমি বললাম, বঙ্গবন্ধু সত্যিই মারা গেছেন। পরবর্তী চিন্তা-ভাবনা করেই নেয়া দরকার। আমরা আরও একটু চিন্তা-ভাবনা করি।
প্রশ্ন : প্রতিরক্ষা বাহিনীর তিন জন প্রধান এরপর মােশতাক সরকারের কাছে আনুগত্য প্রকাশ করেন। আপনি মােশতাক সাহেবের ক্ষমতায় যাবার কথা কখন শোনেন? শপথ নেন কখন?
উত্তর : একটু পরে খবর পেলাম যে, তিন জন চিফ রেডিও স্টেশনে গেছেন। শুনলাম ডালিম অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে শফিউল্লাহ সাহেবের সেনাসদরের অফিসে ঢুকে রেডিও স্টেশনে নিয়ে আসতে চায়। তখন সেনাবাহিনী প্রধান শফিউল্লাহ, নৌবাহিনীর প্রধান এম, এইচ, খান এবং বিমান বাহিনীর প্রধান এ কে খন্দকার এক সাথে হন। অনেকটা নাকি মেজর ডালিমের ইচ্ছানুসারে তারা রেডিও হাউসে এসে মােশতাক সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। এই সময় একজন অফিসার বি, ডি, আর-এর সদর দফতরে আমার সংগে দেখা করতে চান। তাকে প্রধান গেটে আমার লােকেরা নিরস্ত (ডিসআর্মড) করে। খালি হাতেই তিনি আমার সঙ্গে দেখা করেন। সেই অফিসারই (নাম বলেননি) আমাকে প্রথমে বললেন যে মােশতাক সাহেব এখন রাষ্ট্রপতি। তিনি বললেন, খন্দকার মােশতাক সাহেব আমাকে অনুরােধ করেছেন আমিও যেন বেতার ভবনে গিয়ে নতুন সরকারের প্রতি আনুগত্য করি। আমি খুব অল্প সময়ের মধ্যে আমার উপদেষ্টার সাথে পরামর্শ করলাম।
প্রশ্ন : উপদেষ্টা বলতে কি সিনিয়র অফিসারদের বােঝাচ্ছেন?
উত্তর : জ্বী। সিনিয়র অফিসার ছাড়াও আমি টেলিফোনে সমস্ত সেক্টর কমান্ডারদের সাথে পরামর্শ করি। সবাই আমাকে বললেন, সশস্ত্র বাহিনীদের সাথে মননামালিন্য থাকা উচিত নয়। তিন প্রধান যখন নতুন সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছেন তখন আমাদেরও উচিত তাই করা।
প্রশ্ন : আপনাদের এই আলাপ-আলােচনার সময়ও কি আগন্তুক অফিসার ওখানে ছিলেন।
উত্তর : জ্বী না। তাকে আমি বলেছিলাম কিছুক্ষণ পরেই আমি আমার উত্তর জানাব।
প্রশ্ন : রেডিওতে কখন গেলেন?
উত্তর : দুপুরের দিকে সম্ভবত বারােটার কিছু আগেই হবে। রেডিওতে গিয়ে দেখি যিনি রক্ষীবাহিনীর ভারপ্রাপ্ত প্রধান ছিলেন তিনিও উপস্থিত। পুলিশের আইজিও ছিলেন। আমরা একে একে নতুন সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করি। তারপর আমরা সবাই মিলে সেনাসদরে গিয়ে বসি। সেখানে গিয়ে আলােচনা করি আমাদের পরবর্তী কার্যক্রম কি হওয়া উচিত সেই প্রসঙ্গে। সেখানে শফিউল্লাহ, জিয়াউর রহমান, এম, এইচ, খান, এ, কে, খন্দকার এবং আমি উপস্থিত ছিলাম। খালেদ মােশাররফ সাহেবও ছিলেন। জিয়াউর রহমান সাহেব সেখানে মতামত। প্রকাশ করেন, এখনই শাসন ব্যবস্থা পুরােপুরি সামরিক বাহিনীর অধীনে নিয়ে নেয়া উচিত। কিন্তু বাকী সবাই তাৎক্ষণিকভাবে মত প্রকাশ করল সেটা ঠিক হবে না। তাহলে সাংবিধানিক শাসন ব্যবস্থা ভবিষ্যতেও বর্তমান সংকটের মত সংকটের মুখােমুখি হবে। কাজেকাজেই যা হবার তা হয়েছে, বঙ্গবন্ধু নিহত হয়েছে, কিন্তু এখনও বেসামরিক রাজনীতিবিদরাই দেশ চালান উচিৎ বলে আমরা মত প্রকাশ করি। তারপরে গণতন্ত্র ও সংবিধানের বিধান অনুযায়ী নতুন নির্বাচন করা হবে। সরকার তখন সংবিধান সম্মত হবে। মনে হল জিয়াউর রহমানের সাথে আমাদের ঠিক মতের মিল নেই। তবে তিনিও শেষ পর্যন্ত আমাদের যুক্তির কাছে নতুন যুক্তি দাঁড় করালেন না। আমাদের আলােচনা শেষ করে আমরা সবাই মিলে এক সঙ্গে বঙ্গভবনে যাই খন্দকার মােশতাক সাহেবকে জানাতে যে, আপনি বেসামরিক নেতৃবর্গ রাজনীতিবিদদের নিয়ে মন্ত্রীসভা তৈরি করুন। সেখানে গিয়ে আমি দেখলাম খন্দকার মােশতাক সাহেবও একই রকম চিন্তাভাবনা করছেন। তারপরতাে মন্ত্রীসভা গঠন করা হলাে
প্রশ্ন : বঙ্গভবনে গিয়ে কি দেখলেন? খন্দকার মােশতাক সাহেব কেন ক্ষমতায় আসেন এ কথা আপনাদের ব্যাখ্যা করেন?
উত্তর : গিয়ে দেখলাম কিছু বিভ্রান্ত পােশাকধারী অফিসাররা তাদের নেতা ছিলেন ফারুক। তার সাথে অন্যান্য অফিসারদের মধ্যে ছিল ডালিম শাহরিয়ার ইত্যাদি। তারা কিভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করেন কেনই বা ক্ষমতা গ্রহণ করেন এ খবর নেবার মত মানসিক অবস্থা ছিল না। আমাদের কাছে তখন জাতির স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব স্থিতিশীলতার প্রশ্নই বড় ছিল। সে দিন ঘটনা কে ঘটিয়েছে এ প্রশ্নের চেয়ে জাতির কাছে রক্তপাত হানাহানি বন্দের প্রশ্নটাই বড় ছিল। সেদিন আমরা বেতার ভবনে গিয়ে খন্দকার সাহেবকে শুধু একটাই অনুরােধ করি কোনমতেই যেন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা না হয়, অথবা কোনভাবেই যেন আইন-শৃঙ্খলার অবনতি না হয়—এর জন্য সরকার যেন সব সময় সজাগ দৃষ্টি রাখেন এবং এ ধরনের ঘটনা হলে তড়িৎ তা বন্ধের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
প্রশ্ন : মােশতাক সাহেব কি বলেননি তিনি ক্ষমতায় এলেন কেন? বা যারা হত্যাকাণ্ড ঘটালেন তারাও কি বললেন না কেন তারা এমন কাজে গেলেন?
উত্তর : না, মােশতাক সাহেব কিছু বলেননি। তবে যারা ঘটনা ঘটান তাদের নেতা খুব অহংকার করে বললেন, তারা জাতিকে এক মহাসংকট থেকে বাঁচিয়েছেন।
সূত্রঃ ফ্যাক্টস্ এন্ড ডকুমেন্টস্ বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড অধ্যাপক আবু সাইয়িদ