১৪ আগস্ট ১৯৭৫। বৃহস্পতিবার। দিনের আলাে নিভে এল। রাত এল। কাল রাত।
২. মার্চ ১৯৭৫। বঙ্গবন্ধুকে বলা হলাে : সেনাবাহিনীকে বসিয়ে রাখা সঠিক নয়। সে জন্য নির্দেশ গেল : ট্রেনিং কোর্স চালু কর। বিশেষতঃ ট্রেনিং প্রয়ােজন পুনর্গঠিত ট্যাংক বাহিনীর ও গােলন্দাজ বাহিনীর; অর্থাৎ সেকেন্ড ফিল্ড আর্টিলারি এবং বেঙ্গল ল্যালারের। কিন্তু তাদের নিকট ট্রেনিং বড় কথা ছিল না। তাদের মনে ছিল বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্র।
২.১ সে জন্য তারা ১৯৭৫ সনের মার্চ মাস থেকেই একত্রে ট্রেনিং শুরু করে। সেই সাথে তারা এ নির্দেশ ও অনুমতি লাভেও সক্ষম হয় যে অন্যান্য ট্রেনিং ব্যতিরেকও প্রতিমাসে তারা দুইবার নাইট ট্রেনিং করতে পারবে।
৩. ১৯৭৫ সনের ১৪ই আগস্ট। ট্রেনিং-এ ট্যাংক রেজিমেন্ট ও বেঙ্গল ল্যান্সার-এর সাথে সেকেন্ড ফিল্ড আর্টিলারির সম্বন্বয় সাধন করা হয়।
৩.১ এ সব বাহিনীর সর্ব সাকুল্যে সেনাশক্তি ৪০০ জন মাত্র ছিল।
৩.২ টি-৫৫ ট্যাংক ৩০টি, কামান ১৮টি, এর মধ্যে দুটি ট্যাংক নষ্ট, অকেজো ছিল। কামানের ক্যাটাগরি ছিল ১০৫ এম, এম যুগােশ্লাভিয়া তৈরি হাউটজার ।
৪. ষড়যন্ত্র চলছিল অন্যভাবেও। সেকেন্ডে ফিল্ড আর্টিলারি ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার তখন লে. কর্নেল আনােয়ার হােসেন। আর ফাস্ট বেঙ্গল ল্যান্সার বাহিনীর; অর্থাৎ ট্যাংক বাহিনীর কমান্ডিং অফিসারের দায়িত্বে ছিলেন লে. কর্নেল আবদুল মােমেন।
৪.১ কিন্তু ১৪ আগস্ট রাতে নাইট ট্রেনিং-এ যাবার সময় দেখা গেল লে. কর্নেল আনােয়ার হােসেন পূর্বেই প্রেসিডেন্টের স্পেশাল মিলিটারি সেলের ডেপুটেশনে সেখানে কর্মরত আছেন। আরাে দেখা গেল, বেঙ্গল ল্যান্সার বা ট্রাংক বাহিনীর কম্যন্ডিং অফিসার লে. কর্নেল আবদুল মােমেন ছুটিতে বাইরে আছেন।
৪.২ সুতরাং সেকেন্ড ফিল্ড আর্টিলারি কমান্ডিং অফিসারের দায়িত্ব অর্পিত ছিল মেজর রশিদের উপর এবং বেঙ্গল ল্যান্সার বা ট্যাংক বাহিনীর কমান্ডারের দায়িত্ব ন্যস্ত হলাে মেজর ফারুক রহমানের উপর।
৪.৩ সেনাবাহিনীর কোনাে ঊর্ধ্বতন অফিসারের ষড়যন্ত্রে এরূপ সুবর্ণদায়িত্ব। মেজর রশিদ-ফারুকের হাতে গিয়ে পড়েছিল আজো তা প্রকাশিত না হলেও ভবিষ্যৎ নিশ্চয় তা বলে দেবে।
৫. সুতরাং ট্যাংক বাহিনী ও আর্টিলারি রেজিমেন্টের দায়িত্ব পেয়ে দুই ভায়রা পরিকল্পনা মাফিক বর্তমানে জিয়া অন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে সৈন্য সামন্ত, কামানসহ গমন করে।৬
৫.১ জিয়া আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে যাওয়ার পূর্বে তারা সেনাবাহিনী হতে বহিষ্কৃত কতিপয় অফিসারকে শেখ মুজিবের ও তার সরকারের উপর যাদের ব্যক্তিগত আক্রোশ ছিল তাদের ঐ বিমান বন্দরে আসার জন্য সংবাদ প্রেরণ করে।
৫.২ বঙ্গবন্ধু হত্যার মাত্র একঘণ্টা পূর্বে প্রাক্তন অফিসারবৃন্দ তাদের সাথে যােগ দেয়।
৬. ১৫ই আগস্ট ভাের ৪-৪০ মিঃ থেকে পাঁচটার মধ্যে উপস্থিত সেনাশক্তিকে তিনভাগে বিভক্ত করা হলাে। পরিকল্পনামাফিক কাজ শুরু হয়। ১২টি ট্রাকে কালাে যমদূতের দল। ট্যাংক গর্জন করে উঠল। চাঁদ ডুবে গেছে তখন। বিশাখা চলে গেছে। অনুরাধা এসেছে লক্ষ কোটি তারার মিটমিটি রহস্য নিয়ে। স্তিমিত আলাে আঁধারের ছায়াছায়া মূর্তিগুলাে বিভীষিকার মতাে জ্বলছে। জুপিটার আর মার্চ বাঁকা চোখে তাকিয়ে আছে।
৭. ষড়যন্ত্রকারীদের প্রধান ও প্রথম প্রতিবন্ধকতা রক্ষীবাহিনী। ঢাকায় তখন তিন হাজার রক্ষীবাহিনী মােতায়েন।
৮. ফারুক দায়িত্ব নিল রক্ষীবাহিনীকে নিউট্রালাইজ করার।
৯. ডালিমের মেজর মহিউদ্দিনের দায়িত্ব ছিল এক কোম্পানি ল্যাকসার নিয়ে মেজর নূর ও বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যাওয়া। সেরনিয়াবাতকে হত্যার ।
১০. আর শাহরিয়ার অন্যদের রেডিও দখলের দায়িত্ব।
১১. নায়েক সুবেদার মােসলেমের দায়িত্ব ছিল শেখ মনিকে হত্যার ।
১২. ফারুক জানত ঢাকায় তখন তিন হাজার রক্ষীবাহিনী, কিন্তু তাদের হাতে ভারী অস্ত্র নেই। সবই হালকা অস্ত্র। ট্যাংক বিধ্বংসী নেই।
১৩. ট্যাংকে কোন প্রকার গােলাবারুদ ছিল না। সে জন্য রশিদের বাহিনীর নিকট হতে পর্যাপ্ত অন্যান্য অস্ত্র, কামান সরবরাহ নেয়া হয়।১০
১৪. রশিদকে বলা হয়েছিল, শেখ মুজিবের বাসার দিকে গােলা নিক্ষেপ করতে যাতে রক্ষী বাহিনীর মধ্যে আতংক ছড়িয়ে পড়ে। এবং তারা শেখ মুজিবের সাহায্যে অগ্রসর হতে না পারে।
১৫. ফারুক রহমান ২৮টি ট্যাংক নিয়ে সম্ভাব্য প্রতিরােধ দমনের উদ্দেশ্যে ক্যান্টনমেন্ট গ্যারাজ হতে বের হয়, কিন্তু তেজগাঁও বিমান বন্দরের নিকট এসে সে দেখল তাকে শুধু একটি মাত্র ট্যাংকই অনুসরণ করতে সমর্থ হয়েছে।
১৬. ফারুক এক সাক্ষাৎকারে বলেছে, “তাতেও আমি ভড়কে যায়নি। আমার ট্যাংক নিয়ে বিমান বন্দরের সীমান্ত প্রাচীর ভেঙ্গে কয়েকটি গাছকে দুমড়িয়ে আমি যখন রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পের নিকটে চলে এলাম তখন দেখলাম তিন হাজার রক্ষীবাহিনীর একটি ব্রিগেড লাইন আপ হয়ে আছে। তারা যুদ্ধাস্ত্রে সজ্জিত, হেলমেট পরিহিত। এ সব দেখে আমার ট্যাংকের ড্রাইভার আমাকে জিজ্ঞেস করল, তার করণীয় কি? আমি তাকে বললাম যে, ৬ ইঞ্চি ব্যারেল তাদের নাক বরাবর উঁচু করে ধর। গানারকে বললাম : তােমার গান’কে তাদের দিকে তাক কর। দেখলাম। তারা বেশ সাহসী দৃষ্টি নিয়ে তাকাচ্ছে। আমরাও তাই করলাম। আমি ড্রাইভারকে বললাম, যদি তারা আমাদের কিছু করতে চায় তাহলে তুমি ডান দিকে স্টিয়ারিং কেটে সরাসরি চালিয়ে দেবে। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ কিছুই ঘটল না রক্ষীবাহিনী পরিস্থিতি বিবেচনা করছে। মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে আমার স্থির প্রতীতি ছিল যে, তার আর সহসা কোনাে প্রকার রিয়াক্ট করবে না।”১২
১৭. সি. আই. এ. ও আর্ম কু প্লানারদের একটি মাত্র মাথাব্যথা ছিল আর তা হলাে রক্ষীবাহিনী। রক্ষীবাহিনীকে জনগণের সামনে হেয় প্রতিপন্ন করা। এবং সেনাবাহিনীকে রক্ষীবাহিনীর বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তােলার কৌশল গ্রহণ করা ছাড়াও তারা রক্ষীবাহিনীকে নিস্ক্রিয় রাখার জন্য বাস্তব ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে। রক্ষীবাহিনী প্রধান ব্রিগেডিয়ার নূরুজ্জামানকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডিফেন্স সম্পর্কিত একটি কোর্সে প্রশিক্ষণের জন্য আমন্ত্রণ জানানাে হয়। ব্রিগিডিয়ার নূরুজ্জামান সে আমন্ত্রণ গ্রহণ করে। রটনা করা হলাে, রক্ষীবাহিনীর জন্য ট্যাংক যােগাড় করতে ব্রিগেডিয়ার নূরুজ্জামান বিদেশে যাচ্ছে। ব্রিগেডিয়ার নূরুজ্জামান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে ১২ই আগস্ট রওনা হন। পথে লন্ডনে জানলেন বঙ্গবন্ধু নিহত। তার আর কিছু করণীয় ছিল না।
১৭.১ সি, আই, এ রক্ষীবাহিনীকে নিষ্ক্রিয় করার জন্য মােক্ষম সময়ে রক্ষীবাহিনীর প্রধানকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল এটা আজ অত্যন্ত পরিষ্কার। ব্রিগেডিয়ার নূরুজ্জামান যে কুদেতা সংগঠকদের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। তার বড় প্রমাণ ২রা নভেম্বর খালেদ মােশারফের নেতৃত্বে যখন খুনী মেজরদের হটানাে হচ্ছিল তখন তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করেছিলেন।
১৭.২ রক্ষীবাহিনীর চার্জে তখন লেঃ কর্নেল আবুল হাসান। পাকিস্তান প্রত্যাগত অফিসার। ভীত। আতঙ্কগ্রস্ত। পলাতক। ১৭.৩ রক্ষীবাহিনীকে অর্ডার দেয়ার কর্তৃত্ব পাওয়া গেল না।
১৭.৪ দীপক তালুকদার সিনিয়র লিডার রক্ষীবাহিনীর। সেদিন তিনি ডিউটি অফিসার। অতি প্রত্যুষে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার ব্যবস্থাদি দেখতে গেলেন। সহসা বিকট কামানের আওয়াজ। মিৎসুবিসি মাঝারি ট্রাকে তার সাথে এক সেকশন রক্ষী। আওয়াজ লক্ষ্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলেন। না, বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে যাওয়া যাচ্ছে না। গােলাগুলি চলছে। গাড়ি ঘুরিয়ে তারা সদর দপ্তরের দিকে রওনা হয়।
১৮. তােফায়েল আহমদ তখন জেগে গেছেন। ফজলুল হক মনিকে এর মধ্যে হত্যা করা হয়েছে। তােফায়েল আহমদ ফজলুল হক মনির বাড়িতে টেলিফোন করলেন, শেখ সেলিম টেলিফোন ধরলেন। বললেন কালাে পােশাক পরে এক দল সশস্ত্র লােক মনি ভাই ও ভাবিকে গুলি করেছে। ওরা এখনাে বাড়ি ছেড়ে যায়নি। তােফায়েল আহমদ ফোন করলেন বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে। বঙ্গবন্ধু বললেন, “আমার বাড়িও আক্রান্ত, যা পারিস কর।” তােফায়েল ফোন করলেন আবদুর রাজ্জাককে। ফোন করলেন, “তিনি রক্ষীবাহিনীর সদর দফতরে।” রক্ষীবাহিনীর ডেপুটি ডাইরেক্টর একজনকে তিনি ফোন করে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ও ফজলুল হক মনির বাড়িতে দ্রুত যাবার জন্য অনুরােধ করেন। ফোন করেন সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল শফিউল্লাহকে। ফোনে তিনি জানালেন “আই এ্যাম সারাউন্ডেড বাই ট্যাংকস্।” আবার রক্ষীবাহিনীকে তিনি অনুরােধ করেন দ্রুত বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যাবার জন্য। রক্ষীবাহিনী বলল, তাদের ট্যাক দ্বারা ঘিরে ফেলা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে তিনি পুনরায় ফোন করেন। তখন কেউ সে সময় ফোন ধরেনি। রেডিওতে তখন বঙ্গবন্ধু হত্যার খবর ডালিম ঘােষণা করেছে। পুনরায় ফোন করাতে রক্ষীবাহিনীর একটি গাড়ি এসে তাকে রক্ষীবাহিনীর সদর দপ্তরে নিয়ে যায়।১৩
১৮.১ রক্ষীবাহিনী তাদের গাড়িতে করে প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবের হত্যার প্রাক্কালে স্পেশাল এসিস্ট্যান্ট তােফায়েল আহমদকে কেন সদর দপ্তরে নিয়ে গিয়েছিলেন তােফায়েল আহমদ সেখানে রক্ষীবাহিনীর বা সামরিক কোনাে নেতার সঙ্গে কথা বলেছিলেন? কি বলেছিলেন? আজ পর্যন্ত তা পরিষ্কার করে তােফায়েল আহমদ কোথাও বলেছেন বলে আমার জানা নেই। রক্ষীবাহিনী কেন নিষ্ক্রিয় থাকল? বঙ্গবন্ধুকে বাঁচানাের জন্য কেন তারা ত্বরিৎ ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হলাে? কারা দায়ী তাও পরিষ্কার হওয়া দরকার। অথচ ফারুকের জবানীতে জানা যায়, রক্ষীবাহিনী যুদ্ধসজ্জায় সজ্জিত ছিল।
১৮.২ রক্ষীবাহিনীর ব্যর্থতার বিষয়টি নিয়ে নানাভাবে কথা চলে আসছে। হু কিন্তু মুজিব’ বইতে এ এল খতিব রক্ষীবাহিনীর ব্যর্থতার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে বলেছেন, তােফায়েল আহমদ রক্ষীবাহিনীকে ফাইট করার নির্দেশ দিতে পারেননি কেননা তিনি বড় বেশি ভেঙ্গে পড়েছিলেন।১৪
থ. তােফায়েল আহমদ অন্যত্র বলেছেন? রক্ষীবাহিনীকে পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন, কিন্তু রক্ষীবাহিনী সে নির্দেশ পালন করেননি।১৫
গ. ঐ সময়ে উপস্থিত রক্ষীবাহিনীর জনৈক সদস্য বলেছেন, তোফায়েল আহমদ পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ প্রদান না করায় আমরা কিছুই করতে পারলাম না।১৬
ঘ. ছাত্রলীগের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক আবদুর রশিদ বঙ্গবন্ধু হত্যার সংবাদ শুনে তােফায়েল আহমদকে টেলিফোন করেছিলেন। তােফায়েল নাকি তাকে বলেছেন, ওবায়দুর ভাই বলেছেন, যা হবার হয়েছে আর কি করার আছে!১৭
১৯. ফারুক রক্ষীবাহিনীর দ্বিধাগ্রস্ততা বুঝতে পেরে ট্যাংক নিয়ে ধানমণ্ডির দিকে অগ্রসর হয়। বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনে ফারুকের লােকেরা তাকে থামায় এবং বলে যে সব ঠিকঠাক মতাে সম্পন্ন হয়েছে।১৮। ধানমণ্ডির স্বচ্ছ লেকের জলে তখন শেষ রজনীর জ্বলজ্বল নক্ষত্রগুলাে শিহরিত বত্রিশ নম্বর রােডের সবুজ আকাশ প্রদীপ জ্বলা বাড়িটির মাথা বাড়িয়ে বেস পাতার কচি কচি ডগাগুলাে তখন দুলছে। পাশের নিত বাতিগুলাে শেষ রাতের অন্ধকারকে দুই হাতে সরানাের প্রয়াসে ব্যস্ত।
২০. বত্রিশ নম্বর সড়ক ধরে রশীদের গােলন্দাজ বাহিনীর লােক এগিয়ে আসে দ্রুততার সঙ্গে। মেজর মহিউদ্দিন ও মেজর (অবঃ) নূর-এর নেতৃত্বে। একই সঙ্গে এক কোম্পানি ল্যান্সার বাহিনী অগ্রসর হয়।
২০.১ প্রথমেই বাধা পায় তারা প্রেসিডেন্টের গার্ডদের তরফ থেকে। কিন্তু মেজর মহিউদ্দিন গাড়ি হতে নেমে আসে। তাদের পথ ছেড়ে দেবার আদেশ দিলে ল্যান্সার বাহিনীর লােকেরা তাদের স্যালুট করে পথ ছেড়ে দেয়। গার্ডদের ভেতরে কিছু ছিল বেঙ্গল রেজিমেন্টের, তারা সংখ্যায় অল্প ছিল। তারা নির্বাক দর্শকের ভূমিকা গ্রহণ করে।
২০.২ পরিকল্পিতভাবে পূর্বেই ফারুক এদের প্রেসিডেন্টের পাহারায় নিযুক্ত করেছিল।১৯ ব্রিগেডিয়ার মশারুল হক এদের ডিউটিতে নিযুক্ত করে। বলাবাহুল্য মশারুল হক মােনায়েম খানের মিলিটারি সেক্রেটারি ছিলেন।২০
২০.৩ যাহােক প্রেসিডেন্টের সামরিক গার্ডবাহিনী বাধা প্রদান করেনি। বাধা প্রদান করেন একজন পুলিশ ডি, এস, পি। ঘটনা স্থলেই তাকে হত্যা করা হয়।
২১. এরপর সৈন্যরা বাড়িটি ঘিরে ফেলে এবং চারিদিক থেকে গুলিবর্ষণ করতে থাকে।
২২. পুলিশ ডি, এস, পি নিহত হলে মেজর মহিউদ্দিন, মেজর নূর, হুদা সদলে ঘরে ঢুকে পড়ে। এ প্রসঙ্গে ফারুক বলেছেন, শেখকে নিচে এসে আত্মসমর্পণের জন্য বলা হলাে। কিন্তু শেখ বাইরে না এসে ঘরের মধ্যে গিয়ে অবিলম্বে ফোন করলেন আর্মি চীফ জেনারেল শফিউল্লাহকে, প্রেসিডেন্টের মিলিটারি সেক্রেটারি কর্নেল জামিলকে, রক্ষাবাহিনীর হেড কোয়ার্টার্সে। তারা তাকে দ্রুত উদ্ধারের আশ্বাস দিয়েছিল। সেজন্য তিনি উৎসাহিত হয়ে পুত্রদের প্রতিরােধ করার জন্য অস্ত্র তুলে নেয়ার নির্দেশ দেন। এতে ঘটনাস্থলে আমাদের একজন লােক নিহত ও চারজন গুরুতর আহত হন। ফলে আমরা গুলি বর্ষণ করি এবং ঘরের মধ্যে গ্রেনেড নিক্ষেপ করি, সকলেই নিহত হন।২১ ফারুকের এই বিবৃতি সম্পূর্ণ নয়। সেদিন ঘটনার পর পর অনেকেই সে বাড়িতে ঢুকেছিলেন। তারা যা বলেছেন তা হলােপাহারারত পুলিশের লােকটি অভ্যর্থনা কক্ষে নিহত হয়েছেন। শেখ কামালের লাশ পড়েছিল দরজার পাশে বারান্দায়। দোতলায় ওঠার সিঁড়ি বাঁক নিয়ে যেখানে সমান জায়গা সেখানে বঙ্গবন্ধুর লাশ পড়েছিল। বঙ্গবন্ধুর ঘরের সামনে বেগম মুজিব হাঁটু ভেঙ্গে যেন পড়ে আছেন। আর বঙ্গবন্ধুর বড় খাটের পাশে জামালের মৃত দেহ পড়েছিল।২২
২৩. ফারুক বলেছে, বঙ্গবন্ধু ডি. এফ. আই. চিফ কর্ণেল জামিলকে টেলিফোন, করেছিলেন কথাটি সত্যি। ফোন পেয়েই কর্ণেল জামিল কয়েক জায়গায় ফোন করলেন।২৩
২৩.১ কর্নেল জামিল তখন গণভবনের সরকারি কোয়ার্টারে থাকতেন। বঙ্গবন্ধুর ফোন পেয়েই তিনি ড্রাইভার আইনুদ্দিনকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। কিন্তু সােবহানবাগ মসজিদের নিকট তাকে বাধা দেয়া হয় এবং তাকে গুলিতে ঝাঁঝরা করে ফেলা হয়। বঙ্গবন্ধুর প্রাক্তন সামরিক সচিব ও ডি. এফ. আই চিফ কর্তব্য নিষ্ঠার এক উজ্জ্বল উদাহরণ স্থাপন করে জীবন বিসর্জন দিলেন।২৪ পূর্বে ডি এফ আই চিফ ছিলেন ব্রিগেডিয়ার রউফ। কিছুদিন পূর্বে তিনি আমেরিকা থেকে ঘুরে এসেছেন। বঙ্গবন্ধু তাকে অন্যত্র বদলী করেন। তার জায়গায় কর্নেল জামিলকে নিয়ােগ করেন। ব্রিগেডিয়ার রউফ ডি. এফ, আই-এর চার্জ তখন হাতে আটকে রেখেছে, দেই দেই করেও চার্জ দিচ্ছিলেন না।২৫ শেষ পর্যন্ত ১৫ তারিখে চার্জ হ্যান্ড ওভার করার কথা ছিল এবং ঐ দিন কর্নেল জামিলের ব্রিগেডিয়ার পদে প্রমােশনের কথা ছিল।২৬ বঙ্গবন্ধু হত্যার ঐ দিন সকালে যে সকল অফিসার প্রত্যক্ষভাবে হত্যাকাণ্ডে অংশ গ্রহণ করেছেন তারা হলেন- মেজর (অবঃ) ডালিম, মেজর আজিজ পাশা, মেজর শাহরিয়ার, মেজর বজলুল হুদা, মেজর রশীদ চৌধুরী, মেজর মহিউদ্দিন, মেজর নূর, মেজর শরীফুল হােসাইন, ক্যাপ্টেন কিসমত হােসেন, লে, খায়রুজ্জামান ও লে. আবদুল মজিদ।
২৫.১ এরাই মূলত চারটি ভাগে বিভক্ত হয়ে ব্লু প্রিন্ট মােতাবেক আবদুর রব সেরনিয়াবাত, শেখ ফজলুল হক মনি এবং বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আক্রমণ। করে। লে. কর্নেল ফারুক ট্যাংকসহ দায়িত্ব গ্রহণ করে রক্ষীবাহিনীকে নিউট্রলাইজ করার। মেজর রশিদ তেজগাঁও বিমান বন্দরের পাহারা দেয়। মেজর (অব.) ডালিম ও ক্যাপ্টেন কিসমত যায় রেডিও দখল করতে। মেজর শাহরিয়ার ও লে, আবদুল মজিদ যায় মন্ত্রী আবদুর রব। সেরনিয়াবাতের বাসায়। সুবেদার মুসলেম উদ্দিন তিন ট্রাক সৈন্য নিয়ে শেখ ফজলুল হক মনির বাসায় গমন করে। লে. কর্নেল রশীদ, মেজর হুদা, মেজর আজিজ পাশা, মেজর মহিউদ্দিন, মেজর নূর, লে. খায়রুজ্জামান সবাই বাকি সৈন্যদের নিয়ে ধানমণ্ডির ৩২ নং সড়কের উদ্দেশ্যে রওনা হয়।
২৬. ধানমণ্ডি ৩২ নং রাস্তার প্রবেশ পথে মিরপুর রাস্তায় কালভার্ট। সেখানে কিছু সৈন্য রেখে তারা বঙ্গবন্ধুর পুরা বাড়িটি ঘিরে ফেলে এবং চারদিক থেকে গুলি বর্ষণ করে। গুলির শব্দে কামাল ছুটে নেমে আসে। কাউকে টেলিফোন করতে চেষ্টা করে। সেই অবস্থায় খুনীদের হাতে সে মারা যায়।
২৬.১ দরজা খােলাই ছিল। মেজর মহিউদ্দিন, মেজর হুদা, নূর কতিপয় সৈনিক নিয়ে উপরে উঠতে থাকে। সিঁড়ির বাক নিতেই দেখল বঙ্গবন্ধু দাঁড়িয়ে। তাদের দেখে বঙ্গবন্ধু কি বলেছিলেন তা আজও অজ্ঞাত। তবে ফারুকের সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, বঙ্গবন্ধুকে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু আত্মসমর্পণ না করে পুনরায় ঘরের ভিতরে প্রবেশ করেন এবং কয়েক জায়গায় টেলিফোন করেন।২৭ পাঞ্জাবীটি পরে নেন। নেন তার প্রিয় পাইপটি।
২৬.২ কাগজপত্র বিবৃতি ও সাক্ষাৎকার থেকে যদুর বােঝা যায় বঙ্গবন্ধু নিজেই নিচে নেমে আসছিলেন, কিন্তু কামালকে মেরে ফেলেছে এ সংবাদ পেয়ে ঘুরে পুনরায় উপরে উঠতে থাকেন।
২৬.৩ যতদূর জানা যায়, সুবেদার মােসলেম উদ্দিন শেখ মনিকে খুন করে এসে এই অবস্থা দেখে সাথে সাথেই বঙ্গবন্ধুকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। বঙ্গবন্ধু থমকে দাঁড়ান। তারপর পড়ে যান সিঁড়ির উপর ।২৮ সময় সকাল ৫-৪০ মিনিট।২৯ পড়ে যাওয়া পুরা দেহটার উপর চলে ব্রাস ফায়ার। তারপর মেইন সুইচ অফ করে দিয়ে চলতে থাকে নৃশংস হত্যাকাণ্ড। দুই কন্যা ব্যতীত সপরিবারে সবাই নিহত হন [পরিশিষ্ট দ্রষ্টব্য]
২৭. মােসলেম উদ্দিন মৃত্যুর পূর্বে তার জবানবন্দিতে স্বীকার করেছে যে সেই শেখ মুজিবকে প্রথম গুলি করে। মােসলেম উদ্দিন ১৯৭৩ সনের পাকিস্তান প্রত্যাগত সুবেদার। ১৯৭৫ সনের ২রা নভেম্বর খালেদ মােশাররফ ক্ষমতা দখল করলে সে দেশ ত্যাগ করে এবং পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান তাকে তৃতীয় সচিবের মর্যাদা দেয় ও অনারারি কাপ্টেন পদে উন্নীত করে। কিন্তু এতে মােসলেম উদ্দিন সন্তুষ্ট না হয়ে ১৯৭৭ সনের ২রা অক্টোবরের কু-তে জড়িয়ে পড়ে। কু ফেল করে এবং সে ধৃত হয়। স্পেশাল মিলিটারি ট্রাইবুন্যালে রায়ে তার ফাসি হয়। মৃত্যুর পূর্বে তার জবানবন্দীতে সে আরাে বলেছে যে, শেখ মুজিবকে হত্যা করার জন্যই আজকে তার ফাসি হচ্ছে। ১৯৭৫ সনের ১৫ই আগস্ট রাতে সে মাতাল ছিল।৩০
২৮,বঙ্গবন্ধুর শরীরে ২৮টি গুলি লাগে। মুখে কোনাে গুলি লাগেনি। গায়ে সাদা পাঞ্জাবী ও স্যাণ্ডো গেঞ্জি ছিল। পাঞ্জাবীর সাইড পকেটে ছিল তার প্রিয় পাইপটি। বুক পকেটে ছিল চশমা, যার একটি কাচ ভাঙা। কাঁধের উপর ছিল দুই আড়াই হাতের তােয়ালে। ২৯. ফারুক বলেছে, শেখকে জীবিত বন্দি করে রাখা সম্ভব ছিল না। তাহলে তার প্রতিক্রিয়া হতাে ভয়াবহ। রশিদ-ফারুক অন্য এক সাক্ষাৎকারে বলেছে, শেখকে যে হত্যা করা হবে এটা দলের সকলে জানত না।৩২
৩০. অন্য এক তথ্য হতে জানা যায়, শেখকে হত্যা করার পরামর্শ দেয় গণবাহিনীর নেতৃবৃন্দ। অভ্যুত্থান এক সংগে যৌথভাবে ঘটানাের কথা ছিল, কিন্তু মােশতাক চক্র পূর্বেই ঘটনাটি ঘটিয়ে ফেলে [পরিশিষ্ট দ্রষ্টব্য]।৩
সূত্রঃ ফ্যাক্টস্ এন্ড ডকুমেন্টস্ বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড অধ্যাপক আবু সাইয়িদ