বাংলার বাণী
ঢাকা: ১৫ই এপ্রিল, সোমবার, ১লা বৈশাখ, ১৩৮১
এসো হে বৈশাখ, এসো
আজ ১লা বৈশাখ। কর্মক্লান্ত বাংলা ও বাঙালির নিয়ত নিত্য জীবনে এক অবিস্মরণীয় দিন। আজ থেকে শুরু হবে বাঙালির নতুন বছর তেরশো একাশি।
প্রিয়জনের বিদায়লগ্নে প্রেমিক মনে যে নিদারুণ বেদনানুভূতি জাগে, ঠিক সেই বুকচাপা সুখ-দুঃখ আনন্দ-বেদনার নিয়েই আমরা গতকাল চৈতির শেষ চিতায় আশিকে জ্বলতে দেখেছি। সে যেন কি করুণ ভাবেই আমাদের দিকে সজাগ দৃষ্টি ফেলে বার বার চোখের নীরব ভাষায় বলছিল : ‘ক্ষমা করে নিও মোরে, যদি করে থাকি অপরাধ।’ হ্যাঁ, আশিকে বিদায় দিতে আমরাও নিরবে কেঁদেছি তবে হতোদ্যম হয়নি।। কারণ, এটা সৃষ্টিরই শ্বাশত নিয়ম-‘পুরাতন চলে যায় নতুনের তরে।’ সামনে আমাদের বিরাট স্বপ্ন, কত না উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। তাকেও বরণ করে সৃষ্টির সনাতন নিয়মেই জয়গান গাইতে হবে।
আজ থেকেই আমাদের নতুন শপথ, নতুন আত্মপ্রত্যয়ে জীবন পথে চলা শুরু। তাই পুরনো অবসান আর নতুনের আবাহনী সুরের ছন্দে প্রীতি মধুময় আজকের ভাস্বর স্বর্ণোজ্জ্বল দিন। বেদনা আর আনন্দ গীতির আবহমান স্পন্দন বাঙালির বুকের গভীরে আজ নতুন অনুরণ। নানারকম বর্ণাঢ্য আর স্মৃতি ভারাক্রান্ত কিছুদিনকে অনন্ত সময়ের অঢেল ভান্ডারে জমা রেখে আজ থেকে আমরা আবার নতুন করে একে যাব জীবনের নতুন আলপনা। তাই বৈশাখের আগমনের সারাদেশে কত রঙের ছড়াছড়ি।
প্রতিবছরের মতো এবারও ঢাকায় ব্যাপকভাবে ১লা বৈশাখের কর্মসূচি নেয়া হয়েছে। নববর্ষ উপলক্ষে আজ সোমবার দেশের সব খানেই সরকারি ছুটি। আজ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে তাদের পুরনো হিসাব-নিকাশে সুখ বিদায় দিয়ে নতুন হালখাতা লিখবে। বিভিন্ন সমাজ কল্যাণ প্রতিষ্ঠান শিশু ও দুঃস্থদের মাঝে করবে মিষ্টান্ন বিতরণ।
আজকের প্রথম অনুষ্ঠান উদযাপিত হচ্ছে রমনার বটবৃক্ষমূলে ভোর সাড়ে ছটা থেকে। ছায়ানট এর আয়োজন করেছে। এছাড়া বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ ভারত মৈত্রী, নজরুল একাডেমী, উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, বাংলাদেশ কৃষকলীগ এবং আরো অন্যান্য প্রতিষ্ঠান এবং আরো অন্যান্য জনকল্যাণ প্রতিষ্ঠান এবং কলেজ-স্কুলও একাধিক কর্মসূচির মাধ্যমে বৈশাখ পালন করছে।
আমরাও এক বুক ভরা আশা ও স্বপ্নের রঙিন কল্পনা স্বাগতম জানাই-‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো।’ জরাজীর্ণ দিনের ক্লান্তি ঝেড়ে নিয়ে নতুন আলোর সন্ধান দেও তোমার এ আবহমান প্রেমিক জাতিকে। ফুলে ফুলে, রঙে-সৌরভে ভরপুর করে তোলো। বাংলার শ্যামল প্রান্তর, সুখ-আনন্দ, হাসি আর গানে মুখর করে সমস্যা নিষ্পেষিত বাঙালির আজকে নিরব কণ্ঠকে। এসো হে বৈশাখ, এসো আমাদের এ গালিচা পাতা অঙ্গনে, তোমার সম্পদ-প্রচুর প্রাণের সম্ভার নিয়ে। আমরা উন্মুখ চেয়ে আছি, তোমায় স্বাগতম জানাবো বলে।
জাতীয় দ্রব্য মূল্য নির্ধারণে কিছু প্রশ্ন
পাগলা ঘোড়ার মতো দ্রব্যমূল্যের খামখেয়ালি ওঠা-নামা আর ছোটাছুটি হয়রাণ হয়ে দেশের মানুষ অনেকদিন আগে থেকেই কতৃপক্ষের কাছে আকুল আবেদন জানিয়ে আসছে দেশের বিভিন্ন জিনিসের একটি সরকারি মূল্য বেধে দিতে। কারণ, নির্দিষ্ট মূল্য রাখা নেই, যার যতো খুশী মূল্য হাকছে।
এ দাবীর পরিপ্রেক্ষিতে কতৃপক্ষ যে একবারেই কিছু করেন নি, তা নয়। মাঝে মাঝে দু’একটি জিনিসের সরকারি মূল্য ঘোষণা করে কতৃপক্ষ জনতার ক্ষোভের কিছুটা প্রশমনে এক ধরনের বেগারশোধ-আন্তরিকতা দেখিয়েছেন বৈকি। তবে, তাতে সাধারণ মানুষের কোনই উপকার হয়নি বলা চলে।
প্রথমতঃ একান্ত প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য ঠিক না করে এমন সব জিনিসের দাম বেঁধে দেয়া হয়েছিল, যা দীন দুঃখীর চেয়ে ওপরতলার বাবু সাহেবদেরই বেশি কাজে লাগে। ফলে, দাম নির্ধারণে বাবুর সাহেবদের কতটুকু সুখী করেছে বলা মুশকিল, তবে দীন-দুঃখীদের শুধু হতাশ করেছে।
দ্বিতীয়তঃ সে দাম নির্ধারণে এমন ভ্রান্তনীতি অনুসরণ করা হয়েছিল যাতে দাম বেঁধে দিলেও আসলে তাতে কারো কোনো উপকারে আসেনি বা জিনিসের মূল্য সাধ্যায়ত্ত হয়নি। যেমন মূল্য বাধার আগে যে জিনিসের কালোবাজারে দাম ছিল সর্বোচ্চ সেই সর্বোচ্চকেই ন্যূনতম দাম ধরে সরকারি দাম ধার্য করা হয়েছিল।
তৃতীয়তঃ জ্বালা এখানেই শেষ নয়। কালোবাজারের সর্বোচ্চ দামকে ন্যূনতম সরকারি দাম বলে ধার্য করলেও সে সরকারি দামেও জিনিসপত্র পাবার কোনই জো নেই। কারণ এ ব্যাপারে ব্যবসায়ীদের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে সরকার এ যাবৎ কোন কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হননি। ফলে, যেই সরকার কোন জিনিসের এমন উচ্চ মূল্যও ধার্য করেন, অমনি দেখা যায় জিনিসটি কালোবাজারে আরো উচ্চমূল্যে বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ সরকারি দামের একধাপ বা দুচার ধাপ উপরে জিনিসপত্র বিক্রি করায় যেন ব্যবসায়ীদের মূল ইচ্ছা ও প্রবণতা।
আর এই ভাবেই দেশের সমস্ত জিনিস পত্রের দাম রোজই অকারণে বেড়ে বেড়ে মঙ্গল গ্রহের যাত্রী হচ্ছে। নির্যাতনে, নিষ্পেষণে মানুষের গা বেয়ে তর তর করে রক্ত ঝরছে। আর কতৃপক্ষ ফ্যাল ফ্যাল করে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ভাবছেন ‘এবার তাহলে কি করা যায়?’ জিনিসপত্রের দাম কমানোর কোনো উদ্যোগই সফল হচ্ছে না। যেকোনো সামান্যতম উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে অমনি দেখা যাচ্ছে রুই-কাতলা ঘনঘন নিশ্বাস ভবনে প্রাসাদে আনাগোনা, আমলার লাল ফিতার টনে টনে ভাব আর কোলে টেনে ঝোল খাবার সবার একান্ত আগ্রহ বাসনা। ফলে উদ্যোগ ফাইল চাপা পড়ে অঙ্কুরেই বিনাশ হচ্ছে। ধুরন্ধর ব্যবসায়ী মহলের চাল আর প্রভাবশালী মহলের দারুন চক্রান্তের সঙ্গে কিছুতেই এঁটে ওঠা যাচ্ছেনা। মাঝে সাধারণ মানুষের জীবন নাভিশ্বাস।
যাহোক, একটু দেরীতে হলেও আমাদের বাণিজ্য ও বৈদেশিক বাণিজ্য মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ সাহেব আমাদের জন্য একটা সুসংবাদ শুনিয়েছেন। গত শনিবার একটি স্থানীয় কন্টিনেন্টাল হোটেলে এক সুধী সমাবেশে তিনি ঘোষণা করেন যে, দেশের বিভিন্ন এলাকার জনসাধারণ যাতে নিত্যব্যবহার্য প্রায় একই দামে সর্বত্র পেতে পারেন, সেজন্য সরকার যথাসম্ভব বেশিসংখ্যক পণ্যের জাতীয় মূল্য নির্ধারণে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। দেশের ১৩টি শিল্প ও বণিক সমিতি এবং ৬০টি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা এ সমাবেশে যোগদান করেন।
মন্ত্রীমহোদয়ের এ ঘোষণার নিঃসন্দেহে দেশের সর্বস্তরের সাধারণ মানুষকে খুশি করবে। তবে কথা হচ্ছে, আগের মতো এবারও কি কর্তৃপক্ষ কালোবাজারের সর্বোচ্চ মূল্য কি জাতীয় মূল্য ন্যূনতম হার হিসেবে গ্রহণ করবেন, ভাবছেন তাই যদি হয়, তবে সে মূল্য নির্ধারণ অন্ততঃ দেশের সাধারণ মানুষের উপকারে আসবে না সে কথা নিঃসন্দেহেই বলা যেতে পারে। কারণ, স্বাধীনতা প্রাক মূল্য, অর্থাৎ বাংলাদেশ স্বাধীন হবার আগে সাবেক পাক আমলে যে দ্রব্যমূল্য ছিল, তাই ছিল এ দেশের গরীব দুঃখী মানুষের ক্ষমতার বাইরে। এবং এ জন্যই এ অভিশাপ থেকে মুক্ত হবার জন্য তারা অন্যান্য কারণসহ রক্তাক্ত স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু করেছিল। আর বাংলাদেশের বর্তমান দ্রব্যমূল্যের তো কোন প্রশ্নই ওঠেনা। গোদের ওপর বিষফোঁড়া উঠলে যেমন মানুষের উপায় থাকে না, তেমনি অগ্নি শর্মা দ্রব্যমূল্য নিষ্পেষণে মানুষ আজ নিরুপায়। আগুন দামে জিনিস কিনছে বলেই যে তাদের কেনার ক্ষমতা আছে ভাবতে হবে, তা একেবারেই ভুল। আসলে তিরিশ দিনকে তিনদিনে কিনে যাচ্ছে বলে তারা মরতে মরতেও কিনে চলেছে। কারণ, কি আর করবে-উপায় নেই। না কিনলে প্রাণ বাঁচে না। সুতরাং বিভিন্ন জিনিসের জাতীয় মূল্য ধার্য করে কর্তৃপক্ষ নিদেনপক্ষে প্রাক স্বাধীনতার মূল্য দিকে দৃষ্টি রেখে দ্রব্য মূল্য ধার্য করবেন বলেই আশা করছেন। তা না হলে এ ধার্য করেন শুধুমাত্র একটা প্রহসন ছাড়া কিছু হবে না।
অবশ্য, জাতীয় মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের মতামত ও সুপারিশ আহ্বান করা হয়েছে, তা আমরা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের দৃষ্টিকোণেই দেখেছি। কারণ এ কথা সঠিক যে, ব্যবসায়ীদের আন্তরিক অসম্পূর্ণ সহযোগিতা না হলে দেশে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল করা সম্ভব নয়। সরকারের মূল্য নির্ধারণের প্রশংসনীয় উদ্যোগ সংশ্লিষ্ট সংস্থা ব্যবসায়ী ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান সত্যিকারে আন্তরিকতা ও সহযোগিতার হাত নিয়ে এগিয়ে এসে দেশের মানুষের দুর্ভোগ নিরসনে উদ্যোগী হবেন বলেই আমরা আশা করছি।
শনিবারের এ সমাবেশে আমদানি নীতি, টিসিবির কার্যক্রম পদ্ধতি, বন্টন ব্যবস্থা, ভোগ্যপণ্য সংস্থা, মূল্যনির্ধারণ, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, রপ্তানি বৃদ্ধির উপায়, বীমা পরিত্যক্ত শিল্প প্রতিষ্ঠানের সমস্যা ইত্যাদি সম্পর্কে যেসব গুরুত্বপূর্ণ ও তথ্যবহুল আলোচনা হয়েছে, তাকে সম্পূর্ণ চিত্র ধরে রেখে এবং দেশের মানুষের সত্যিকারের বর্তমান ক্রয় ক্ষমতার কথা লক্ষ রেখে কর্তৃপক্ষ জাতীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি বাস্তবায়িত করতে উৎসাহী হলে তাতে সত্যিকারভাবে দেশের মানুষের উপকার হবে বলে আশা করা যায়। অন্যথায়, যে কোনো উদ্যোগ বিফল হবেই।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক