বাংলার বাণী
১৮ই আগস্ট, শনিবার, ১৯৭৩, ১লা ভাদ্র, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
সলভেন্ট তেলের অভাব নেই তবু মিল বন্ধের আশঙ্কা
পূর্বাঞ্চলীয় সংবাদ সংস্থার একটি খবরে প্রকাশ, সলভেন্ট তেলের অভাবে অনতিবিলম্বে দেশের ডজন খানেক কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে চলেছে। এই মিলগুলো ঢাকা, টঙ্গী ও নারায়ণগঞ্জে অবস্থিত। মিলগুলোর মধ্যে রয়েছে রাবার, বৈদ্যুতিক বাতি তৈরী ও এই জাতীয় কয়েকটি কারখানা। সলভেন্ট তেলের সংকটের কারণ হিসাবে জানা গেছে যে, যানবাহন সমস্যাই এর প্রধান অন্তরায়। চট্টগ্রামে সলভেন্ট তেলের মওজুত রয়েছে কিন্তু যানবাহনের অভাবে তা ঢাকা আনা সম্ভব হচ্ছে না। গত পরশুদিনের একটি সংবাদে জানা গেছে, দেশের উত্তরাঞ্চলের মিলকারখানাগুলোর গোয়ালপাড়া পাওয়ার স্টেশনের রেশনিং বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্যে উৎপাদন মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে। বিদ্যুৎ সরবরাহে গোলযোগের জন্যে খুলনা ও যশোর সহ উত্তরাঞ্চলের প্রায় সবগুলো মিল নিদারুণ সংকটের সম্মুখীন। উত্তরাঞ্চলের মিলগুলোর যখন এমনি দুরবস্থা ঠিক তখনই আবার সলভেন্ট তেলের অভাবে ঢাকা-ট্ঙ্গী ও নারায়ণগঞ্জের কিছুসংখ্যক মিল বন্ধ হবার উপক্রম। আমরা পূর্বাপর লক্ষ্য করেছি—সরকার কোন বিষয়ে হ্স্তক্ষেপ করেন যখন ঐ বিষয়টি শেষ অবস্থায় এসে পৌঁছায়। সলভেন্ট তেলের অভাব হতে পারে এটা পূর্বাহ্নেই সরকারের অনুধাবন করা উচিত ছিল। মিল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর তা চালু করার জন্যে জরুরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা কোনমতেই সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গির পরিচায়ক নয়। সলভেন্ট তেলের অভাব নেই। চিটাগাংয়ে-এর মওজুত রয়েছে। দেশে এখনও যানবাহনের অভাব রয়েছে—একথা সত্য। স্বাধীনতা অর্জন করার পর থেকে সর্বাত্মকভাবে সরকার প্রচেষ্টা করছেন যানবাহন সমস্যার সমাধানের জন্যে। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও সরকার এ অচলাবস্থা বেশ খানিকটা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছেন। তবু কিছু সমস্যা এখনও রয়েছে। যানবাহন সমস্যার সমাধান করে তারপর দেশের মিলকারখানা চালু রাখার প্রয়োজনীয় দ্রব্য বা কাঁচামাল সরবরাহ করতে হবে এটা হতে পারেনা। সরকার উৎপাদন বা রাষ্ট্রীয় আয়ের খাতগুলোকে অবশ্য অন্যান্যের তুলনায় জরুরী বিষয় বলে ধরে নেবেন এটাই স্বাভাবিক। আর সে কারণে মিলকারখানার জন্যে প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সরবরাহ করতে হবে এটাও অনস্বীকার্য। ঢাকা, টঙ্গী, নারায়ণগঞ্জ এলাকায় যে কয়েকটি মিল আজ সলভেন্ট তেলের অভাবে বন্ধ হবার উপক্রম হয়েছে তার জন্যে নিশ্চয়ই অদূরদর্শী মিল ও সরকারী কর্তৃপক্ষই দায়ী। আমরা দেশে সলভেন্ট তেল থাকতে মিলের বন্ধাবস্থা দেখতে রাজী নই। দেশের মানুষ কর্তৃপক্ষের এই খামখেয়ালী কোনক্রমেই গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয়। যে করেই হোক বিকল্প ব্যবস্থার মাধ্যমে উল্লেখিত সংকটাপন্ন মিলকারখানা কর্তৃপক্ষ চালু রাখবেন, এটাই আমাদের বিশ্বাস।
ভুট্টোর সংসদীয় সরকারের প্রথম থাবা
পাকিস্তানের ভুট্টো সাহেব আবার বেলুচদের উপর হিংস্র থাবা বিস্তারের প্রয়াস পেয়েছেন। বেলুচিস্তানের সাবেক গভর্নর মীর গাউস বখশ বেজেঞ্জো, মুখ্যমন্ত্রী সর্দার আতাউল্লাহ খান মেঙ্গল এবং বিশিষ্ট ন্যাপনেতা মীর খায়ের বখশ মারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অনুমান করা হচ্ছে যে, বেলুচিস্তানের সাম্প্রতিক সশস্ত্র বিদ্রোহের সাথে জড়িত থাকার সন্দেহে নাকি তাদের গ্রেফতার করা হয়। পাকিস্তান সরকারের এই কাজ সংসদীয় গণতন্ত্রের নামাবলী গায়ে জড়ানোর পরই এই প্রথম এবং ভুট্টো সাহেব জোর করে চাপে পড়ে যে সংসদীয় গণতন্ত্রের বটিকা সেবন করেছেন সেই সংসদীয় গণতন্ত্রের সুফলগুলো সযত্নে পরিহার করে এটাকে সাধারণ মানুষের কাছে বিকৃত করার অপচেষ্টায় মত্ত হয়েই এই আত্মঘাতী কার্যকলাপে লিপ্ত হচ্ছেন।
বেলুচিস্তান আজ বিস্ফোরণোন্মুখ। বেলুচিস্তান পাকিস্তানের বুকে দ্বিতীয় বাংলাদেশ। বেলুচিস্তান পাকিস্তান ও ইরানের অশুভ আঁতাতের বিরুদ্ধে আগ্নেয়গিরি। বেলুচিস্তানের হুঙ্কারে ভুট্টোর গদি টলটলায়মান। বেলুচিস্তান ভুট্টো-টিক্কা শাহী ফ্যাসিবাদের মৃত্যুঘন্টা। কাজেই ভুট্টো সরকার আজ মাতাল—দিশেহারা।
বিগতক ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ওয়ালী খানের ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বেলুচিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। ইয়াহিয়ার পতনের পর ন্যাপ নেতা সর্দার আতাউল্লাহ খান মেঙ্গলের নেতৃত্বে বেলুচিস্তান প্রদেশের মন্ত্রীসভা গঠিত হয়। গভর্নর নিযুক্ত হন ন্যাপনেতা মীর গাউস বখশ বেজেঞ্জো। এরপরই শুরু হয় বেলুচিস্তান ও বালুচদের বিরুদ্ধে ভুট্টো-শাহী আঁতাতের চক্রান্ত। ভুট্টো সাহেব পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট হিসেবে বেলুচিস্তানের গভর্নরকে বরখাস্ত ও মন্ত্রীসভা বাতিল করে প্রেসিডেন্টের শাসন জারী করেন। এরপর সেখানটায় একজন তাঁবেদার গভর্নর নিয়োগ করে একটি তথাকথিত কোয়ালিশন সরকার চেপে দেয়—যেমনটি দিয়েছিল ইয়াহিয়া খাঁ স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাংলাদেশে। বেলুচরা এর বিরুদ্ধে তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের দাবীতে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে দেন। ভুট্টো সাহেবও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ক্রীড়নক ইরানের শাহের চক্রান্তে এই সংগ্রাম দমন করার জন্যে চরম নির্যাতন চালানোর পন্থা বেছে নেন। বীর বেলুচিরা কিন্তু এতে দমে যাননি। কিছুদিন আগে সশস্ত্র বেলুচদের সাথে এক সম্মুখ সমরে পাকিস্তানের ৬ জন সরকারী সৈন্যেরা ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যায়। এরপর ভুট্টো সাহেবরা আরো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন এবং তারই ফলশ্রুতি বেলুচদের প্রিয়নেতা বেজেঞ্জো-মেঙ্গল-মারীকে গ্রেফতার।
কিন্তু এই তিনজন জনপ্রিয় নেতাকে গ্রেফতার করে ভুট্টো সরকার যদি মনে করেন যে, মুক্তিপাগল বেলুচদের দমন করা সম্ভব হবে তবে মনে করতে হবে—তারা বোকার স্বর্গের বাসিন্দা। সেক্ষেত্রে ভুট্টো সাহেবকে আমরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে বলবো। আইয়ুবের সামরিক শাসনামলেও বেলুচিস্তানে ঈদের জামাতের উপর বোমাবর্ষণ করে বহু নারী ও শিশু সহ কয়েকশ’ বেলুচকে হত্যা করা হয়েছিলো—মেঙ্গল-মারীকে খুনের মামলায় আসামী করে বছরে পর বছর জেলে পুরে রাখা হয়েছিলো—বেজেঞ্জোকেও কারারুদ্ধ করা হয়েছিলো কিন্তু বেলুচদের দমন করা সম্ভব হয়নি তবুও। ইতিহাসের অমোঘ বিধানে বেজেঞ্জো-মেঙ্গল-মারী আবার তাদের স্বস্থানে ফিরে গেছেন—জনতার অন্তরে তাদের আসন সুপ্রতিষ্ঠিত। কিন্তু আইয়ুব খাঁরা নিক্ষিপ্ত হয়েছেন ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে। তাই ভুট্টো সাহেবকেও আমরা বলতে চাই জনগণের আস্থাবান নেতৃবৃন্দকে জেলে পুরে—জনগণের সাথে হঠকারিতা করে সাময়িক কালের জন্যে হয়তো ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা যায়, কিন্তু শান্তিতে টিকে থাকা যায় না। পরিণামে নিক্ষিপ্ত হতে হয় ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে। ভুট্টো সাহেব, এখনো সময় আছে—নিজেকে সেই আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবার হাত থেকে বাঁচান। বেলুচদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার তথা স্বাধিকারের দাবী মেনে নিন।
নিক্সন সাহেব স্বাভাবিক আছেন ত!
ওয়াটারগেট কেলেংকারীর ব্যাপারে তিনি নির্দোষ বলে গত বুধবার এক টেলিভিশন বক্তৃতায় প্রেসিডেন্ট নিক্সন দাবী করেছেন। তিনি বলেছেন, ওয়াটারগেট কেলেংকারী সংক্রান্ত সংবাদ ধামাচাপা দেবার পরিবর্তে এতদসংক্রান্ত ‘তথ্যাদি বের করার’ চেষ্টা তিনি করেছেন। তিনি আরো বলেছেন, ওয়াটারগেটের ঘটনাবলী থেকে যেন আমরা শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পারি।
প্রেসিডেন্ট নিক্সন ওয়াটারগেট কেলেংকারীর বিষয়ে তিনি যে নির্দোষ এটা একটা ‘সহজ সত্য’ ব্যাপার বলে উল্লেখ করেছেন এবং তিনি মার্কিন জনগণকে বোঝাবার চেষ্টা করেছেন যে, শত্রুরা নিরপরাধ একজন প্রেসিডেন্টের রাজনৈতিক জীবনের ভরাডুবি ঘটাতে চেষ্টা করছে। সবশেষে তিনি সহকর্মীদের সব অপকর্মের দায়িত্ব নিজ স্কন্ধে নেবার কথাও ঘোষণা করেছেন।
বলা বাহুল্য, ওয়াটারগেট কেলেংকারীর খবর প্রকাশিত হয়েছে চার মাস আগে। এই দীর্ঘ চার মাস স্বেচ্ছাকৃত নীরবতার পর প্রেসিডেন্ট নিক্সন তাঁর সমালোচকদের সাথে সংগ্রামে অবতীর্ণ হলেন।
প্রেসিডেন্ট নিক্সন নিজে নির্দোষ ‘এটা সহজ সত্য’ বলে দাবী করার সঙ্গে সঙ্গে ওয়াটারগেট মামলার সাইত্রিশ দিন শুনানীকালে তাঁর বিরুদ্ধে আনীত সুনির্দিষ্ট অভিযোগগুলোর কোনটিরই জবাব দিতে তিনি অস্বীকৃতি জানিয়েছেন এবং উক্ত মামলার সাথে সংশ্লিষ্ট টেপ রেকর্ডগুলো হস্তান্তরে অসম্মতি প্রকাশ করেছেন। এবং সাথে সাথে সহকর্মীদের সহ অপকর্মের দায়িত্ব নিজ স্কন্ধে নেবার কথাও জানিয়েছেন। সব মিলিয়ে তাহলে কি দাঁড়াচ্ছে? যে অপকর্মের জন্যে তিনি নির্দোষ, তিনি কিছু জানেন না বলে দাবী করেছেন সেই তিনিই আবার তাঁর বিরুদ্ধে আনীত সুনির্দিষ্ট অভিযোগ খন্ডন করতে টেপ রেকর্ড হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন, সহকর্মীদের সব অপকর্মের দায়িত্ব নিজের কাঁধে নেবার কথা ঘোষণা করে সহকর্মীদের প্রীতিভাজন হয়েছেন। অর্থাৎ তিনি উক্ত কেলেংকারীকে না পারছেন উড়িয়ে দিতে না পারছেন স্বীকার করে নিতে। ব্যাপারটি যেন তাঁর গলায় বেঁধে গেছে। হজমও করতে পারছেন না, উদগীরও করতে পারছেন না। এবং সে কারণেই তিনি ওয়াটারগেট কেলেংকারীর ঘটনা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে জনগণকে দেশের সমস্যা সমাধানের দিকে মনোযোগী হবার আহ্বান জানিয়েছেন। সাম্রাজ্যবাদী কুটনীতিতে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু নিক্সন সাহেবকে একথা ভুললে চলবেনা শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যায় না। সত্যকে কোনদিন গলা টিপে হত্যা করা যায়নি, যাবেও না। সুতরাং ওয়াটারগেট কেলেংকারীর ব্যাপারে নিক্সন সাহেব যেভাবে স্ববিরোধী বক্তব্য রাখতে শুরু করলেন তাতে তাঁর মস্তিষ্কের স্বাভাবিকতা সম্পর্কে সন্দিহান হলে অত্যুক্তি করা হবে কি?
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক