You dont have javascript enabled! Please enable it! খেপুপাড়া আক্রমণ - সংগ্রামের নোটবুক
খেপুপাড়া আক্রমণ

৬ই ডিসেম্বর আমরা খেপুপাড়া আক্রমণ করার পরিকল্পনা করলাম। জাহাজ এবং আরও একটা লঞ্চ নিয়ে রওয়ানা হলাম। খেপুপাড়ার ২ মাইল দূরে তিনটা দলে বিভক্ত হলাম। শাজাহান (এয়ার ফোর্সের) যাবে জাহাজে। লঞ্চটা ওখানেই থাকবে। শাজাহানের সাথে থাকবে এলএমজিসহ ১৫জন রাইফেলধারী। সে খেপুপাড়ার থানার ঘাটে জাহাজ ভিড়াবে স্বাভাবিকভাবে। অন্যরা পজিশন নিয়ে থাকবে। শত্রুপক্ষ ভাববে তাদেরই গানবােট। জাহাজটা অনেকটা গানবােটের মতােই এবং সকলকে জাহাজে উঠে আসার নির্দেশ দেবে। শাজাহানের দেহাকৃতি পাঞ্জাবীদের মতােই ছিল। শাজাহান পাকিস্তান আর্মি ক্যাপ্টেনের অভিনয় করবে। জাহাজের সামনে ওরা এসে শাজাহানের নির্দেশে মতাে ফল ইন করবে। সাথে সাথে জাহাজ থেকে এলএমজি এবং রাইফেলের গুলিতে শেষ করা হবে সবগুলােকে। আমরা এর আগেই দুটো দল নিয়ে থানা ঘিরে ফেলব এবং থানার দিকে এলােপাতাড়ি গুলি করে থানায় ঢুকে পড়ব। পরিকল্পনাটা ছিল এমনি সুন্দর। শওকতকে একটা দল নিয়ে থানার উত্তর দিক দিয়ে পজিশন নিতে পাঠালাম। আমি একটা দল নিয়ে থানার পূর্ব দিক দিয়ে একটা ছােট খালের পুল পার হয়ে থানার ৫০ গজের মধ্যে প্রস্তুত। শওকতের সাথে ইউসুফ, দেলােয়ারসহ ২৫জনের একটা দল এবং আমার সাথে বাবুদা’, হাবীব, রবীনসহ ২৫জনের একটা দল। এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, সরদার জাহাঙ্গীর একটা দল নিয়ে গলাচিপা এসেছিল। তার দলের সদস্য ছিল ৯জন। তারা আমার দলে যােগ দিয়ে দলকে শক্তিশালী করল। ক্যাপ্টেন মেহদীর নির্দেশক্রমে গলাচিপা ও পটুয়াখালী থানার মুক্তিবাহিনীর অন্যান্য ছােট দলগুলিও আমার একক নেতৃত্ব মেনে নিয়ে কাজ করা শুরু করেছিল।

হাবীব খেপুপাড়ার ছেলে। সে সকলের সামনে, তার পিছনে আমি, আমার পিছনে বাবুদা’। খেপুপাড়ায় কোনদিন যাইনি। হাবীব ছিল একমাত্র পথঘাট চেনা ছেলে। পুলের উপর উঠতে যাব, অমনি শত্রুপক্ষের পেট্রোল পার্টির সামনে পড়ে গেলাম। ওরা আমাদের উপরে গুলি করল। কিন্তু আমাদের কারও গায়ে গুলি লাগতে পারেনি। তারপরই আরম্ভ হল থানা থেকে গুলি করা। আমরা আর পুল পার হতে পারলাম না। ওদিকে আমাদের জাহাজ থেকে পরিকল্পনা কার্যকরী হবার আগে গােলাগুলির শব্দ পেয়ে ওরাও থানার দিকে গুলি ছুঁড়ল। আমরা সারারাত থানা ঘিরে রাখলাম। সকালে আমি চলে এলাম। শওকতের উপর সমস্ত ভার দিয়ে সমস্ত দল ওখান থেকে একটু দূরে সরিয়ে আনলাম। চলে এলাম বগাবন্দর। আমার সাথে আনলাম বাবুদা’, মাষ্টার সাহেব, লাতিফ, বাবুল , ফোরকান, দেলােয়ার এদের কয়েকজনকে। বগাবন্দর থেকে পাকজলযানের উপর আক্রমণ ও বাগা এসে পৌছলাম ৮ তারিখ রাত আটটার সময়। পটুয়াখালী থেকে বাগাতে টেলিফোন এল যে, পাকবাহিনী পালিয়ে যাচ্ছে। বাগা তখন মুক্ত এলাকা। ওখানে পঞ্চম আলীর দলের ১৫/১৬ জনের ঘাঁটি ছিল। আমাকে পেয়ে ওরা খুশি হল। বাগা পােস্ট অফিসে গিয়ে পটুয়াখালীর সাথে যােগাযােগ করলাম। রাত নয়টার সময় দুটো লঞ্চে পাকজান্তার দল ও দালালদের দল পালিয়ে আসল পটুয়াখালী থেকে। কিন্তু তাদের যেতে হবে বগাবন্দরের নদী দিয়ে। বাউফলে ফোনে জানালাম সবকিছু। ফোন পেয়ে বাউফল থেকে একটা দল রওনা হল বাগার দিকে। দূরত্ব ৮ মাইল। পটুয়াখালী থেকে যথারীতি আমরা খবর পেতে থাকলাম।

পটুয়াখালীর তখনকার ডিসি আবদুল আউয়ালের সাথে যােগাযােগ করলাম এবং খবরের সত্যতা প্রমাণ করলাম। আমরা ২০জনের মতাে লােক রাইফেল হাতে বগা নদীর কূলে পজিশন নিলাম। রাত দশটার সময় লঞ্চ দুটো আমাদের রেইঞ্জের মধ্যে এসে গেল। গুলি ছুঁড়লাম। ওরাও ছুঁড়ল। ৩/৪টা এলএমজির ব্রাশ। লঞ্চ দু’টো রাখতে পারলাম না। ফুল স্পীডে চালিয়ে রেঞ্জের বাইরে চলে গেল। | ৯ তারিখ সকাল ৮ টার সময় ভারতীয় বিমান বােম্বিং করল পটুয়াখালীতে । আমরা পটুয়াখালী চলে গেলাম । খবর পেয়ে অন্যান্য দলের কিছু কিছু মুক্তিবাহিনী চলে এসেছিল। থানা, পুলিশ ক্যাম্প সব দখলে নিয়ে নিলাম এবং প্রত্যেক পজিশনে পয়েন্টে করে কড়া গার্ড মােতায়েন করালাম। ওদিকে শওকত পরের বারে খেপুপাড়া আক্রমণ করে এবং থানার সমস্ত অস্ত্রশস্ত্রসহ খেপুপাড়া থানা দখল করে নেয়। ৯ই ডিসেম্বরের মধ্যে আমরা পটুয়াখালীর সমস্ত থানাসহ পটুয়াখালীকে মুক্ত এলাকা ঘােষণা করলাম । তখন আমার কমাণ্ডে প্রায় ১৫০০ মুক্তিবাহিনী। (সূত্র : বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, অষ্টম খণ্ড।)

সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত