You dont have javascript enabled! Please enable it! ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিদ্রোহ - সংগ্রামের নোটবুক
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিদ্রোহ
 

ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের চতুর্থ ব্যাটালিয়নটি কুমিল্লা সেনানিবাসে অবস্থান করছিল। মুষ্টিমেয় কয়েকজন পাকিস্তানী ছাড়া এই ব্যাটালিয়নের সকল সৈনিক ছিলেন বাঙালি। বিরাজমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও জনগণের স্বাধিকার আন্দোলন বাঙালি সৈনিকদের মনে রেখাপাত করে। পাশাপাশি পাকবাহিনী কর্তৃক সারা দেশব্যাপী নিরস্ত্র জনগণের হত্যা, নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে সামরিক জান্তার টালবাহানা, পাকিস্তান। থেকে সাদা পােশাকে সৈন্য অবতরণ এবং দীর্ঘ দিনের পশ্চিম পাকিস্তানীদের সেনাবাহিনীতে বাঙালি সৈনিকদের প্রতি ঘৃণা ও বিজাতীয় মনােভাব এদের বিক্ষুব্ধ করেছিল। বাঙালি অফিসারগণ ও সাধারণ সৈনিকেরা বাঙালির হাজার সংগ্রামের স্রোতধারার সঙ্গে সচেতনভাবে মিলিত হয়ে গিয়েছিলেন। এই সময় চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলের অধিনায়ক ছিলেন লেঃ কর্নেল খিজির হায়ত খান। ২২শে মার্চ সন্ধ্যায় মেজর খালেদ মােশাররফ উপ-অধিনায়ক হিসেবে যােগদান করেন। এই বাঙালি ব্যাটালিয়নটিকে দুর্বল করে দেয়ার জন্য বিভিন্ন কোম্পানীগুলােকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার ষড়যন্ত্র করা হয়। মেজর খালেদ মােশাররফ ঢাকা সেনানিবাসে ৫৭ ব্রিগেডের মেজর ছিলেন। ১ লা মার্চ থেকে ২১শে মার্চ পর্যন্ত সেনাবাহিনীর সন্দেহজনক মােতায়েন সম্পর্কে তিনি অবহিত ছিলেন। প্রহসনমূলক আলােচনা বৈঠক ও সময় প্রস্তুতি মেজর খালেদকে বিচলিত করে তােলে। এর আগে ফেব্রুয়ারি মাসে চট্টগ্রামে তিনি বাঙালি অফিসারদের সঙ্গে উত্তপ্ত পরিস্থিতি ও সম্ভাব্য পাকিস্তানী গণহত্যা সম্পর্কে আলােচনা করেন।

মার্চের প্রথমদিকে তিনি শেখ মুজিব ও কর্নেল ওসমানীর সঙ্গে দেখা করেন। ১৯শে মার্চ আকস্মিকভাবেই মেজর খালেদ ঢাকা সেনানিবাস থেকে কুমিল্লার চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলের উপ-অধিনায়ক হিসেবে বদলির আদেশ পেলেন। ২২শে মার্চ সন্ধ্যায় চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলে পৌছেই তিনি বুঝতে পারলেন বাঙালি সৈনিকেরা বেশ উদ্ধিগ্ন । তিনি জানতে পারলেন ৫৩ ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারীর কামানগুলাে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলের দিকে মুখ। করে বসানাে হয়েছে। তৃতীয় কমাণ্ডে ব্যাটালিয়নের দূর পাল্লার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রগুলাে চতুর্থ বেঙ্গলের দিকে তাক করে রাখা হয়েছে। পাঞ্জাৰী কমাণ্ডো ও গােলন্দাজ বাহিনী চতুর্থ। বেঙ্গলের চতুর্দিকে পরিখা খনন করে অবস্থান নিয়েছে। এই ব্যাটালিয়নকে দুর্বল করার। অভিপ্রায়ে ইতিমধ্যেই মেজর শাফায়াত জামিলে নেতৃত্বে ‘সি’ কোম্পানী ও মেজর সাদেক নেওয়াজ (পাঞ্জাবী) এর নেতৃত্বে ‘ডি’ কোম্পানীকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পাঠানাে হয়েছিল। কল্পিত ভারতীয় অনুপ্রবেশ রােধ করার অজুহাতে ১লা মার্চ থেকেই এই কোম্পানী দুটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অবস্থান করছিল। মেজর শাফায়ত জামিলের দায়িত্ব ছিল শাহবাজপুর ব্রীজ পর্যন্ত এবং মেজর সাদেক নেওয়াজ কোম্পানীর দায়িত্বে ছিল উজানিচর ব্রীজ পর্যন্ত। মেজর খালেদ অবিলম্বে সকল বাঙালি সৈনিকদের সতর্ক করে দিলেন এবং আত্মরক্ষার জন্য প্রহরী দ্বিগুণ করার নির্দেশ দিলেন।
পরদিন ২৩শে মার্চ ছিল ছুটির দিন। সকালে লেঃ কর্নেল খিজির হায়াত খান মেজর খালেদ মােশাররফকে ডেকে এক কোম্পানী সৈন্য নিয়ে সেদিনই শমশের নগর যেতে নির্দেশ দিলেন। মেজর খালেদ বললেন, মাত্র একদিন হল এসেছি। সব দায়িত্ব এখনাে বুঝে নেয়া হয়নি, এই সময় যাওয়া ঠিক হবে না।’ খিজির হায়াত বললেন, ‘সিলেটের শমসের নগরে নকসাল পন্থীদের তৎপরতা বেড়েছে। ভারত তাদের অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সাহায্য করছে। এদেরকে দমনের জন্য একটি কোম্পানী সেখানে পাঠানাে দরকার।
মেজর খালেদ একজন জুনিয়র মেজরকে পাঠানাের জন্য অনুরােধ করলেন। খিজির হায়াত অপ্রস্তুত হয়ে মেজর খালেদকে বললেন, “ব্রিগেড কমান্ডার ইকবাল শফি আপনাকে ডেকেছেন। অতঃপর খিজির হায়াতের সঙ্গে মেজর খালেদ ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শাফির অফিসে গেলেন। ইকবাল শফি খালেদকে দেখেই বললেন, ‘আমি তােমারই জন্য অপেক্ষা করছিলাম। বিশেষ একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ যা তুমি ছাড়া কেউ পারবে না, সেজন্য তােমাকে পাঠানােই ঠিক করেছি।’ মেজর খালেদ দেখলেন, কোন উপায় নেই, তাকে যেতে হবে। মেজর খালেদ বললেন, ‘শুধু একটা কোম্পানী দিয়ে এই গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে না, বেশি সৈন্য, স্বয়ংক্রিয় ভারী ও হালকা অস্ত্রশস্ত্র, মর্টার ও পর্যাপ্ত গােলাবারুদ দিতে হবে। হেড কোয়ার্টারের সঙ্গে যােগাযােগের জন্য একটা শক্তিশালী অয়ারলেস সেটও দিতে হবে।’ ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শাফি বললেন, ‘যে কাজে তােমাকে পাঠাচ্ছি তাতে ভারী অস্ত্রের দরকার হবে না।’ জবাবে খালেদ বললেন, “যে গুরুত্বপূর্ণ কাজে তাকে পাঠানাে হচ্ছে তাতে ভারী অস্ত্রশস্ত্র দরকার। তাছাড়া অত দূর থেকে হেড কোয়ার্টারে কোন সাহায্য পাওয়ার আশা কম।’ এবার ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফি খিজির হায়াতকে যা প্রয়ােজন দেবার জন্য নির্দেশ দিলেন।
ইউনিটে এসে মেজর খালেদ এডজুটেন্ট ক্যাপ্টেন গাফফারকে ডেকে ব্যাটালিয়ন থেকে বেছে বেছে ভালাে ২৫০ জন সৈনিককে আলফা কোম্পানীতে দিতে বললেন। প্রয়ােজনবােধে একমাস যুদ্ধ করা যায় এমন পর্যাপ্ত গােলাবারুদ ও অস্ত্রশস্ত্র দেবারও নির্দেশ
দিলেন। মেজর খালেদকে ২৬টি গাড়ি দেয়া হল। সবকটি গাড়ি সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে তৈরি করতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। খিজির হায়াত ও ব্রিগেডের পাঞ্জাবী স্টাফ অফিসারদের এসব লক্ষ্য করতে দেখা গেল। ২৪শে মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার সময় মেজর খালেদ যাত্রা শুরু করলেন। যাত্রা শুরু করার আগে মেজর খালেদ ক্যাপ্টেন মতিনকে এক প্রান্তে ডেকে বললেন, ‘যদি কোন অঘটন ঘটে তাহলে চতুর্থ বেঙ্গলের বাকী সৈন্যের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবে। প্রয়ােজন হলে যুদ্ধ করে সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে আসবে এবং আমার সাথে যােগাযােগ করবে।’ শমসের নগর যাওয়ার পথে রাত আড়াইটার সময় মেজর খালেদের কনভয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের উপকণ্ঠে পৌছল। রাস্তায় অসংখ্য ব্যারিকেডের ফলে সামনে অগ্রসর হওয়া যাচ্ছিল না। শহরের উপকণ্ঠে ব্রীজের সন্নিকটে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছাত্র-জনতা বাধা দেয়। হাজার হাজার ছাত্র-জনতা কনভয়ের সামনে শুয়ে পড়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। বিদ্রোহী জনতা বলল, “দেশে পাকসেনাদের গুলির প্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় নির্দেশে সেনাবাহিনী চালচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদের ইচ্ছাকৃত ভাবে দূরে পাঠানাে হচ্ছে। সুতরাং আমরা আপনাদের যেতে দেব না।’ | বেশ কয়েক ঘন্টা এইভাবে কেটে গেল। এমন সময় মেজর শাফায়াত জামিল এসে উপস্থিত হলেন এবং উত্তাল ছাত্র-জনতাকে শান্ত হয়ে ব্যারিকেড সরিয়ে নিতে অনুরােধ জানালেন। জনতা কিছুতেই রাজী হল না।
উপায়ন্তর না দেখে মেজর খালেদ মেজর শাফায়াতের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ক্যাম্পে গেলেন। সেখানে স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বিস্তারিত আলাপ হল। মেজর খালেদ জানালেন, ‘বেঙ্গল রেজিমেন্ট বাংলাদেশের রেজিমেন্ট। প্রয়ােজনের সময় তারা বাঙালি। জাতির জন্য যুদ্ধ করবে।’ শেষ পর্যন্ত ভাের সাড়ে পাঁচটায় স্থানীয় নেতৃবৃন্দ বাধা না দিয়ে যেতে দিতে সিদ্ধান্ত নেন। | ২৫শে মার্চ সকালে মেজর খালেদ আবার শমসের নগরের দিকে যাত্রা শুরু করলেন। এবং বেলা এগারােটা নাগাদ শ্রীমঙ্গল পৌছলেন। সেখান থেকে শমসের নগর যাওয়ার রাস্তা জানা ছিল না। ব্রিগেড সদর দফতর থেকে মৌলভীবাজার হয়ে যেতে বলা হয়েছিল। স্থানীয় লােকদের জিজ্ঞেস করে জানা গেল মৌলভীবাজার হয়ে যাওয়া যেতে পারে। এই রাস্তার অবস্থা খারাপ হলেও দূরত্ব কম। মেজর খালেদ সােজা রাস্তা দিয়ে বেলা দু’টোর। দিকে শমসের নগর পৌছলেন এবং সেখানকার ডাক বাংলােতে ক্যাম্প করলেন। তিনি পাকা রাস্তা ছেড়ে কাচা রাস্তা দিয়ে গিয়েছিলেন বলেই রক্ষা পেয়েছিলেন। কারণ। মৌলভীবাজারে পাকা রাস্তার পাশে ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের একটি কোম্পানী এমবুশ। করার জন্য অপেক্ষা করছিল।
২৫শে মার্চ চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল নিম্নভাবে অবস্থান করছিল। এ-কোম্পানী-মেজর খালেদের নেতৃত্বে শমসের নগরে।
বি-কোম্পানী—ক্যাপ্টেন মতিনের নেতৃত্বে কুমিল্লা সেনানিবাসে। লেঃ আমজাদ সাইদ (পাকিস্তানী) কোম্পানী অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
সি-কোম্পানী—মেজর শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। লেঃ কবিরসহ (বাঙালি) কোম্পানী অফিসার ছিলেন।
ডি-কোম্পানী—লেঃ মাহমুদুল হাসানের (পাকিস্তানী) নেতৃত্বে।
এছাড়া ব্যাটালিয়ানটির এডজুটেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন ক্যাপ্টেন। গাফফার এবং কোয়ার্টার মাস্টার হিসেবে নিয়ােজিত ছিলেন ক্যাপ্টেন মাহমুদুল হাসান। একটি প্লাটুন সুবেদার জলিলের নেতৃত্বে জাঙ্গালিয়া বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রে অবস্থান করছিল। | চতুর্থ ইস্টবেঙ্গলের চতুর্দিকে পাকসেনারা অবস্থান নিয়েছিল। এর আগে ১৭ই মার্চ কুমিল্লা সেনানিবাসে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলের মাঠে ব্রিগেড কমান্ডারের নির্দেশে এক ফুটবল  খেলার আয়ােজন করা হয়। বেঙ্গল রেজিমেন্টের সকল অফিসারকে এই খেলা দেখার জন্য উপস্থিত থাকতে বলা হয়। বস্তুতঃ এই খেলার মাঠে বাঙালি সৈনিকদের হত্যা করার পরিকল্পনা করা হয়। ক্যাপ্টেন গাফফারের নির্দেশে যে কোন পরিস্থিতি মােকাবেলার জন্য। বাঙালি সৈন্যরা প্রস্তুত ছিল বলেই পাকিস্তানীদের এই পরিকল্পনা কার্যকর হয়নি। কোন নির্দেশ ব্যাতিরেকেই রাতে পেট্রোল পার্টি ধরা পড়ে গেল। ক্যাপ্টেন গাফফার খিজির হায়াতের হস্তক্ষেপের ফলে গ্রেফতারের হাত থেকে বেঁচে যান।  ক্যাপ্টেন গাফফার বুঝতে পারলেন ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফি চতুর্থ ইস্টবেঙ্গলের কোম্পানীগুলাে দূরে পাঠিয়ে সিলেটে অবস্থানরত ৩১ পানুব রেজিমেন্ট, কুমিল্লা সেনানিবাসে অবস্থিত ২৪ ফ্রনটিয়ার ফোর্স এবং তৃতীয় কমান্ডাে ব্যাটালিয়ান নিয়ে আক্রমণ করে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলকে ধ্বংস করে দেবে। এই পরিস্থিতিতে ক্যাপ্টেন গাফফার ব্যাটালিয়নের বাকী অংশ নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাওয়া স্থির করেন।  লেঃ কর্নেল খিজির হায়াত ক্যাপ্টেন গাফফারকে পছন্দ করতেন। ক্যাপটেন গাফফার এই সুসম্পর্কের সদব্যবহার করলেন এবং ব্যাটালিয়নের বাকী অংশ ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাওয়ার ব্যাপারে তাকে সম্মত করালেন।  ২৫শে মার্চ বেলা ১টার মধ্যে ৩০ টা ৩ টন গাড়িতে বেশি পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র ও সব সৈন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হল। শুধুমাত্র ক্যাপ্টেন আইনুদ্দিন (যাকে চট্টগ্রাম। 
নবম বেঙ্গলে বদলি করা হয়েছিল) কুমিল্লা সেনানিবাসে রয়ে গেলেন। ২৮শে মার্চ ক্যাপ্টেন আইনুদ্দিন কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে পালিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলে যােগ দেন।এদিকে খালেদ মােশারফ ও লেঃ মাহবুব শমসের নগর পেীছে চারদিকে পেট্রোল পার্টি পাঠালেন। ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীর কোন খোঁজ পাওয়া গেল না। শমসের নগরে ইপিআর-এর দুটো কোম্পানী থাকার কথা ছিল—তাদের কোন খোঁজ পাওয়া গেল না। শমসের নগর চা-বাগানের পাকিস্তানী কর্মচারীরা ঢাকায় চলে গেল।
২৫শে মার্চ পেট্রোলিং করে কেটে গেল। খালেদ মােশাররফ ২৬শে মার্চ সকালে অয়ারলেসে সদর দফতরের সঙ্গে যােগাযােগ করতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল। এমন সময় শােনা গেল পাকিস্তানী সৈন্যরা শমসের নগর বাজারে কারফিউ জারী করেছে। একজন পাকঅফিসারের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেল মৌলভীবাজারে ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের এক কোম্পানী সৈন্য অবস্থান নিয়েছে। দু’দিন আগে এরা এখানে এসেছে অথচ খালেদকে এসব কিছু বলা হয়নি। মেজর খালেদের কাছে পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে জটিল মনে হতে লাগল। তিনি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন।  বিকেলে লােক মুখে শােনা গেল ঢাকায় পাকিস্তানীরা হত্যাকান্ড শুরু করেছে। হাজার হাজার বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছে। পাকিস্তানী ট্যাংক কামানসহ আধুনিক মারণাস্ত্র ব্যবহার করছে।
সদর দফতরের সঙ্গে অয়ারলেসে পুনরায় যােগাযােগ করার চেষ্টা করা হল। লেঃ মাহবুব অনেক চেষ্টার পর বিকেলে যােগাযােগ করতে সক্ষম হলেন। খালেদ কথা বললেন। খিজির হায়াত ও আহম্মদ কথা বললেন। খালেদ জানালেন পরিস্থিতি শান্ত। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ফিরে আসার জন্য অনুমতি চাইলেন। খিজির হায়াত অনুমতি দিলেন। এরপর ক্যাপ্টেন গাফফার ও শাফায়াত জামিলের সঙ্গে আলাপ হল। শাফায়াত জানাল যে, ঢাকায় পাকসেনাবাহিনী গণহত্যা শুরু করেছে। ২৬শে মার্চ সন্ধ্যায় এই আলাপ হচ্ছিল। সে আরাে জানাল যে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কারফিউ জারী করেছে। জনতা। কারফিউ ভঙ্গ করছে। চতুর্থ বেঙ্গলকে বিদ্রোহ দমন করতে বলা হচ্ছে। শাফায়াত জামিল খালেদের কাছে নির্দেশ চাইলেন। খালেদ নিরস্ত্র জনতার ওপর গুলিবর্ষণ করতে নিষেধ করলেন। খালেদ বললেন, ‘তুমি তৈরি থাক আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়া আসছি।’ | ২৫শে মার্চের সন্ধ্যার মধ্যেই কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে চতুর্থ বেঙ্গলের বাকী অংশ। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পৌছল। শুধুমাত্র মেজর খালেদ ও লেঃ মাহবুব ‘এ’ কোম্পানীসহ শমসের। নগরে অবস্থান করছিল। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ওয়াপদা কমপ্লেক্সে চতুর্থ বেঙ্গল তাঁবু ফেলেছিল। অধিনায়ক লেঃ কর্নেল খিজির হায়াত, মেজর সাদেক নেওয়াজ ও ক্যাপ্টেন গাফফার ওয়াপদা বিশ্রামাগারে অবস্থান করছিলেন।
সামনে পুকুর। পুকুরপাড়ে সাধারণ সৈন্যদের তাঁবু। বিশ্রামাগারের সন্নিকটে তিনটি পাশাপাশি তাঁবুতে মেজর শাফায়াত জামিল, লেঃ হারুন, লেঃ কবির বাস করছিলেন। বিশ্রামাগারের পাশে অয়ারলেস রাখা হয়েছিল একটি তাঁবুতে। তিনজন অয়ারলেস অপারেটরের মধ্যে মাত্র একজন বাঙালি ছিলেন। এর পর লেঃ আমজাদ সাইদের তাবু। লেঃ হারুনের তাবুর সামনে ক্যাপ্টেন মতিন তবু ফেললেন। মার্চের ১০ তারিখে সিলেটে অবস্থিত ৩১ পাঞ্জাবের সৈন্যদের রেশন পাঠানাের কনভয় কমান্ডার করে সিলেট পাঠানাে হয়েছিল। তাঁকে আর আসতে অনুমতি দেয়া হয়নি। পরবর্তীকালে পরিস্থিতির চাপে ১৮ই মার্চ মেজর শাফায়াত জামিলকে বাহ্মণবাড়িয়া আসতে অনুমতি দেয়া হয়। বাঙালি সৈন্যদের থেকে শাফায়াত জামিলকে বিচ্ছিন্ন করাই এর উদ্দেশ্য ছিল। ২৫শে মার্চের রাত। রাত তখন এগারােটা বেজে কয়েক মিনিট । স্থানীয় রাজনৈকি নেতা লুৎফুল হাই চতুর্থ বেঙ্গলের ক্যাম্পে এসে লেঃ হারুনের সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন। সেন্ট্রি এসে লেঃ হারুনকে জানাল লুৎফুল হাই তার সঙ্গে দেখা। করতে চায়। ততক্ষণে খিজির হায়াত লুৎফুল হাইকে বলেছে ঢাকায় প্রচন্ড সংঘর্ষ এবং গােলমাল হয়েছে। লেঃ হারুণ বিচলিত হয়ে উঠলেন এবং বলতে গেলে সারারাত তিনি ঘুমােতে পারলেন না।
২৫শে মার্চ রাত ১২টার সময় খিজির হায়াত ‘সি’ কোম্পানীর অধিনায়ক মেজর শাফায়াত জামিলকে তার কোম্পানী নিয়ে শাহবাজপুর দূরে সরিয়ে দেয়াই এর উদ্দেশ্য ছিল। ডি’-কোম্পানীকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে কারফিউ জারী করতে নির্দেশ দেয়া হল। ‘বি’-কোম্পানীকে রিজার্ভ হিসেবে ক্যাম্পেই রাখা হল।  ২৬শে মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে ও উপকণ্ঠে উপস্থিত জনতা সমবেত হতে লাগল। ঢাকা ও কুমিল্লা থেকে পলায়নরত জনতা ঢাকায় গণহত্যার খবর দিল। এই উত্তেজনার পরিস্থিতিতে একজন সিনিয়র বাঙালি অফিসার দরকার হতে পারে এই ভেবে খিজির হায়াত এইদিন বিকেলে মেজর শাফায়াত জামিলকে পুনরায় তার কোম্পানী নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে আসতে বললেন। অবশ্য ২৬শে মার্চ সকাল থেকে ছাত্রনেতা (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন) জাহাঙ্গীর ওসমান রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের হয়ে তার সঙ্গে যােগাযােগ রাখছিল। একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এসে গেছে। কোন সুষ্ঠ রাজনৈতিক নির্দেশের অনুপস্থিতিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পরিধির মধ্যে থেকে বিদ্রোহ করার সিদ্ধান্ত নেয়া সহজসাধ্য ছিল না। ঢাকার গণহত্যার খবর ছড়িয়ে পড়া সত্বেও দেশের অন্যান্য স্থানে বাঙালি ভূমিকা তখনাে স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি।
২৭শে মার্চ সকাল সাতটার সময়ে তিনজন এনসিও সহিদ, মুনির ও বেলায়েত এসে। মেজর শাফায়াত জামিলের সাথে দেখা করল। লেঃ হারুন ও কবির সেখানে উপস্থিত ছিলেন। এই তিনজন এনসিও মেজর শাফায়াত জামিলকে একটা সিদ্ধান্ত নিতে অনুরােধ জানাল। তাঁরা বলল যদি কোন সিদ্ধান্ত না নেয়া হয়, তাহলে সাধারণ সৈনিকেরা অস্ত্রসহ ক্যাম্প ছেড়ে চলে যাবে—কারণ মা, বােনের ইজ্জত রক্ষাই যদি না করা যায় তাহলে। সেনাবাহিনীতে চাকরি করে কি লাভ? শাফায়াত জামিল তাদেরকে শান্ত হতে বললেন এবং একদিন অপেক্ষা করতে বললেন। তাঁরা একদিন অপেক্ষা করতে রাজী হয়ে চলে গেলেন।  মেজর শাফায়াত জামিল গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন। একটা কিছু করা দরকার। জাতির মহাক্রান্তিলগ্নে চুপচাপ বসে থাকা যায় না। কি করা যায়, কিভাবে করতে হবে। এইসব চিন্তা তার মাথায় ঢুকে ঘুরপাক খেতে লাগল। যদি বিদ্রোহ না করা যায় সেক্ষেত্রে বাঙালি অফিসারগণ বন্দি হবে অথবা তাদেরকে হত্যা করা হবে। মেজর শাফায়াত বিদ্রোহ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তখন সকাল সাড়ে সাতটা। তিনজন এনসিও বিশ্রামাগারের তিন কোণায় অস্ত্রসহ দাঁড়াল। লেঃ হারুনকে পাঠানাে হল অয়ারলেস তাঁবুতে। হারুন বাঙালি অপারেটরকে নির্দেশ দিল মেজর খালেদকে এই মর্মে মেসেজ পাঠাতে যে চতুর্থ বেঙ্গল বিদ্রোহ করেছে। আর শাফায়াত জামিল সােজা বিশ্রামাগারের ভিতরে প্রবেশ করলেন। খিজির হায়াত ও সাদেক নেওয়াজ তখন ডাইনিং টেবিলে প্রাতঃরাশ শেষে বসে আলােচনা। করছিলেন। হারুন যখন বাঙালি অপারেটরের সঙ্গে কথা বলছিলেন তখন আমজাদ সাইদ শুনে ফেলে এবং দৌড়ে বিশ্রামাগারে চলে আসে খিজির হায়াতকে বলার জন্য। হারুন কাল বিলম্ব না করে বিশ্রামাগারের ভেতরে প্রবশে করলেন। | মেজর শাফায়াত জামিল শান্ত অথচ দৃঢ়কণ্ঠে বললেন, ‘চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল বিদ্রোহ করেছে।
আমরা এখন আর পাকিস্তানী সৈন্য নই, আপনারা যদি কোন গােলমাল না করেন তাহলে আমি আপনাদের জীবনের নিশ্চয়তা দিচ্ছি।’ সাদেক নেওয়াজ তার ব্যক্তিগত অস্ত্র নেয়ার জন্য মুখ ঘােরাতেই দেখল সশস্ত্র লেঃ হারুন ও লেঃ কবির শাফায়াত জামিলের দু’পাশে দন্ডায়মান। প্রসঙ্গত উল্লেখযােগ্য যে লেঃ হারুনের নির্দেশে মেজর সাদিক নেওয়াজের এসএমজির ফায়ারিং পিন তার বাঙালি ব্যাটম্যান সরিয়ে ফেলেছিল।  বন্দি খিজির হায়াত, সাদেক নেওয়াজ ও আমজাদ সাইদকে বিশ্রামাগারের সামনে একটা খালি তাঁবুতে নিয়ে যাওয়া হল। মাত্র দুটো চেয়ার ছিল। খিজির হায়াত ও সাদেক নেওয়াজকে চেয়ারে বসতে দেয়া হল এবং আমজাদ সাইদকে মাটিতে বসতে বলা হল। এই সময় সুবেদার মেজর ইদ্রিস খিজির হায়াতকে সাধারণ সৈন্যদের কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। এতে সাধারণ সৈন্যদের মধ্যে দ্বিধার সৃষ্টি হত। খিজির হায়াত চেয়ার থেকে উঠে যাওয়ার চেষ্টা করলে লেঃ হারুন তার এসএমজি খিজির হায়াতের বুক বরাবর ধরে বললেন, ‘এক পা অগ্রসর হলে আমি গুলি করতে বাধ্য হব।’ ভীত সন্ত্রস্ত খিজির হায়াত বসে পড়লেন।
পরবর্তীকালে খিজির হায়াত ও অন্যান্য পাকিস্তানী অফিসারদের ভারতীয় কর্তৃপক্ষের হাতে জীবিত অবস্থায় হস্তান্তর করা হয়। লেঃ হারুন ও লেঃ কবিরকে বন্দিদের ভার দিয়ে মেজর শাফায়াত জামিল সৈন্যদের কাছে গেলেন বিদ্রোহের কথা জানাতে। এমন সময় স্টাফ কোয়াটারের ওপর থেকে একজন বাঙালি বন্দুক দিয়ে ওপরের দিকে গুলিবর্ষণ করে বিদ্রোহের সপক্ষে শ্লোগান দিতে লাগল।  কয়েক মিনিটের মধ্যে হাজার হাজার মানুষ সমবেত হল-এবং এদের মুহূর্তের গগণবিদারী শ্লোগানে আকাশ বাতাশ প্রকম্পিত হল। বাঙালি জনগণ ও সৈনিক যেন এই মুহূর্তটির জন্যই অপেক্ষা করছিলেন।  শাফায়াত জামিল লেঃ কবিরকে পাঠালেন স্থানীয় পুলিশদের জানাতে আর হারুনকে। পাঠালেন মহকুমা প্রশাসককে খবর দিতে।  খালেদ মােশারফকে মেজর শাফায়াত জামিল অয়ারলেসে বিদ্রোহের কথা জানালেন। খালেদ মােশাররফ বললেন, ‘তুমি অপেক্ষা কর, আমি আসছি।’ বেলা দুটো নাগাদ মেজর খালেদ তার কনভয়সই ব্রাহ্মণবাড়িয়া এসে পৌছলেন।
মেজর খালেদ চতুর্থ বেঙ্গলের অধিনায়কত্ব গ্রহণ করলেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে পশ্চিমে ঢাকা থেকে পাকসেনাদের গতিরােধ করার জন্য ক্যাপ্টেন গাফফারকে ‘বি’ কোম্পানীসহ গােকনঘাটে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেয়ার জন্য পাঠান হল। ‘ডি’ কোম্পানী উজানির ব্রীজ এলাকায় প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করল লেঃ হারুনের নেতৃত্বে কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে সম্ভাব্য পাকিস্তানী আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য। ঐ রাতে পেট্রেলিংরত অবস্থায় পাকিস্তানী অফিসার লেঃ মাহমুদুল হাসান নিহত হল লেঃ হারুনের বাহিনীর হাতে। ‘এ’ কোম্পানী ও ‘সি’ কোম্পানীকে সিলেটে অবস্থিত ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টকে মােকাবেলা করার জন্য মােতায়েন করা হল। খালেদ মােশাররফ তেলিয়াপাড়ায় তার সদর দফতর স্থাপন করলেন। বাংলাদেশের গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে তখন বিদ্রোহের আগুন দাবানলের মতাে ছড়িয়ে পড়ল। দেশপ্রেমিক জনগণ, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র-জনতা ও বাঙালি সৈনিকেরা অসীম সাহসিকতায় অমিত তেজ দুর্জয় প্রতিরােধ গড়ে তুলল। 

সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত