অক্টোবরে ৯ তারিখে সড়ক এবং রেল যােগাযােগ বিচ্ছিন্নকারী দলটি প্রত্যেকের নির্দিষ্ট কাজের নির্দেশ নিয়ে সন্ধ্যার পর রওনা হল। গােপনে ও অতিসন্তর্পণে এই দলটিকে উলিপুর এবং চিলমারীর মাঝামাঝি স্থানে ঘাঁটি স্থাপন করে মূল আক্রমণ শুরু না হওয়া পর্যন্ত আত্মগােপন করে থাকতে হবে। ১১ই অক্টোবর মূল বাহিনী চিলমারীর উদ্দেশ্যে রওনা হল। অনেকগুলাে দেশি নৌকা তাদের বহন করে এগিয়ে চলল। একসাথে এতগুলাে দেশি নৌকার ব্যবস্থা করা ও তাদের বিভিন্ন অবস্থান থেকে গােপনে একই সময়ে শত্রু ঘাটির কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া সেই সময়ে বড় কঠিন ব্যাপার ছিল। কমাণ্ডার। আবুল কাসেম চাঁদ, ঢাকা প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এ ব্যাপারে এগিয়ে এসে অপর সমস্ত ব্যবস্থা সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন করল। রাতের অন্ধকারে দূরপাল্লার কামানগুলাে স্থাপন করা হল। এই ভারী অস্ত্রগুলােকে নৌকা থেকে নামিয়ে বালুচরের উপর দিয়ে টেনে নিয়ে নির্ধারিত স্থানে স্থাপন করা যে কি বিপদজনক এবং কঠিন ছিল তা লিখে বুঝানাে যায় না। স্বাধীনতা যুদ্ধের আর এক অসমসাহসী সৈনিক নায়েক সুবেদার মান্নান। তার উপরে ন্যস্ত ছিল ওয়াপদা ভবন ধ্বংস করার দায়িত্ব। ওখানে পাকিস্তানী অফিসাররা প্রমোেদ বিলাসে মত্ত ছিল। তাহেরের সঙ্গী মুক্তিবাহিনীর মাত্র দুটি রকেট লাঞ্চ তাদের সঙ্গে ছিল। কমাণ্ডার চাদের নেতৃত্বে বিভিন্ন দল গােরগাছা, রাজভিটা, থানাহাট পুলিশ স্টেশন এবং ব্রীজ অবস্থান আক্রমণের জন্য নির্দিষ্ট হল। এদের অর্ধেকের সাথে ছিল ৩০৩ রাইফেল, কিছু পুরনাে। স্টেনগান আর বাকিদের কাছে শুধুমাত্র গ্রেনেড। মূল বাহিনীর এই ছােট ছােট দলগুলাের নেতৃত্ব দিচ্ছিল খালেদুল, সুলতান, নূর আহমেদ আলাে আর নজরুল। বলবাড়ি পুলিশ স্টেশনের জন্য কোন দল পাঠানাে হয়নি।
কারণ তাহের ও তার সঙ্গী মুক্তিবাহিনীর জানা ছিল শত্রুসেনারা রাতে সেই অবস্থান ছেড়ে চলে এসেছে। আক্রমণ পরিচালনার জন্য চালিয়া পাড়ায় তাহের ও তার সঙ্গী মুক্তিযােদ্ধারা হেড কোয়টিার স্থাপন করলেন। চিলমারীর দুই মাইল দক্ষিণে গাজীর চরকে আক্রমণকারী বাহিনীর আক্রমণের পূর্ব মুহূর্তের ঘাঁটি হিসেবে বেছে নেয়া হল রাত গভীর। ১টার সময় খবর এল তাহেরের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী আক্রমণ স্থলের নিকটবর্তী ঘাঁটিতে পৌঁছে গেছে এবং যার যার নির্দিষ্ট আক্রমণ স্থলের উদ্দেশ্য যাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছে। গ্রাউণ্ড সিট বিছিয়ে কর্নেল তাহের ঘুমিয়ে পড়লেন। রাত সাড়ে তিনটায় তাহেরকে জানান হল কিছুক্ষণের মধ্যেই তাহেরের নেতৃত্বাধীন মুক্তিসেনা ঝাপিয়ে পড়বে। রাত চারটা। খুব কাছে থেকে রকেট লাঞ্চার দিয়ে ওয়াপদা ভবনের আঘাত হানার সাথে সাথে সবত্মিক আক্রমণ শুরু হল। সমস্ত শত্রু ধ্বংসযজ্ঞ নেমে এল। দূরপাল্লার কামানগুলাে শক্রসেনাদের গান বােটগুলাের সম্ভাব্য অবস্থানের উপর গোলাবর্ষন করে চলেছে। কামানের গােলা, গ্রেনেড, মেশিনগান আর ছােট অস্ত্রের আওয়াজে রাতের নিস্তদ্ধতা ভেঙ্গে যেতে লাগল। সকাল ৬ টার মধ্যে গােরগাছা, রাজভিটা, পুলিশ স্টেশন ও ব্রীজের অবস্থানগুলাে তাহেরের বাহিনীর আয়ত্বে এল । কিন্তু ওয়াপদা ভবনের আশপাশের কংক্রীট বাংকারে শত্রুসেনাদের অবস্থান নজরে পড়ল। তাহেরের সঙ্গী মুক্তিযােদ্ধাদের একমাত্র নির্ভর রকেট লাঞ্চার দুটি শক্র বাংকার গুলিকে নির্মূল করতে পারল না বটে, তবে ওয়াপদা ভবনে অবস্থানরত প্রচুর শত্রুসেনা খতম করতে সক্ষম হন। শুধুমাত্র দুটি অস্ত্রের উপর নির্ভর করায় তাহেরের সঙ্গী মুক্তিসেনারা শত্রুর এই অবস্থানটি দখল করতে সক্ষম।
হলেন না। যেহেতু সম্পূর্ণভাবে শক্রকে ধ্বংস করা গেল না, তাই শক্রকে তাদের ঘাঁটিতে আটক রাখার জন্য তাহেরের বাহিনীকে তাদের অবস্থান আঁকড়ে থাকতে হল। কারণ একমাত্র রাতের অন্ধকারেই সফল পশ্চাদপসরণ সম্ভব। সকাল ৮টা। তাহেরের কাছে খবর এল চাঁদ আরাে সাহায্য চাচ্ছে। মনে হল অবস্থা সংকটজনক। সে লক্ষ্য করেছে। বলবাড়ি রেল স্টেশন থেকে শক্রসেনার নতুন আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাহের ছােট্ট স্পীডবােডটি নিয়ে নদী পার হয়ে চালিয়াপাড়া থেকে গাভীর চরে গিয়ে পৌঁছলেন। সেখানে গিয়ে তাহের দেখলেন স্কোয়াড্রন লিডার হামিদুল্লাহ বন্দিদের কাছ থেকে খবর বার করার চেষ্টা করছেন। তার ব্যবস্থাপনা মন্দ ছিল না। যাওয়ার সাথে সাথে তাহেরকে এককাপ গরম চা দেওয়া হল। তাহের জানতে পারলেন চাঁদকে সাহায্য পাঠানাের মতাে কোন বাড়তি দল রাখা হয়নি। তৎক্ষণাৎ তাহের তার ছােট্ট রক্ষাকারী বাহিনী নিয়ে থানা অভিমুখে এগিয়ে গেল। ভাগ্যক্রমে তাহেরের একটি এলএমজি ছিল। এই অস্ত্রটি সেদিন তাহের ও তার সঙ্গী মুক্তিবাহিনীর ভীষণ উপকারে আসে। নানাদিক থেকে মাঝে মধ্যেই গােলাগুলি চলছিল। গ্রামবাসীরা যে যেদিকে পারছিল দৌড়াচ্ছিল। কেউ কেউ ‘জয় বাংলা ‘জয় বাংলা’ বলে চিৎকার করছিল। থানার এক মাইলের মধ্যে চলে এসে রাস্তায় ফেলে যাওয়া একটি গরুর গাড়ি রাস্তার মাঝখানে পেলেন তাহের। গাড়িতে শুয়েছিল একজন মেয়েলােক। একটা হাত ভাঙ্গা, বুকের স্তন নেই। পাকিস্তানী মর্টার শেলের শিকার। তার বাচ্চা ছেলেটি মায়ের রক্তে মাখা, বসে বসে কাঁদছে। এই নিস্পাপ শিশুটি তার মাকে ছেড়ে যেতে পারেনি। একজন গ্রামবাসীকে ডেকে জানা গেল মেয়েটিকে হাসপাতালে নেয়া হচ্ছিল।
থানার পাশেই হাসপাতাল। আর ঐ দিক থেকেই গুলি আসছে। তাই তাকে | ছেড়ে সবাই পালিয়েছে। তাহের ঐ লােকটাকে গাড়ি চালিয়ে তাদের সাথে আসতে বললেন। তাহের ও তার সঙ্গী মুক্তিযােদ্ধারা থাকায় লােকটি আসতে সাহস পেল। হাসপাতালে যখন পৌছালাম গুলিবর্ষণ তখন আরাে তীব্রতর হয়েছে। ঝাকে ঝাকে। মেশিনগানের গুলি হাসপাতালের ভেতরে। ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায় ডাক্তারকে পেলাম । তাহের সেই হতভাগ্য মেয়েলােকটির ভার ডাক্তারের উপর ছেড়ে দিলেন। হতভাগ্য মেয়েটি বেঁচে আছে কিনা কে জানে! হাসপাতাল থেকে বের হয়েই তাহের দেখতে পেলেন চাঁদ দৌড়ে আসছে তার দিকে। সে কাঁদছিল। তাহেরকে জানাল, তার দল ৭৬টি দখল করা অস্ত্র, প্রচুর গােলাবারুদ ফেলে থানার অবস্থান ছেড়ে চলে এসেছে। তাকে উৎসাহ দিয়ে তাহের এগিয়ে গেলেন পূর্ব অবস্থান পুনর্দখলের জন্য। মেশিনগানের একঝাঁক গুলি। তাহের ও তার সঙ্গী মুক্তিযােদ্ধাদের মাথার উপর দিয়ে চলে গেল। তাহের দেখতে পেলেন পাকিস্তানী সৈন্যরা প্রায় ১০০ গজ দূরে রেললাইনের উপর অবস্থান নিয়েছে। বাঁশঝাড়ের আড়ালে আড়ালে তাহের ও সঙ্গী মুক্তিযােদ্ধারা এগিয়ে গেলেন এবং শত্রুবাহিনীর এক পাশে তাহেরকে রক্ষাকারী মুক্তিসেনারা এলএম জিটি স্থাপন করলেন। এক নাগাড়ে গুলি করার পর কিছু পাকিস্তানী সেনা পড়ে গেল।
বাকিরা তাদের অবস্থান ছেড়ে রেললাইনের উপরে চলে গেল। তড়িৎ গতিতে তাহের ও তার সঙ্গী মুক্তিযােদ্ধারা রেললাইন দখল করলেন। গুলি চালিয়ে আরাে কিছু পাকিস্তানী বাহিনীকে খতম করা হল। কিছুক্ষণ পরই বলবাড়ি স্টেশনের অবস্থান থেকে শত্রুসেনারা তাহেরের বাহিনীর উপর গুলি। চালাল। তাহের ও তার সঙ্গী মুক্তিযােদ্ধারা পিছু হটে ষ্টেশনে অবস্থান নিলেন। সেখানে পাকিস্তানীদের তৈরি পরিখার অভাব ছিল না। বেশ কিছুক্ষণ পর তাহের একজন বৃদ্ধ লােককে পেলেন। তাহের তাকে দরকার থাকলে কিছু চাউল নিয়ে যেতে বললেন। কিছুক্ষণের মধ্যে চারদিক থেকে লােকজন আসতে লাগল। হট্টগােল শুরু হয়ে গেল । ছেলে, বুড়াে, পুরুষ, মেয়েলােক সবাই কাড়াকড়ি করছে চাল তুলে নেয়ার জন্য। কয়েক মিনিটের মধ্যেই থানা ও থানার পাশের বাসাগুলাে খালি হয়ে গেল। এদৃশ্য ভােলার নয়।
রাতের অন্ধকার নেমে আসছে। সাথে সাথে তাহের কিছু সংখ্যক মুক্তিযােদ্ধা রেখে। প্রধান দলটি নিয়ে পাড়ির চরে চলে গেলেন। কিছু সংখ্যক মুক্তিযােদ্ধা রেখে আসার উদ্দেশ্য ছিল যাতে পাকিস্তানীরা তাহেরের পিছু নিতে না পারে। যদিও তাহের ও তার সঙ্গীরা ভবনের বাংকারগুলাে এবং বলবাড়ি রেলওয়ে স্টেশনের অবস্থান সম্পূর্ণ ধ্বংস করতে পারেননি, তবুও পাকিস্তানী সেনাবাহিনী দারুণ ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। অতি । নিকট থেকে সম্পূর্ণভাবে ঘেরাও হয়েও শত্রুসৈন্যরা আত্মসমর্পন করেনি। সত্যিই তারা । বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিল। তাহের ও তার সঙ্গী মুক্তিযােদ্ধারা জানতেন তারা চলে আসার পর ঐ এলাকার জনসাধারণের উপর পাকিস্তানীরা কি ভয়াবহ অত্যাচার চালাবে। কিন্তু পেছনে ব্রহ্মপুত্র নদীর বাধা নিয়ে তাহের ও তার সঙ্গীদের পক্ষে দখল করা অবস্থান আঁকড়ে থাকা সম্ভব ছিল না। এই আক্রমণ এর উদ্দেশ্যেই ছিল শত্রুকে অকস্মাৎ আঘাত হানী, যত বেশি সম্ভব শক্রসেনা খতম করা, তাদের মনােবল ভেঙ্গে দেওয়া, অস্ত্র ও গােলা বারুদ দখল করা। তাহের ও তার সঙ্গী মুক্তি সেনারা সম্পূর্ণ সফল হয়েছিলেন। তাহের ও তার সঙ্গী মুক্তিযােদ্ধারা চলে আসার পর পাকিস্তানীরা ঐ এলাকায় নিরীহ, নিরস্ত্র গ্রামবাসীদের উপর নির্মম অত্যাচার চালায়। নিরস্ত্র জাতি এমনিভাবে অত্যাচার সহ্য। করেই বাংলার স্বাধীনতা এনেছে।
ওয়ারেন্ট অফিসার সফিউল্লার নেতৃত্বে যােগাযােগ বিচ্ছিন্নকারী দলটি অভূতপূর্ব। সাফল্যের সাথে তাদের কাজ সম্পন্ন করে। তারা শুধু সড়ক এবং রেলপথের ব্রীজগুলাে ভেঙ্গে দিয়েই শান্ত হয়নি, জায়গায় জায়গায় রেলওয়ে লাইন এবং রাস্তা কেটে তারা সমান করে দেয়। বেশ কিছুদিনের জন্য এই যােগাযােগ ব্যবস্থা পাকিস্তানীরা ব্যবহার করতে। পারেনি। ১৩ই অক্টোরব। বিপুল সংখ্যক যুদ্ধবন্দি এবং প্রচুর অস্ত্র গােলাবারুদ নিয়ে তাহের ও তার সঙ্গী মুক্তিবাহিনীরা রৌমারী ফিরে যান। জনগণের আদালতে ওয়ালী মাহমুদ ও পাচু মিয়ার বিচার হল। দেশ প্রেমিক হত্যা, রাজাকার বাহিনীর সংগঠন এবং লুণ্ঠনের অপরাধে। তারা দোষী সাব্যস্ত হয় এবং তাদের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হল। বহু সংখ্যক বাঙ্গালি রাজাকার মুক্তিযুদ্ধে যােগদান করে। ওয়ারেন্ট অফিসার সফিকউল্লাহ, নায়েব সুবেদার মান্নান, চাঁদ, দুলু, আলাে, নায়েক সুবেদার এবং আরাে অনেকের বীরত্ব এবং ত্যাগের কথা কোনদিনই ভােলা যাবে না। এরাই বাংলার সােনার ছেলে।
সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত