বাংলার বাণী
৪ঠা মে, শুক্রবার, ১৯৭৩, ২১শে বৈশাখ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
সময় থাকতেই সজাগ হওয়া ভালো
একটা নৈরাজ্যের মুখে যেন আমরা দিনের পর দিন এগিয়ে চলেছি। স্বাধীনতা উত্তরকালে যে আশা এবং উদ্দীপনা নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ শান্তি সমৃদ্ধি এবং প্রগতির পথে অগ্রসর হবার সংকল্প নিয়েছিলো একটা সংঘবদ্ধ ষড়যন্ত্রের চাপে তা আজ অনেকটা নিষ্প্রভ হয়ে পড়েছে। একথা অস্বীকার করবার আর কোন উপায় নেই যে, স্বাধীনতা আমাদের সামনে যে প্রতিশ্রুতি রেখেছিলো সামাজিক অর্থনৈতিক ক্রিয়াকর্ম তা থেকে ইতিমধ্যেই বেশ কিছুটা দূরে সরে গেছে। আর এই দূরে সরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে যারা মূল ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে তাদের প্রতিরোধ বা উৎখাত করার ব্যাপারে সরকারী কার্যকারিতা যথেষ্ট মনে করবার কারণ এখনো ঘটেনি।
বহুবার আমরা বলেছি সরকারী নীতি প্রণয়ন এবং তার বাস্তবায়ন এক কথা নয়। সরকারী নীতিতে অনেক ভালো ভালো কথা থাকতে পারে, কিন্তু তা যতদিন কার্যকরী না হচ্ছে ততদিন তার সুফল জনগণের কাছে পৌঁছবার কথাই উঠতে পারে না। সমাজতান্ত্রিক স্পিরিট নিয়ে আমরা কলকারখানা রাষ্ট্রায়ত্ত করেছিলাম কিন্তু সেই সামাজিক সম্পদকে আমরা জনগণের স্বার্থে এখনো ব্যবহার করতে পারিনি। সরকারের অনুমোদন নিয়েই যে সমাজতন্ত্র বিরোধী শক্তি এই কলকারখানা পরিচালনার দায়িত্ব লাভ করেছিলেন তাদেরই কূটকৌশলে কল-কারখানার যন্ত্রপাতি পাচার হয়েছে, কাঁচামাল আমদানীর নামে লক্ষ লক্ষ টাকার বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশের ব্যাংকে জমা হয়েছে আর উৎপাদন হ্রাসের ফলে জনসাধারণের বৃদ্ধি পেয়েছে দুর্ভোগ। আজ তাই ন্যায়তঃই আমাদের বিশ্বাস করবার কারণ ঘটেছে, যে আন্তরিকতা ও আদর্শবোধ থেকে সরকার বিভিন্ন প্রগতিশীল কর্মসূচী প্রণয়ন করেছিলেন তা বাস্তবায়নে সরকার তেমন নিষ্ঠা ও কর্মোদ্যমের পরিচয় দিতে সক্ষম হননি।
কালকের কাগজে পাট কর্পোরেশন ও পাট বোর্ডের একশ্রেণীর আমলার দেশের স্বার্থবিরোধী কার্যকলাপের যে সংবাদ বেরিয়েছে তা রীতিমতো উদ্বেগজনক। বাংলাদেশের পাট সম্পদকে ধ্বংস করে দেবার জন্য পাকিস্তানী ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এদের আঁতাত উলঙ্গভাবেই এই সকল গণদুশমনদের আসল চেহারা উদ্ঘাটিত করেছে। এতো অনেকের মধ্যে মাত্র একটি দৃষ্টান্ত। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর ভিজিলেন্স টিমের চক্ষু এড়িয়ে এমন অনেক কীর্তিমানের বিদেশে পাড়ি জমানোর ঘটনাও বিরল নয়। আমাদের প্রশ্ন হলো, এরা কাদের শক্তিতে ভর করে বাংলাদেশে নানা ষড়যন্ত্রমূলক কার্যকলাপ অব্যাহত রাখার দুঃসাহস দেখায়? সরকার কি এদের কাছে এতই অসহায়? সাড়ে সাত কোটি মানুষ এক বাক্যে যাদের পেছনে সকল শক্তি নিয়ে দন্ডায়মান তাদের অন্ততঃ এত দুর্বলতা প্রদর্শন সাজে না। জনগণের দুর্ভোগের কথা স্মরণ রেখেও সরকারের এখন অধিকতর সজাগ হওয়া উচিত।
খাদ্য সমস্যার বাস্তব সমাধান প্রয়োজন
জাতিসংঘের মহাসচিব ডঃ কুর্ট ওয়াল্ড হেইম গত পরশুদিন বাংলাদেশের সাহায্য তৎপরতা সম্পর্কে এক রিপোর্ট প্রকাশ করেছেন। রিপোর্টে তিনি বাংলাদেশের আশঙ্কাজনক খাদ্য ঘাটতি সম্পর্কে কতকগুলো প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের কথা উল্লেখ করেছেন। আগামী শরৎকালীন ফসল উঠার পূর্বে যথোপযুক্ত খাদ্য মওজুত করার জন্য তিনি আহ্বান জানিয়েছেন। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞদের উল্লেখিত এই রিপোর্ট অনুযায়ী ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের জন্যে পাঁচ লক্ষ টন খাদ্য আমদানী করতে হবে। সরকার বারো লাখ টন খাদ্যশস্য আগামী মার্চ মাসের মধ্যে ক্রয় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ইতিমধ্যে বিভিন্ন দেশ থেকে ছয় লাখ টন খাদ্যের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় অর্থনৈতিক গোষ্ঠী, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, জাপান ও নেদারল্যান্ড থেকে খাদ্য সংগ্রহের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। জাতিসংঘের মহাসচিবের রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশ বিগত ১৯৭৩ সালের জানুয়ারীর মধ্যে বাইরের বিভিন্ন দেশ থেকে একশত আটত্রিশ কোটি ডলার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি পেয়েছে বলে জানা গেছে। মহাসচিবের রিপোর্ট মোতাবেক বাংলাদেশের আসন্ন খাদ্য সমস্যা সমাধানের যে পরিকল্পনার কথা জানা গেছে তাতে আশ্বস্ত হবার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। তদুপরি সমস্যা এতো বেশী প্রকট যে, যে কোন আশ্বাসই দেশের সাধারণ মানুষের কাছে আর আবেদন জাগাতে পারছে না। দেশের খাদ্য সংকট কাটিয়ে উঠতেই হবে। এর জন্যে সরকারকে যতদূর সম্ভব দেশ বিদেশের কাছে যেতে হবে। এবং ঘাটতি পূরণের জন্যে খাদ্য সংগ্রহ করতে হবে। জরুরী ভিত্তিতে খাদ্য ঘাটতি পূরণ করে সরকারকে উৎপাদনের উপর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। পরমুখাপেক্ষী হয়ে জাতি তার স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে পারে না। আমাদের মতো অনুন্নত দেশ শুধুমাত্র খাদ্য সমস্যা সমাধানের জন্যে নিজেকে বিকিয়ে দিতে পারে না বিদেশী শক্তির কাছে। কেননা, আমাদের দেশে যে প্রচুর সম্পদ রয়েছে তার যোগ্য ব্যবহার হওয়া দরকার। সমস্ত সম্পদ ব্যবহৃত হলে দেশের কোন সমস্যাই আর অসমাধান থাকতে পারবে না। দেশে কৃষি উৎপাদনের যে বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে তাকে অবশ্যই কাজে লাগাতে হবে। অনিশ্চিত সময়ের জন্যে জাতিকে খাদ্য সংকটের মধ্যে নিপতিত রাখা যায় না। দেশের কৃষিখাত থেকে যে উৎপাদন হবে তাতে গোটা জনশক্তির চাহিদা পূরণ হতে পারে। জাতিসংঘের মহাসচিবের বক্তব্য অনুযায়ী খাদ্য সমস্যার আপাতঃ সমাধান হলেও স্থায়ী সমাধানের জন্যে আমাদের কৃষিখাতে অধিক উৎপাদনের বাস্তব পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। এবং তা হলেই সম্ভব দেশের খাদ্য পরিস্থিতির সঙ্গে মোকাবেলা করা।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক