বাংলার বাণী
ঢাকা: ১৭ই অক্টোবর, বুধবার, ৩০শে আশ্বিন, ১৩৮০
বঙ্গবন্ধুর জাপান সফর
বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রীতি, শুভেচ্ছা ও মৈত্রীর বাণী নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজ জাপান সফরে যাচ্ছেন। জাপান সরকারের আমন্ত্রণে বঙ্গবন্ধু যাচ্ছেন সেখানে। এক সপ্তাহব্যাপী জাপানে অবস্থান কালে বঙ্গবন্ধু জাপানের প্রধানমন্ত্রী মিঃ কাকুই তানাকার তার সাথে আলাপ-আলোচনা করবেন ও সম্রাট হিরোহিতোর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করে মিলিত হবেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডঃ কামাল হোসেনও জাপান যাচ্ছেন।
বঙ্গবন্ধুর জাপান সফর এর তাৎপর্য ও গুরুত্ব রয়েছে অনেক। জাপান আজ এশিয়ার মধ্যে একটি সমৃদ্ধশালী দেশ। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর জাপানের জনসাধারণ ও সরকারের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সেখানে অভাবনীয় অর্থনৈতিক উন্নতি সাধিত হয়েছে। আজকের এই সমৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক ভিত্তি নির্মাণে জাপানের জনগণকে বিপুল অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে হয়েছে। সেই অতীত ও বর্তমান অভিজ্ঞতা যে কোনো অনুন্নত দেশের অগ্রগতির পক্ষে সহায়ক হতে পারে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর জাপান বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এসেছে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে সাহায্য করতে। জাপানি জনসাধারণও বাংলাদেশের অগ্রগতি কামনা করে।
একথা আজ আর কারো অজানা নয় যে, পাকিস্তানি জল্লাদ বাহিনী বাংলাদেশকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়ে গেছে। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে পঙ্গু করে দিয়ে গেছে সোনার বাংলাকে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পূনর্গঠনের জন্য আজ বাংলাদেশের প্রয়োজন অর্থনৈতিক ও কারিগরি সাহায্য-সহযোগিতা। জাপান আজ যে অর্থনৈতিক উন্নতির শিখরে অবস্থান করছে তাতে সে অনায়াসে প্রতিবেশী উন্নয়নকামী দেশগুলোর অর্থনৈতিক সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসতে পারে। আমরা যতদূর জানি জাপান বাংলাদেশকে সাহায্য করতে আগ্রহীও বটে। ইতিপূর্বে যমুনা নদীর উপর সেতু নির্মাণের প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে।
পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা বঙ্গবন্ধুর জাপান সফর এর ফলে উভয় দেশের বন্ধুত্ব আরো সুদৃঢ় হবে। এছাড়া জাপানি প্রধানমন্ত্রী এবং সরকারি অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আলোচনার ফলশ্রুতিতে জাপানের পক্ষ থেকে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পূনর্গঠনের জন্য সাহায্য সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি পাওয়া যাবে। বঙ্গবন্ধুর জাপান সফর সুন্দর হোক সার্থক হোক এই কামনা করছি।
মধ্যপ্রাচ্যেও সাম্রাজ্যবাদের কবর রচিত হবে
যুদ্ধবাজ মার্কিনিরা মধ্যপ্রাচ্যের বুকে তাদের হিংস্র থাবা বিস্তারে উদ্যত হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে মুক্তি সংগ্রামে লিপ্ত আরবদের হাত থেকে সাম্রাজ্যবাদী চক্রের ইসরাইলকে রক্ষার নামে মানবজাতির কাছে ঘৃণিত নিন্দিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড এম, নিক্সন রণ হুঙ্কার ছেড়েছেন। ইসরাইলের তথাকথিত নিরাপত্তা বিধানের জন্য সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন সরকার তার সকল দানবীয় শক্তি দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের সামরিক হস্তক্ষেপ করার জন্য এগিয়ে আসছে। শুধু তাই নয়, টার্সিয়া দ্বীপে অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটি থেকে তিনশত মার্কিন জঙ্গিবিমানকে পাঠানো হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের রণাঙ্গনের উদ্দেশ্যে।
বস্তুত আজকের দুনিয়ায় সর্বত্রই উত্তেজনা সৃষ্টি, উত্তেজনাকর পরিবেশ জিইয়ে রাখা এবং বিশ্বের সকল এলাকাতেই শান্তিকামী মানুষের শান্তি হরণ, জাতীয় স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা বিঘ্নিতকরণ এবং দেশে দেশে পরিচালিত জাতীয় মুক্তিসংগ্রামকে দাবিয়ে রাখার সকল অপচেষ্টার এই ঘৃণিত ধিক্কৃত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের কালো হাত সর্বদাই সচেষ্ট।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরই ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা ইহুদি সাম্প্রদায়িকতার নামে এই ইসরাইলের প্রতিষ্ঠা করে উদ্দেশ্য ইসরাইলের বুকে বসে মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলোর সম্পদ লুণ্ঠন করা এবং সুয়েজ খাল ও পারোসাপসাগরের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে এশিয়ার দেশ এদেশের সমরাস্ত্র বিক্রয়ের অবাধ ও একচেটিয়া পুঁজিবাদ সম্মিলিত রাজনীতির কুটকৌশল চালিয়ে যাওয়া এবং এশিয়া আফ্রিকার প্রাকৃতিক সম্পদ লুট করে নেয়া। ১৯৫৯ সালে আরব জাতীয়তাবাদের জনক মরহুম জামাল নাসের সুয়েজ খাল জাতীয়করণ করলে এরা হিংস্র হায়েনার মতো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং ইসরাইলের ওপর ভর করে মিশরের ওপর হামলা চালায়। সে যুদ্ধে মিশর সাম্রাজ্যবাদীদের বিষদাঁত ভেঙে দিয়ে সুয়েজের ওপর পূর্ণ কর্তৃত্ব অর্জন করে। আরবরা নিজেরাই নিজেদের তেল সম্পদকে নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার অর্জন করে। ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে সাম্রাজ্যবাদীরা।
আর তাদের সেই ক্ষিপ্ত তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে আবার ১৯৬৭ সালে। সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের লেজুড় ইসরাইলকে দিয়ে অর অতর্কিতে হামলা চালায় মিশর তথা আরব ভূ-খণ্ডের উপর। ভূমধ্যসাগরে টহলদানরত মার্কিন ৬ষ্ঠ নৌ-বহর থেকে বিমান হামলা ও গোলাবর্ষণ করে মিশরীয় বিমান বাহিনীকে ধ্বংস করে ইসরাইলকে দিয়ে সিনাই উপত্যকা ও গোলান মালভূমিসহ সুয়েজের পূর্বতীর দখল করে নেয়। নিরাপত্তা পরিষদে ওই বছরের ২২শে নভেম্বর ইসরাইলের প্রতি অধিকৃত এলাকার ছেড়ে দেবার আহবান জানিয়ে এক প্রস্তাব গৃহীত হয়। কিন্তু এই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের উস্কানিতে ইসরাইল সেই প্রস্তাব অমান্য করে।
এবারও আরব বিশ্ব যখন নিজেদের তাই নিজেদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনার উদ্যোগ নিয়েছে নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য আর স্বার্থ সংরক্ষণে আগ্রহী হয়েছে ঠিক সেই মুহূর্তে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ তাদের লেজুড় ইসরাইলকে লেলিয়ে দিয়ে আরব বিশ্বের ওপর আঘাত হানে। কিন্তু এবার মিশর, সিরিয়া, লেবানন, লিবিয়া, ইরাক, জর্ডান, কুয়েত, সৌদি আরব, ইয়েমেন, কাতার, ওমান, আবুধাবি আরব জনগোষ্ঠী ঐক্যবদ্ধ। আর এই ঐক্যবদ্ধ আরবদের পেছনে দাঁড়িয়েছেন শান্তি আর মৈত্রীর বাণীবাহী বাংলাদেশ, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতসহ বিশ্বের সকল শান্তিকামী মানুষ। তাদের নৈতিক ও সক্রিয় সমর্থন উদ্বুদ্ধ আরবরা যখন পাল্টা আঘাত হেনে ইসরাইলী হানাদার কুপোকাত করতে শুরু করেছেন, ঠিক তখনই ৬ষ্টগ নৌবহর দিয়ে এগিয়ে এসেছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। ফ্যান্টমজেট, বোমারু বিমান, আধুনিক সমরাস্ত্র আর বৈমানিক পাঠিয়ে চাঙ্গা করে তুলতে চাইছে আরবদের মারে ধসে যাওয়া ইসরাইলি সামরিক শক্তিতে। কিন্তু শেষরক্ষা কি করতে পারবে সাম্রাজ্যবাদীরা? ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া, চিলি, এ্যাঙ্গোলা, মোজাম্বিক, গিনি-বিসাউ, দক্ষিণ আফ্রিকা, রোডেশিয়ায়ও কি করতে পেরেছে ওদের শেষরক্ষা? মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ আর পারলে যুদ্ধের খবর অবশ্যই রচিত হবে মুক্তিকামী আরবদের বিজয় অভিযানের মুখে।
রাজধানীর বিধ্বস্ত রাজপথ
ঢাকা নগরীর অধিকাংশ রাস্তা ব্যাপকভাবে ভেঙেচুরে যাবার ফলে একদিকে যান চলাচলে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে অন্যদিকে জনজীবন মারাত্মক বিপদের সম্মুখীন হচ্ছে ফলে। নাগরিক জীবনে এক বিপদজনক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনার সম্ভাবনা ও খানা খন্দকে টাল খেয়ে রিকশা উল্টে গিয়ে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি বিড়ম্বনা আজ নিত্যদিনের সঙ্গী হয়েছে।
শহরের ছোট-বড় প্রায় চারশ চল্লিশ মাইল রাস্তা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ঢাকা পৌরসভার। কিন্তু কার্যত দেখা যাচ্ছে পৌর কর্তৃপক্ষ তাদের দায়িত্ব পালনে সম্পূর্ণ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। এবং বর্তমানে ঢাকা নগরী রাজপথ গুলি এমন দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে-যা এর আগে কোনদিনই হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং স্বাধীনতা লাভের পর মাল-মশলা অভাবে রাস্তা রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করা হয়তো সম্ভব হয়নি, কিন্তু সেটি একমাত্র কারণ নয় বলে আমাদের ধারণা।
পৌর কর্তৃপক্ষ যে ঠিকাদারদের সঙ্গে যোগ সাজশ করে রাস্তা তৈরি বা মেরামতের কাজ করাচ্ছেন তার মধ্যেই রয়েছে ফাঁক। রাস্তাগুলি ধ্বংস হওয়ার আরেকটি প্রধান কারণ হলো শহরে পানি নিষ্কাশন এর কোন ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। ফলে বৃষ্টি হলেই শহরের অধিকাংশ রাস্তাগুলি দীর্ঘ সময়ের জন্য পানির নিচে পড়ে থাকে। বিশেষজ্ঞদের মতে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা না হলে ঢাকা শহরের রাস্তার স্থায়িত্ব বৃদ্ধি করা প্রায় অসম্ভব। অন্যদিকে রাস্তার ওপর যানবাহনের চাপ আগের তুলনায় অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। বাস ও ট্রাক গুলো ক্ষমতার তুলনায় অনেক বেশি যাত্রী ও মাল নিয়ে চলাচল করে এতে রাস্তার ওপর স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি চাপ পড়ে। ফলে রাস্তা স্থায়িত্ব আরও দ্রুত কমে যাচ্ছে।
সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে পৌর কর্তৃপক্ষের ঔদাসীনতাই প্রকট হয়ে দেখা দিচ্ছে। কারণ সড়ক তৈরি বা মেরামতের মালমশলা দেখা, সে ব্যাপারে বিশেষজ্ঞের সাহায্য নেওয়া, পানি নিষ্কাশনের আশু সুব্যবস্থা করা, যানবাহন ও মাল পরিবহন এর গতি বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করা তাদেরই কাজ। যদি তারা আপন কর্তব্যে সততা ও নিষ্ঠা রাখতেন তাহলে রাস্তাগুলো অসমান, ভাঙ্গাচুরা, যেখানে সেখানে ভয়াবহ গর্ত, রাস্তার উপর পয়প্রণালী, ফাটা পানি ও বৃষ্টির পানির স্রোত এবং এমনি ধরনের অজস্র অরাজকতায় নাগরিক জীবনে এত ভোগান্তি নেমে আসতো না। বলাবাহুল্য অসংখ্য সড়ক দুর্ঘটনা এড়িয়ে অঙ্গীভূত। শুধু তাই নয় এতে করে প্রচুর অর্থ ও শ্রমের অপচয় হচ্ছে। রাস্তা তৈরি ও মেরামতের নামে জনসাধারণের অর্থের অপচয় এবং নাগরিক জীবনের এই ভোগান্তি যেন আর দীর্ঘায়িত না হয় সেদিকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে লক্ষ রাখতে হবে বৈকি।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক