You dont have javascript enabled! Please enable it! 1973.10.27 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | জাতির জীবনে ঈদের পবিত্রতা প্রতিফলিত হোক | বিশ্ব শান্তি সম্মেলন | এটা নতুন কিছু নয় | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা: ২৭শে অক্টোবর, শনিবার, ১০ই কার্তিক, ১৩৮০

জাতির জীবনে ঈদের পবিত্রতা প্রতিফলিত হোক

সারাদেশব্যাপী আগামীকাল পবিত্র ঈদুল ফিতর উদযাপিত হতে চলেছে। বিশ্বের সর্বত্র ইসলাম ধর্মাবলম্বলীরা আগামীকাল এ দিন উদযাপন করবে। রমজান মাসে কঠোর সাধনার পর আসে ঈদুল ফিতর। ধর্মাবলম্বীদের নিকট এ দিনের মাহাত্ম্য ও গুরুত্ব অপরিসীম। বছরের সর্বসেরা মাস হল রমজান। মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোতে এই পবিত্র দিনটি অত্যন্ত মর্যাদার সঙ্গে পালিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশও তাই এদিন এর মর্যাদা অনেক বেশি। দেশ স্বাধীনতা লাভ করার পর দ্বিতীয়বারের মতো ঈদ-উল-ফিতর আমাদের জীবনে পবিত্রতার আহ্বান নিয়ে এসেছে। কিন্তু যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের মানুষ নানা দুঃখ কষ্টের মাঝে ঈদের পবিত্রতা পুরোপুরি জীবনের প্রতিক্ষেত্রে প্রতিপালিত করতে পারেনি। ঈদের সকল আনন্দ মানুষের কাছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে। এক ঐতিহাসিক রক্তাক্ত যুদ্ধের পর তিরিশ লক্ষ মানুষের আত্মদানের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে। ধ্বংসপ্রাপ্ত দেশের মানুষের জীবনে তাই স্বাভাবিকভাবে নেমে আসে নানা দুঃখ-কষ্ট। তবু ঈদ বা এমনই ধরনের বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা পর্ব যখনই আমাদের সামনে এসেছে তখনই শত কষ্টের ডালি মাথায় নিয়েও সেই দিনটি পালনের জন্য মানুষ উন্মুখ হয়ে উঠেছে। ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা প্রতি মানুষের এই সহজাত দুর্বলতা অনন্তকালের । তাই এই সহজাত বৃত্তি প্রতি সকল যুগে সকল মানুষই সহানুভূতিশীলতার নিদর্শন দেখিয়েছে। এবারের পবিত্র ঈদে ও আমাদের সাধারন মানুষের দুঃখ-কষ্ট অসীম। জিনিসপত্রের দাম ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। কাপড়ের এবং খাদ্য দ্রব্যের দাম সাধারন মানুষকে হতাশাগ্রস্ত করে তুলেছে। কতৃপক্ষ একদিকে যেমন আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য অন্যদিকে তেমনি এক শ্রেণীর আমলা ও অসৎব্যবসায়ীরা মজুদ ও ঘাপলা সৃষ্টি করে মানুষের দুঃখ-কষ্টকে আরো উত্তুঙ্গে তুলেছে। এ হেন নিদারুণ অবস্থার মধ্যে এসেছে ঈদ। বাংলাদেশের মানুষের নৈতিক মনোবল অনেক বড় তাই যেকোন দুঃখ তারা জয় করতে পারে। সেই আসীম মনোবল নিয়েই যোগ করবে তারা বর্তমানে দুঃখ-কষ্ট। ঈদের আগমনে আত্মীয়-পরিজনের মাঝে অভাব-অনটন সাময়িকভাবে বড় হলেও জনগণ তা জয় করে ঈদের পবিত্রতা পালন করবে বলে আমাদের বিশ্বাস। আমরা পবিত্র ঈদে দেশের জনগণের কল্যাণ কামনা করি, সেই সাথে দেশের প্রগতি ও স্থায়িত্বও কামনা করি।

বিশ্ব শান্তি সম্মেলন

গত ২৫শে অক্টোবর মস্কোর ক্রেমলিন প্রাসাদে বিশ্ব শান্তি সম্মেলন শুরু হয়েছে। এতে সারা বিশ্বের মোট ১৪৪টি দেশের প্রায় ছ’হাজার প্রতিনিধি যোগদান করেছেন। আমাদের বাংলাদেশের প্রায় ৩৫ জন প্রতিনিধি অংশ নিচ্ছেন। এর উদ্বোধন করেন বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে আন্তর্জাতিক প্রস্তুতি কমিটির ভাইস-চেয়ারম্যান মিঃ সীন ম্যাক ব্রাইড। তার মতে এ সম্মেলন বিশ্বের সমস্ত বেসরকারি সংস্থার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সম্ভাবনাময়।
সোভিয়েত কম্যুনিস্ট পার্টির নেতা মিঃ ব্রেজনেভ, প্রধানমন্ত্রী মিঃ আলেক্সি কোসিগিন এবং প্রেসিডেন্ট মিঃ পদগর্নী উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
সর্বশেষ খবরে জানা যায় যে, মিঃ ব্রেজনেভ সম্মেলনে যে ভাষণ দিতে চেয়েছিলেন তা তিনি অজ্ঞাত কারণে স্থগিত রাখেন।
শোনা যাচ্ছে, তার এ সিদ্ধান্ত মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতির পদ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এক বিশেষ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীকে সজাগ সম্প্রতি যে নির্দেশ দিয়েছে তার সঙ্গে মিঃ ব্রেজনেভের এ সিদ্ধান্তের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে বলে অনেকেই অনুমান করছেন। যা হোক, জাতি হিসেবে আমরা বাঙালিরা শান্তির প্রতি শ্রদ্ধাশীল আমরা একান্তভাবে বিশ্বাস করি যে, ‘শান্তি’ ও ‘অশান্তি’ দুটোই ‘কো-রিলেটিভ’ ব্যাপার সম্পর্কিত পাশাপাশির। একটি এলে অপরটিকে পর্যায়ক্রমে আসতেই হয়। যাকে কোভিদ ভাষায় বলা যায় ‘শীত এলে, বসন্ত কি দূরে থাকে ওই?’
একদিকে মধ্যপ্রাচ্যের দারুন রণ হা-হুঙ্কার, জঙ্গির উৎপাত, আহত বা নিহত মানবতার করুণ আর্তনাদ, অন্যদিকে ক্রেমলিনের এ শান্তি সম্মেলন আপাত: দৃষ্টিতে বৈশাদৃশ্য মনে হলেও এর আশাব্যঞ্জক দিকেটিকে কোনক্রমেই অস্বীকার করা চলে না।
আজকের বিজ্ঞান দর্শী পৃথিবীতে কোন কিছুরই অভাব নেই, আছে শুধু একমুঠো শান্তির অভাব। শুধুমাত্র এই শান্তি ও শুভ বুদ্ধির অভাব এই যুগ যুগের পরিশ্রমে গড়া সভ্যতার মিনার আজ বিধ্বস্ত হবার আশঙ্কায় বিপন্ন।
বাংলাদেশ জন্মমুহূর্ত থেকেই স্বার্থহীনভাবে শান্তির বাণীই জগৎ সমূহে প্রচার করে এসেছে।
আমাদের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ক্রেমলিনের এই বিশ্ব শান্তি সম্মেলনের যে গুরুত্বপূর্ণ বাণী পাঠিয়েছেন তাতে তিনি স্পষ্টভাবে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের অগ্রণী ভূমিকা এক স্পষ্ট চিত্র দিয়েছেন।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূল সুরই শান্তি ও পারিপার্শ্বিক সহনশীলতার মাধ্যমেই শ্রদ্ধাশীল জীবন যাপন। আমরা উপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও বর্ণবাদের ঘোর বিরোধী। যেখানেই ‘অত্যাচারীর উদ্যত খড়গ’ বিদ্যমান সেখানেই আমাদের তার বিরুদ্ধে ঘোরতম অভিযান। আমাদের সমস্ত শক্তির, সাহায্য ও সহানুভূতি জগতের সমস্ত নির্যাতিত, নিষ্পেষিত অত্যাচারিত মানবতার স্বপক্ষে প্রসারিত।
একমাত্র এই নীতিতে বিশ্বাস রেখেই আমরা ভিয়েতনামের ওপর জঘন্য মার্কিনী হামলার নিন্দে করেছি। সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যে জেহাদরত সংগ্রামী আরব ভাইদের জন্যও আমাদের সমস্ত সহানুভূতি নিয়োজিত।
আমরা নির্যাতিত ও অত্যাচারীতের দুঃখ প্রাণে প্রাণে উপলব্ধি করতে সক্ষম। কারণ আমরা নিজেরাও বহু আত্নত্যাগ, রক্তদান আর সংগ্রামের মাধ্যমে কুটিল হার্মাদদেরা হাত থেকে আমাদের রক্তস্নাত স্বাধীনতা সূর্য ছিনিয়ে এনেছি।
বর্তমানে অধিবেশন প্রাপ্ত বিশ্বশান্তি কাউন্সিল সম্পর্কে আমাদের শ্রদ্ধা ও নির্ভরতা অসীম ও অটুট। কারণ, অতীতে আমাদের বিভীষিকাময় মুক্তি সংগ্রাম চলাকালেই বিশ্বশান্তি কাউন্সিল ১৯৭১ সনে তার বুদাপেস্ট সম্মেলনে আন্তরিকভাবে আমাদের ন্যায্য সংগ্রামের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে তা আমাদের জাতীয় কৃতজ্ঞতার ইতিহাসে স্বর্ণোজ্জল হয়ে থাকবে।
আমরা সর্বোচ্চ করণে আশা করছি যে, ক্রেমলিনে অনুষ্ঠিত বিশ্ব শান্তি সম্মেলন সফল হবে এবং এর মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের অন্যান্য সমস্ত অঞ্চলে এক চিরস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে এবং কুটিল, পরধন লোভী সাম্রাজ্যবাদী শক্তিবর্গের ওপর এক কঠিন চাপ সৃষ্টি করে এ বিশ্বশান্তিতে প্রকৃতই সফল করবে।

এটা নতুন কিছু নয়

ব্যাপারটা এমন কিছু নতুন নয়। হরহামেশাই হচ্ছে। সরকারি আমলাদের বদৌলতে ন’টার ট্রেন ক’টায় আসবে তা কেউ বলতে পারেন না।
গতকাল ‘বাংলার বাণী’তে “এ প্রহসনের জবাব কি?” শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশ ভোগ্য পণ্য সরবরাহ সংস্থা ফলাও করে ন্যায্যমূল্যে শিশুখাদ্য বিক্রয় বিজ্ঞাপন দিলেন। কোন কোন দোকানে ভোগ্যপণ্য সংস্থায় শিশুখাদ্য পাওয়া যাবে তার লিস্টও ছাপালেন। দোকান গুলোর নাম দেখে হাজার হাজার ক্রেতা শিশুখাদ্য কেনার জন্য লিস্টিকৃত দোকানগুলোতে গিয়ে খালি হাতে ফিরেও এলেন। কারণ মাল নেই। আদৌ দোকানগুলোতে ভোগ্যপণ্য সংস্থার কোন প্রকার শিশুখাদ্য পৌঁছেনি। ভোগ্যপণ্য সংস্থা কথা দিয়ে কথা রাখতে পারেনি এতে বিস্মিত হবার কোন কারণ নেই। কেননা এ ধরনের ব্যাপার-স্যাপার আগেও হয়েছে, এখনও হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও যে হবে না এমনটি নিশ্চিত ভাবে বলা যায় না। যেমন ধরুন, এই তো কিছুদিন আগে বলা হলো, রেশনে কোটা মোতাবেক চাল দেয়া হবে। কিন্তু তারপরও চালের কোন পাত্তা নেই। চাল এলো গদাই লস্করি চাল এর অনেক পরে। বলা হল ঈদ উপলক্ষে রেশন দোকান থেকে ময়দা, সেমাই, চিনি দেয়া হবে। কোন কোন এলাকাতে চিনি সেমাই দেয়া হলেও ময়দার কোন নাম নিশানা নেই। ওটা বাতকে বাতই হয়ে রইলো। ও, জি, এল এর কাপড় ঈদের আগেই আসবে আর তা বিলি বন্টনও করা হবে বলে ঘোষণা করা হলেও শেষ পর্যন্ত দেখা গেল সমুদ্রে গোস্পদের মত সামান্য পরিমাণের কাপড় এসেছে। তাও আবার সব জায়গায় সমানভাবে বিলিবন্টন করা সম্ভব হয়নি। তাই সবকিছু দেখেশুনে বলতে হচ্ছে এটা নতুন কিছু নয়-এসব আমাদের গাঁ সহা ব্যাপার হয়ে গেছে।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন