You dont have javascript enabled! Please enable it! হানাদারদের রুখে ছিল যে বীর তাঁর নাম ক্যাপ্টেন ইদ্রিস - সংগ্রামের নোটবুক
হানাদারদের রুখে ছিল যে বীর তাঁর নাম ক্যাপ্টেন ইদ্রিস
সেলুট সেই বীরদের, তােমরা যারা দিনাজপুরের স্কুল পাড়ায় রুখেছিলে হানাদারদের, ধ্বংস করেছিলে এক প্লাটুন শত্রুকে। তােমাদের বীরত্বের গাঁথা চিরদিন আঁকড়ে রাখবে স্কুলপাড়ার মাটি গৌরবে, অহংকারে অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে ক্যাপ্টেন ইদ্রিস আকস্মিকভাবে একটি সিক্রেট ইনফরমেশন পেয়ে গেলেন। ধেয়ে চললেন তিনি তার মুক্তিবাহিনী নিয়ে। হাতে তাদের থ্রি নট থ্রি, গ্রেনেড় আর দুটি এল এমজি। হানাদার পাকবাহিনী সেদিন দিনাজপুর শহর থেকে স্কুলপাড়া হয়ে বর্ডার সাইডে আসছিল যে রুটে সেই রুটে পৌছে গেল ক্যাপ্টেন ইদ্রিস। খানসেনারা পৌঁছানাের আগেই বিকেল তিনটা। খানদের ট্রাকের আওয়াজ পাওয়া গেল দিনাজপুরের স্কুলপাড়ার রাস্তার পাশে, ঝােপ-ঝাড়ে, গাছের ফাঁকে, আমের গাছের ওপর বাঁশ ঝাড়ের ফাঁকে প্রস্তুত লেঃ সাইদুল্লাহ, লেঃ আমিন, লেঃ কায়সার, সুবেদার এস এ রহমান, সুবেদার ইয়াসিন, হাবিলদার হাসান, হাবিলদার আজিজ, প্লাটুন কমাণ্ডার দেলওয়ার হােসেন, এফ এফ বাবুল, আবদুল লতিফ, আবদুর রাজ্জাক, নূর মােহাম্মদসহ দেড়শ’ মুক্তিবাহিনীর বীর সেনানী।  এগিয়ে আসছে হানাদার ট্রাক দুটো স্কুলবাড়ির সন্নিকটে। ক্যাপ্টেন ইদ্রিস পর পর দুটো শিস দিলেন। ফায়ারিং-এর সংকেত আসবে শুধু একটা শিস। প্রস্তুত । থ্রি নট থ্রি’র ট্রিগার আঙুল নিশপিশ করছে। দম ধরে মুক্তিযােদ্ধারা শুনে যাচ্ছে প্রতিটি সেকেণ্ড মুক্তিবাহিনীর এ্যাম্বুশের ভেতরে ঢুকছে হানাদারদের প্রথম ট্রাক। ট্রাকের ওপর ২০/৩০ জন জোয়ান, হাতে তাদের অটোমেটিক চায়নিজ অস্ত্র। ট্রাকের ওপর এল এম জি ধরে দাড়িয়ে আছে তাগড়া দু’জন, সামনের ট্রাক এ্যাম্বুশ পার হয়ে যাচ্ছে প্রায়। ক্যাপ্টেন ইদ্রিসসংকেত দিচ্ছেন না। সবাই হতভম্ব হয়ে যাচ্ছে। কি হচ্ছে। কিন্তু ক্যাপ্টেনের লক্ষ্য তখন পেছনে। আরও ভারি অস্ত্র সজ্জিত হয়ে ঢুকছে আরাে ট্রাক পেছনে, সেটাকে এ্যাম্বুশের মধ্যে এনে না ফেলে তিনি পারেন না সামনের ট্রাকে ফায়ার ওপেন করার নির্দেশ দিতে।
সৌভাগ্য খানদের। পেছনের ট্রাক প্রায় ১৫০ গজ ব্যবধানে এবং এ্যাম্বুশের এলাকায় এক ইঞ্চি ঢােকা মাত্র ক্যাপ্টেনের শিস, সাথে সাথে ফায়ার। বজ্রের কড় কড় আওয়াজের মতাে ভেঙ্গে পড়লাে মুক্তিবাহিনী হানাদারদের ওপর। এমন হাতের মুঠোয় বহুদিন পায়নি খানদের। সম্পূর্ণ নিরাপদে দাঁড়িয়ে অকস্মাৎ বজ্রপাতের মতাে ঝাপিয়ে পড়ল মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা, জোয়ানরা। পেছনের ট্রাক, সামনের ট্রাক-দুই ট্রাকের ওপরেই চলছে বৃষ্টির মতাে থ্রি নট থ্রি আর এল এম জি’র ফায়ার। সম্বিত ফিরে পাবার আগেই পেছনের ট্রাক শেষ এ্যাম্বুশের যেখানে লুটিয়ে। কোনটা ট্রাকের ওপর, বাকিগুলি পাশে, রাস্তার নিচের খানায়। কিন্তু না, সামনের ট্রাককে ততখানি কাবু করা গেল না। মাত্র দুটো ডেড বডি পেছনে ফেলে ট্রাকটি গোঁ গোঁ করতে করতে ছুটে বেরিয়ে গেল ক্যাপ্টেন ইদ্রিসের কবজা থেকে। যদিও ট্রাকটি পালাবার আগেই গাছের ওপর থেকে মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা ফায়ার করে কয়েকজনকে আহত ও নিহত করে। পাওয়া যায় বহু গােলাবারুদ, কয়েকটি এল এম জি, দুই ইঞ্জি মর্টার এবঙ চায়নিজ অটোমেটিক রাইফেল কিছু। ৩রা অক্টোবরের সেই সাফল্যের পর এ্যাম্বুশে হানাদারকে খতম করার পরিকল্পনা ক্যাপ্টেন ইদ্রিস বাড়িয়ে দেয় এবং এভাবে বহু খানসেনা ঐ সেক্টরে হতাহত হতে থাকে এবং গেরিলা যুদ্ধের এই কৌশলের ও সাফল্যের প্রােগ্রাম সকল সেক্টরে জানিয়ে দেয়া হয়। এর ফলে সব স্থানে অনুপ্রেরণার সৃষ্টি হতে থাকে।
৪ঠা অক্টোবর সেই আম, জাম, বাঁশ ঝাড়ে ঢাকা স্কুলপাড়া দেখতে যায় হামজাপুরের সকল মুক্তিযােদ্ধা। খানদের চরমভাবে পরাজিত ও খতম করে দেয়ার সেই পবিত্র ভূমিতে মুক্তিযােদ্ধারা স্কুল পাড়ার মাটি কপালে চুঁইয়ে যাত্রা করে ফ্রন্টের দিকে। ১৪ই ডিসেম্বরের যুদ্ধে লেঃ সাইফুল্লাহ’র একটা হাতের সমস্ত মাংস কাধের নিচ থেকে উড়ে যায় শত্রুর ব্রাশ ফায়ারে। কিন্তু হাড় ভাঙ্গেনি। দিনাজপুরের রণাঙ্গণে যে বীর বহুবার পাঞ্জা লড়েছে হানাদারদের সাথে বিজয়ের দু’দিন আগে তিনি আহত হন। দুর্ধর্ষ ক্যাপ্টেন ইদ্রিসও আহত হন অন্য যুদ্ধে এবং তারা কোমরের নিচ দিয়ে ব্রাশ ফায়ার লেগে হিপের মাংস ধসে যায়। এই ছিল মুক্তিযুদ্ধ। এইভাবে বীর মুক্তিযােদ্ধারা আত্মদান ও রক্তদানের পথ ধরে মুক্তিযুদ্ধকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল চূড়ান্ত বিজয়ের দিকে সকল রণাঙ্গনে। বাংলার রণাঙ্গনগুলাে আজও নাম ধরে ডাকে সেই রণাঙ্গনের বীরদের, যাদের দাপটে, বিক্রমে পরাভূত হয়েছিল পাকিস্তানীরা। যে বীরদের রক্ত, মাংস প্রাণের দামে কেনা এই বাংলার স্বাধীনতা। (সূত্র : মুক্তিযুদ্ধ হৃদয়ে মম, মুসা সাদিক)

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত