মুক্তিবাহিনীকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশে বাধা দেয়ার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন স্থানে সীমান্ত এলাকায় পাকবাহিনীর অনেকগুলাে ক্যাম্প ছিল। সাতক্ষীরার মাহমুদপুরে এরূপ খানসেনাদের একটা ক্যাম্প ছিল, এটা ভারত সীমান্তের কাছাকাছি এলাকায় প্যাট্রোল পার্টির মাধ্যমে পাহারা দিত, ফলে মুক্তিবাহিনীর লােকজনদের চলাচলের দারুণ অসুবিধা সৃষ্টি হত। পাকসেনাদের সবসময় একটা ধারণা ছিল যে, বাঙালিরা একটা অসামরিক জাতি, তারা ভীতু এবং শারিরীক দিক থেকে যুদ্ধের জন্য উপযুক্ত নয়। তাই তারা বাঙালিদের দীর্ঘ ২৪ বছরের পাকসামরিক বাহিনীতে কখনও তেমন গুরুত্ত্ব দেয়নি। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময় তারা বাঙালি যােদ্ধাদের গুরুত্বই দেয়নি। বরং প্রায় সময়ই তাদেরকে তাচ্ছিল্য কুরত। পাকিস্তানের ২৪ বছরের ইতিহাসে তাই পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে বাঙালি সৈনিক ও বাঙালি অফিসারদের সবসময় অবজ্ঞা করা হত এবং বিশ্রী ভাষায় বিভিন্ন সময় গালিগালাজ করা হত। অথচ বাঙালির বুদ্ধিমত্তা ও রণকৌশলের কাছে পাঞ্জাবী, পাঠান ও বালুচরা পর্যন্ত সমর ক্ষেত্রে হার স্বীকার করেছে। কিন্তু তারা কোন দিনও ন্যায় বিচার ও যথাযােগ্য মর্যাদা পায়নি। তাই মাহমুদপুরের পাকসেনারা সম্ভবত বাঙালি মুক্তিযােদ্ধাদের অবজ্ঞা করে। কারণ এ সামরিক ঘাঁটি আক্রমণ করার দুঃসাহস বাঙালিদের হবে না বলে খানসেনাদের ধ্রুব বিশ্বাস ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার মহান মন্ত্রে উজ্জীবিত মুক্তিবাহিনী যে কত দুর্জন অভিযানে অংশ নিয়েছে মাহমুদপুর অপারেশন তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। মাহমুদপুর অপারেশনের পূর্বে ঐ এলাকার অধিবাসী কামরুজ্জামানসহ ৩/৪ জন ঐ এলাকায় জেলে ও রাখালের বেশে মাহমুদপুর খারসেনাদের ক্যাম্পের অবস্থান, তাদের শক্তি-সামর্থ ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তারিত খবর আনার জন্য রেকিতে যায়। গ্রামবাসীদের নিকট থেকেও বিভিন্ন তথ্যাদি নেয়া হয়।
ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর এই মাহমুদপুর ক্যাম্প অপারেশনের পরিকল্পনা তৈরি করেন। ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর এই আক্রমণ পরিচালনার ক্ষেত্রে যে কত বড় চাতুর্যের আশ্রয় নেন তা চিন্তাও করা যায় না। ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর ছিলেন পাকসেনাবাহিনীর একজন দুর্ধর্ষ কমান্ড, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে তিনি দেশ মাতৃকার পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্ত করার জন্য মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেন। মাহমুদপুর পাকাবহিনীর ক্যাম্পের দুর্বলতার দিক ছিল ক্যাম্পের উত্তর দিক এবং ঐ ক্যাম্পের দক্ষিণ দিকটা অত্যন্ত মজবুত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার আওতায় ছিল। তাই ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর পরিকল্পনা করেন যে, দুর্বল উত্তর দিক থেকে কয়েকজন মুক্তিযোেদ্ধা এলএমজি দিয়ে মাহমুদপুর ক্যাম্পে আক্রমণ চালাবে। এই আক্রমণ প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে খানসেনারা স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর দিকে ঝুঁকে পড়বে এবং দক্ষিণ দিকের প্রতিরক্ষা মজবুত থাকায় সেদিকে স্বাভাবিক ভাবে কম গুরত্ব দেবে। পিছন দিক থেকে তখন তিনি এলএমজি, রকেট লাঞ্চার ও এনার্গা গ্রেড আক্রমণের মাধ্যমে শত্রুকে চরম শিক্ষা দেবেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী তিনি নিজেই স্বল্পসংখ্যক দুঃসাহসী মুক্তিযােদ্ধাদের বাছাই করে তাদেরকে প্রয়ােজনীয় প্রশিক্ষণ ও পরিকল্পনা সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা দিলেন। তারপর খানসেনাদের মাহমুদপুর ক্যাম্প আক্রমণের দিন, তারিখ ও সময় নির্ধারণ করেন। অতঃপর নির্দিষ্ট দিনে প্রথম আক্রমণকারী দল পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী খানসেনাদের মাহমুদপুর ক্যাম্প উত্তর দিক থেকে ব্যাপক আক্রমণ চালাতে থাকে। পাকসেনারা তাদের ক্যাম্পের দক্ষিণ দিকে মজবুত প্রতিরক্ষা থাকায় উত্তর দিকের আক্রমণ প্রতিহত করতে আসে।
এই আক্রমণের আধাঘন্টা পর ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরও পরিকল্পনা অনুযায়ী তার দল নিয়ে মাহমুদপুর ক্যাম্পে এক অবিশ্বাস্য রকমের ঝটিকা আক্রমণ পরিচালনা করেন। তিনি ও তার দল এ আক্রমণে এলএমজি, রকেট লাঞ্চার ও গ্রেনেড নিক্ষেপকারী এনার্গা ব্যবহার করে মাহমুদপুর খানসেনাদের ক্যাম্প পুরােপুরি তছনছ করে দেন। পাকসেনাদের ধারণাই ছিল না যে, পিছন দিক থেকে এ ধরনের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কেউ কখনও আক্রমণ করতে পারে। গােটা ক্যাম্প ধ্বংসপ্রাপ্ত ও সবকিছু লন্ড-ভন্ড হয়ে যায়। শত্রুপক্ষের ৩/৪ জন গুরুতর আহত হয়ে বেচে ছিল আর সবাইকে ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের দলের কাছে প্রাণ হারাতে হয়। প্রাণ দিয়েই সম্ভবত তারা উপলব্ধি করেছিল বাঙালি যুদ্ধ জানে কিনা, বাঙালি সামরিক জাত না অসামরিক জাত। এই মহান বীর বিভিন্ন দুঃসাহসিক অভিযান পরিচালনায় নেতৃত্ব দেন এবং এক যুদ্ধে শহীদ হয়ে বীর শ্রেষ্ঠ উপাধি লাভ করেন। বাঙালি জাতির স্বাধীনতার ইতিহাসে তাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে অঙ্কিত থাকবে। ক্যাপ্টেন । ( সূত্র ও স্বাধীনতার দুর্জয় অভিযান, স, ম, বাবর আলী )