You dont have javascript enabled! Please enable it! পারুলিয়া ব্রীজ অপারেশন - সংগ্রামের নোটবুক
পারুলিয়া ব্রীজ অপারেশন
পারুলিয়া সাতক্ষীরা ও কালিগঞ্জ রাস্তার উপরে মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা একটি বড় খাল পারুলিয়ার বুক চিরে প্রবাহিত। এই খালের উপরই শতাধিক ফুট লম্বা একটি ব্রীজ ছিল যে ব্রীজ কালিগঞ্জ ও সাতক্ষীরার সি এন্ড বি রাস্তার একমাত্র যােগসূত্র। তাই পারুলিয়া ব্রীজের গুরুত্ব অপরিসীম। এই ব্রীজ যুদি ধ্বংস করে দেয়া যায় তবে সাতক্ষীরা থেকে সড়ক পথে কালিগঞ্জ দেবহাটা ও শ্যামনগর থানা পুরােপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। তাই মুক্তিবাহিনী এই ব্রীজ ধ্বংস করে দেয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। পক্ষান্তরে পাকসামরিকবাহিনী এই ব্রীজ রক্ষা করার জন্য সর্বপ্রকার প্রচেষ্টা নেয় এবং রাজাকারদের দায়িত্বে দিন-রাত ২৪ ঘন্টা এই বীজ প্রহরায় থাকে। শ্রাবণ মাসের প্রথম দিকে একবার ভারতীয় ন্যাশনাল ক্যাডেট কোরের দু’জন বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ মিঃ মুখার্জি ও মিঃ মন্ডল, মােশারেফ হােসেন মশু, আমিসহ ১১জন। এক অভিযানে আসি। বিস্ফোরক লাগান হয় এবং ব্রীজের সামান্য ক্ষতি হয় কিন্তু ব্রীজ ধ্বংস করা সম্ভব হয়নি। আরাে দু’বার দু’টি দল পারুলিয়া ব্রীজ অপারেশনে আসে কিন্তু একটি দল ব্রীজের কাছে আসতে ব্যর্থ হয় এবং অন্য দলটি ব্রীজের সামান্য ক্ষতি সাধন করতে সক্ষম হয়, কিন্তু ব্রীজ ঠিকই চলাচলের উপযােগী থাকে।
পারুলিয়া বীজ ধ্বংস করার আর একটি দুঃসাহিসক প্রচেষ্টা নেন যশাের জেলার ফজলুর রহমান নামক দুঃসাহসিক একজন মুক্তিযােদ্ধা। তার কৌশল ছিল যেমন অদ্ভুত তেমনি অভিনব। তিনি তার কয়েকজন সঙ্গীসহ পারুলিয়া ব্রীজের কয়েকশত গজ দূরে পৌছান এবং একটা বড় ধরনের খড়ের গাদার উপর বিস্ফোরক রেখে দরির মাধ্যমে। সেটাকে ব্রীজের কাছাকাছি নেন। যখন পাহারাদার রাজাকাররা এটাকে আদৌ সন্দেহ করল, তখন তিনি নিজে আর একটা মাঝারি ধরনের খড়ের গাদা পানিতে ভাসিয়ে তার নিচে। আত্মগােপরে ঐ বিস্ফোরকের নিকট উপস্থিত হন এবং ব্রীজে বিস্ফোরক স্থাপন করে, ফিরে এসে তাতে আগুন লাগিয়ে দেন। বিস্ফোরণ ঠিকই ঘটেছিল কিন্তু ব্রীজের সামন্যই ক্ষতি হয়েছিল। কয়েকজন পাহারত রাজাকারও আহত হয় এবং সাতক্ষীরা মুসলিম লীগের গফুর সাহেবের ছেলে একটা পা হারায়। কিন্তু মূল উদ্দেশ্য সফল হয়নি। অতঃপর নবম সেক্টরের অন্যতম দুর্ধর্ষ সৈনিক ও অসীম সাহসী যােদ্ধা লেঃ বেগ ১১. জনের একটা দল নিয়ে পারুলিয়া ব্রীজ ধ্বংসের লক্ষ্যে টাকী থেকে রওনা হয়ে ইছামতি। পার হয়ে পারুলিয়া আসেন। তিনি অর দুলকে বীজ থেকে প্রায় ৫০০ গজ দূরে একটা, স্থানে কভারিং-এর জন্য রেখে একাই পারুলিয়া খালে নেমে পড়েন এবং ধীর,অতি ধীর চলতে চলতে ব্রীজের নিচে চলে আসেন। রাজাকাররা নিয়মিত প্রহরায় ছিল, কিন্তু ব্রীজের। নিচে বা পানির দিকে তারা কোন সময় তেমন খেয়ালই করেনি। অতিকষ্টে তিনি স্লাব ফিট করে ৫০০ গজ দূরে কড নিয়ে যান, তিনি পানি থেকে উঠে দেখেন তার শরীরে অসংখ্য ছােট ছােট নৌকাঁকড়া আচ্ছাদিত, সমস্ত শরীর সাদা। তিনি জীবনে এ ধরনের কাঁকড়া কখনাে দেখেননি, ভয়ে আতকে ওঠেন এবং দ্রুত এসব ক্ষুদে প্রাণীগুলাে ঝেড়ে ফেলেন। এই অপারেশনে তিনি এত গভীরভাবে মগ্ন ছিলেন যে, হাজার হাজার মৌ কাকড়া তার।
সমস্ত দেহে তিড়বিড় করলেও তিনি সেদিকে আদৌ খেয়াল করেননি। অবশ্য এ ক্ষুদে প্রাণী খুবই নিরীহ, আদৌ ক্ষতিকারক নয়। তারপর একসময় আগুন দিয়ে স্লাব বিস্ফোরণ ঘটান, বিকট আওয়াজে মেদিনী কেঁপে ওঠে এবং পারুলিয়া-ব্রীজ ভেঙ্গে পড়ে ধ্বংস হয়, রাজাকাররা হতভম্ব হয়ে পড়ে; সম্বিত ফিরে পেয়ে গুলি করার পূর্বেই লেঃ এমএ বেগ ও তার দল চম্পট দেয়। পর পর কয়েকবার ব্যর্থ অভিযানের পর লেঃ মাহফুজুল আলম বেগের এ অপারেশন সফল হওয়ায় নবম সেক্টরে আনন্দের ফোয়ারা বয়ে যায় এবং লেঃ বেগকে নবম সেক্টর অধিপতি মেজর জলিল আন্তরিক অভিনন্দন জানান। পারুলিয়া ব্রীজ অপারেশনের একক কৃতিত্ব ছিল লেঃ বেগের। সাতক্ষীরার পারুলিয়া ব্রীজ ধ্বংসের ফলে হানাদারপাকবাহিনী আরও ক্ষিপ্ত ও সজাগ হয়ে যায়। এই ব্রীজ অবশ্য তারা পরবর্তীকালে , পুনঃ মেরামত করে কিন্তু মুক্তিবাহিনীর চোরা গুপ্তা আক্রমণের জন্য তারা সবসময়ই ভীত সন্ত্রস্ত থাকত, আবার কোন সময় মুক্তিবাহিনী এই ব্রীজ উড়িয়ে দেয়। (সূত্র : স্বাধীনতার দুর্জয় অভিযান, স, ম, বাবর আলী ।)

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত